#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৫১
রাতে মীরা ডাইনিংয়ে জগ থেকে পানি ঢেলে গ্লাসটা মাত্র মুখের কাছে এনেছে। এখনও গলা জেভায়নি। তার আগেই তনির বিকট ডাকে হাত থেকে কাচের গ্লাসটা নিচে পড়ে ভেঙে অনেকগুলো টুকরোয় পুরো ফ্লোরে ছড়িয়ে পড়লো। মীরা কোমরে হাত চেপে রাগী চোখে তনির দিকে তাকাল। তনি মীরার রাগ পাত্তা না দিয়ে বলতে লাগল,
“তোরা দুইটা কবে মানুষ হবি বল তো? টম এন্ড জেরির মতো লেগেই থাকতে হয়! একটুও শান্তি দিবি না?”
“আমি কী করেছি আপু? তোমার জন্য গ্লাস ভেঙে এখন আমি বকা খাব। তার উপর তুমিও বকছো?”
” তোরা আবার কী নিয়ে লেগেছিস হ্যাঁ? কোন সম্পত্তির ভাগ নিয়ে এভাবে লাগিস দুইটা।”
“পাগলের মতো কী সব উল্টাপাল্টা বলছো বলো তো?”
“আমি পাগল! মাহিমার সাথে আবার কী নিয়ে লেগেছিস?”
“আমি লেগেছি! কখন, কোন সময়? আমি লাগিনি তো।”
“তোদের ঝগড়া হয়নি?”
“আরে বাবা ঝগড়া কেন হবে? কী আজব! কইতরি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।”
তনি ব্যাঙ্গ করে বলল,
“তোমার বেস্ট ফ্রেন্ডই বলেছে তুমি ওর সাথে ঝগড়া করে কথা বলছো না। তাই সে কেঁদেকেটে বাড়িঘর ভাসিয়ে ফেলছে। ফুপু মাত্রই আমাকে বলেছে, তোকে বুঝিয়ে যেন মাহিমার সাথে ভাব করিয়ে দিই।”
মীরা আকাশ থেকে পড়ল। তাদের কখন ঝগড়া হলো? বাস্তবে তো হয়নি। স্বপ্নে হয়েছে নাকি? তনি বকরবকর করেই যাচ্ছে। মীরা গ্লাস ভেঙে ফেলেছে দেখে বড়মা এসেও বকাবকি করছে। মীরার হয়েছে সব জ্বালা। যেদিকে যাবে সেদিকেই বকা খাওয়া কপাল। মীরা ঘরে গিয়েই মাহি মীরজাফরনীটাকে কল করল। রেগেমেগে আগুন হয়ে বলল,
“কোন জন্মের শত্রুতা মেটাতে ফুপুর কাছে আমার নামে বানিয়ে বলে ওরকম একটা কেস খাওয়ালি? তোর সাথে কবে আমি ঝগড়া করেছি রে জঘন্য মেয়ে।”
মাহিমা নাক টানতে টানতে উত্তর দিল,
“তখন মুবিন ভাইয়ের কথা মনে পড়ে ভীষণ কান্না পাচ্ছিল। কিছুতেই কান্না আটকাতে পারছিলাম না। শুধু শুধু তো কেউ কাঁদে না। মা এসে হাজারটা প্রশ্ন করছিল কেন কাঁদছি। আমি কি মা’কে সত্যিটা বলতে পারতাম? তাই এই মিথ্যাটা বলেছি।”
“বাহ ভাই বাহ! তোমরা সবাই আমার কাঁধে রেখেই বন্দুক চালাও। বাড়িতে কিছু হলেই মীরার দোষ। এখন তুইও পুষ্টিকর সব কেস খাওয়াচ্ছিস। আমি কী করব? পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব?”
“রাগ করিস না প্লিজ। তুই ছাড়া আমার তো আর কেউ নেই। কার কথা বলবো বল।”
“নাটক। এসব ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের নাটক আমার সাথে চলবে না। তোর রিলেশনের ঘটকালি আমি করেছি তো! আমিই তোর ব্রেকআপ করাব। কীভাবে তোরা ব্রেকআপ না করে থাকিস সেটা দেখব শুধু।”
“মীরা তুই দেখছিস আমি কাঁদছি। তবুও তুই এসব কথা বলছিস! কোথায় আমাকে একটু সান্ত্বনা দিবি।”
“সান্ত্বনা না৷ তোকে চটকানা দেওয়া উচিত। বজ্জাত মেয়ে।”
“মুবিন ভাই কোথায় আছে, কী করছে আমি তো কিছুই জানি না। টেনশন হবে না বল?”
“এই, মুবিন ভাই কি কচি খোকা? বেডা মানুষ সে। রাতে একা রাস্তায় শুয়ে থাকলেও কোন সমস্যা হবে না। তুই এমন করছিস যেন তোর বয়ফ্রেন্ড হাইস্কুলের নিব্বা।”
“তুই নিজে তো কাউকে ভালোবাসিস নি। তাই বুঝবি না, আমার কতটা কষ্ট হচ্ছে।”
“কে বলেছে আমি কাউকে ভালোবাসিনি? আমার সে না তোর মুবিন ভাইয়ের মতো গাধা না। আর আমার ভালোবাসাও তোর মতো ন্যাকা না। ফোন রাখ খবিশ। আর জীবনে আমার সাথে কথা বলবি না।”
….
“তুমিও বসে পড়ো। দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
“তুমি খাচ্ছ খাও। আমার খিদে পেলে খাব। আমার চিন্তা তো তোমাকে করতে হবে না। তুমি পেট ভরে খাও।”
জামান হোসেনের কথার উত্তরে সুমনা ত্যাড়া জবাব দিলে জামান হোসেন আর কথা বাড়ালেন না। প্লেটের ভাত শেষ করে উঠে পড়লেন। জায়িন নিশ্চুপ থেকে একবার শুধু বাবাকে উঠে যেতে দেখল। মাকেও সে কিছু বলল না। এখন এরকমই হবে। অন্তত যতদিন না মুবিন বাড়ি ফিরে আসছে ততদিন মা কারোর সাথেই ভালো করে কথা বলবে না। আজকের খাবারে লবণ কম হয়েছে। জায়িন সেই কথাটাও মা’কে বলার সাহস পেল না। চুপচাপ খেয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। মুবিনের ফোন জায়িনের ঘরেই ছিল৷ মুবিন তার এক ফ্রেন্ডের ফোন থেকে কল করেছে। জায়িন জিজ্ঞেস করল,
“কোথায় আছিস তুই এখন?”
“বন্ধুর ফ্ল্যাটে উঠেছি। ওর রুমমেট কয়েদিদের জন্য বাড়িতে গেছে। ও ফিরে আসতে আসতে আমি একটা ব্যবস্থা করে নিব। ওদিকের আবহাওয়া এখন কেমন?”
“আবহাওয়া কেমন হতে পারে এটা তোর অজানা না। মায়ের আদরের ছেলে। তোর জন্য মা আমাদের জীবন নুন ছাড়া তরকারি করে রেখেছে।”
মুবিন হাসলো। যাক ভাইয়ার কথা শুনে মনে হচ্ছে না ভাইয়াও তার উপর রেগে আছে। আসার সময় রাগের মাথায় একটু বেশিই বলে ফেলেছে। তবে কথাগুলো তো মিথ্যা না।
“ইয়ে ভাইয়া আমার ফোন কি তোমার কাছেই ছিল?”
“আমার ঘরেই ছিল।”
“আব্বু নিয়ে যায়নি!”
