মন নিয়ে কাছাকাছি পর্ব – ৩০+৩১+৩২

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
Jerin Afrin Nipa
৩০

হাই হিল পরার অভ্যাস না থাকলেও আজ শখ করে পরেছিল। সেই শখই কাল হলো। এমনিতে মাহিমা যথেষ্ট লম্বা হলেও উঁচু জুতোতে আরও লম্বা লাগে। উঁচু জুতো পরার এটাও অবশ্য একটা কারণ। কিন্তু এই জুতো পরে বেচারির পা বাজে ভাবে ছিলে গেছে। চামড়া উঠে লাল মাংস বেরিয়ে পড়েছে। এজন্যই তো এভাবে জ্বলছিল। হাঁটার সময় ব্যথা হচ্ছিল। কিন্তু মাহিমা খেয়াল করেনি। এখন জুতো খুলে ছিলে যাওয়া জায়গাটা দেখে রীতিমতো আঁতকে উঠতে হচ্ছে। ক্ষতটা দেখার আগে ব্যথা এতটাও অনুভব হচ্ছিল না। কিন্তু এখন ক্ষত দেখে যন্ত্রণা যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। মাহিমা নিচের ঠোঁট ফুলিয়ে কাতর গলায় বলল,

“কতটা ছিলেছে! উফ, ভীষণ জ্বালা করছে।”

মুবিন হতাশ নয়নে এই মেয়েটাকে দেখলো। কিছুটা শাসন মেশানো গলায় বলল,

“যেটা পরে কম্ফোর্ট ফিল করো না সেটা পরতে যাও কেন? কেউ নিশ্চয় জোর করেনি।”

“কিন্তু লেহেঙ্গার সাথে হিল না পরলে লেহেঙ্গা মাটিতে গড়ায়।”

মুবিন কী বলবে এই মেয়েকে? রাগ লাগলেও কঠোর ভাবে কিছু বলার অধিকার এখনও তার হয়নি।

“পরেছ, এখন হয়েছে? ভালো লাগছে?”

“না। ব্যথা লাগছে।”

মুবিন চাইলেও এখন মাহিমার জন্য নতুন একজোড়া জুতা এনে দিতে পারবে না। আনলেও মাহিমা নিজেই হয়তো নিতে চাইবে না। উল্টো তার এরকম আচরণে সন্দেহ করবে। ভুলও বুঝতে পারে। কিন্তু মাহিমা পুরোটা অনুষ্ঠানে এই জুতা পরে হাঁটবে কীভাবে? মুবিন পকেট হাতড়ে টিস্যু খুঁজে পেলো। বুদ্ধি বের করে গোড়ালির দিকে জুতোতে টিস্যু গুঁজে দিল। মাহিমা মনোযোগ সহকারে মুবিনের প্রতিটা কাজ দেখছে। মুবিন এবার বলল,

“এবার পরো দেখি। এখনও ব্যথা পেলে পরতে হবে না।”

মাহিমা জুতো পরে উঠে দাঁড়াতে নিলে মুবিন বলল,

“হেল্প লাগবে?”

“না, ঠিক আছে।”

মাহিমা নিজে নিজেই দাঁড়াল। নিচে পা ফেলে দেখল টিস্যু থাকায় এখন আর জুতোয় ঘষা লেগে কষ্ট হচ্ছে না। মাহিমা কৃতজ্ঞতার চোখে মুবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,

“ধন্যবাদ মুবিন ভাই। আপনাকে অনেকগুলো ধন্যবাদ দিলেও কম পড়বে।”

মুবিন হাসলো। সে ভালোবাসা চায় কিন্তু এই মেয়ে তাকে ধন্যবাদ দিয়ে কৃতজ্ঞতা জানায়। যাক এটাই বা কম কিসে? কৃতজ্ঞতাই হয়তো একদিন ভালোবাসার রুপ নিবে। মুবিন ততদিন অপেক্ষা করবে।
মুবিনের কাছ থেকে চলে এলেও মাহিমা এখনও মুবিনকে নিয়েই ভাবছে। মুবিন ভাইয়ের আজকের আচরণ তার কাছে অবিশ্বাস্য হলেও খারাপ লাগেনি। মুবিন ভাই তার জন্য কতটা ভেবেছে! আচ্ছা, উনি মীরাকে পছন্দ করে বলেই কি তার এতটা খেয়াল রেখেছে? শালিকে ইমপ্রেস করে মীরাকে পটাতে চাচ্ছে? কোন মেয়েকে পটানোর আগে প্রথম শর্তই হচ্ছে তার বান্ধবীকে পটাও। বান্ধবী পটে গেছে মানেই মেয়েটাও পটে গেছে। মুবিন ভাইও এই পথই ধরেছে। তবুও মুবিন ভাইয়ের আজকের কেয়ারটুকু মাহিমা কোনদিন ভুলবে না। ছেলে ফার্স্ট ক্লাস। মীরাটার কপাল আছে বলতে হবে।

“কোথায় ছিলি এতক্ষণ? খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হচ্ছি। চল ভাবীর সাথে সেল্ফি তুলে আসি। ভাইয়া ভাবীর ছবিও তো তুলতে হবে।”

মীরা মাহিমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। মাহিমা পড়ে যেতে যেতেও সামলে নিয়ে হাঁটছে। ভাবছে, মুবিন ভাইয়ের কথাটা মীরাকে বলবে কি-না। অবশ্যই বলবে। বেচারা কত কষ্ট করে মীরাকে ইমপ্রেস করার জন্য তার সেবা আত্তি করেছে। এই কথা মীরা না জানলে ইমপ্রেস হবে কীভাবে?

