#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৩
🌸
মীরা ব্যাগ কাঁধে তিড়িংতিড়িং করে মুবিন ভাইয়ের কাছে পড়তে যাচ্ছে। এসএসসি পরীক্ষার্থী একটা মেয়ে কি ভালোবাসার নামক অনুভূতি বুঝে না? অবশ্যই বুঝে। তাদের ক্লাসের এমন কোন মেয়ে নেই যে রিলেশন না করে। মাহিমা আর সে-ই বাকি শুধু। এটা পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়ার বয়স। প্রেম করার বয়স তো আর চলে যাচ্ছে না। কলেজে গিয়ে না করলেও ভার্সিটি গিয়ে করবে। কিন্তু এখন না। আবির ভাই, তনি আপু ভার্সিটিতে পড়ে তাই বাড়িতে জানাজানি হলে তাদের মেনে নিবে। মীরার এখনই প্রেম করার শখ নেই। তবে মুবিন ভাইকে যে তার ভালো লাগতে শুরু করেছে এটা ঠিকই বুঝতে পারছে। কিন্তু এই ভালোলাগা কি প্রেম ভালোবাসা টাইপ ভালোলাগা। নাকি সাধারণ ভালোলাগা এটা বুঝতে পারছে না। প্রেম ভালোবাসা টাইপ ভালোলাগা কেমন হয় এটাই তো জানে না। গেট দিয়ে ঢোকার সময় দারোয়ান চাচার সাথে কতক্ষণ গল্প করল। চাচীর খোঁজ খবর ছেলেমেয়েদের খোঁজ খবর নিয়ে ভেতর পা বাড়াল। সামনে একটা ভাঙা ইট পড়েছিল মীরা সেটা দেখেনি। না দেখে উস্টা খেয়ে নখ উলটে ফেলেছে। কলকল করে রক্ত পড়ছে। ব্যথায় চোখ মুখ খিঁচে কেঁদে উঠল মীরা। দারোয়ান চাচা ছুটে এসেছে।
“আহা হা, এইডা কী করলা মা? কেমনে ব্যথা পাইলা? ইশশিরে, অনেক ব্যথা পাইছো?”
মীরা কেঁদেকেটে চোখ লাল করে ফেলে নাক টানতে টানতে বলল,
“চাচা আমি বাড়ি যাব।”
“এই অবস্থায় কেমনে যাইবা মা? রক্ত বন্ধ করা লাগব না? চল তোমারে জায়িন বাবার কাছে নিয়া যাই। সে তো ডাক্তার। রক্ত বন্ধ করে দিব।”
ওই বদমেজাজি লোকটার নাম শুনেই মীরার ব্যথা আরও বেড়ে গেল যেন। সে দু’পাশে মাথা নেড়ে তীব্র প্রতিবাদ করে বলল,
“না চাচা। আমাকে বাড়ি দিয়ে আসুন।”
ওরা কথা বলার এপর্যায়ে জায়িনকে আসতে দেখা গেল। মনে হচ্ছে সে কোথাও বেরুচ্ছে। পরনে কালো শার্ট, পরিপাটি চুল দেখতে ভালো লাগলেও মীরার এখন দেখার সময় নেই। জায়িন কাছে এসে মীরাকে মাটিতে বসে কাঁদতে দেখে কপালে সামান্য ভাঁজ ফেলে তাকাল। মীরার পায়ে রক্ত দেখেই হয়তো বুঝে গেল কী হয়েছে। মীরা তখনও কেঁদে যাচ্ছে। জায়িন দারোয়ান চাচাকে জিজ্ঞেস করল,
“কোন সমস্যা চাচা?”
