মন নিয়ে কাছাকাছি পর্ব – ২৭+২৮+২৯

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
Jerin Afrin Nipa
২৭

আবির মীরার দিকে ধাওয়া করলে মীরা ছুটে জায়িনের পেছনে গিয়ে লুকালো।
জায়িনের লম্বা চওড়া বিশাল দেহের পেছনে মীরার ছোট দেহ আড়াল হয়ে গেছে। মীরা জায়িনের পেছনে থেকেই বাঁচার জন্য বলছে,

“আবির ভাই তুমি যা বলবে আমি সব করে দিব। মাথা টিপে দেব। পানি এনে দিব। তুমি বললে তোমার পা-ও টিপে দেব। তুমি শুধু আমাকে বাদে ওদের হলুদ লাগাও।”

“উঁহু। এখন বাঁচতে এই কথা বলছিস! কিন্তু তুই-ই সবচেয়ে বেশি আমার কথার অবাধ্য হোস। তাই আগে তোকে মাখাব। জায়িন তুই সরে দাঁড়া।”

জায়িন ভাই সামনে থাকলে আবির ভাই তাকে ধরতে পারবে না বুঝতে পেরে মীরা পেছন থেকে জায়িনের পাঞ্জাবি খামচে ধরল। জায়িন ভাই সামনে থেকে সরে গেলেই আবির ভাইয়ার হাত থেকে তার রক্ষে নেই। আবির জায়িনকে বলছে,

“জায়িন তুই ওটাকে তোর পেছন থেকে বেরিয়ে আসতে বল। আজ কেউ রক্ষা পাবে না।”

মীরা জায়িনের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসবে তো দূর উল্টো শক্ত করে জায়িনের পাঞ্জাবি আঁকড়ে ধরল। বলল,

“না জায়িন ভাই প্লিজ। আপনি আবির ভাইয়ার কথা শুনবেন না।”

“না শুনলে। জায়িন নিজেও ভিক্টিম হবে। আমার কিছু করার নেই।”

“জায়িন ভাই আপনি আবির ভাইকে একটা শিক্ষা দিন না। আমরা ছোট মানুষ বলে আমাদের সাথে কেমন করছে দেখুন।”

জায়িন একবার ঘাড় ঘুরিয়ে মীরাকে দেখলো। মীরা ঠোঁট উলটিয়ে অসহায় মুখে অনুরোধ করলো। জায়িন আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল,

“আবির ছেলেমানুষী করিস না তো। বাচ্চাদের সাথে বাহাদুরি করে মজা নেই। সমানে সমানে টক্কর দিতে হয়।”

“তাহলে তুই আয় শালা।”

বলেই আবির জায়িনের উপর ঝাপিয়ে পড়ল। ঘটনা আকষ্মিক ভাবে ঘটলেও জায়িন আবিরের দুই হাত হাওয়ায় ধরে ফেলল। মীরা উঁকিঝুঁকি পেরে জায়িনের পেছন থেকে আবিরকে দেখছে। আবির ভাই জায়িন ভাইকে নাগালই পাচ্ছে না। মীরা মনে মনে হাসল।

“খুব তো আমাদের সাথে বেডা গিরি দেখাচ্ছিলে। এবার জায়িন ভাইয়ের সাথে পারছো না কেন?”

🌸

এই যাত্রায় জায়িন ভাইয়ের জন্য মীরা বেঁচে গেল। নইলে আবির ভাই সত্যি সত্যিই হলুদে ডুবাতো।
বিকেল গড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। সন্ধ্যা নেমে চারদিক অন্ধকার হওয়ার আয়োজন চলছে। এবার মীরাদের ফেরার পালা। ইভান ভাইকেও তো এখনও হলুদ দেওয়া হয়নি। মীরা মুখ ধুয়ে টিস্যু খুঁজছিল। একটা তোয়ালে টোয়ালে পেলেও হতো। আবির ভাইরা বেরিয়ে পড়েছে। মীরা মুখ ধোয়ার জন্য ভেতরে এসেছিল। টিস্যু, তোয়ালে পায়নি কিন্তু মুবিন ভাইকে পেয়ে গেল। মীরা মুবিনকে দেখেই বলল,

“মুবিন ভাই টিস্যু বক্স কোথায় জানেন?”

মুবিন মীরাকেই খুঁজছিল। বুকে যথেষ্ট সাহস সঞ্চয় করে রেখেছে। কিন্তু মীরাকেই একা পাচ্ছিল না।
মুবিন ফুসফুস ভরে দম টানলো।

“মীরা! তোমাকে কিছু বলতে চাই।”

মীরার আত্মা ধক করে উঠল। কলিজায় চিলিক দিল। শ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। মাহিটা ঠিকই বলেছিল। মুবিন ভাই আজ তাকে প্রপোজ করবে! মীরা মনে মনে বলছে,

“না। মুবিন ভাই না। প্রপোজ করবেন না। রিজেক্ট হলে আপনিই কষ্ট পাবেন। বোনের বিয়েতে প্রেমে ছ্যাকা খাওয়া প্রেমিক হয়ে ঘুরে বেড়াবেন। তার থেকে ভালো প্রপোজই কইরেন না।”

“মীরা! কী ভাবছো?”

মীরার ভাবনার সুতো কাটলো। হুঁশে ফিরে এসে বলল,

“আমার তো সময় নেই মুবিন ভাই। আমাকে রেখে আবির ভাইরা চলে যাবে। আমাকে যেতে হবে। সামনে থেকে সরুন তো। ওইযে গাড়ির শব্দ হচ্ছে। ওরা আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছে নাকি? হায় আল্লাহ!”