“তোর সাথে কথা আছে।”

“কী কথা?”

“দরকারি কথা।”

“দরকারি অদরকারি সব কথা পরে শুনব। এখন তুই আমার কয়েকটা সুন্দর সুন্দর ছবি তুলে দে। আমি পোজ দিচ্ছি দাঁড়া।”
🌸

মীরারা নতুন ভাবী নিয়ে রাতে বাড়ি ফিরলো। এখনও সবাই ইভান ভাইয়ের ঘরে নতুন ভাবীকে ঘিরে বসে আছে। মীরাও এতক্ষণ ওখানেই ছিল। কাপড় চেঞ্জ করতে মাত্র রুমে এসেছে। ওয়াশরুম থেকে চেঞ্জ করে এসে বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে কানের দুল, চুড়ি, টিকলি খোলার সময় পায়ের দিকে চোখ গেল। তার এক পায়ে নূপুর নেই। মীরা ব্যস্ত হয়ে আশেপাশে খুঁজতে লাগল। কখন হারিয়েছে এটা? বাড়িতে আসার পর? নাকি বিয়েতে? রুমে পড়লে পেয়ে যাবে। কিন্তু অন্য কোথাও পড়ে থাকলে? মীরা ফ্লোরে বসে উঁকিঝুঁকি দিয়ে বেডের নিচে দেখছে। এমন সময় ছোট চাচী ঘরে এলো। ছোট চাচী মীরাকে নিচে বসে থাকতে দেখে বলল,

“কী করছিস তুই? নিচে কী খুঁজছিস?”

মীরা মুখ তুলে চাচীর দিকে চাইল। মুখ কালো করে বলল,

“আমার নূপুর হারিয়ে… ” মীরা লক্ষ করল চাচীর হাতে ফোন ধরা। সে বুঝে গেল। আজকের এত খুশির দিনটাও ওই মহিলা নষ্ট করতে চাচ্ছে? ওই মহিলা কি তাকে খুশি থাকতে দেখতে পারে না? মীরার চোখ মুখ কঠিন হয়ে গেল। তীক্ষ্ণ গলায় সে বলল,

“আজও কেন বাইরের একটা মানুষের সাথে তুমি কথা বলছো ছোট চাচী? ওই নোংরা স্বার্থপর জঘন্য মহিলার কথা কেন শোনো।”

মীরার কথা মানুষটা শুনতে পারছে ভেবে ছোট চাচী ফোনের স্পিকার চেপে ধরলো। তাতেও অবশ্য শেষ রক্ষা হলো না। মীরা আরও চেঁচিয়ে বলতে লাগল,

“একটা বাইরের মানুষের সাথে আমি জীবনেও কথা বলবো না। আমার জন্য উনার এতই দরদ থাকলে উনাকে বলো আমাকে যেন শান্তিতে বাঁচতে দেয়। আমি উনার ছায়াটাও আমার জীবনে চাই না।”

ছোট চাচী অসহায় মুখে মীরার দিকে তাকিয়ে বলল,

“তোর মা হয় মীরা। মা কি সন্তানের সাথে… ”

“কে সন্তান ছোট চাচী? কাকে মা বলছো তুমি? উনি মা হলে সন্তানকে ছেড়ে চলে যেত? তুমি মাহাকে ফেলে চলে যেতে পারবে? উনি আমাকে তখন ছেড়ে গেছেন যখন আমার শুধু উনাকেই লাগত। এখন তো আমার উনাকে লাগবে না। উনাকে ছাড়াই তো এতগুলো বছর থেকেছি। বাকি জীবনও থাকতে পারব।”

কথাগুলো বলে মীরা কাঁদতে লাগল। এই মহিলা যখনই কল দেয় মীরার কষ্ট হয়। সবকিছু ভুলে থাকতে চাইলেও পারে না। মনে হয় সে কতটা দুর্ভাগা। তার মা তাকে ছেড়ে চলে গেছে। সে কি এতটাই খারাপ ছিল? ছেড়েই চলে যাবে তাহলে দুনিয়ায় এনেছিল কেন? ছোটবেলা যখন বুঝতো না, সব জায়গায় মা’কে খুঁজত। মা কেন আসে না? কেন তাকে আদর করে না এই কথাই জিজ্ঞেস করতো। স্কুলে সব বাচ্চাদের বাবা মা যেত। শুধু তার মা-ই যেত না। কোন বাচ্চারা তার সাথে খেলতো না। মীরা অনেক কাঁদত। সেই সময় গুলো মীরা কখনও ভুলতে পারবে না। আর না ওই মানুষটাকে ক্ষমা করতে পারবে। তিক্ত অতীত মনে পড়ায় মীরার কষ্ট হচ্ছে। সে হাতপা ছেড়ে মেঝেতে বসে কাঁদতে লাগল। ছোট চাচীও তার কান্না থামাতে পারল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাকি সবাই নতুন বউকে ছেড়ে মীরার ঘরে হাজির হয়েছে। মীরাকে কাঁদতে দেখে অস্থির হচ্ছে। তার কান্নার কারণ বারবার জিজ্ঞেস করছে। বড় ফুপু মীরার মাথা, মুখে হাত বুলিয়ে বলছে,

“কী হয়েছে আমার মা’টার? কেন কাঁদছে? ও মা বল না। আমাদেরকে কেন টেনশন দিচ্ছিস?”