“দেখ না বাবা, মীরা মা উস্টা খেয়ে নখ উলটে রক্ত বেরুচ্ছে। আমি তোমার কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বললে ও বাড়ি যাওয়ার কথা বলছে। বাড়ি তো অনেক দূরে। উপরে নিয়ে গিয়ে তুমিই তো রক্ত বন্ধ করে দিতে পারবা।”
মীরা পা চেপে ধরে চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছে। লোকটার সামনে মন খুলে কাঁদতেও পারছে না। মীরা উপরে যেতে চাচ্ছে না শুনে লোকটা মনে হলো বিরক্ত চোখে তার দিকে তাকালো। মীরা সেদিকে না তাকিয়ে আহত পায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। জায়িন একনজর মেয়েটাকে দেখে স্বভাবসুলভ গম্ভীর গলায় বলল,
“ওকে উপরে নিয়ে আসুন চাচা।”
মীরা এবার প্রতিবাদ করতে গিয়েও লোকটার তীক্ষ্ণ চাহনির দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেল। গতকাল কুকুরের তাড়া খেয়ে যে ঘটনা ঘটিয়েছে। সেই লজ্জাই তো এখনও ভুলতে পারছে না। তার পর জায়িন ভাইয়ার সামনে আজকে আবার আরেকটা ঘটনা। লোকটা তাকে কী ভাববে? কুকুর ভয় পায়। যেখানে সেখানে পড়ে যায়। দারোয়ান চাচা তাকে তুলে দাঁড় করিয়েছে। হাঁটতে গিয়ে পায়ের ব্যথাটা চিগবিগিয়ে পা থেকে উপরে উঠে গেল। মীরা অস্ফুটস্বরে কেঁদে ফেলে বলল,
“হাঁটতে পারছি না চাচা। ব্যথা লাগছে।”
জায়িন শান্ত চোখে কান্নারত মীরাকে দেখল। একটু কেঁদেই চোখ ফুলিয়ে লাল করে ফেলেছে। ব্যথা সহ্য করতে ঠোঁট কামড়ে ধরে রেখেছে। জায়িন ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেলল। পরক্ষণেই মীরাকে অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে দিয়ে ওকে পাঁজাকোলা করে শূন্যে তুলে ফেলল। প্রথমটায় মীরা ভয় পেয়ে চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে উঠল,
“ওরে বাবা! পড়ে যাব।”
জায়িন কেমন চোখে যেন তাকে দেখল। মনে মনে হয়তো বকা দিচ্ছে। মীরা জায়িন ভাইয়ের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিলেও ব্যাপারটা কী হচ্ছে বুঝতে পেরে যতটা না বিস্মিত হলো, তার থেকেও বেশি লজ্জায় গুটিয়ে গেল। যে লোক কোনদিনও তার সাথে ভালো করে কথাও বলেনি। আজ কি-না সে সেই লোকের কোলে উঠে বসে আছে। নিতান্তই বাধ্য হয়ে হয়তো কোলে তুলেছে। ডাক্তার মানুষ তো চোখের সামনে তাকে কষ্ট পেতে দেখতে পারছে না। যেকারণেই হোক মীরা তার ষোল বছরের জীবনে এই প্রথম কোন পুরুষের এতটা কাছাকাছি এসেছে। ইচ্ছে না করে হোক তবুও লোকটার স্পর্শে মীরার সর্বশরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। লোকটার হার্টবিট