মীরা কোনরকমে মুবিনকে পাশ কাটিয়ে চলে আসতে নিচ্ছিল। মুবিন ভাইয়ের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। মীরা দু’কদম বাড়িয়েছে তখনই মুবিন পেছন থেকে বলে উঠল,

“আমি মাহিমাকে পছন্দ করি মীরা।”

মীরার পা থেমে গেল। ভ্রু কুঁচকে ঝট করে মুবিনের দিকে ফিরল। সে যা শুনেছে মুবিন ভাই কি তা-ই বলেছে? মুবিন মীরার চোখের দৃষ্টি বুঝতে পেরে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।

“হ্যাঁ মীরা। আমি মাহিমাকে পছন্দ করি।”

মীরা কতক্ষণ থম মেরে থেকে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল,

“মুবিন ভাই।”

মুবিন ভয় পেয়ে গিয়েছিল। মীরা হঠাৎ এমন চেঁচাবে আশা করেনি। মীরা থপথপ পা ফেলে মুবিনের সামনে এসে দাঁড়াল।

“আপনি আমার সাথে মজা করছেন?”

“না মীরা। মজা করবো কেন? আমি সত্যি বলছি।”

“এই কথা তাহলে আমাকে বলছেন কেন?”

“মীরা তুমি কি রেগে যাচ্ছ? রাগ কোরো না প্লিজ।”

মীরা মনে মনে বলল,

“রাগ করব না। আমি খুশিতে মাটিতে শুয়ে সাপের মতো মোচড়ামুচড়ি করে নাগিন ডান্স করব। এতদিন হাবভাবে আমাকে পছন্দ করেন বুঝিয়ে এসেছেন। এখন এন্ড মোমেন্টে আমার বোনকে প্রপোজ করছেন? আপনাকে ফিরিয়ে দিলে কষ্ট পাবেন ভেবে আমি নিজেকে অপরাধী ভাবছিলাম। কিন্তু এখন ছ্যাঁকাটা তো আপনি আমাকেই দিয়েছেন।”

“তোমাকে বলছি কারণ, মাহিমা মনে হয় আমার ব্যাপারে এমনটা ভাবে না। কিন্তু আমি অনেকদিন ধরেই মাহিমাকে পছন্দ করি। ওকে কীভাবে বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। তুমি তো মাহিমার বেস্ট ফ্রেন্ড আবার বোনও। তুমি আমার হয়ে ওকে..

“এজন্যই আমরা কলেজ যাওয়ার সময় আপনি দোকানে বসে থাকতেন?”

“তোমরা লক্ষ করেছিলে? মাহিমা লক্ষ করেছে?”

“মুবিন ভাই!”

মীরা রাগে দুঃখে শুধু শুধু চেঁচাচ্ছে। মুবিন ভাই তাকে প্রপোজ করলে সে নিজেই না করে দিত। কিন্তু এখন মুবিন ভাই মাহিমাকে পছন্দ করে। মীরার কেমন ছ্যাঁকা খাওয়া ফিলিংস হচ্ছে।

“কী মীরা?”

“আপনি মাহিমাকে দেখার জন্য দোকানে বসে থাকতেন?”

কথাটা শুনে মুবিন লজ্জা পেল। লজ্জিত ভঙ্গিতেই বলল,

“ইয়ে মানে..

” এখন আর ইয়ে মানে করছেন কেন? যা করার তা তো আগেই করে ফেলেছেন।”

“মাহিমা কি আমাকে পছন্দ করে মীরা?”

“দুধ কলা দিয়ে ঘরে এত হ্যান্ডসাম একটা ভাই পালছেন। তাকে রেখে কোন মেয়ে কেন আপনার দিকে ফিরবে? ভাইটাকে একটু কম হ্যান্ডসাম হতে বলতে পারলেন না। আপনি যাকে বাবুর আম্মু বানানোর স্বপ্ন দেখছেন সে আপনাকে চাচা বানানোর চেষ্টায় আছে।”

মনের কথা মনেই রয়ে গেল। এসব কথা মীরা মুবিনের সামনে বলতে পারল না। কইতরি শালি দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা তার কানে মন্ত্র পড়ত, মুবিন ভাই তোকে পছন্দ করে। কানা কইতরি চোখ খুললে দেখতে পেত মুবিন ভাই কাকে পছন্দ করে। কানার বাচ্চা আন্ধা, মুবিন ভাই তোকে পছন্দ করে।

“আপনি এখন কী চান মুবিন ভাই?”

“তোমার সাহায্য ছাড়া আর কী চাইব মীরা? প্লিজ তুমি আমাকে হেল্প করো।”

“কেন?”

মুবিনের কপালে ভাঁজ পড়ল।

” কেন মানে কি?”

“আপনাকে আমি কোন স্বার্থে সাহায্য করব?”

“স্বার্থ?”

“অবশ্যই। মীরা কাউকে মাগনা সার্ভিস দেয় না। মীরার সার্ভিসের দাম আছে।”

“তুমিই বলো কী চাও তুমি?”

“আমি যেদিন বলব ছুটি দিতে হবে। পড়ার চাপ তো একেবারেই দেওয়া যাবে না। কোন হোমওয়ার্ক করব না। আমার যতক্ষণ চন চাইবে পড়ব, তারপর গল্প করব। পরীক্ষায় কম মার্কস পেলেও আপনি বকবেন না। বাবা, চাচা, ভাইয়ারা জানতে চাইলে বলবেন, মীরার মতো ব্রিলিয়ান্ট, ইন্টেলিজেন্ট মেয়ে এই ওয়ার্ল্ডে দু’টা নেই।”

মুবিন হাঁ করে মীরার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়ে এসব শর্ত রাখছে? একটু বেশি বেশি হয়ে গেল না! হলেও এখন চুপচাপ মেনে নিতেই হবে।

“আরও কিছু শর্ত আছে। সেগুলো এখন মনে পড়ছে না।”

“ঠিক আছে। মনে পড়লে বলে দিও।”

মুবিন ভাই তার সব কথা মেনে নিয়েছে দেখে মীরা বিশ্ব জয় করা হাসি দিল।

“আর হ্যাঁ, এখন থেকে তো আপনাকে মুবিন ভাই ডাকব না।”

“তাহলে?”