আবির সবসময় মীরাকে ক্ষেপায়। মজা করে। কিন্তু মীরার একটু মন খারাপ হলেই তার দুনিয়া ভার লাগে।

“ও মীরাবাঈ, কী হয়েছে চাঁদ? কেন কাঁদছিস তুই? কেউ কিছু বলেছে?”

মীরা কারো কোন কথার জবাব দিচ্ছে না। ছোট চাচী আসল কারণ বলার জন্য মুখ খোলার আগেই মীরা বলল,

“আমার নূপুর হারিয়ে গেছে। কোথাও পাচ্ছি না।”

মীরা কেন কাঁদছে এটা জানতে পারলে সবাই ছোট চাচীকে বকবে। ফুপু তো ভীষণ রাগ করবে। তাই মীরা নূপুর হারানোর বাহানা দিয়েছে।
মীরার কান্নার এই সামান্য কারণ শুনে সকলে হতাশ। কিন্তু মেয়েটা এরকম ভাবে কাঁদছে তাই কেউ কিছু বলতে পারল না। ইভান মীরাকে ধরে বিছানায় বসিয়ে আশ্বস্ত করল,

“তোর কতগুলো নূপুর লাগবে? আমাকে বল। আমি তোকে এনে দেব। তবুও এভাবে কাঁদিস না লক্ষী। তুই না ভালো মেয়ে। এভাবে কেঁদেকেটে কেন আমাদের কষ্ট দিচ্ছিস? তুই কাঁদলে আমাদেরও তো কান্না পায়।”

মীরা হেঁচকি তুলতে তুলতে চোখ মুছছে। যতবার চোখ মুছছে ততবারই আবার জল গড়িয়ে পড়ছে। ইভান মীরার চোখ মুছে দিল। মাথার চুল ঠিক করে দিতে দিতে বলল,

“তোর দুইটা ভাই থাকতে তুই কেন একটা নূপুরের জন্য কাঁদছিস পাগলি!”

মীরা নাক টেনে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,

“ওইটাও তুমিই এনে দিয়েছিলে।”

“তাতে কি? আবার এনে দেব। পৃথিবীতে নূপুর আবিস্কারই হয়েছে আমার বোনের সুন্দর সুন্দর দুইটা পায়ের জন্য।”

🌸

মীরা দু-হাত ভরে মেহেদি পরেছে। ইভা আপু, উঁহু ভাবী। এতো সুন্দর করে মেহেদি দিতে পারে মীরার জানা ছিল না। ইভা আপু ইভান ভাইয়ের বউ হয়ে আসার পর থেকে এই বাড়িটা যেন আগের থেকেও সুখী সুখী হয়ে গেছে। তার ভাবী সবকিছু পারে। মীরা ইভার এত গুণ দেখে মুগ্ধ হয়। একটা মানুষ এতটা পারফেক্ট কীভাবে হতে পারে? যেমন রূপবতী তেমনই গুণবতীও। তার হাতের মেহেদি দেখানোর জন্য মীরা সিঁড়ি দিয়ে উড়ে উড়ে নামছে। নিচে নেমেই সে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। কারণ জায়িন ভাই সহ পুরো পরিবার এসেছে। আজ ভাবীর বাড়ির মানুষ আসবে মীরা জানতো । সে অপ্রস্তুত হয়ে হেসে সবাইকে সালাম দিল। সুমনা মীরার হাত দেখে বলল,

“মেহেদি দিয়েছিস?”

“হ্যাঁ ইভা আপু, এই আপু বলার অভ্যাসটা এখনও ছাড়তে পারছে না। ভাবী ডাকতে গিয়েও মুখ দিয়ে আপু চলে আসে।
” ভাবী দিয়ে দিয়েছে।”

ইভার বিয়ের পর জায়িন অনেকদিন বাড়িতে আসেনি। গতকাল রাতে ফিরেছে। আজকে শুনলো সবাই এখানে আসছে। তার মানে আজ পড়া বন্ধ। তার প্রেয়সীকে দেখতে হলে কাল বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। জায়িন এই দীর্ঘ অপেক্ষা করতে পারল না। যাকে দেখার জন্য এসেছে তাকে যতক্ষণ না দেখবে ততক্ষণ অস্থিরতা কমবে না। তাই মা, খালামনি কয়েকবার বলার পরেই এখানে আসতে রাজি হয়ে গেছে। এখানে এসে কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখতে পেয়ে তৃষ্ণার্ত হৃদয় শান্ত হয়েছে।
মীরা ইভাকে ডাকতে চলেই যাচ্ছিল। এর মাঝে আরেকটা কাণ্ড ঘটলো। ফ্লোরে মাহার রাবারের খেলনা হাঁসটা পড়ে ছিল। মীরা ওটার উপর পাড়া দিয়ে স্লিপ খেয়ে সোজা হুমড়ি খেয়ে পড়ল। পড়লো তো পড়লো, সেটাও অন্য কারো উপর না। তার দু’হাতের মেহেদির ছাপ জায়িনের সাদা শার্টে ফোটে আছে। মীরা চোখ তুলে জায়িনকে দেখে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলে আরেকটা অঘটন ঘটালো। সরি বলতে বলতে শার্ট থেকে মেহেদি মুছতে গিয়ে আরও লেপটে দিল। সে ভুলেই গিয়েছিল এটা মেহেদি। যত ধরবে ততই লাগবে।