স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। গা থেকে অদ্ভুত সুন্দর একটা ঘ্রান আসছে। কী পারফিউম মেখেছে কে জানে। মীরা লজ্জা, সংকোচ, অস্বস্তিতে শেষ হয়ে যাচ্ছে। শক্ত করে চোখ বন্ধ করে, দম বন্ধ রেখে সময়টা পার করছে। মনে মনে আল্লাহকে বলছে, আল্লাহ এত লজ্জায় আমাকে কেন ফেললে? মুবিন ভাই হলেও না একটা কথা ছিল। কিন্তু মুবিন ভাইয়ের বড় ভাইয়ের কোলে উঠে বসে আছি! ছি ছি। আজকের পর থেকে উনার সামনে মুখ দেখাব কীভাবে আমি? উনার সামনে পড়লেই তো আজকের এই ঘটনা মনে পড়ে যাবে।
এই জীবনে এতটা অস্বস্তির মধ্যে মীরা কোনদিনও পড়েনি। সে না পারছে মুখ ফুটে কিছু বলতে না পারছে চুপ থাকতে। মুবিন ভাইদের ফ্ল্যাট তিনতলায়। লিফট না থাকায় সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয়। মীরা আটার বস্তার মতো মোটা না হলেও বাঁশের মতো চিকনও না। মোটামুটি পর্যায়ে আছে। সঠিক ওজন জানা নেই বিদায় বলতে পারছে না। কালই গিয়ে ওজন মাপবে। লোকটা তাকে নিয়ে এতগুলো সিঁড়ি ভাঙবে? লোকটার উপর তার মায়া হচ্ছে। মীরা সহানুভূতির চোখে লোকটার মুখের দিকে দেখল। কষ্ট হচ্ছে এটা বোঝা যাচ্ছে না। সবে তো মাত্র একতলা উঠল। আরও দোতলা বাকি। মীরা অনেক ভেবেচিন্তে মিনমিনে গলায় বলল,
“আমাকে নামিয়ে দিন ভাইয়া। আমি যেতে পারব।”
লোকটা তার কথা শুনেছে বলে তো মনে হচ্ছে না। কারণ তিনি মীরাকে নামাবে তো দূর চলার গতিও সামান্য কমালো না। দোতলায় উঠে মীরা লক্ষ করলো লোকটার শ্বাসপ্রশ্বাস কিছুটা দ্রুত হয়েছে। সে একা একাই কয়েকটা সিঁড়ি উঠে হাঁপিয়ে যায়। লোকটা তো তাকে নিয়ে উঠছে। হাঁপাবে এটা স্বাভাবিক। তবুও বেটা থামছে না। শক্তি দেখাচ্ছে। দেখাক, মীরার কি? সে তো একবার বলেছেই। তাকে না নামালে সে কি জোর করে নেমে যাবে? সাহায্য করার এত শখ থাকলে করুক। দারোয়ান চাচাও তাদের সাথে আসছিল। ফ্ল্যাটের সামনে এসে জায়িন মীরাকে কোলে নিয়ে কলিংবেল বাজাতে পারল না। দারোয়ান চাচা পেছন থেকে এগিয়ে এসে কলিংবেল চাপল। মীরা আড়চোখে একবার দেখে নিল জায়িন ভাইয়ার কপালের ঘাম দেখা দিয়েছে। আহা বেচারা কত কষ্টই না করল। মুবিন দরজা খুলে দিয়ে ভাইয়ের কোলে মীরাকে দেখে হতভম্ব হয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে রইল। এই দৃশ্য হজম করতে তার সময় লাগছে। মুবিন ভাইয়ের সামনে মীরা তার বড়ো ভাইয়ের কোলে বসে আছে। ভেবেই মীরা লজ্জায় মরে যাচ্ছে। মুবিন ভাই কী ভাববে? হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উঠে মুবিন প্রশ্ন করল,
“কী হয়েছে ভাই? মীরা, কী হয়েছে তোমার?”