“নিজের বাপকে তুই কী ভাবিস বল তো।”
“হিটলার। যাকগে সেসব কথা। কাল তুমি বাজারের দিকে এলে আমার ফোনটা একটু নিয়ে এসো।”
“তুই নিজে এসে নিয়ে যা।”
“আমি আর কোনদিন ওই বাড়িতে যাব না। ”
“তাহলে আমিও পারব না।”
“ভাইয়া তুমি আমার সাথে এমন করছো! তুমি না আমার ভাই। ”
“আমিও তো সেটাই জানতাম। তাছাড়া তুই বাবার বাড়িতে থাকবি না। তাহলে বাবার ফোন চালাবি কেন?”
“ফোন চালাব না। কিন্তু ফোনের ভেতর সিমটা তো আমার।”
“ছেলেমানুষী বাদ দিয়ে কাল বাড়ি ফিরে আয়। মা কান্নাকাটি করছে।”
“আমি আর ওবাড়ি ফিরব না। তুমি আম্মুকে বলে দিও।”
মুবিনটা তো ভালোই বেঁকে বসেছে। মুবিন এরকম করলে মা প্রতিদিনই তাদের লবণ ছাড়া তরকারি খাওয়াবে। মুবিন কথায় কথায় আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করল,
“আমার ফোনে কেউ কল করছে ভাইয়া?”
জায়িন এবার ভাইয়ের আসল উদ্দেশ্য ধরতে পারল। এই কথাটা জানার জন্য এত বনিতা! তারপরও জায়িন বলল,
“তোর ছাত্রীর আটত্রিশটা মিসড কল।”
“মীরা তো ওরকমই, পাগলি!”
জায়িন দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে বলল,
“ভাবীকে পাগল ডাকছিস? মীরা তোর ভাবী বুঝেছিস গাধা। ভাবীর সাথে যদি তোর কিছু-মিছু বের হয় রে মুবিন! আমি তোকে এমন মার মারব। বাংলাদেশের কোন ডাক্তারও তোর হাড়গোড় জোড়া লাগাতে পারবে না।”
“আর কেউ কল দেয়নি?”
“ভীতু নামের কেউ একজনও অনেকবার কল করেছে।”
মুবিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক এই যাত্রায় বাঁচা গেল। মাহিমার নাম্বার সে ভীতু দিয়ে সেভ করেছিল। কারণ মাহিমা অলওয়েজ ওদের সম্পর্কের ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় পায়।
প্রথম দিনে ‘বউ’ দিয়ে সেভ করা ছিল। ওইটা এখনও থাকলে আজ বড়ো ভাইয়ের সামনে মুখ দেখানোর জো থাকত না।
ফোন বাড়িতে রেখে আসায় মুবিন মাহিমার সাথে কথা বলতে পারেনি। কিন্তু সে মাহিমাকে দেখার জন্য মাহিমাদের বাসার নিচে গিয়েছিল। গিয়েও অবশ্য লাভ হয়নি। দীর্ঘ দুই ঘন্টা অপেক্ষা করেও মাহিমার দেখা পায়নি।
মুবিন কল কেটে দিলে জায়িন চিন্তিত মুখে ঘরজুড়ে পায়চারি করতে লাগল। সে কি মীরাকে মনের কথা জানাতে দেরি করে ফেলেছে? এতদিনে কি মুবিনের মনেও মীরার জন্য কোনকিছু তৈরি হয়েছে? কিন্তু মীরা তো তাকে পছন্দ করে। সে প্রমাণও পেয়েছে?
“নাকি আমার মনের ভুল। মীরা আমাকে না বরং মুবিনকেই পছন্দ করে! না না না। অসম্ভব।”
জায়িন চিল্লিয়ে উঠল। এরকমটা হলে বেচারার পৃথিবী ছাড়তে হবে। কারণ মীরাকে সে কোনদিনও ছোট ভাইয়ের প্রেমিকা রুপে দেখতে পারবে না।
“মুবিনের বাচ্চারে! তোরেই আমি দুনিয়া থেকে পাঠিয়ে দিব। ভাবীর সাথে কী চালাচ্ছিস হ্যাঁ? আমার তো এখন মনে হচ্ছে, মীরার মনের কথা জানার অপেক্ষায় নিজের মনে কথা না জানিয়ে আমি ভুল করে ফেলেছি। মুবিনটা সব কাজেই এত ফাস্ট কেন? আমার আগে মীরাকে প্রপোজ করে ফেলবে না তো? ওরে ভাই, কেন নিজের ভাইয়ের সুখে হাত দিচ্ছিস!”
…
মাহিমার বাবার চাচাতো ভাই স্ট্রোক করেছে। ওরা রাতেই গাজীপুর গিয়েছে। মীরার আজ একাই কলেজ যেতে হয়েছে। ওদিকে মুবিন মাহিমাকে দেখার জন্য কলেজের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনেকেই নানান প্রশ্ন করছে। মানুষের এত আগ্রহ দেখে মুবিন বিরক্ত হয়ে বলল,
“ভালোই মুসিবত হয়েছে দেখা যাচ্ছে! একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েই এত প্যারা। সেলিব্রিটিরা কেমনে জীবনযাপন করে! বিরক্ত হয়না এরা?”
মীরা মুবিনকে দেখে উচ্ছ্বাসিত হয়ে ছুটে এসেছে। মুবিনের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল,
“আরে সেলিব্রিটি মানুষ নাকি? আপনি তো এখন স্টার! দিনেদুপুরে স্টার মানুষ মাটিতে নেমে এলেন কেন?”
“তুমিও মজা নিচ্ছ?”
“মজা নিব! কী যে বলেন, এখন কি আর আমাদের সেই সম্পর্ক আছে?”
“আরে বাবা, তুমি কিছুই জানো না মীরা। সেজন্য রাগ করছো।”
“আমি সব জানি। কাল রাতে কোথায় থেকেছেন? আপনার কইতরি চিন্তায় চিন্তায় মরে যাচ্ছিল। যাচ্ছিল কি? অর্ধেক গেছে।”
“তুমি জানো, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি?”
“হ্যাঁ।”
“কিকরে?”
“ম্যাজিক।”
“আচ্ছা, মাহিমা কলেজে আসেনি?”
“ওরা গাজীপুর গেছে।”
“কেন?”
“ওর চাচার স্ট্রোক হয়েছে। অবস্থা খারাপ। দেখতে গেছে।”
“ওর তো কোন চাচা ছিল না।”
“সব জেনে বসে আসেন! আপন চাচা না। ফুপার চাচাতো ভাই।”
“কবে ফিরবে?”
“আজই। আজ না ফিরলে কাল।”
মুবিনের মন খারাপ হয়ে গেল। আরও একটা দিন মাহিমাকে না দেখে থাকতে হবে? মাহিমাকে দেখলে হাজার প্যারার মাঝেও অদ্ভুত একটা শান্তি পাওয়া যায়।
“মীরা, আমার ফোনটাও আমার কাছে নেই। কাল অনেকক্ষণ মাহিমাদের বাসার নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু ও ব্যালকনিতে আসেনি। আজ ফোনেও যোগাযোগ করতে পারছি না। তুমি আমার একটা হেল্প করবে?”
“শুধু হেল্প করার বেলায় মীরা! গিফট, চকলেট পাওয়ার বেলায় অন্য কেউ? তবুও হেল্প করব। আমার মনটা অন্নেক বড়ো। বলুন।”
“মাহিমা ফেরার সাথে সাথে আমার সাথে ওর দেখা করাতে পারবে?”