“দুলাভাই ডাকব। আমার বোনের সাথে প্রেম করলে সম্পর্কে আমি আপনার শালি হবো না।”

“এই না, না। তোমাকে কেউ দুলাভাই ডাকতে শুনে ফেললে প্রবলেম হয়ে যাবে মীরা।”

“এরকম পিঁপড়ার কলিজা নিয়ে তো প্রেম করতে পারবেন না দুলাভাই। মাহির ভাই জানতে পারলে ছেঁচা দিয়ে আপনার এটুকু সাহসও নিগড়ে দিবে। আমি তো শুনেছিলাম প্রেমে পড়লে ছেলেদের ছাতি ছত্রিশ হয়ে যায়। শোনায় ভুলও থাকতে পারে। তাই তো দেখছি, আপনারটা কমেছে।”

🌸

মীরা গাড়িতে এসে বসলে মাহিমা জিজ্ঞেস করল,

“এতক্ষণ কোথায় ছিলি?”

“তোর বন্দোবস্ত করে এলাম।”

“মানে?”

“মানে তোর মাথা। তুই আর কোনদিন ছেলেদের দেখে বলবি না এই ছেলে ওই মেয়েকে পছন্দ করে। ওই ছেলে ওই মেয়েকে পছন্দ করে। তোর ধারণা আকাশ পাতাল ভুল বেরোয়।”

“জীবনেও না। আমি ছেলেদের চোখ দেখেই বলে দিতে পারি মনে কী চলছে।”

“এই কথাটা দ্বিতীয় বার তোর মুখে শুনলে লা’থি মেরে চাপা ত্যাড়া করে ফেলব।”

মাহিমা কিছুই বুঝতে পারল না মীরা হঠাৎ তার উপর এত ভড়কে গেল কেন? সে কী করেছে? আজব!
🌸

বিয়ে কমিউনিটি সেন্টারে হবে। বাড়ির মেয়েরা সবাই পার্লারে চলে গেছে। আবির ইভানকে পার্লারে যাওয়ার কথা বললে ইভান বলল,

“সাবান দিয়ে ঘষে মুখ ধুয়ে ফেললেই আমি সুন্দর করে যাব।”

এই কথা শুনে আবির হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল। মীরাদের পার্লার থেকে নিয়ে যেতে হবে। ইভাকেও পার্লার থেকে তুলে নিতে হবে। জায়িন মুবিনকে যেতে বললে মুবিন জানাল, তার শেরওয়ানি চেঞ্জ করতে যেতে হবে। সে মল থেকে সোজা কমিউনিটি সেন্টারে চলে যাবে।
জায়িন গাড়িতে হেলান দিয়ে পার্লারের সামনে দাঁড়িয়ে ইভাকে কল করছে। ইভা আপুই তাকে কল করে আসতে বলেছিল। একঘন্টা আগে বলেছে সাজা শেষ। কিন্তু এখনও বের হচ্ছে না। জায়িনের মেডিকেলের একটা বন্ধুর কল এলে জায়িন ফোন কানে কথা বলছিল। হঠাৎ তার চোখ সামনে পড়তে জায়িন ফ্রিজড হয়ে গেল। ফোন হাত থেকে পড়েই যাচ্ছিল। জায়িন নিজেকে সামলে নিয়ে ফোন পকেটে রাখল। সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বুকে হাত বাড়ল। ইভা সহ মীরা মাহিমা সবাই বেরিয়ে আসছে। মীরার পরনে লাল টুকটুকে লেহেঙ্গা। স্ট্রেইট করা চুলগুলো খোলা রেখেছে। ডান কাঁধে ওড়না ফেলে বাঁ দিকে কিছুটা চুল সামনে এনে রাখা। দু’হাতে লেহেঙ্গা উঁচু করে ধরে হেঁটে আসছে। মাঝে মাঝে বাঁ হাতে কানের পেছনে চুল গুঁজে দিচ্ছে। জায়িনের হাঁসফাঁস লাগছে। বাতাসে অক্সিজেনের অভাব দেখা দিয়েছে মনে হচ্ছে। ওরা যতটা কাছাকাছি আসছে জায়িনের নিজেকে সহজ শান্ত স্বাভাবিক রাখতে তত বেশি কষ্ট হচ্ছে।

চলবে…

(কিছু কিছু পাঠক, প্রতিদিন গল্প চায়। একসাথে দুই পর্ব চায়। বড় পর্ব চায়। যদিও আমি ১৩০০/১৪০০ শব্দের নিচে পর্ব দিই না।
এখন কথা হলো, গল্প লেখাই কি আমার একমাত্র কাজ? ব্যক্তিগত জীবনে আমার কি কোন ব্যস্ততা নেই? ১৩০০ শব্দ পড়তে আপনাদের সময় লাগে পাঁচ মিনিট। কিন্তু একটা পর্ব সাজিয়ে ফোনে টাইপ করতে আমার অন্তত এক/দেড় ঘন্টা সময় লাগে। এক ঘন্টা একটানা ফোন হাতে রাখাও সম্ভব না। চোখের সমস্যার কথা বাদ দিলাম। কিন্তু আম্মুর বকার কী করব? তাই যতটুকু দিতে পারছি তা নিয়েই খুশি থাকুন না🖤)#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
Jerin Afrin Nipa
২৮

জায়িনের পরনে সাদা পাঞ্জাবি। বাম হাতে সবসময়ের মতো একটা ঘড়ি। খুব সিম্পল লুক। তবুও দূর থেকে জায়িনকে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মাহিমা গদগদ গলায় মীরাকে বলল,

“জায়িন ভাই কি দিনদিন আরও হ্যান্ডসাম হচ্ছে রে মীরা? লোকটা মনে হয় এলাকার সবগুলো মেয়েকে পাগল করে তবেই শান্ত হবে।”

মীরার চোখও জায়িনের উপর পড়েছে। কিন্তু মাহিমাকে জায়িন ভাইয়ের উপর দুই নাম্বারি নজর দিতে দেখে পিঠে দুম করে কিল বসালো।

“যাকে তাকে দেখেই গলে যাস না। হতে পারে ভবিষ্যতে গিয়ে সম্পর্ক উল্টেপাল্টে গেছে।”

মাহিমা বিরক্ত চোখে মীরার দিকে দেখল। চুল নষ্ট হয়েছে কিনা দেখতে দেখতে বলল,

“দুনিয়ার কাউকে নিয়ে তোর সমস্যা নেই? জায়িন ভাইয়ের কথা এলেই তোর বদহজম শুরু হয়। কেন রে?”