মীরা উত্তর দিতে পারল না। সে লজ্জিত মুখে একবার মুবিন ভাইকে দেখে আরেকবার তার ভাইয়ের দিকে তাকাল। বেশি সময় না নিয়ে চোখ নামিয়েও নিল। মুবিন এখনও দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সরে গিয়ে জায়গা দিচ্ছে না। জায়িন ভ্রু কুঁচকে মুবিনকে দেখলে সে নিজের ভুল বুঝতে পেরে সরে দাঁড়াল। জায়িন মীরাকে ড্রয়িংরুমের সোফায় এনে বসিয়ে দিল। মুবিন কিছুই বুঝতে পারছে না। সে আবার জিজ্ঞেস করল,
“কী হয়েছে ভাইয়া? বলবে তো।”
জায়িন মুবিনের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে না করে রুমের দিকে হাঁটা ধরল। ভাই তো মাত্রই বেরিয়েছিল। সে আবার ফিরে এলো কেন? আর মীরাকেই বা পেলো কোথায়? ওকে ওভাবে কোলে করে বাড়িতে এনেছে কেন? একঝাঁক প্রশ্ন নিয়ে মুবিন মীরার সামনে এসে দাঁড়াল। দারোয়ান চাচা ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলছে।
“বুঝছো বাবা, মীরা মা পড়ে গিয়ে নখ উলটে রক্তারক্তি কাণ্ড। জায়িন বাবা না গেলে কি যে হতো! ব্যথা পায়ে হাঁটতে পারছিল না তো।”
জায়িন রুম থেকে ফার্স্টএইড বক্স হাতে নিয়ে ফিরে এসেছে। তাকে দেখে মুবিন সাইড দিয়ে দাঁড়াল। জায়িন মীরার পাশের সোফায় বসেছে। মীরার পা সোফার উপর তুলে হাতে ধরে দেখতে নিলে মীরা এপাশ-ওপাশ মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে উঠল,
“না না। পায়ে হাত দিবেন না।”
চলবে…#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৪
🌸
“না না। পায়ে হাত দিবেন না।”
ওর বাধা পেয়ে জায়িন শান্ত অথচ শাসন মাখানো দৃষ্টিতে তাকাল। লোকটা তার থেকে কত বড়। উনি পায়ে হাত দিলে মীরার পাপ হবে। তার থেকে বড় কথা অস্বস্তি লাগবে। মুবিন বলল,
“পায়ে হাত না দিলে চিকিৎসা কীভাবে করবে মীরা? ব্লিডিং অফ করতে হবে না? ভাইয়াকে দেখতে দাও।”
মীরা আর আপত্তি জানাতে পারল না। জায়িন দক্ষ হাতে ফার্স্টএইড বক্স থেকে জিনিসপত্র বের করে তুলো নিয়ে রক্ত মুছে জায়গাটা পরিষ্কার করে দিচ্ছে। মীরা একটু একটু ব্যথা পেলেও দাঁত কিড়মিড় করে সহ্য করে নিল। কিন্তু কী একটা মলম লাগাতেই অস্যহ রকম জ্বলে উঠল। মীরা অস্ফুটস্বরে ব্যথিত শব্দ করে উঠল। জায়িন মলম লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে মুবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“পানি নিয়ে আয়।”
মুবিন বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল,
“হাত ধুবে?”
জায়িন কঠিন চোখে তাকিয়ে বলল,
“গ্লাস দিয়ে পানি আন।”
মুবিন পানি নিয়ে এলে জায়িন মীরার সাথে একটা ট্যাবলেট ধরিয়ে দিয়ে খেতে বলল। মীরা ভেবে পেল না কিসের ঔষধ এটা। উনি কি পুরোপুরি ডাক্তার? ভুলভাল ঔষধ খেয়ে মরতে চায় না সে। জায়িন হয়তো মীরার মনের কথা বুঝেছে। সে বলল,
“পেইন কিলার। ব্যথা কমে যাবে।”
মীরা নিঃশব্দে পেইন কিলার খেয়ে নিল। জায়িন ঘরে চলে গেছে। মুবিন এসে মীরার পাশে বসল। এতক্ষণেও আন্টির দেখা না পেয়ে মীরা জিজ্ঞেস করল,
“আন্টি কোথায় মুবিন ভাই?”
“মা আজ সকালেই খালামুনির বাসায় গেছে। রাতে চলে আসবে মনে হয়।”
“ওহ।”
“তুমি কি এখন পড়বে?”