“এ আর এমন কি কাজ! কিন্তু আপনি উঠেছেন কোথায়?”
“আপাতত এক ফ্রেন্ডের কাছে আছি। কাল পরশু শিফট করব। তুমি আমার ফ্রেন্ডের নাম্বারটা রাখো।”
“দিন।”
চলবে#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৫২
মীরা আন্টিকে দেখতে জায়িনদের বাড়ি এসেছে। ইভার কাছে শুনেছে মুবিনের বাড়ি ছাড়া নিয়ে আন্টি কান্নাকাটি করে। মীরা আন্টিকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য এসেছে। তার আরও একটা উদ্দেশ্য আছে অবশ্য। জায়িনকে দেখা। কিন্তু এখানে এসে দেখল জায়িন বাড়ি নেই। মীরার মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। একটা গাধা লোকের প্রেমে পড়েছে। তার মনের কথা বুঝবে তো দূর উল্টো দেখাও দিচ্ছে না।
“আমার ভালোবাসার গল্প যেভাবে কচ্ছপের গতিতে এগোচ্ছে এরকম চলতে থাকলে মাথার চুল কয়েক গাছি পেকে যাবে।”
“মীরা তুই বোস। এসেছিস ভালো করেছিস। এই বাড়িটাতে একা একা আমার দম বন্ধ লাগে।”
মীরা বসে বসে চিন্তিত মুখে জায়িনকে নিয়ে ভাবছিল। আন্টির কথায় উত্তর দিল,
“তুমি ব্যস্ত হইয়ো না আন্টি। আজ অনেকক্ষণ থাকব।”
জায়িনের ঘরের দিকে উঁকি দিয়ে মনে মনে বলল,
“অন্তত তোমার ছেলেকে না দেখে ফিরছি না। গাধা একটা ছেলে পয়দা করেছ আন্টি। মেয়েদের মনের কথা কিচ্ছু বুঝে না। এইযে আমি উনার সামনে এত ঘুরঘুর করি। উনি কি আমার দিকে একটু নজর দিতে পারেন না? কিন্তু উনি তা করবেন না। চোখে সমস্যা আছে কী না!”
“কিছু খাবি তুই?”
“আচার টাচার কিছু আছে? থাকলে দাও একটু।”
সুমনা বাটিতে আচার নিয়ে এসে মীরার সামনে বসলো। মেয়েটাকে দেখলে তার মনে শান্তি লাগে। মাঝে মাঝে মন চায় মীরাকে যদি একেবারের জন্য নিজের কাছে এনে রাখা যেত। মীরা আঙ্গুলের ডগায় নিয়ে একটু আচার মুখে দিয়ে জিহবা দিয়ে টাস করে শব্দ করল।
“ইয়াম্মি!”
“বাড়িতে জানিয়ে এসেছিস?”
মীরা আচার খেতে খেতে পাল্টা প্রশ্ন করল,
“না জানিয়ে এলে আমাকে আসতে দিত?”
সুমনা মেয়েটাকে দেখতে দেখতে মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মীরার কোন বাধা নেই। ও যা করতে চায় সবই করতে দেওয়া হয়। ওই বাড়ির মানুষ গুলোই অন্যরকম।
“মুবিন যে বাড়ি থেকে চলে গেছে জানিস?”
“হ্যাঁ। মুবিন ভাই চলে আসবে। তুমি টেনশন করো না তো।”
“আসবে না রে।”
“আসবে। আমাকে বলেছে।”
সুমনা নড়েচড়ে বসে জিজ্ঞেস করল,
“তোকে বলেছে! কখন?”
“কলেজ থেকে ফেরার সময় দেখা হয়েছিল। আমি পড়তে এলে মুবিন ভাইকে পাব না ওটাই বলেছে। তখন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি কবে বাড়ি ফিরবেন? বলেছে, ফিরব কয়েকদিন পর।”
“ওটা তো কথার কথা বলেছে।”
সুমনা উঠে দাঁড়াল। ছেলেটার সাথে কথা হয়েছে তার। তবুও তো মা’র মন। বাইরে কোথায় কী খাচ্ছে কে জানে। বন্ধু কি আর মায়ের মতো খেয়াল রাখবে? মীরা সুমনার দিকে তাকিয়ে বলল,
“কোথায় যাও?”
“বোস তুই। আমার হাতে কাজ আছে।”
“আমিও সাহায্য করি।”
“তুই কী সাহায্য করবি! তুই বরং আচার খা।”
সুমনা জায়িনের ঘরের দিকে যাচ্ছে দেখে মীরা কীভাবে এখানে বসে থাকতে পারে! জায়িন ভাইয়ের ঘর দেখার এই সুযোগ কোনভাবেই হাতছাড়া করবে না। মীরা হুড়মুড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
“আচ্ছা। তুমি কাজ করবে আমি বরং গল্প করব।”
“ঠিক আছে আয়।”
মীরা এই বাড়িতে আসছে এসএসসি পরীক্ষার একমাস আগে থেকে। এর মাঝে এই ঘরে মাত্র একবার আসা হয়েছে। সেটাও ওইযে সেদিন রাতে ছাদে আড্ডা দেওয়ার সময় মুবিন ভাইয়ের গিটার নিতে এসেছিল। তখন জায়িনের পেছন পেছন অল্প কিছু সময়ের জন্য এই ঘরে আসা হয়েছিল। কিন্তু কিছুই দেখা হয়নি। আজ জায়িন ভাই বাড়িতে নেই। তার ঘরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার এটাই সুযোগ। সুমনা বিছানার উপর রাখা শার্ট প্যান্ট গুলো ভাঁজ করে রাখছে। মীরা আচারের বাটি হাতে নিয়ে চারপাশে ঘুরে ঘুরে ঘরটা দেখছে। মনে মনে ভাবছে,
“ভালো করে দেখে নে মীরা। ভবিষ্যতে এই ঘরেই তোকে থাকতে হবে। তোর নিজের রুমের থেকে এই ঘরটা একটু ছোট। তবে তোর বরের মনটা বড়ো হলেই হবে। বড়ো ঘর তো বিলাসিতা মাত্র। আমি তো বরের মনেই রাজত্ব করব।”
সুমনা কাপড় গোছাতে গোছাতেই জামান হোসেন নিজের ঘর থেকে তাকে ডাকছেন। কিন্তু সুমনা স্বামীর কথা শুনেও না শোনার ভান করে হাতের কাজ করে যাচ্ছে। মীরা আন্টির দিকে দেখল। আঙ্কেল ডাকছে। সে শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু আন্টিকে দেখে মনে হচ্ছে না আন্টি শুনতে পাচ্ছে।
“ও আন্টি, আঙ্কেল তোমাকে ডাকছে তো।”
“ডাকুক।”
ডাকুক! এটা আবার কেমন কথা! মীরা চালাক হওয়ায় বুঝে গেল স্বামী স্ত্রীর মাঝে মান অভিমান চলছে।
“সুমনা ডাকছি। দেখে যাও।”
সুমনা এখনও পাত্তা দিচ্ছে না। মীরা বেচারা আঙ্কেলের হয়ে বলল,
“আঙ্কেল ডাকছে। যাও না। দাও আমি তোমার কাজ করে দিই।”
“তোকে করতে হবে না।”
“হবে। দাও আমাকে। তুমি গিয়ে দেখে এসো আঙ্কেল কেন ডাকছে।”
সুমনা চলে গেলে মীরা জায়িনের একটা শার্ট হাতে নিয়ে সামনে মেলে ধরল। লজ্জা পাওয়া ভঙ্গি করে বলল,
“ইশ! মনে হচ্ছে শার্ট না, মানুষটাকেই ধরে রেখেছি।”
মীরা দুই হাতে শার্টটা ধরে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ঘরজুড়ে নেচে বেড়াচ্ছে। সুমনা ঘরে এসেও স্বামীর সাথে কথা বলছে না। জামান হোসেন কোথাও বেরুচ্ছেন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাই বাঁধতে বাঁধতে বললেন,
“তোমাকে যে টাকাগুলো রাখতে দিয়েছিলাম বের করো তো।”
সুমনা বিনা বাক্যে টাকার প্যাকেটটা বের করে বেডের উপর রাখল। টাই বাঁধা শেষে জামান হোসেন ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন,
“এখন তো তোমার ছেলে এবাড়িতে থাকছে না । তারপরও মেয়েটা আজ কেন এসেছে?”