চলবে_#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
Jerin Afrin Nipa
৩১

মীরার এরকম কাজে তার বাড়ির সকলে হতভম্ব। ইভার বাবা মা হাসলেও তারা হাসতে পারছে না। কারণ মেয়েটা করেছেই একটা গাধামি কাজ। হাসি আসবে কীভাবে? ইভানের মা এই মেয়ের নির্বুদ্ধিতা দেখে বাকরুদ্ধ। ভুলবশত মেহেদি লেগেছে ঠিক আছে। তুই আবার কোন আক্কেলে তা মুছতে যাস? তিনি চাপা গলায় মীরাকে ধমক দিয়ে বললেন,

“ছেলেটার শার্ট নষ্ট করে দিলি।”

বড়মার দিকে তাকিয়ে মীরার গলা ফাটিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে,

“আমি কি ইচ্ছে করে করেছি? উনি দেখেছিলেন না আমি পড়ে যাচ্ছি। উনি কেন সামনে থেকে সরে গেলেন না।”

কিন্তু মীরা এই কথাটা বলতে পারলো না। দোষ এখন সবাই তাকেই দিবে। মাহার খেলনা কে নিচে ফেলে রেখেছে এটা দেখবে না। খেলনা পড়ে না থাকলে সে-ও স্লিপ খেত না। দোষ কার কাঁধে চাপানো যাবে মীরা এটা নিয়ে মোটেও ভাবছে না। তার আসল ভাবনা জায়িন ভাই তাকে খেয়ে ফেলবে। মীরা জায়িনের দিকে তাকিয়ে প্রায় কেঁদে ফেলের মতো করে বলল,

“সরি জায়িন ভাই। ইচ্ছে করে করিনি। আপনার শার্ট নষ্ট হয়ে…আপনি শার্ট খুলে দিন আমি ধুয়ে..’

কী বলছে সে এসব? জায়িন ভাইকে শার্ট খুলতে বলছে! মাথাটা পুরো গেছে।

“আমি আপনাকে নতুন শার্ট কিনে…’

“ওয়াশরুমটা কোনদিকে নিয়ে চলো।”

জায়িনের এমন নির্লিপ্ত ভাব দেখে মীরা যথেষ্টই অবাক হলো। জায়িন ভাই তাকে কিছু বলবে না? একটুও বকবে না? অন্তত দু’একটা বকা দেওয়াই উচিত। সে কাজটাই ওরকম করেছে। বড়মা দাঁত চেপে চোখ ইশারা করে জায়িনকে নিয়ে যেতে বলল। মীরার হুঁশ হয়েছে। সে তাড়াতাড়ি করে বলে উঠল,

“আসুন আসুন। আমি ওয়াশরুম দেখিয়ে দিচ্ছি।”

ওয়াশরুমে জায়িন শার্ট পরিষ্কার করলেও মীরা বাইরে দাঁড়িয়ে বকবক করে যাচ্ছে,

“আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি জায়িন ভাই। আপনি কি রাগ করেছেন?”

জায়িন ভেতরে আয়নায় নিজেকে দেখে হাসলো। মীরা একা একাই বলে যাচ্ছে,

“মেহেদির দাগ মনে হয় উঠে যাবে। আর না উঠলেও শার্টটা যদি আপনার খুব প্রিয় হয় তাহলে আপনি আমাকে বকতে পারেন। আমি কিছু মনে করব না।”

জায়িন ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছে। মীরা জায়িনকে দেখে চুপ করে গেল। জায়িন সরু চোখে মীরার দিকে তাকিয়ে কিছুটা ঝুঁকে এসে বলল,

“কিছু ক্ষেত্রে এক প্রিয় জিনিস, আরেক প্রিয় জিনিসের থেকেও বেশি প্রিয় হয়ে যায়।”

মীরা হাঁ করে জায়িনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বুঝতে পারল না কিছুই। জায়িন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল,

“বুঝলে কিছু?”

মীরা দু’পাশে মাথা নেড়ে না জানাল। জায়িন হেসে বলল,

“সময় হলে বুঝবে।”

মীরা যন্ত্রের মতো প্রশ্ন করলো,

“কী বুঝবো?”

“এইযে তুমি আমার পছন্দের শার্ট নষ্ট করে দিলে। এর পরিবর্তে আমি তোমার থেকে কিছু নেব না? কী নিব সেটাই সময় হলে বুঝবে।”