“পড়তেই তো এসেছিলাম।”
“আচ্ছা তাহলে অল্প পড়ে যাও। ব্যথা নিয়ে পড়ায় মনোযোগ বসবে না। কিন্তু সামনে পরীক্ষা। আজ বরং এখানেই পড়ি আমরা কেমন?”
“হুম।”
মীরা ব্যাগ খুলে বইপত্র বের করল। পড়ার ফাঁকেও তার চোখ অনেক বারই জায়িনের রুমের দিকে চলে গেছে। লোকটা যে সেই কখন রুমে ঢুকেছে। একবার বাইরে আসবে তো দূর একটু শব্দও পাওয়া যাচ্ছে না। যেন বাসায় তৃতীয় কোন ব্যক্তি নেই। এমন নিঃশব্দে কীভাবে থাকে মানুষ? মীরা বাড়িতে থাকলে হৈচৈ করে বাড়ি মাথায় তুলে রাখে। পড়ার ফাঁকে মীরা জিজ্ঞেস করল,
“মুবিন ভাই, উনি কিসের ডাক্তার?”
মুবিন বই থেকে চোখ তুলে হেসে বলল,
“এখনও ডাক্তার হয়নি। পড়ছে। আরও এক বছর লাগবে।”
“ওহ।” মীরা মনে মনে ভাবল ডাক্তার না হয়েই এত ভালো চিকিৎসা করেছে। ডাক্তারি ডিগ্রী নিয়ে বেরুলে একটা রোগীকেও অসুস্থ থাকতে দিবে না।
মীরার পড়া শেষ। আজ অল্পই পড়েছে। পায়ের ব্যথা টের পাওয়া যাচ্ছে না তবুও মুবিন বলল,
“তুমি একা যেতে পারবে না। আমি বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসি।”
মীরা আর না করলো না। মুবিন ভাইয়ের উপর তার দুর্বলতা আছে। মানুষটাকে দেখলেই কেমন ভালোলাগা কাজ করে।
“তুমি বসো। আমি রুম থেকে বাইকের চাবি নিয়ে আসি।”
মুবিন মীরাকে নিয়ে বেরুবার আগে ভাইকে ডেকে বলল,
“ভাইয়া আমি মীরাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। তুমি দরজা লাগিয়ে নিও।”
সিঁড়ি ভেঙে নামবার সময় মুবিন মীরার হাত ধরে নামতে সাহায্য করলো। মুবিন ভাই জাস্ট তার হাতটা ধরেছে। এতেই মীরার মনের বাগানে লাল নীল প্রজাপতিরা পাখা ঝাপটিয়ে উড়াউড়ি করতে শুরু করে দিল। ওরা গেটের কাছে এসে দেখল আগে থেকেই একটা রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। মুবিন দারোয়ান চাচাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন,
“জায়িন বাবাই তো বললো মীরা বাড়ি যাবার সময় যেন রিকশা ডেকে দিই। পায়ে ব্যথা নিয়া ও তো হাঁটতে পারব না।”
রিকশা অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এখন তাড়িয়েও দেওয়া যাবে না। মুবিন মীরাকে বলল,
“তুমি রিকশায় উঠে যাও। আমি নাহয় বাইকে পেছনে আসছি।”
মীরা কতকিছু ভেবে বসেছিল। বাইকে মুবিন ভাইয়ের পেছনে বসে যাবে। আহা, তার সব স্বপ্নে ওই লোকটায় এক বালতি ঠান্ডা পানি ফেলে দিল। কে বলেছিল উনাকে মীরার জন্য এতো চিন্তা করতে? মীরা রিকশায় উঠে পড়ল। মুবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনাকে কষ্ট করে আসতে হবে না ভাইয়া। রিকশা তো আমাদের গেটের সামনেই যাবে।”
“তুমি যেতে পারবে?”
“হুম।”
“শিওর?”