সুমনার চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো। ঝাঁঝাল গলায় বলল,
“কী ধরনের কথা বলছো তুমি এটা!”
“তুমি খুব ভালো করেই জানো, এই মেয়েটার আমার বাড়িতে আসা আমি একদম পছন্দ করি না।”
“তুমি পছন্দ না করো। তোমার পছন্দ দিয়েই তো সবকিছু হবে না।”
“আমার বাড়িতে আমার পছন্দই সবকিছু হবে।”
কথাটা শুনে সুমনা স্থির থাকতে পারল না। উত্তেজিত গলায় বলল,
“তুমি কি চাও আমিও তোমার বাড়ি থেকে চলে যাই? আমি চলে গেলে তুমি বাড়ি নিয়ে থেকো। মানুষের কি বাড়িঘর থাকে না? কোন মানুষটা সারাক্ষণ তোমার মতো আমার বাড়ি আমার বাড়ি করে? শেষ কালে না তোমাকে বাড়ি নিয়েই থাকতে হয়।”
আন্টিই বেশি গুলো ভাঁজ করে রেখে গিয়েছিল। রঙঢঙ শেষ করে মীরা বাকি জামাকাপড় গুলো গুছিয়ে আলমারিতে রাখতে গেল। মীরা এখন থেকেই সবকিছুর উপর এমনভাবে অধিকার দেখাচ্ছে যেন এটা তার নিজেরই ঘর। কাপড় রাখার সময় একটা জিনিস মীরার চোখে পড়ল। জায়িনের সেই সাদা শার্টটা। যেটাতে সে ভুল করে মেহেদি লাগিয়ে দিয়েছিল।
“জায়িন ভাই কি শার্টটা ধুতে দেয়নি? টিউব মেহেদি তো উঠে যাওয়ার কথা। কিন্তু এটা তো এখনও সেদিনের মতোই আছে।”
মীরা ভীষন অবাক হলো। মনে হচ্ছে শার্টটা সবার চোখের আড়ালে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। নইলে আন্টির চোখে পড়লে কি ধুয়ে দিত না? মীরা শার্টটা বের করতে গিয়ে ওটার ভেতর থেকে আরেকটা জিনিস বেরিয়ে এলো। জিনিসটা ঝুমুর শব্দ করে নিচে পড়লে মীরা দুপা পিছিয়ে গিয়ে পায়ের দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল।
“জায়িন ভাইয়ের কাছে মেয়েদের নূপুর! সেটাও শার্টের ভেতর লুকিয়ে রাখা!”
মীরা ঝুঁকে নূপুরটা তুললো। এবং ওটাকে চোখের সামনে ধরে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। এটা তার সেই নূপুর যা ইভান ভাইয়ের বিয়ের দিন হারিয়ে ফেলেছিল। অবিশ্বাস্যে মীরার চোখ বড়ো হয়ে গেল। বিস্ময়ে মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না।
“এ-এটা তো আমার নূপুর! আমার হারিয়ে যাওয়া নূপুর জায়িন ভাইয়ের কাছে কী করে এলো? উনি এটাকে নিজের কাছে কেন রেখেছেন?”
মীরা প্রথমটায় কিছু বুঝতে না পারলেও আস্তে আস্তে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নিল। ভাবনাটা মনে আসতেই খুশিতে চিৎকার করতে গিয়ে মুখে হাত চেপে ধরে ফেলল। মীরা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে চিংড়ি মাছের মতো লাফাচ্ছে।
“আমার নূপুর! আমার মেহেদি লাগিয়ে দেওয়া শার্ট। জায়িন ভাই নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন? কেন? কারণ উনি এগুলো আমার স্মৃতি হিসেবে রাখতে চেয়েছেন। তার মানে, উনি আমাকে.. উনি আমাকে পছন্দ করেন! এজন্যই উনার আচরণে এতটা পরিবর্তন এসেছে। হায় এটা সত্যি হলে এখন আমি কী করব? আমার তো খুশিতে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। মনে মনে আমি যাকে ভালোবাসি, সে-ও আমাকে পছন্দ করে! পছন্দ করেন তাহলে এতদিন বলেননি কেন?”
বাইরে কারো শব্দ পেয়ে মীরা তাড়াহুড়ো করে নূপুরটা লুকিয়ে ফেলল। এই খুশি লুকানো সম্ভব না। তবুও চেষ্টা তো করতে হবে। দু’হাতে চুল ঠিক করে শান্ত হয়ে দাঁড়াল। তখনই সুমনা ঘরে এলো। মীরা কাপড় গুছিয়ে রেখে দিয়েছে দেখে সুমনা হেসে বলল,
“বাহ! তুই তো বেশ কাজের মেয়ে। কে বলে আমাদের মীরা কাজ পারে না!”
আকাশ ছোঁয়া খুশি লুকিয়ে মীরা সামান্য একটু হাসল। মনে মনে বলল,
“বাকি সবাই গোল্লায় যাক। তুমি আমার দলে আছো এটাই যথেষ্ট। তোমার ছেলের সাথে সুখের সংসার করতে গেলে তোমাকে তো আমার দলে থাকতেই হবে শাশুড়ী মা।”
মীরা বাড়ি ফিরে অপেক্ষা করতে লাগল জায়িন কখন জানবে তার কাছে থাকা মীরার নূপুরটা যে হারিয়ে গেছে। জেনে নিশ্চয় আন্টিকে জিজ্ঞেস করবে তার ঘরে কে এসেছিল। বাইরের কেউ তো জায়িনের ঘরে যাবে না। আন্টি মনে করে তার কথা বললেই হয়। জায়িন তখন বুঝে যাবে মীরা সব জেনে ফেলেছে। তখন নিশ্চয় মীরার সাথে যোগাযোগ করবে। মীরা সেই সময়টার অপেক্ষাতেই প্রহর গুনতে লাগল।
চলবে…
আপনারা মনে হয় কমেন্ট করতে ভুলে যান। কিন্তু আমার তো আপনাদের সুন্দর সুন্দর কমেন্ট দেখেই লিখতে ইচ্ছে করে🤍#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৫৩
মীরার অপেক্ষা শেষ হওয়ারই নাম নিচ্ছে না। গতকালকের পুরোটা দিন কেটে গেল। কিন্তু জায়িনের দেখা পাবে তো দূর, কোন ফোন কল, মেসেজ কিচ্ছু পেলো না। মীরা নখ কামড়াতে কামড়াতে ঘরময় পায়চারি করে ভাবছে,
“জায়িন ভাই যা ভেজা লোক! উনি হয়তো এখনও টেরই পাননি নূপুরটা যে আমি নিয়ে এসেছি। এটা না জানলে কীভাবে হবে? দূর কী গাধা লোকের প্রেমে পড়লাম রে বাবা। সামান্য একটা মিস্ট্রি সল্ভ করতে উনার একদিন সময় লেগে যাচ্ছে।”
গতকালকের একটা দিন মীরার এমন কেটেছে সিম কোম্পানি কল দিলেও সে জায়িনের কল ভেবে ছুটে এসেছে। কলিংবেল বাজলেই মনে হয়েছে কোনো না কোন অজুহাতে জায়িন ভাই হয়তো তাদের বাড়িতে চলে এসেছে।
“এই লুকোচুরি খেলা আর কত চলবে? এখন তো আমিও জানি উনি আমাকে পছন্দ করেন। তাহলে আর কিসের অপেক্ষা করছি আমি? না, উনার বলার অপেক্ষা কেন করছি আমি? আমিই তো আগে বলে দিতে পারি। আমিই বলব। এই বেডার আশায় থাকলে আমার লাভ লাইফে ঠা’ডা পড়বে।”
আর কোন লুকোচুরি না। আর কোন বনিতা না৷ এবার যা হবে সব খোলাখুলি। মীরার সাহস কি কারো থেকে কম? সে দিব্যি আগেভাগে নিজের ভালোবাসার কথা জানাতে পারে। এতে সে কাউকে ভয় পায় নাকি?