“না জেনে ভবিষ্যত ভাসুরের উপর নজর দিচ্ছিস। বদহজম হবে না তো কী করবে? ওদিকে ছোট ভাই তার উপর লাড্ডু হয়ে আছে। এদিকে সে বড় ভাইয়ের উপর হারাম দৃষ্টিতে দেখছে।”

“কী বিড়বিড় করছিস? ইদানীং খুব বেশি বিড়বিড় করিস।”

“তুই জায়িন ভাইকে মাথা থেকে বের করে চোখ মেলে আশেপাশে দেখ। তোকে দেওয়ার জন্য কত মজনু হৃদয় খুলে হাতে নিয়ে বসে আছে।”

মাহিমা জবাব দেওয়ার সুযোগ পেলো না। তনি ওদের ধাক্কা দিয়ে জায়িনের দিকে এগিয়ে গেল।

“ওহ-হো হিরো! আজ আমার ছোপা রুস্তম নিজের ফর্মে বেরিয়ে এসেছে। আগুন লাগছিস বেটা।”

জায়িন হাসলো। তনির দিকে তাকিয়ে চোখ বাঁকিয়ে বলল,

“বাংলায় আগুন বললি তাতে কিন্তু অপরাধ হবে না। কিন্তু আমি তোকে হট বললেই তোর বয়ফ্রেন্ড আমাকে মারতে আসবে।”

“মোটেও না। হট একটা মেয়েকে হট না বললেই বরং অপরাধ হবে।”

তনির সাথে ফ্লার্ট করে অন্তত কেউ পারবে না। জায়িন তো তার বন্ধু। অচেনা একটা ছেলের সাথেও তনি এরকম ভাবেই কথা বলবে।

“তোর বয়ফ্রেন্ড এরকম সুন্দরী একটা গার্লফ্রেন্ড রেখে কোন মেয়ের পেছনে ঘুরছে?”

“ঘুরুক, মরুক যা খুশি করুক। ওর কপালে আমি ছাড়া আর কেউ নেই।”

ইভা জায়িনের সামনে এসে দু’হাতে লেহেঙ্গা মেলে ধরে বলল,

“আমাকে কেমন লাগছে?”

জায়িন বোনকে দেখে মৃদু হেসে জানাল,

“ইভান ভাই হার্ট অ্যাটাক করবে।”

“যাহ!” ইভা লজ্জা পেলো। জায়িনও এমন মজা করবে আশা করেনি। আবির এখনও পৌঁছায়নি। ইভা তনিকে জিজ্ঞেস করল,

“তোমরা আমাদের সাথে যাবে? আবিরের আসতে কতক্ষণ?”

“জানি না। একঘন্টা আগে বলেছে রাস্তায় আছে। তার রাস্তা এখনও শেষ হচ্ছে না।”

জায়িন আবিরকে কল করল। আবির ত্রিশ মিনিট ধরে জ্যামে আটকা পড়ে বসে আছে। আরও ত্রিশ মিনিটেও জ্যাম ছুটবে কি-না সন্দেহ। তাই ওদেরকে জায়িনের সাথে চলে যেতে বলল।

“এক গাড়িতে সবার জায়গা হবে?”

জায়িন দেখল ইভা আপুকে নিয়ে পাঁচ জন। পাঁচজন যাওয়া যাবে জানালে আবির বলল,

“তাহলে তুই ওদেরকে নিয়ে কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছা। আমি পেছনে আসছি।”

“হুম।”

তনি সামনে জায়িনের পাশে বসেছে। বাকিরা ঠেলাঠেলি করে পেছনে উঠেছে। মাহিমা হিল জুতা দিয়ে মীরার পায়ে পাড়া দিলে মীরা চিৎকার করে উঠে মাহিমাকে মারতে লাগলো।

“আল্লাহ! মোটির বাচ্চা আমাকে মেরে ফেলল। হাতির বাচ্চা চোখে দেখিস না। আমার পা পিষে ফেলেছিস। উফ, আল্লাহ।”

মাহিমা দেখে পাড়া দেয়নি। তবুও অপরাধী হয়ে বলতে লাগল,

“সরি সরি। সরি রে। আমি দেখিনি সত্যি।”

“তোর সরি দিয়ে আমি আচার দিব খবিশ! তোর সরি তুই নিজের কাছে রাখ।”

“সরি বলছি তবুও মানছিস না। এখন কিন্তু আরেকটা পাড়া দিব।”

“আর আমি তোকে লা’থি দিয়ে গাড়ি থেকে বের করে দিব।”

“গাড়ি তোর? তুই আমাকে বের করার কে?”