“হ্যাঁ।”
রিকশায় বসেও মীরা ওই লোকটার উদ্দেশ্যে কতক্ষণ গালাগালি করতে লাগল। এমন একটা রাক্ষস বড় ভাই থাকলে মুবিন ভাইয়ের এই জন্মে প্রেম করা হয়েছে! মীরা বাড়ির সামনে নেমে ভাড়া দিতে চাইলে রিকশা ওয়ালা বলল ভাড়া নাকি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কে দিয়েছে জিজ্ঞেস করতে লোকটা জায়িনের কথা বলল। মীরার রাগ হলো। একদিনে এত সাহায্য নেওয়া যাচ্ছে না। লোকটা তার রিকশা ভাড়া দিতে গেল কোন দুঃখে?
“টাকা বেশি হয়েছে। সমস্যা নেই। আপনার দাবি আমি রাখব না। সব দাবি চুকিয়ে দেব।”
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মীরা সদরদরজায় পা রাখতেই রুমশি ছুটে এসে মীরার উপর আক্রমণ চালালো। মীরা প্রাইভেট পড়ে আসার সময় প্রতিদিন রুশমির জন্য চকলেট নিয়ে আসে। আজও চকলেটের লোভে রুমশি আপুকে জড়িয়ে ধরল। ওরা চলে এসেছে মীরা জানত না। প্রাইভেটে যাওয়ার আগেও দেখে গেছে এখনও আসেনি।
রুমশি তোতলা তোতলা কন্ঠে বলল,
“আপু আমাল চকলেত। চকলেত এনেচ?”
মীরা ঝুঁকে রুমশিকে কোলে নিয়ে গালে চুমু খেয়ে বলল,
“তোরা চলে এসেছিস এটা তো আমি জানতাম না বোনু। সরি।”
রুশমি মন খারাপ করে বলল,
“চকলেত আনোনি?”
“কাল এনে দিব প্রমিজ।”
রুমশিকে কোলে নিয়ে হাঁটতে গিয়ে পায়ের ব্যথাটা টের পেলো। মীরা পায়ে ব্যথা পেয়েছে এই কথাটা সন্ধ্যায় জানাজানি হলো। পুরো দুইটা দিন পর আজ তার রুমে আড্ডা বসেছে। আবির ভাই এত এত খাবার নিয়ে এসেছে। আজ লেট নাইট মুভি দেখা হবে। আবির ভাই ভুল করে মীরার পায়ের উপর বসে পড়েছিল। মীরা ব্যথার ককিয়ে উঠলে আবির ভাই দেখতে পেল। সাথে সাথে চিৎকার চেঁচামেচি করে সবাইকে জানিয়ে দিল। ছোট চাচী, বড় মা এসে মীরাকে বকাবকি করে গেল। কেন ওদের জানাল না। মীরা শত বলেও কাউকে বোঝাতে পারল না।
“আমার কিছু হয়নি। সত্যি বলছি। এখন আর ব্যথা নেই।”
আবির জায়িনকে চেনে। ওরা এক সাথেই পড়েছে। এখনও বন্ধু। আবির গর্ব করে বলল,
“আমার বন্ধু চিকিৎসা করেছে ব্যথা থাকবে কীভাবে বল। দেখতে হবে না বন্ধুটা কার।”
তনি মুখ ভেঙচি দিয়ে বলেছে,
“এত বন্ধুর প্রশংসা করতে হবে না। নিজে তো ডাক্তার হতে পারলে না।”
“সবাই ডাক্তার হলে আর্মি কে হবে বল? তোর বাপের তো আবার আর্মি ছেলে পছন্দ।”