মীরা ফোন খুঁজতে লাগল। তার মনে পড়ল, ফোন তো রুশমির কাছে। মীরা দৌড় লাগালো।
….
দুইটা দিন জায়িনের ভীষণ ব্যস্ততায় কেটেছে। এর মাঝে একবার ঢাকা যেতে হয়েছে। এত ব্যস্ততার মাঝেও মীরার কথা মাথা থেকে বেরোয়নি। মুবিন কোন গণ্ডগোল পাকিয়ে দেওয়ার আগেই মীরাকে তার মনের কথা জানাতে হবে। আজ কি মীরা তাদের বাড়িতে আসবে?
“না এলেও আমি যাব। ওবাড়িতে যাবার অজুহাত হিসেবে আমার বোনটা তো আছেই।”
জায়িন পরনের একটা শার্ট বের করার জন্য আলমারি খুললো। তার আলমারিতে কি কেউ হাত দিয়েছিল? কিছু একটা পরিবর্তন চোখে পড়ছে। নিশ্চয় মা এসেছিল। জায়িন মীরার নূপুরটা খুঁজতে গিয়ে ওটা পেলো না। তন্নতন্ন করে পুরো আলমারি খুঁজে ফেলল। কিন্তু জিনিসটা কোথাও পেল না।
“কে নিয়েছে ওটা? মা নিয়ে গেছে?”
জায়িন মা’কে ডাকতে লাগল। সুমনা এসে দরজার সামনে থেকে বলল,
“ডাকছিস কেন?”
“আলমারি তুমি গুছিয়েছ?”
“না। তোর তো বউ আছে। তোর বউ গুছিয়ে দিয়ে গেছে।”
“আলমারি গোছানোর সময় তুমি কি কিছু পেয়েছ?”
“কি হারিয়েছে?”
জায়িন মা’র উপর ঠিক ভরসা করতে পারছে না। মা কি জিনিসটা পেয়েছে? পেয়ে তাকে পরীক্ষা করার জন্য অজানা ভাব করছে। কী হারিয়েছে জায়িন এটা মা’কে বলতেও পারল না। কীভাবে বলবে? তার আলমারিতে একটা মেয়ের নূপুর কেন থাকবে?
“আমার ঘরে কি কেউ এসেছিল মা?”
“তোর ঘরে কে আসবে? বাইরের কেউ আমাদের বাড়িতে আসে নাকি?”
“তারপরও একটু ভেবে বলো। আমি বাড়ি ছিলাম না তখন কি কেউ আমার ঘরে এসেছিল?”
সুমনা ছেলের কাজকর্মে বিরক্ত হচ্ছে। তাদের বাড়িতে বাইরের কে আসবে? সুমনা আসলে মীরাকে বাইরের কেউ ভাবছেই না। তাই মীরার নামটা নিতে এত সময় লাগল।
“ওহ হ্যাঁ। দু’দিন আগে আমার সাথে মীরাও তোর ঘরে এসেছিল।”
“কেন?”
সুমনা ছেলের এত প্রশ্ন শুনে রেগে বলল,
“তোর ঘর তো কোন জাদুঘর না যে দর্শন করতে আসবে। আমি তোর কাপড় গোছাচ্ছিলাম। মীরাও তখন এখানেই ছিল। তাই আমার সাথে এসেছে। মেয়েটা নিজে আমার হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দিল। আর তুই হাজারটা প্রশ্ন করছিস।”
এর পরে আর কিছু বোঝার বাকি থাকে না। মীরা যেভাবেই হোক নূপুরটা আলমারিতে দেখেছে। এবং নিজের নূপুর চিনতে এই মেয়ের এক সেকেন্ডও সময় লাগেনি। মীরাই তাহলে ওটা সাথে নিয়ে গেছে। জায়িন আরও কিছু ভেবে ওঠার আগে টুং করে তার ফোনে মেসেজ এলো। সুমনা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। আজকাল তার এই ছেলেটাকে আস্ত একটা গাধা মনে হয়। জায়িন সবসময় বাবার সব কথা শুনে বলে এজন্যই ছেলের উপর সুমনার রাগ। জায়িন ফোন হাতে নিয়ে মেসেজ দেখে মাঝারি আকারের একটা ধাক্কা খেল। বেচারা নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। নাম্বারটা সেভ না। তবুও মেসেজ দেখে বোঝার বাকি রইল না এটা কে হতে পারে।
“আপনার ঘর থেকে কি কোনকিছু হারানো গিয়েছে?”
মেসেজটা পড়ে জায়িন অজান্তেই হেসে ফেলল। এই মেয়ে কতটা অধৈর্য এটাই তার প্রমাণ। জায়িনের খোঁজ পাওয়ার আগেই সে মেসেজ করে বসে আছে। ছেলের মুখে হাসি দেখে সুমনা দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো।
“মোবাইলের দিকে তাকিয়ে হাসছিস কেন তুই? কী দেখছিস ওটার ভেতর?”
মা’র দিকে তাকিয়েও জায়িন হাসি মুছতে পারল না।
“কিছু না মা।”
“তাহলে আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিস কেন?”
“তুমি যাও।”
“কী যে করিস তোরা আমার বুঝে আসে না। বাপ ছেলে সব পাগল।”
সুমনা বকবক করতে করতে চলে গেল। জায়িন মেসেজটা আরও একবার পড়ে রিপ্লাই দিল।
“হারানো যায়নি। একজন সৎচোর সেটিকে চুরি করে নিয়ে গেছে।”
“কারো হারিয়ে যাওয়া নূপুর পেয়ে, তাকে ফিরিয়ে না দিয়ে নিজের কাছে রেখে দেওয়া কি চুরির মাঝে পড়ে না?”
“কারো মন চুরি করে নিয়ে নিজের কাছে রেখে দেওয়াও কিন্তু চুরির মাঝেই পড়ে।”
“কে কার মন চুরি করেছে শুনি?”
“সেটাও কি বলার অপেক্ষা রাখে?”
“আপনি যে আমার দিনের শান্তি, রাতের ঘুম চুরি করে নিয়েছিলেন তার বেলা! আপনার তো আরও বড়ো শাস্তি হওয়া উচিত।”
“তাই!”