মুহূর্তে এদের ঝগড়া লেগে যাওয়া দেখে জায়িন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। সামান্য একটা ব্যাপারে এরকম ঝগড়া! তা-ও এরা নিজেদের বেস্ট ফ্রেন্ড দাবী করে! তনি এদের ক্যাঁচক্যাঁচানিতে অসহ্য হয়ে বলল,

“তোরা চুপ না করলে দু’টাকেই গাড়ি থেকে বের করে দিব। ফেলে চলে গেলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঝগড়া করিস।”

একেতো মীরা পায়ে ব্যথা পেয়েছে। তনি আপু উল্টো তাকেই বকছে। মীরা অভিমানী গলায় বলল,

“ফেলে চলে যাও। আমি হেঁটে যাব। না যেতে পারলে এখানেই বসে থাকব।”

মীরাকে মন খারাপ করতে দেখে মাহিমা নিজের ভুল বুঝতে পারল। এমনকি তনি আপু মীরাকে কেন বকেছে এজন্য তনিকে বলতে লাগল,

“মীরাকে রেখে গেলে আমিও তোমাদের সাথে যাব না। চল মীরা আমরা গাড়ি থেকে নেমে যাই।”

তনি কপাল চাপড়াল। যার জন্য করলো চুরি সে-ই বলে চোর! তনির অবস্থা কিছুটা এরকম। ওদের ঝগড়া থামানোর জন্যই দুইটাকে ধমক দিয়েছিল।

“তোদের ঝগড়ার মাঝে কথা বলে জীবনের সবথেকে বড় ভুলটা করে ফেলেছি বোন। আমাকে ক্ষমা কর। তবুও গাড়ি থেকে নেমে যাস না। আজ ইভান ভাইয়ের বিয়ে। মনে আছে তো?”

মীরা মাহিমা ঝগড়া করেও মিলে গেছে। মাঝখানে তনি ভিলেন হয়েছে। ইভা এদের কাণ্ড দেখে হাসলো। গাড়িতে বসে পুরোটা পথ মীরা মাহিমা সেল্ফি তুলে গেছে। সাথে ওদের ননস্টপ বকবকানি। জায়িন ড্রাইভ করতে করতে আড়চোখে বার কয়েক রিয়ারভিউ মিররে তাকিয়েছে। খুব অল্প সময়ের জন্য দেখে সামনের রাস্তায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে।
🌸

মুবিন মাহিমাকে দেখে স্থান, কাল, পরিস্থিতি ভুলে হাঁ করে দেখতেই থাকলো। মাহিমা গাধী মীরাকে ঠেলা দিয়ে বলল,

“দেখ দেখ! কীরকম হ্যাংলার মতো তাকিয়ে আছে।”

মীরা এই গাধার গাধামিতে বিরক্ত হয়ে বলল,

“হ্যাংলা, গাধা, ঘোড়া, পাঠা যা খুশি ডাক। তোর অধিকার আছে।”

“ডাকবোই তো। দুলাভাই বলে কথা!”

এই গাধীটা কি এখনও কিছু বুঝতে পারছে না? মুবিন ভাইয়ের হাবভাব বুঝেছে। কিন্তু সেটা যে মীরার জন্য না এটা বুঝতে এত সময় লাগছে কেন? এমনিতে তো ক বলার আগে কলকাতা বুঝে যায়। শুধু মুবিন ভাইয়ের মনটাই বুঝছে না।

“কিরে কোথায় ডুবে গেলি?”

“গভীর ভাবনায়।”

“অত ভাবতে হবে না। ভাবাভাবি সাইডে রেখে প্রপোজ করলে ফট করে হ্যাঁ বলে দিবি।”

“মুবিন ভাইকে তোর কেমন লাগে?”

“ভালোই। কিউট। জায়িন ভাইয়ের মতো এতটাও হ্যান্ডসাম না হলেও চলে।”

মীরা রেগে বলল,

“এখানে জায়িন ভাই কোত্থেকে এলো? কথা তো হচ্ছে মুবিন ভাইকে নিয়ে।”

মাহিমা মীরার রাগের অন্য মানে ধরে নিয়ে বলল,

“আচ্ছা বাবা মুবিন ভাইও হ্যান্ডসাম। চেহারা সুরত লম্বা চওড়া পড়াশোনা সবদিক দিয়েই পারফেক্ট।”

“এমন পারফেক্ট একটা ছেলে প্রপোজ করলে তুই রাজি হবি?”

মাহিমা ভাবছে মুবিন ভাই প্রপোজ করলে মীরা এক্সেপ্ট করবে কি-না সেটা জানতে চাচ্ছে। তাই মাহিমা কিচ্ছু না ভেবে বলে বসল,

“অবশ্যই। কেন করব না? কী কমতি আছে মুবিন ভাইয়ের মাঝে? আজকাল এমন ছেলে পাওয়া যায়?”

মীরা ঠোঁট বাঁকিয়ে রহস্যময় হাসলো।

“কথাটা মনে রাখিস। ভুলে গেলে খবর আছে।”
🌸

জায়িন মেয়েদের ভীড়টার মাঝে একজনকে খুঁজছে। অনেকক্ষণ ধরে দেখছে না। কোথায় গেল? কয়েকজন গেস্টকে অ্যাটেন্ড করতে তাকে যেতে হয়েছিল। নইলে চোখে চোখেই রেখেছিল। এখন এসে খুঁজে পাচ্ছে না।

“কাকে খুঁজছিস রে?”

তনির কথায় জায়িন চোখ বন্ধ করে ছোট্ট করে দম ফেলল। তনিটার ভুল জায়গায় ভুল মুহূর্তে টপকে পড়ার অভ্যাসটা এখনও পাল্টালো না। জায়িন ঘুরে তাকাল। তনি কৌতূহলে চিকচিক করা চোখে জায়িনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

“কোন মেয়েকে দেখছিলি, না? হ্যাঁ। মেয়েকেই দেখছিলি। কোন মেয়েটা রে? আশেপাশে এত সুন্দর সুন্দর মেয়েরা ঘুরছে। এক আধটা তো পছন্দ হয়ে যাওয়ারই কথা। কোন মেয়েটা আমাকে দেখা না। শুধু কি চোখে চোখেই মন দেওয়া নেওয়া করে বসে আছিস? নাকি কথাও এগিয়েছিস? তুই না পারলে আমাকে বল। আমি মামলা সেট করে দিব।”

জায়িন তনির কথার কোন গুরুত্বই দিল না। বরং তনিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চলে যেতে নিলে তনি পথ আটকে দাঁড়াল।

“চোরের মতো পালিয়ে যাচ্ছিস কেন চোর? বল কোন মেয়েকে দেখছিলি?”