🌸

বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়ই আকাশে মেঘ করেছিল। কয়দিন ধরেই এমন হচ্ছে। আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গিয়ে চারিদিক অন্ধকার করেও বৃষ্টি হয় না। কতক্ষণ উল্টাপাল্টা বাতাস বয়ে সব ঠান্ডা। মীরা আজও তেমনই ভেবেছিল। বৃষ্টি তো হবেই না। শুধু শুধু প্রাইভেট মিস দিয়ে কাজ নেই। তাই ছোট চাচীর বারণ স্বত্বেও ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে পড়ল। প্রচুর বাতাস বইয়ে। গাছের ডালপালা নুইয়ে যাচ্ছে। মেঘাচ্ছন্ন এমন দিনে মীরার ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগে না। বৃষ্টিতে ভেজার আশা নিয়ে কবে থেকে বসে আছে। কিন্তু বৃষ্টি হওয়ারই খবর নেই। রাস্তায় মানুষজন ছোটাছুটি করে নিজেদের গন্তব্যে পৌঁছুচ্ছে। মীরা ব্যাগ বুকের সাথে চেপে ধরে দৌড় লাগাল। বাতাসের সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা করছে এমন একটা ভাব। মুবিন ভাইদের বাড়ির কাছাকাছি আসতেই ঝিরিঝিরি ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে লাগল। মীরা খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠল। দাঁড়িয়ে পড়ে দু’হাত মেলে দিয়ে চোখ বন্ধ করে এবছরের প্রথম বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে মাখল। প্রাইভেট থেকে ফেরার সময়ও বৃষ্টি থাকলে ভিজে বাসায় ফিরবে। এটা ভেবেই দৌড়ে গেটের ভেতর ঢুকে পড়ল। এটুকু জায়গা আসতে আসতেই মোটামুটি ভিজে গেল। জাম কালারের জামায় যেখানে যেখানে বৃষ্টির ফোঁটা পড়েছে সেটুকু কালো রঙ হয়ে গেছে। মাথার চুলও হালকা ভেজা। মীরা হাত দিয়ে চুল থেকে পানি ঝাড়তে ঝাড়তে কলিংবেল চাপছে। একবার, দু’বার, তিনবার। তারপরও কেউ দরজা না খুললে বিরক্ত হয়ে কলিংবেলের সুইচে চাপ দিয়ে ধরে রাখল। মীরা নিচু হয়ে পায়জামার নিচের দিকটা দেখছিল। ময়লা লেগে গেছে। তখনই দরজা খুলে গেল। কে দরজা খুলেছে এটা না দেখেই মীরা বলল,

“উফ, এত দেরি হলো কেন আন্টি?”

আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু চোখ তুলে সামনের দিকে তাকিয়ে তার সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল। আন্টি না। জায়িন ভাই দরজা খুলেছে। মীরা অপ্রস্তুত হাসল। ইনি কবে এসেছে? সেদিন শার্ট নষ্ট করার ঘটনাই তো এখনও পুরোপুরি ভুলেনি।
জায়িন ভাবলেশহীন মুখে দরজায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মীরাকে দেখে তার চেহারায় কোন ভাবান্তর হলো না। বরং এভাবে কলিংবেল চাপায় একটু বিরক্ত হয়েছে বলে মনে হলো। মীরা জায়িনের হাতের নিচ দিয়ে উঁকি দিয়ে ভেতরের দিকে দেখল। মনে মনে ভাবল, ইনি এভাবে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে আমি ভেতরে যাব কীভাবে?
জায়িন দরজার সামনে থেকে সরছে না দেখে গলা পরিষ্কার করে মীরাই হালকা স্বরে বলল,

“একটু সরুন জায়িন ভাই। আমি ভেতরে যাব।”

জায়িন সরে দাঁড়ালে মীরা ভেতরে চলে এলো। রান্নাঘর, মুবিন ভাইয়ের ঘরের দিকে উঁকি দিয়ে আন্টি মুবিন ভাইকে খুঁজছে। মীরা উঁকি ঝুকি চালিয়ে যাওয়ার সময় জায়িন দরজা লাগিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে রুমে চলে গেল। জায়িন চলে গেলে মীরা জোরে মুখ মোচড় দিয়ে ভেঙিয়ে বলল,

“কথা বললে হায়াত কমে যাবে!”

রান্নাঘর থেকে কোন শব্দ আসছে না। আন্টি কি বুঝেনি সে এসেছে? মুবিন ভাই রুমে কী করে? বেরিয়ে এসে দরজা খুললো না। মীরা গলা ছেড়ে ডাকতে যাচ্ছিল। কিন্তু জায়িন ভাই বাড়ি আছে মনে পড়তে ধীরে ডাকল। এই লোক আবার শব্দদূষণ সহ্য করতে পারে না।

“আন্টি। ও আন্টি…

নিজের ঠিক পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে মীরা ঝট করে পেছনে ফিরল। জায়িনকে দেখে ভয় পেয়ে বুকে হাত দিয়ে বলে উঠল,

” ওরে বাবা!”

জায়িন শান্ত চোখে মীরার দিকে তাকিয়ে হাতের তোয়ালে এগিয়ে দিল। এই মেয়ের কোন আচরণেই এখন আর সে বিরক্ত হওয়ার প্রয়োজন মনে করে না। কারণ এই মেয়ের প্রতিটা উদ্ভট আচরণে বিরক্ত হওয়ার শুরু করলে তার বিরক্ত হওয়ার ক্ষমতা লোপ পেতে খুব বেশি সময় লাগবে না। বৃষ্টিতে ভিজে আসার কী দরকার ছিল? মীরা প্রথমে বুঝতে পারল না। তাই জিজ্ঞেস করল,

“কী করব এটা দিয়ে?”

“বৃষ্টিতে ভিজে এসেছ খেয়াল নেই?”

কথা না যেন চাবুকের বাড়ি। জন্মের সময় মুখে মধু দিলে এই অবস্থা হতো না। হাহ! মীরা সংকোচে তোয়ালেটা নিল। মাথা মুছতে মুছতে মুবিন ভাইয়ের রুমের দিকে হাঁটা ধরল। আর তখনই পেছন থেকে গমগমে গলায় শুনতে পেল।

“মুবিন আজ সকালে মা খালামনিকে নিয়ে নানার বাড়ি গেছে।”

বাংলা কথা। তবুও মীরার কাছে চায়নিজ বলেই মনে হলো। সে বুঝতে না পেরে আবার জিজ্ঞেস করল,

“মুবিন ভাই বাড়িতে নেই?”