“জি তাই।”
“শাস্তি কে দিবে? তুমি? তাহলে আমি যেকোনো শান্তি সানন্দে গ্রহণ করতে প্রস্তুত।”
দুইটা দিন জায়িনের মনে যে অস্থিরতা বিরাজ করছিল। আজ সেখানে একঝাঁক প্রশান্তির বাতাস ছুঁয়ে গেল। এই দিনটার অপেক্ষা সে কতগুলো বছর ধরে করছিল। অপেক্ষার ফল যে এত মিষ্টি হবে সেটা জায়িনের ধারণার বাইরে ছিল।
….
প্রেমে পড়ার সবগুলো লক্ষণই মীরার মাঝে দেখা যাচ্ছে। বাড়ির কেউ ধরতে পারছে না এটা তাদের ব্যর্থতা। রাতে খেতে বসে মীরা একটুও খেতে পারল না। আনমনে কোনকিছু ভাবতে ভাবতে ভাতের প্লেটে আঙুলে আঁকিবুঁকি করছে। সবাই খাচ্ছে অথচ মীরা গালে হাত দিয়ে বসে মুচকি মুচকি হাসছে। ছোট চাচী মীরার প্লেটের রুই মাছের পেটি দিতে গিয়ে লক্ষ করল, এই মেয়ে তো এখনও কিছুই খায়নি। শুধু শুধু বসে আছে। ছোট চাচীর ঠেলায় মীরার হুঁশ ফিরল।
“খাচ্ছিস না কেন? খাওয়ার সময় গালে হাত দিয়ে বসে আছিস। পৃথিবীর সব বাজে স্বভাব আল্লাহ এই মেয়েটার ভেতর দিয়ে রেখেছে।”
ছোট চাচীর কথায় এবার সবাই মীরার দিকে ধ্যান দিল। মীরা পড়ে গেল অস্বস্তিতে। ইভান মীরার প্লেট দেখে বলল,
“এখনও তো কিছুই খাসনি। তাড়াতাড়ি খাওয়া শুরু কর।”
মীরা মাথা দুলিয়ে হু বলে খেতে লাগল। মনে মনে বলল,
“বাড়ির মানুষ না যেন সিসি ক্যামেরা!”
ঘরে এসেও মীরা দোটানার মাঝে সময় কাটাচ্ছে। এখন তো জায়িন ভাই তার বয়ফ্রেন্ড। কেউ কাউকে আই লাভ ইউ বলেনি। তাতে কি? মন বিনিময় তো হয়েই গেছে। মীরা ভাবছে,
“অফিসিয়ালি বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড না হলে কি রাতের বেলা কল করা যাবে না? প্রেমে পড়ে উনার মাঝে কেমন পরিবর্তন এসেছে এটাও তো জানি না। আমি কল দিলে কি উনি বিরক্ত হবেন? দূর!”
মীরা এতকিছু ভাবতে পারলো না। অনুভূতি প্রকাশ পাওয়ার আগের মুহূর্ত গুলোই সুন্দর ছিল। অন্তত এত কনফিউশান ছিল না।
“উনি কি মুবিন ভাইয়ের মতো আদর্শ প্রেমিক হবেন? আমার জন্য কলেজের বাইরে অপেক্ষা করবেন? দিনে একশো বার কল করে আমার খোঁজ খবর নিবেন। আমার মন খারাপ হলে চকলেট গোলাপ পাঠাবেন? আমার জন্য উনি সব করতে পারবেন?”
মীরা বালিশে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে শুয়ে পা নাচাতে লাগল।
“ধ্যাত! আগে দুই চারটা প্রেম করে রাখলে এখন এই সমস্যা গুলো দেখা দিত না। প্রপোজ করার পরের ধাপ কী? এক সেকেন্ড। উনি তো আমাকে এখনও প্রপোজই করলেন না। জায়িন ভাই আপনি এমন কেন? আপনি একটা ভেজাইল্লা লোক।”
….
“তোর কপালে বয়ফ্রেন্ড নাই। বাপ ভাই ধরে বেঁধে যদি কোন আহাম্মকের গলায় তোকে ঝুলিয়েও দেয়। মনে রাখিস, ওই বেচারাও বিয়ের রাতই তোকে ছেড়ে পালিয়ে যাবে।”
রাতুলের টিটকারির সুরে বলা কথাটা শুনে মীরার মাথায় আগুন ধরে গেল। তুলতুলের বাচ্চাটার কত বড়ো সাহস! মীরা ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
“রাতুইল্লার বাচ্চা! যত বড়ো মুখ নয় তত বড়ো কথা! আজ আমি তোর মুখই ভেঙে ফেলব।”
রাতুলকে মারার জন্য মীরা রাতুলের পেছনে ছুটছে। রাতুলও পাগলকে খেপিয়ে দিয়েছি বলে মাঠ বরাবর এক দৌড় লাগাল। এদিকে মাহিমা হাসতে হাসতেই শেষ। এই দুইটার ঝগড়া দেখে হাসি না পেলে টাকা ফেরত।
“আমার বর আমাকে ছেড়ে দিবে? তুই বেশি জানিস না? দেখব তোর কপালে কেমন বউ জুটে! তুই একটা জল্লাদ বউ পাবি।”
মীরা ছুটতে ছুটতে হুট করে দাঁড়িয়ে পড়ল। বেচারি নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। সত্যিই কি ওটা জায়িন ভাই? নাকি প্রেমের ভূত মাথায় চড়ে দিনেদুপুরে স্বপ্ন দেখছে।
“জায়িন ভাই আমাদের কলেজে কেন আসবে?”
মীরাকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে রাতুলও ফিরে তাকাল। ওখান থেকেই ভেঙিয়ে বলল,
“মীরার জামাই আহাম্মক। আহাম্মককে আহাম্মক বললে এত চেতার কী আছে রে?”
জায়িন দূর থেকেই মীরাকে একটা ছেলের পেছনে ছুটতে দেখেছে। এখন কাছাকাছি থাকায় ছেলেটার কথা শুনে বুঝতে পারল কেন মীরা ছেলেটার পেছনে ছুটছিল। জায়িন মুচকি হেসে মীরার পাশ দিয়ে চলে গেল। মীরা এখনও স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা তাকে পাত্তাই দিল না! এখন তো ওরা বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড। আচ্ছা বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড না হোক। কিন্তু বিশেষ একটা পছন্দ করা তো দু’জনের মধ্যেই আছে। তাহলে এই এটিটিউড কেন?
মাহিমা জায়িনকে দেখে মীরার কাছে ছুটে এলো। ফিসফিস করে বলতে লাগল।
“ভাসুর ব্যাটা আমাদের কলেজে কী করছে রে?”
“তুই দাঁড়া। আমি গিয়ে উনাকে জিজ্ঞেস করে আসি।”
“রেগে যাচ্ছিস কেন তুই?”
“তাহলে আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন? আমি কী করে জানব।”
“আচ্ছা বাদ দে। ভাসুরকে নিয়ে মাথা ঘামিয়ে আমার কাজ নেই। আমি তো ভাসুরের ভাইটাকে নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি। তুই কিন্তু বলেছিলি আজ দেখা করাতে নিয়ে যাবি। মনে আছে তো?”
মাহিমা বাদ দিতে বললেও মীরা কি এত সহজে বাদ দিতে পারবে? এই ব্যাটাকে নিয়ে মাথা ঘামানোই তো তার একমাত্র কাজ। জায়িন ভাই এখানে কেন এসেছে? তার জন্য? দূর তার জন্য কীভাবে? তার জন্য এলে কি তার সাথেই কথা না বলে চলে যেত!