মীরা সব জেনেও কিছুই না জানার ভান করে ওদের সামনে গাধা সেজে রইল। আড়ালে মুখ টিপে হাসল। ওহ তাহলে এই ব্যাপার! চাচ্চু আর্মি ছেলে পছন্দ করে বলেই আবির ভাই তার বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে আর্মি হতে চাচ্ছে! আহা হা, কী ভালোবাসা দেখেছ! প্রেমিকার জন্য সব করতে রাজি। মাহি গাধীকে কালই এই কথাটা জানাতে হবে। আজ আর পড়া হলো না। সবাই ইভান ভাইয়ের অপেক্ষায় ছিল। ইভান ভাই বাড়ি ফিরেই মুভি ছেড়ে বসল। আজকে হরর মুভি দেখবে সবাই। মীরা শুরুর দিকে ভয় পেয়ে পেয়ে একটু দেখলেও যখন ভূতটা সামনে এলো তখন আর চোখ খোলা রাখতে পারল না। রুমশি ভয়ে কাঁদতে লাগলে ওকে চাচীর কাছে দিয়ে আসা হলো। মীরা তনি আপুকে খামচে ধরে কতক্ষণ পর্দার দিকে তাকিয়ে মুভি চলাকালীনই ঘুমিয়ে পড়ল। মুভি শেষ করে ওরা কখন ওর রুম থেকে গেল বলতেই পারল না।
🌸
মাহিমা মীরাকে নিতে এসে শুনলো মীরা পায়ে ব্যথা পেয়েছে। সে বিরক্তি নিয়ে মীরার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ল্যাংড়া লুলার মতো যেখানে সেখানে পড়ে যাস কেন? আমার মামারা যে এত খাওয়ায় ওসব যায় কই শুনি?”
পরীক্ষার জন্য মাহিমা এতদিন তাদের বাড়ি আসেনি। তার একটা রোগ আছে। মামার বাড়ি এলে আর যেতে মন চায় না। তাই পরীক্ষা শেষ করে একেবারে চলে আসবে। দুই মামীই মাহিমাকে পছন্দ করে। সে মীরার উদ্দেশ্যে বকবক করেই যাচ্ছে। বড় মামী এসে বলল,
“কইতরি এতদিন কই ছিল? মামা মামীদের ভুলে গিয়েছিল নাকি?”
“ইচ্ছে করে ভুলিনি গো মামী। পরীক্ষা ভুলিয়ে দিয়েছে।”
“বাবাহ! মেয়ে পড়ায় ভীষণ মনোযোগ দিয়েছে বোঝা যাচ্ছে।”
“ভালো রেজাল্ট দিয়ে তোমাদের মুখ উজ্জ্বল করতে হবে তো। আজকাল ফেয়ার এন্ড লাভলী ব্যবহার করে মুখ উজ্জ্বল হয় না।”
মাহিমার কথা শুনে মীরা খিলখিলিয়ে হাসতে লাগল। বড় মামী খাবার নিয়ে এসেছে। মাহিমা তাড়াতাড়ি করে বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছে। কিন্তু মামী এখন তাকে না খাইয়ে ছাড়বে না। এটাও খুব ভালো করে জানে। মাহিমা, মীরা একসাথে খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। গেটের সামনে থেকে রিকশায় উঠে মাহিমা জিজ্ঞেস করল,
“ব্যথা পেয়েছিস কীভাবে?”
“প্রাইভেট পড়তে গিয়ে। শোন না। তুই কি একটা কথা জানিস?”
“কোন কথাটা বল তো?”
“আবির ভাইয়া চাচ্চুকে খুশি করতে আর্মি জব নিতে চাচ্ছে।”
“এটা আর নতুন কি? হবু শ্বশুরের পেয়ারের জামাই বাবাজী।”
ওরা রিকশা দিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তার পাশের একটা দোকানে মুবিন ভাইকে দেখতে পেল। মুবিন ভাইও মনে হয় ওদেরকে দেখেছে। মাহিমা মুবিন ভাইকে দেখে সন্দেহের চোখে মীরার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“মুবিন ভাই আর তোর মধ্যে কি কিছু চলছে মীরা?”
চলবে_