জায়িনের চেহারায় স্পষ্ট হতাশা দেখা গেল। সে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে কিচেনের দিকে এগোতে লাগল। মীরার কথার উত্তর দিল না। মীরা জায়িনের পেছন পেছন আসতে আসতে আবার জিজ্ঞেস করল,

“আন্টিও বাড়িতে নেই? ওরা কেউ বাড়িতে নেই?”

“মুবিন আজ সকালে মা খালামনিকে নিয়ে নানার বাড়ি গেছে। এই একটা কথার পরও কি আরও প্রশ্ন থাকার কথা?”

লোকটার ভাব দেখে মীরার গা জ্বলে যাচ্ছে। এক কথা দুই বার বললে সমস্যা কি? মানুষ বুঝতে না পারলে জানতে চাইবে না? আশ্চর্য! ইনি এমন কেন? কেমন রোবটের মতো আচরণ করে। স্বাভাবিক মানুষের মতো কোন কথা বলতে পারে না কেন? মীরার ঠেকা পড়েছে উনার সাথে কথা বলতে। মুবিন ভাই বাড়িতে নেই এখন আর এখানে একমিনিটও থাকার প্রশ্নই আসে না। আজকের পড়া ছুটি। মীরা দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এসে, যাবার আগে এই লোকটাকে বলে যাওয়ারও প্রয়োজন মনে করল না। সে দরজা খুলতে নিলে গুরুগম্ভীর সেই গলা শুনে থামতে হলো।

“বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে।”

মীরা নাক ফুলিয়ে বলল,

“আমি যেতে পারব।”

“সাথে ছাতা আছে?”

“না। কিন্তু আমি ভিজে চলে যাব। আসার সময় বৃষ্টিতে ভিজে ফেরার জন্যই ইচ্ছে করে ছাতা আনিনি।”

“বৃষ্টি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আবির অপেক্ষা করতে বলেছে।”

মীরা মনে মনে ভাবল, হায় আল্লাহ! এ কোন জ্বালা! আবির ভাই আবার কোত্থেকে জানলো সে ছাতা ছাড়া এসেছে। বৃষ্টি কখন থামে কে জানে। এতক্ষণ মীরা এখানে অপেক্ষা করবে? এই লোকের সাথে? অসম্ভব। ইনি নিজে তো একটা কথাও বলবে না। মীরা কথা বললে তাকেও মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে বসিয়ে রাখবে। না বাবা তার থেকে চলে যাওয়াই ভালো। মীরার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। সে বলল,

“আপনাদের একটা ছাতা দিন। আমি কাল এসে দিয়ে যাব।”

“ছাতা নেই।”

চলবে…#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
Jerin Afrin Nipa
৩২

ছাতা নেই! মীরা বিড়বিড় করল, আল্লাহ তুমি কি আমাকে কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছ! ছাতা আবার থাকে না কীভাবে? নিশ্চিত আছে। কিন্তু উনি জানেন না। মীরা দরজার কাছ থেকে ফিরে এলো। জায়িন এখনও কিচেনে কী করছে কে জানে। মীরা কিচেনের দিকে মুখ বাড়িয়ে বলল,

“ছাতা মনে হয় আছে। আপনি জানেন না। আন্টিকে কল দিন। আন্টি বলে দিবে ছাতা কোথায় আছে।”

মীরা কথাটা বলে অপেক্ষা করল। অনেকক্ষণ পরেও কোন জবাব না পেয়ে সে ব্যাগ সোফার উপর রেখে কিচেনে এসে ঢুকলো। জায়িন কফি বানিয়ে মগে ঢালছে। মীরা কিচেনের সামনে থেকে বলল,

“জায়িন ভাই, আন্টিকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করুন। ছাতা আছে মনে হয়।”

জায়িন মীরার দিকে শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে মীরা চুপ মেরে গেল।
সে কিচেন থেকে বেরিয়ে এসেছে। এই লোকের সাথে এক কথার বেশি দুই কথা বললেই কেমন কটমট করে তাকায়। শয়তান লোক। মীরা ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে পড়ল। আসার সময় দোয়া করছিল যেন বৃষ্টি হয়। এখন দোয়া করছে তাড়াতাড়ি যেন বৃষ্টি থেমে যায়। জায়িন কফির মগ হাতে বেরিয়ে এসেছে। মীরা সোফার উপর পা তুলে বসেছিল। জায়িনকে দেখে তাড়াতাড়ি করে পা নামিয়ে নিল। মীরা নখ কামড়াতে কামড়াতে ভাবছে, জায়িন ভাই একবার ঘরে যাক। প্রথম সুযোগেই মীরা এখান থেকে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু জায়িন রুমে গেল না। কফিতে চুমুক দিতে দিতে মীরার পাশের সোফায় আরাম করে বসে পড়ল। হায় আল্লাহ! ইনি কি এখন এখানেই বসে থাকবে? জায়িন সময় নিয়ে কফি খাচ্ছে। কিন্তু মীরার ঘড়িতে সময় যে আটকে আছে। একেকটা সেকেন্ড একেক বছর মনে হচ্ছে।
দু’মিনিট নীরবতার পর মীরা ধীর গলায় বলল,

“জায়িন ভাই, আমি চলে যাই? বৃষ্টিতে ভিজলে আমার কিছু হয় না। আবির ভাই শুধু শুধু টেনশন করে।”