চলবে#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৫৪
বিকালে ওদের বেরুবার কথা থাকলেও মীরা দুপুরে শুয়ে বিকাল পর্যন্ত ঘুমিয়ে কাটাল। মাহিমা এসে মুখে পানি ছিটা দিয়ে ওর ঘুম ভাঙাল। পানির ছিটা পেয়ে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে মীরা। আতঙ্কিত চোখে ছাদের দিকে তাকিয়ে দেখে। না ছাদ তো ঠিকই আছে। মাহিমা চোখ পাকিয়ে মীরার দিকে তাকিয়ে আছে। এই অঘুমার বাচ্চা ঘুমের জন্যেই জীবনে কিছু করতে পারবে না।
“রাতের বেলা কী করিস তুই? ডাকাতি করতে বের হোস? পুরো রাত ঘুমালে আবার দিনে ঘুমাতে হয় কেন রে?”
ঘুম থেকে উঠলে এমনিতেই মেজাজ চিড়চিড়ে হয়ে থাকে। তার উপর কেউ যদি কাচা ঘুমে পানি মেরে জাগিয়ে দেয়। মীরার ইচ্ছে করছে কইতরিটাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে। সে বেচারি এক মুহূর্তের জন্য ভেবেছিল তার ঘরের ছাঁদ ভেঙে পানি পড়ছে। মাহিমা তীক্ষ্ণ গলায় বলল,
“এখনও ঘুমাবি তুই! কী কথা ছিল? আমাদের বেরুতে হবে মনে আছে তোর?”
মীরা কাত হয়ে আবার শুয়ে পড়ল। অলস ভঙ্গিতে বলল,
“তোর দরকার তুই যা। আমাকে এখন পায়ে ধরেও নিয়ে যেতে পারবি না। মুখে পানি না ছিটালে অবশ্য অন্য কথা ছিল।”
“তুই যাবি। তোর ঘাড়ও যাবে।”
বলেই মাহিমা মীরার পা ধরে টেনে বিছানা থেকে ফেলে দিতে লাগল। মীরা চিৎকার করতে লাগল।
“তোকে আমাদের বাড়িতে কে আসতে দেয় রে? আমি ঘুমানোর সময়ই তোর ম’রি লাগে?”
“জন্মের ঘুম শ্বশুরবাড়ি গিয়ে ঘুমাস। আমার মামার বাড়িতে ঘুমিয়ে কাটানো যাবে না।”
মাহিমার ঠেলাঠেলিতে মীরাকে উঠতেই হলো। এই মেয়ে নাছোড়বান্দা। এত সহজে তাকে ছাড়বে না। মাহিমা ঠেলেঠুলে মীরাকে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিয়েছে। মীরা চোখে পানি দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে বের হলে মাহিমা জিজ্ঞেস করল,
“এখনও ঘুম আছে?”
মীরা মুখ মুছতে মুছতে মাহিমাকে দেখে উপহাস করে বলল,
“ফুপির বিয়ের শাড়িটা পরে নিতি! মেকআপ তো কম হয়ে গেছে। আমার একটা লাল টকটকে লিপস্টিক আছে। ওটা লাগিয়ে নে।”
মাহিমা মুখ মোচড় দিয়ে বলল,
“বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। তুমি কী বুঝবা হ্যাঁ? নিজের তো একটা বয়ফ্রেন্ড বানানোর মুরোদ নাই।”
বয়ফ্রেন্ডের কথা শুনেই মীরার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। বয়ফ্রেন্ড যখন ছিল না তখন এসব কথা গায়ে লাগত না। কিন্তু যেমন তেমন হোক এখন তো একটা বয়ফ্রেন্ড আছে।
মাহিমা মীরাকে তাড়া দিয়ে রেডি করিয়ে নিল।
মীরা সাদা রঙের গোল জামার সাথে চুলে বেণী করেছে। বেরুবার আগে আয়নার সামনে গিয়ে ঠোঁটে হালকা একটু লিপস্টিক লাগিয়ে নিল। মীরাকে তাড়া দিতে লেগে মাহিমা বলল,
“হয়েছে। এভাবেই তোকে সুন্দর লাগছে। আর সাজতে হবে না বোন। তাড়াতাড়ি কর।”
“নিজে বউ সেজে এসে আমাকে একটু লিপস্টিকও লাগাতে দিচ্ছিস না। এই তুই যে এত সেজে বাড়ি থেকে এসেছিস ফুপি কিছু বলেনি?”
“তোর ফুপি মানুষ ভালো। সাজগোছ নিয়ে আমাকে কোনদিনই কিছু বলে না।”
“এজন্যই তো শাসনের অভাব উচ্ছন্নে যাচ্ছিস। না, অলরেডি গিয়েছিস।”
“ভালো হয়েছে। এখন চল।”
মীরা মাহিমা বাড়ি থেকে মিথ্যা বলে বের হলে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে কোথায় যাচ্ছে, তখন তাদের ঠোঁটের আগায় উত্তর রেডি থাকে, রিমুদের বাসায় যাচ্ছি।
এই কথার পর বড়মা বা ছোট চাচী কেউ বাধা দেয় না। তনি আগ্রহী হয়ে দ্বিতীয় প্রশ্ন “কেন যাচ্ছিস?” করলেও তাদের উত্তর হয়, কেন আবার? সামনে পরীক্ষা না? গ্রুপ স্টাডি করতে।
আজকেও এই মিথ্যা কয়টা বললে তনি সন্দেহের গলায় জিজ্ঞেস করল,
“এত সেজেগুজে গ্রুপ স্টাডি করতে যাচ্ছিস! আমাকে গ্রুপ স্টাডি শেখাও তোমরা?”
তনির জেরার সামনে মীরা আজ চুপ করে আছে। সে মনে মনে চাচ্ছে কইতরিটা আজ একটা কেস খাক। একটা বয়ফ্রেন্ড বানিয়ে আকাশে উঠছে। একবার মাটিতে পড়লে বুঝবে কত মজা। মীরা অবুঝ বাচ্চার মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। তনি মাহিমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“কিরে কথা বলছিস না কেন? তুই তো এমন ভাবে সেজেছিস যেন কারো বিয়েতে যাচ্ছিস।”
“দূর আপু। তোমার স্বভাব দিনদিন আমার ভাইটার মতো হয়ে যাচ্ছে। খুঁতখুঁতে। সবকিছুতে খালি সন্দেহ করো। ভাইয়া নাহয় ছেলে। ও সাজগোজের কিছু বুঝে না। কিন্তু তুমি তো মেয়ে। তুমিও এটুকু সাজগোছ করাকে এত বড়ো করে দেখছো?”
মীরা মনে মনে প্রশংসা না করে পারল না। কইতরিটার বুদ্ধি আছে। অবশ্য বুদ্ধি না থাকলে প্রেম করা যায় না।
দু’জন মিথ্যা বলে মুবিনের নতুন ফ্ল্যাট দেখার উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়ল। রাস্তায় এসে রিকশা পেয়ে চড়ে বসল। আজ কলেজের ঘটনাটা নিয়ে মনটা খারাপ ছিল। জায়িন তাকে দেখেও কথা বলেনি। এটা কেমন পছন্দ করা? নাকি জায়িন তাকে সেরকম ভাবে পছন্দই করে না। প্রেমিক হলে মুবিন ভাইয়ের মতো হওয়া উচিত। প্রেমিকাকে না দেখে যার দিন শুরু হয় না।
…..