“তোর বোনকে।”

তনি ঠোঁট কামড়ে সরু চোখে জায়িনের দিকে তাকাল। জায়িনও এমন মজা করতে শিখে গেছে দেখে হাসল। জায়িনের পেটে চিমটি কেটে বলল,

“আমার কোনো বোনকে দেখলে আমি এক্ষুনি তোদের দুইটাকে ধরে বিয়ে দিয়ে দিতাম।”

জায়িন মনে মনে হাসলো। তনি নাছোড়বান্দা। তাগাদা দিতেই লাগল,

“মেয়েটা কে বল না। এমন করছিস কেন? আমাকে বন্ধু মনে করিস না?”

“তনি প্লিজ জ্বালাস না। কোন মেয়েকে দেখব?”

“মেয়ে না দেখলে মহিলাদের দেখছিলি লু’চ্চা?”

জায়িন তনির দিকে ঝুঁকে এসে গলা খাদে নামিয়ে বলল,

“কাকে দেখছিলাম শুনবি?”

তনিও কৌতূহলী হয়ে আরও ঝুঁকে এসে। নিচু গলায় বলল,

“হুম। বল বল।”

“মাইন্ড করবি না বল।”

“মাইন্ড করব কেন? আমার মতো ফ্রি মাইন্ডের মেয়ে তুই আরেকটা খুঁজে পাবি!”

“ঠিক আছে, শোন তাহলে।”

“হুম। বল।”

“বলছি।”

“বল।”

“তোর বোনকে।”

তনি কটমট করে জায়িনের দিকে তাকিয়ে ফুঁসতে লাগল। জায়িন হেসে ফেলল। তনি রেগেমেগে জায়িনের চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল,

“মর শালা। তোর কপালে মেয়ে নাই। সিঙ্গেলই মরবি তুই।”

তনি চলে গেলে জায়িন গম্ভীর হলো। সে সত্যিই বলেছে। কিন্তু তনি মরে গেলেও তার কথা বিশ্বাস করবে না। আবির, তনির এই বিশ্বাসটাই জায়িনের পায়ে শেকল হয়েছে। তার উপর এত বিশ্বাস কেন? এই বিশ্বাস ভাঙলে ওরা কি জায়িনকে ক্ষমা করবে?

চলবে..#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
Jerin Afrin Nipa
২৯

মীরার ওড়নায় টান পড়লে সে দাঁড়িয়ে গেল। কিসের সাথে ওড়না আটকেছে দেখার জন্য মীরা পেছন ফেরার আগেই জায়িন এসে লোকটাকে বলল,

“এক্সকিউজ মি, আঙ্কেল। আপনার পায়ের নিচে..

লোকটা নিচে তাকিয়ে লক্ষ করতেই দেখল তিনি কারো ওড়নায় পা রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। লোকটা জায়িনের দিকে তাকিয়ে লজ্জিত মুখে হেসে বলল,

” ওহ সরি ইয়াংম্যান। আন্তরিক সরি।”

মীরা এদিকে তাকালে দেখতে পেল জায়িন তার ওড়না হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে একটা লোকের সাথে কথা বলছে। মীরা অবাক হওয়ার সাথে সাথে কিছুটা বিরক্তও হলো। জায়িন ভাই কোন সুখে তার ওড়না ধরে রেখেছে? ব্যাপারটা দেখার জন্য মীরা ওদের কাছে এসে দাঁড়াল। লোকটা মীরাকে দেখে জায়িনের দিকে তাকিয়ে উদেশ্য পূর্বক হেসে বলল,

“নতুন বিয়ে? এমনই হয়। এসময় বউয়ের আঁচল ধরেই ঘুরতে হয়। আমিও এমনভাবেই তোমার চাচীর আঁচল ধরে ঘুরতাম। একমুহূর্তের জন্য চোখের আড়াল হতে দিতাম না। আর এখন দেখো। বিয়ের ছাব্বিশ বছর পেরিয়েছে। আমি কোথায় তোমার চাচী হয়তো জানেই না। সে-ও মিসেস সালেহ নয়তো মিসেস হকের সাথে গসিপ করছে। হা হা। এমনই হয়। শুরুতে প্রেমটা যেমন থাকে বিশ বছর পর তার কিছুই থাকে না।”

লোকটা নিজে নিজেই ওদের স্বামী স্ত্রী কল্পনা করে এতগুলো কথা বলে গেল। জায়িন চেয়েও বাধা দিতে পারল না। মীরা চোখ বড় বড় করে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। পাগল লোক কাকে কার বউ বলছে? দিনেদুপুরে চড়িয়ে এসেছে নাকি? মীরা জায়িনকেও দেখল। জায়িন ভাই লোকটার ভুল শুধরে দিল না! মীরার জায়িন ভাইয়ের উপরও রাগ হলো।

“না না না। আঙ্কেল আপনার ভীষণ বড় ভুল হচ্ছে। আমরা..

লোকটা মীরাকে থামিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বলল,

” শুরুতে সবাই এটাই বলে মা। আমাদের প্রেম আমৃত্যু থাকবে। কিন্তু দু’জন মানুষ একসাথে থাকা শুরু করলে একে অপরের অনেক খুঁত জানতে পারে। শুরুতে পার্টনারের যে অভ্যাসে ভালোবাসা পেত বছর কয়েক গেলে সেটাই বিরক্তিকর হয়ে উঠে।”

মীরা নাকের পাটা ফুলিয়ে আগুন চোখে জায়িনকে দেখছে। জায়িন ভাই কিছু বলছে না কেন? আশ্চর্য!

“আঙ্কেল আপনি থামবেন? না জেনে কতকিছু বলে যাচ্ছেন!”