“মীরা যত বাহানাই দেক, যা কিছুই বলুক। ভুলেও তুই ওকে বৃষ্টির মধ্যে বেরুতে দিবি না। মাথায় এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়লেও ওর ১০০° জ্বর এসে যায়। এটা তোমার ভাইয়েরই কথা।”

মীরা ফোঁস করে দম ফেলল। আবির ভাই তাকে ভালো ভাবেই ফাঁসিয়ে দিয়েছে। এই লোক তো মনে হচ্ছে তাকে পাহারা দিয়ে রেখেছে।
সময় কাটছে না। ইনি মজা করে কফি খেলেও মীরা শুধু মুখে বসে আছে। ভয়ে ভয়ে টিভির রিমোট নিয়ে টিভি ছেড়ে দিল। কয়েকটা চ্যানেল ঘুরিয়েও ভালো কিছু না পেয়ে একটা হিন্দি মুভিই দেখতে লাগলো। আগে কখনও দেখেনি। সময় কাটানোর জন্য মাঝখান থেকেই মুভি দেখা শুরু করেছিল। কিছুক্ষণ দেখে মজাই লাগছিল। কিন্তু হঠাৎ করে একদম অপ্রত্যাশিত ভাবে নায়ক নায়িকার চুমাচাটির সিন শুরু হয়ে গেলে মীরার চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইল। সে ভাবতেই পারেনি এখন এমন কিছু হবে। মীরা রিমোট খুঁজে হুড়মুড়িয়ে টিভি অফ করে দিল। কী লজ্জা কী লজ্জা! জায়িন ভাইও কি এসব দেখেছে? লজ্জায় সত্যি সত্যিই মীরার ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। সে চোখ বন্ধ করে জায়িনের দিকে তাকাল। দূর কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না। ধীরে ধীরে একচোখ খুলল। না, জায়িন ভাই মনে হয় দেখেনি। কারণ তিনি মনোযোগ সহকারে ফোন চাপছে। মীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। বিড়বিড় করে বলল,

“যাক বাঁচা গেল। উফ আল্লাহ।”

মীরা মনে মনে শপথ করল, আজকের পর কোন মানুষের সামনে টিভি দেখতে বসবে না। দেখা মুভিও দেখবে না। আসলে টিভি দেখাই ছেড়ে দিবে সে। জায়িন ভাইও যদি টিভির দিকে তাকিয়ে থাকতো তাহলে কী লজ্জাটাই না পেত! কোনোদিন উনার সামনে আসতে পারত না।
জায়িন ফোন থেকে মুখ তুলে দেখল মীরা টিভি বন্ধ করে বসে আছে।

“কফি চলবে?”

জায়িন ভাইয়ের সামনে থাকলে মীরা কি কানে কম শুনে? নাকি উনার মুখের বাংলা কথাও বুঝতে পারে না। একটা কথা দুই তিনবার জিজ্ঞেস করতে হয়। এতে উনি বিরক্তও হয়। এবারও জায়িন ভাই কী বলল মীরা বুঝতে পারল না। কথাটা তাকে বলেছে কি-না এটাও বুঝলো না। উনার মুখের দিকে হাবার মতো তাকিয়ে আছে। ওকে এরকম ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে জায়িন ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইল। মীরা তখনও উত্তর দিতে পারল না। জায়িন স্পষ্ট বিরক্ত হলো। পরিষ্কার গলায় ঝরঝরে উচ্চারণে জিজ্ঞেস করল,

“কফি খাও?”

মীরা মাথা নাড়ল। জায়িনের ভ্রু কোঁচকাতে দেখে সাথে সাথে বলে উঠল,

“কফি খাই না। চা খাই।”

“হু।”

জায়িন নিজের খালি মগ নিয়ে উঠে যাচ্ছে দেখে মীরাও উঠল। জায়িনের পেছনে পেছনে কিচেন চলে এলো। অবাক হয়ে দেখতে লাগল জায়িন ভাই ছেলে হয়েও কিচেনে কোন জিনিস কোথায় আছে সব জানে। কত দক্ষ হাতে গ্যাসে চায়ের পাতিলে পানি বসিয়ে দিল। আর মীরা এখন পর্যন্ত রান্নাঘর কোনদিকে এটাই বলতে পারবে না। রান্নাঘরে কোন জিনিস কোথায় রাখা আছে বলবে তো দূরের কথা। জায়িন ভাই তাকে চা বানিয়ে খাওয়াবে। সে অপদার্থের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে? তাই সাধারণ মানবতা থেকে বলল,

“আমি সাহায্য করি? কী সাহায্য লাগবে বলুন।”

“চা পাতা কোথায় আছে দেখো।”

হায় হায়! জায়িন ভাইয়ের যে স্বভাব, মীরা ভেবেছিল সে সাহায্য করার কথা বললে জায়িন ভাই বলবে, না থাক। তোমার সাহায্য করতে হবে না। তুমি গিয়ে সোফায় বসে টিভি দেখো। কিন্তু ইনি তো সাহায্য চাচ্ছেন! মীরা তো এবার ফেঁসে গেল। চা পাতা কোথায় আছে কে জানে। আন্টি কতদিন চা করে খাইয়েছে। কিন্তু চা পাতার খোঁজ তো সে রাখেনি৷ মীরা পেঁচা মুখ করে এই ড্রয়ারে, ওই তাকে চা পাতা খুঁজে যাচ্ছে। পাচ্ছে না তো কোথাও। জায়িন ভাইকে বলবে, পাচ্ছি না। জায়িন আড়চোখে মীরাকে দেখছে। হাসি পেলেও হাসছে না।

“কী হলো, পাওনি?”