জায়িন এসেছে ভাইয়ের নতুন সংসার গুছিয়ে দিতে। মুবিন এবার কিছুতেই বাড়ি ফিরবে না। অনেক বুঝিয়েও জায়িন যখন ব্যর্থ তখন আর জোর করল না। একটা রুম, কিচেন ও ছোট্ট ব্যালকনি ওয়ালা ফ্ল্যাট ন্যায্য ভাড়ার থেকেও অনেক কমে পেয়ে গেল। কীভাবে পেলো? বাড়ি ওয়ালা বুড়ো রীতিমতো মুবিনের ভক্ত হয়ে গেছে। প্রথম দেখাতেই মুবিনকে লোকটা চিনে ফেলে। ওর বাসা লাগবে শুনে একপ্রকার খুশি হয়েই তাকে থাকতে দিচ্ছে। ভাড়া নিতেও রাজি ছিলেন না বুড়ো।
“এ বাবা, কী বলো? তোমার স্টাগলের দিনে তোমার থেকে ভাড়া নিব? তুমি যেদিন বড়ো তারকা হবা তখন আমারে মনে রাখবা সেটাই তো অনেক। তবুও যদি তোমার মন সায় না দেয় তাহলে অর্ধেক ভাড়া দিও। মাসের যেকোনো তারিখে দিলেই হবে। আমার সমস্যা নাই।”
এই লোকটাকে দেখে মুবিন তার বাবার বলা কথাগুলো মনে করছে। দুনিয়া এত সহজ না। বাইরে বেরোলেই বুঝতে পারবে বাস্তবতা কত কঠিন। বাস্তবতা সত্যিই কঠিন হতো, যদি পৃথিবীতে শুধুমাত্র তার বাবার মতো মানুষই বসবাস করতো। কিন্তু আফসোস তার বাবার কথা মিথ্যা প্রমাণ হলো। এই বুড়ো চাচার মতো লোকেরা আছে বলেই হয়তো পৃথিবী এখনও সুন্দর।
জায়িন মুবিনের সাথে খাট সেট করে দিচ্ছে। খাটটা কোথায় রাখবে সেটাই ঠিক করে উঠতে পারছে না।
“তোকে গরীব ভেবে চাওয়ার আগেই টাকা দিয়ে ভুল করে ফেলেছি। তুই তো আমার থেকেও বড়লোক।”
ভাইয়ের খোঁচা শুনে মুবিন হাসল। ভাইয়া ইনডিরেক্টলি তার থেকে জানতে চাচ্ছে এসব করার টাকা কোথায় পেয়েছে।
“আমি আগেও গরীব ছিলাম। এখনও আছি। চাচা মিয়া আমার ভক্ত বের হওয়ায় মাথার উপর ছাদটা পেয়ে গেছি। আর এই সিঙ্গেল বেডটা এক বন্ধু দান করেছে।”
“সংসার তো গুছিয়ে ফেলেছিস। এবার রান্নাবান্নাটাও শিখে ফেল।”
“ইচ্ছে না থাকলেও শিখতে হবে। কী আর করার? তুমি বাড়িতে আম্মুর হাতের মজার মজার রান্না খাবে। আমি এখানে পোড়া রুটি, বাসি ডাল খেয়ে কাটিয়ে দিব।”
“বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত তোরই ছিল। এখন পস্তালে লাভ নেই।”
“পস্তাচ্ছি না। তুমি জানো না আমি কবে থেকেই চাচ্ছিলাম এমন একটা কাণ্ড ঘটাতে। কিন্তু সুযোগ, সাহস কোনটাই পাচ্ছিলাম না।”
“তুই বাড়ি ফিরবি না ঠিক করে নিয়েছিস?”
“আমার হিটলার বাপ যেদিন স্বীকার করবে উনি ভুল ছিলেন। আমার গায়ক হবার স্বপ্ন দেখায় অন্যায় কিছু ছিল না। সেদিনই বাড়ি ফিরে যাব। তার আগে না।”
কলিংবেলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। মুবিন এখানে উঠেছে একথা তার বন্ধুরা ছাড়া আর কেউই এখনও জানে না। মুবিন ভেবেছে আরাফাতই হয়তো এসেছে।
মুবিন দরজা খুলে সামনে মীরা মাহিমাকে দেখে অবাক হওয়ার সাথে সাথে আনন্দিতও হয়েছে। ওরা কীভাবে এখানকার ঠিকানা জানলো একথা জিজ্ঞেস করার আগেই মাহিমা এক কাণ্ড করে বসলো। সে মুবিনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে কিছু বলতে লাগল। মাহিমার এই কাজে মুবিন বিস্ময়ের ধাক্কা সামলাতে না পেরে এক মুহূর্তের জন্য জমে গেছে। এই দৃশ্য দেখে মীরার মুখ হাঁ হয়ে গেছে। চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার জোগাড়। শয়তান কইতরির মনে এরকম কিছু ছিল এটা আগেই বলে নিত। তাহলে মীরা তার চোখ বন্ধ করে নিত। মীরা না পারছে নায়ক নায়িকার রোমান্টিক এই সিন দেখতে। না পারছে ছুটে পালিয়ে যেতে। মুবিন বেচারা নিজেও বিস্ময়ের ধাক্কা কাটিয়ে উঠে মাহিমাকে শান্ত করতে চাইল। তার চোখ মীরার দিকে পড়লে কিছুটা লজ্জা পেলো। মীরা ঠোঁট টেনে বোকার মতো হেসে অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে মনে মনে বলল,
“আস্তাগফিরুল্লাহ! নাউজুবিল্লাহ! তওবা! এই ছিল তোর মনে? বড়ো বোনের সামনেই প্রেম লীলা চালিয়ে যাচ্ছিস। লজ্জা শরম যে শব্দ দু’টো ছিল ওদের মাগফেরাত কামনা করছি।”
“মাহিমা! এই, আরে পাগলি, কাঁদছো কেন? তাকাও আমার দিকে।”
জায়িন এতক্ষণ রুমেই ছিল। কলিংবেলের শব্দ শোনে মুবিন দরজা খুলতে গেছে অনেকক্ষণ হয়েছে। এখনও কারো সাড়াশব্দ পাচ্ছে না দেখে জায়িন নিজেই দেখতে এসেছিল বাইরে কে এসেছে। জায়িন ঘর থেকে বেরিয়ে বলতেই যাচ্ছিল, কে এসেছে? কিন্তু তার মুখের কথা মুখেই আটকে রইল। বেচারা এই দৃশ্যের সাক্ষী হতে চাচ্ছে না। কিন্তু তার এখান থেকে উল্টো ঘরে ফিরে যাওয়ার কথাও মাথায় আসছে না। বোকার মতো দাঁড়িয়েই আছে। মীরা অন্য দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ করে তার চোখ জায়িনের উপর পড়লে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। পরক্ষণে মুবিন মাহিমার কথা মনে পড়তে হেঁচকি তুলে ঝট করে দু’হাতে নিজেই নিজের চোখ ঢেকে নিলো। হেঁচকির শব্দ শুনে মুবিন মীরার দিকে তাকালে দেখতে পেল মীরা চোখ বন্ধ করে আছে। তখনই মুবিন বুঝতে পারল তার ভাই হয়তো তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।
চলবে
ছোট্ট করে হলেও মন্তব্য করে যাবেন। আপনাদের ভালোবাসা পেলে লেখার আগ্রহ বেড়ে যায় 💜