লোকটা মীরার রাগ দেখেও হাসলো। মীরার রাগের পাত্তা না দিয়ে জায়িনের দিকে তাকিয়ে মুখের হাসি চওড়া করে বলল,

“অনেক ভালোবাসে। তাই মানতে পারছে না। ভালো ভালো। এই ভালোবাসা থাকাটা ভালো। তবে যত ভালোবাসাই থাকুক। এটাই বাস্তব ইয়াংলেডি।”

লোকটার কথা শুনে মীরার রেগেমেগে আগুন হওয়া চেহারা দেখতে জায়িনের ভালোই লাগছে। লোকটার কথাগুলোও শুনতে তেমন খারাপ লাগছে না। বিবাহিত জীবনে হাঁপিয়ে ওঠা একটা লোক মীরাকে তার স্ত্রী ভেবে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছে। লোকটাকে বাধা দেওয়ার কোন অধিকার তো তার নেই। সব মানুষের বাকস্বাধীনতা আছে।
মীরা এই বুড়োর মাথা ফাটিয়ে দিবে। তোর জীবনে সুখ নাই বুড়ো এখন তুই যারে তারে জামাই বউ বানিয়ে জ্ঞান ঝাড়বি! জায়িন লক্ষ করল মীরা কঠিন কিছু কথা বলার জন্য তৈরি হচ্ছে। তার আগেই সে লোকটাকে অন্যদিকে পাঠিয়ে দিল।

“আঙ্কেল আন্টি হয়তো আপনাকে খুঁজছে।”

এই অসহ্যকর লোক যাবার আগেও একটা কথা বলে মীরার গা জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। তিনি আসলে মীরাকে উদ্দেশ্য করে জায়িনকে বলেছে,

“জিতে গেছো ইয়াংম্যান। তোমার লাক ভালো। তোমার মতো ভাগ্য সবার হয়না। আমার মতো অবহেলায় হারিও না। ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখো।”

লোকটা চলে গেলে মীরা জায়িনের উপর ফেটে পড়ল। ঝাড়া মেরে জায়িনের হাত থেকে ওড়নার কোনা ছাড়িয়ে নিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলল,

“আপনি লোকটার ফালতু কথা কেন শুনছিলেন জায়িন ভাই? উনি আমাদের…! আপনি উনার ভুল কেন ভাঙেননি? চুপ করে শুনলেন! একটা কথাও বলেন নি! কেন?”

“বয়স্ক লোক। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ব্যক্তিগত জীবনের বেচারা সুখে নেই।”

“বুড়োর নিজের জীবনে সুখ নেই বলে যাকে তাকে..। আপনি নিজেও ওই লোকটার মতো পাগল। দুই পাগলের পাগলামির মাঝে আমাকেও ফাঁসিয়ে দিয়েছেন।”

“আমি তো উনাকে কিছু বলিনি। উনি নিজে নিজে ভেবে নিয়েছেন। এতেও কি আমার দোষ?”

“অবশ্যই। আপনি ভুল ভাঙানোর চেষ্টা করেননি। উল্টো উনাকে এমনটা ভাবতে দিয়েছেন।”

“আচ্ছা মানলাম, কিন্তু উনার ভুল ভাঙালে কী হতো?”

“কী হতো মানে? উনি এমনটা ভাবত না।”

“এখন উনি এমনটা ভাবছেন। তাতে তোমার আমার কারো ক্ষতি হচ্ছে কি?”

“ক্ষতি না হোক। একটা মানুষ কেন না জেনে এমনটা ভাববে!”

“সেটা উনার ভাবনা মীরা। আমাদের তো কিছু না। উনার ভাবনা উনাকে ভাবতে দাও। কারো ভাবনার উপর নিশ্চয় আমাদের কন্ট্রোল নেই।”

জায়িনের কথার প্যাঁচে ফেঁসে গিয়ে মীরা আর তর্ক করার মতো কোন কথা খুঁজে পেলো না। শেষে রেগেমেগে শুধু এটুকু বলল,

“আপনি ডাক্তার না। আপনি নিজেও একটা মস্ত বড়ো পাগল।”

কথাটা বলেই মীরা গটগটিয়ে জায়িনের সামনে থেকে চলে গেল। মীরার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে জায়িন শব্দ করে হেসে ফেলল।

“পাগলি!”

জায়িনের কাঁধে কারো হাত পড়তে জায়িন চমকে তাকালো। আবির অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে সামনের দিকে চোখ রেখেই বলল,

“পাগলিটা কে রে? ওই মেয়েটা? এখানে এসেছে!”

মীরা ততক্ষণে পুরোপুরি চোখের আড়ালে চলে গেছে বুঝতে পেরে জায়িন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। যাক আবিরের চোখে পড়েনি। আবিরটার টাইমিংও মাশাল্লাহ। যখনতখন যেখানে সেখানে টপকে পড়ে। জায়িন কিছু বলছে না দেখে আবির ওর পেটে খোঁচা মারল।

“পাগলিটা কে বল। আমি কিন্তু স্পষ্ট শুনে ফেলেছি। আর লুকাস না। বলে ফেল। ভাবী এখানে উপস্থিত আছে?”

জায়িনের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। স্বর্ণে বাঁধানো কপাল তার। একবার তনি এসে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফেলে। একবার আবির এসে কথা শুনে ফেলে। এই দুইটার কি আর কোন কাজ নেই? গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড দুইটা নিজেদের ফেলে তার পেছনে গোয়েন্দা খাটছে। এরা থাকতে তার প্রেম তো এই জীবনে হবে না। এখন দেখা যাচ্ছে এদের যন্ত্রণায় দুনিয়ায়ও থাকা যাবে না। গাট্টিগুট্টি বেঁধে সে কি এখন মঙ্গল গ্রহে চলে যাবে? আবির জায়িনের কাঁধে চেপে ধরলো। তনিকে ভুলভাল বোঝানো গেলেও আবিরকে উল্টাপাল্টা বোঝ দেওয়া সহজ হবে না।

“তনিকে মনে হয় এতদিন আমি ভালো করে দেখিনি। নইলে ওকে শুধু বন্ধুর নজরেই দেখেছি। তনিও যে একটা মেয়ে এটা মিস করে গিয়েছিলাম।”

আবির সানগ্লাসের উপর দিয়ে বড়ো বড়ো চোখে জায়িনকে দেখল। এই শালা বলে কি! আবির সানগ্লাস খুলে ফেলে আতঙ্কিত গলায় বলল,

“তুই আমার না হওয়া সংসার শুরু হওয়ার আগেই ভাঙতে চাচ্ছিস! বন্ধুর সম্পদের উপর কুদৃষ্টি দিচ্ছিস?”