মীরা ঠোঁট ফুলিয়ে মিনমিন করে বলল,

“পাচ্ছি না জায়িন ভাই।”

“ভালো করে দেখেছ?”

“হ্যাঁ। সব জায়গায় খুঁজেছি। আন্টি কোথায় রেখেছে পাচ্ছি না। চা খেতে হবে না। আপনি রেখে দিন। এমনিতেও আমি এত চা খাই না।”

মীরা জায়িনের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। জায়িন হঠাৎ পেছনে ফিরলে মীরা চুপ হয়ে গেল। জায়িন ওকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে উপরের একটা তাক থেকে চা পাতার কৌটো বের করে আনলো। এটা চা পাতার কোটা! মীরা তো এটা দেখেছেই। কিন্তু বুঝতে পারেনি। সে লজ্জিত মুখে বলল,

“এই কৌটৌটা বুঝতে পারিনি।”

জায়িন সুন্দর করে কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই চা বানিয়ে ফেলল। এবং হাতপা না পুড়িয়ে কাপেও ঢাললো। মীরা আশ্চর্য হয়ে ওকে নিপুণভাবে কাজ করতে দেখেছে। মীরাকে চা ঢালতে দিলে এতক্ষণে গরম চা ফেলে নির্ঘাত হাতপা পুড়িয়ে বসে থাকত। জায়িন চায়ের কাপটা মীরার দিকে এগিয়ে দিল। মীরা এই প্রথম জায়িনের সামনে মন থেকে আন্তরিক ভাবে হাসল। কিচেন থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে চায়ে চুমুক দিয়ে মনে মনে প্রশংসা না করে পারল না। এই চায়ের প্রশংসা না করলে চা তাকে অভিশাপ দিবে। এত সুন্দর চা বানিয়ে খাওয়ানোর জন্য জায়িন ভাইকে একটা ধন্যবাদ দিতেই হয়। মীরা পিছন দিকে ঘুরে বলতেই যাচ্ছিল,

“ধন্যবাদ ভাইয়া।”

এমম সময় হঠাৎ কানে তালা লাগিয়ে আশেপাশেই মনে হয় কোথাও বজ্রপাত হলো। সাথে সাথে ইলেক্ট্রিসিটিও চলে গেল। এতো জোরে বাজ পড়ায় মীরা ভয় পেয়ে হাত থেকে চায়ের কাপ ফেলে দিল। গরম চা পায়ের উপর পড়তেই যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল। সবকিছু ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেছে। মীরা কিছুই দেখতে পারছে না। আবারও পরপর কয়েকটা বজ্রপাত হলো। মীরা কানে হাত দিয়ে কেঁদে ফেলে ডাকল।

“জায়িন ভাই! জায়িন ভাই! কোথায় আপনি?”

অন্ধকারের মাঝেই দু’টো হাত মীরার হাত ধরল। মীরা তখন থরথর করে কাঁপছে। সে জায়িনের হাত শক্ত করে ধরে ফেলল। জায়িন ওর ভয় কমাতে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,

“আমি এখানেই আছি। ভয় পেয়ো না। আলো জ্বালিয়ে দিচ্ছি।”

জায়িনের দুই হাতই মীরা শক্ত করে ধরে রেখেছে। মেয়েটা ভয় পেয়ে কবুতরের বাচ্চার মতো কাঁপছে। জায়িন একটা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আরেক হাতে মীরাকে ধরে রেখে কিচেনে মোমবাতি খুঁজছে। অনেক খোজাখুজি করেও মোমবাতি পেল না। জায়িন মীরাকে নিয়ে অন্ধকারেই কিচেন থেকে বেরিয়ে এলো। ড্রয়িংরুমে এসে মীরা সোফার সাথে ধাক্কা খেল। একে তো পায়ে গরম চা পড়ে প্রচণ্ড জ্বালা করছে। তার উপর সোফার সাথে বেশ জোরেই নখে বাড়ি খেল। মীরা অস্ফুটে কেঁদে উঠল। জায়িন অন্ধকারে মীরার মুখ দেখতে না পারলেও মীরা কষ্ট পাচ্ছে ঠিকই বুঝতে পারল। ড্রয়িংরুমে সোফার উপরেই তার ফোনটা রেখে গিয়েছিল। জায়িন অন্ধকার হাতড়ে ফোন খুঁজছে। এরকম সময় ঠিক আরেকটা বজ্রপাত হলো। এবং এটা যেন জায়িনদের ছাঁদেই হলো এত প্রচন্ড শব্দ হয়েছে। মীরা ভয়ে বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলল। সজ্ঞানে থাকলে সে হয়তো এরকম কাজ কোনোদিনও করতো না৷ কিন্তু এই মুহূর্তে লাজলজ্জা, বোধবুদ্ধি ভুলে মীরা জায়িনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থরথর করে কাঁপতে লাগল। ওর এরকম আচরণে জায়িনও স্তব্ধ হয়ে গেল। নড়াচড়া করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে সে। এদিকে মীরা শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে জায়িনকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। জায়িন পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

“আমার ভয় লাগছে। জায়িন ভাই আমার ভয় লাগছে। প্লিজ আলো জ্বালুন।”

অজান্তেই জায়িনের একটা হাত মীরার পিঠে উঠে এলো। মৃদু হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত করতে লাগল।

“ভয় নেই মীরা। আমি আছি তো। তোমার কোন ভয় নেই।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here