“কী করব? তুই ঠিকঠাক মতো বন্ধুর দায়িত্ব পালন করলে এই দিন আসতো না।”

“কীভাবে দায়িত্ব পালন করব শালা। তুই তো কিছু বলিসই না। পছন্দের মেয়ে থাকলে বল। না থাকলে সেটাও বল। তোকে কি আমি সিঙ্গেল মরতে দিতাম? বল কেমন মেয়ে পছন্দ। আশেপাশে না পেলে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে হলেও তেমন মেয়ে খুঁজে আনবো।”

“প্রজাপতির মতো একটা মেয়ে।”

“কিহ! এইটা আবার কোন প্রজাতি?”

“প্রজাপতি দেখেছিস কখনও? প্রজাপতির সব বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে থাকবে। তার পৃথিবী প্রজাপতির ডানার মতোই রঙিন হবে। প্রজাপতির মতো ছটফটে চঞ্চল।”

“ওরে ভাই, প্রজাপতি যেমন এক ফুলে বেশিক্ষণ বসে না ওই মেয়ের মনও তোর উপর বেশিদিন টিকবে না। তখন দেবদাস হয়ে আমার কাছেই তো আসবি। তার থেকে ভালো কচ্ছপ প্রজাতির মেয়ে খুঁজে দিই? কচ্ছপের মতো ওই মেয়ের মন তোর উপর থেকে নড়বে না।”

🌸

মাহিমা বাম হাতে কানের পেছনে চুল আটকে রেখে ঝুঁকে নিচে তার কানের দুলটা খুঁজছে। একটু আগে চুল ঠিক করতে গিয়ে আবিষ্কার করল তার বাঁ কানের দুল হারিয়ে গেছে। এখানেই হয়তো কোথাও পড়েছে। আবার অন্য জায়গায়ও পড়তে পারে। বিয়ে উপলক্ষে নতুন একজোড়া দুল কিনেছিল। তার থেকে বড় কথা দুলটা না পেলে এখন এক কান খালি নিয়ে কীভাবে ঘুরবে? মাহিমা মানুষের ভীরের মধ্যেই এর ওর পায়ের ফাঁকে দুলটা খুঁজে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে এক-দুজনের সাথে ধাক্কা খেয়ে সরিও বলছে। মাহিমা কুঁজো হয়ে ঝুঁকে ছিল ওর সামনে এসে একজোড়া পা থেমে গেলে মাহিমা মাথা তুলে মুবিনকে দেখলো। মুবিন মাহিমার দিকে মুঠো করা হাত বাড়িয়ে দিয়ে মুঠো খুলে বলল,

“এটা খুঁজছিলে?”

মাহিমা দেখল তার হারিয়ে যাওয়া কানের দুলটা মুবিন ভাইয়ের হাতে। মনে মনে দুলটা পাওয়ার আশা ছেড়েই দিয়েছিল। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে দুলটা পেয়ে গিয়ে মাহিমা খুশি হয়ে গেল। সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মুবিনের দিকে তাকিয়ে মুখে হাসি নিয়ে বলল,

“হ্যাঁ। হারিয়ে গিয়েছিল। আপনি এটা কোথাও পেয়েছেন মুবিন ভাই?”

দুলটা মাহিমার কান থেকে খুলে পড়ে যাওয়ার সময়ই মুবিন দেখেছিল। সাথে সাথেই সে দুলটা তুলে নেয়। মাহিমা মুবিনের হাত থেকে দুলটা নিয়ে কানে পরতে লাগল। মুবিন মুগ্ধ হয়ে এই দৃশ্য দেখছে। মাহিমা দুল পরা শেষে বলল,

“ধন্যবাদ মুবিন ভাই। আপনি জানেন না দুলটা আমার কত পছন্দের ছিল। একটা হারিয়ে গেলে অন্যটাও পরতে পারতাম না।”

মাহিমা চলে যাওয়ার সময় মুবিন লক্ষ করল মাহিমার হাঁটতে যেন একটু কষ্ট হচ্ছে। হয়তো জুতার জন্য অসুবিধা হচ্ছে। মুবিন সাহস করে পেছন থেকে মাহিমাকে ডাকল। মাহিমা ফিরে তাকিয়ে বলল,

“কিছু বলবেন?”

মুবিন মাহিমার কাছে এগিয়ে এলো। পাশ থেকে একটা চেয়ার টেনে এনে মাহিমাকে বসতে ইশারা করলে মাহিমা বুঝতে পারল না।

“বসো।”

মাহিমা অবাক হলো। বসবে কেন সে? এটা কেমন আবদার!

“তোমার মনে হয় হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে। হয়তো সমস্যাটা জুতোর জন্য হচ্ছে।”

মাহিমা বিস্মিত হলেও তর্ক না করেই চেয়ারে বসল। মুবিন একহাঁটুতে মেঝেতে ভর দিয়ে মাহিমার সামনে বসলো। মাহিমা মুবিনের আচরণে যথেষ্ট চমকাচ্ছে। মুবিন নিজে মাহিমার জুতো খুলতে নিলে মাহিমা আঁতকে উঠে পা সরিয়ে নিয়ে বলল,

“কী করছেন মুবিন ভাই!”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here