মন নিয়ে কাছাকাছি পর্ব -৫+৬

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা

🌸

মাহিমার কথা শুনে মীরা বিষম খেয়ে উঠল। সে মুবিন ভাইকে মনে মনে পছন্দ করে। কিন্তু এই পছন্দ এতটা গুরুতর না। মীরা রাগ দেখিয়ে বলল,

“মাহি! বাজে কথা বলবি না।”

“বাজে কথা কি? আমরা কোচিং-এ যাবার সময় প্রায়ই মুবিন ভাইকে এদিকে দেখা যায়। হ্যাঁ মানলাম উনার বাড়িও এই এলাকাতেই। একদিন দুদিন দেখা হতেই পারে। তাই বলে এভাবে প্রতিদিন তো আর কো ইন্সিডেন্স মানা যায় না। আমার মনে হয় উনি ইচ্ছে করে আমরা কোচিংয়ে যাবার সময় এখানে বসে থাকেন।”

“কিন্তু উনি যে আমার জন্যই বসে থাকেন এটা তোকে কে বলেছে?”

“এই সহজ কথাটা বলতে হবে কেন? তুই উনার কাছে প্রাইভেট পড়িস। উনি তোকে চেনে। তোর জন্য বসে না থেকে কি তাহলে আমার জন্য বসে থাকবে?”

“হু। কিন্তু মুবিন ভাই আমাকে কোনদিন ইশারা ইঙ্গিতেও এমন কিছু বোঝাননি। উনি অনেক ভালো।”

“তোর চোখে পৃথিবীর সবাই ভালো বোন। আসলে তুই-ই যে ভীষণ ভালো। তাই কাউকে খারাপ মনে হয় না।”

কোচিং শেষে ফেরার সময় মীরা মাহিমাকে চেপে ধরল,

“চল না হসপিটালে গিয়ে ওজনটা মাপিয়ে আসি।”

মাহিমা বিরক্ত হয়ে বলল,

“হঠাৎ তোর ওজন মাপানোর কিড়া মাথায় নাচছে কেন?”

“নাইনে উঠে মেপেছিলাম। এখন কত হবো জানি না তো।”

“জেনে কি করবি? কার কোলে উঠবি?”

কোলে উঠবি কথা শুনেই মীরার ওই ঘটনা মনে পড়ে গেল। সে জায়িন ভাইয়ের কোলে উঠেছে চিন্তা করেই কান, গাল গরম হয়ে উঠল।

“দূর বাজে বকিস কেন?”

“ওজন মাপতে হবে না৷ আমি তোকে দেখেই ওজন বলে দিচ্ছি। কম করে হলেও পঞ্চাশ কেজি হবি।”

মীরা প্রতিবাদ করে বলে উঠল,

“এত বেশি! জীবনেও না। আমাকে কি তোর কুমড়োপটাশ মনে হয়। ত্রিশ, পয়ত্রিশ হবো।”

“তাহলে তো জানিসই কত হবি। আর ওজন মাপতে হবে না বোন।”

মাহিমা বাড়ি চলে যেতে চাইলে মীরা জোর করে মাহিমাকে ওদের বাড়িতে নিয়ে এসেছে। মাহিমারও আসার ইচ্ছে ছিল। শুধু পরীক্ষাটা জীবনের সুখ শান্তি কেড়ে নিয়েছে। দুপুরে খেয়েদেয়ে দুই বোন একসাথে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। মাহিমা জিজ্ঞেস করল,

“ধর মুবিন ভাই তোকে পছন্দ করেছে। তুই কি তখন রাজি হবি?”

“না। এটা কি আমার প্রেম করার বয়স? বাবা, চাচ্চুরা জানতে পারলে অনেক কষ্ট পাবে।”

“তাহলে কি করবি? উনাকে ফিরিয়ে দিবি?”

“আমার জন্য অপেক্ষা করতে বলব। ভার্সিটিতে ওঠার পর প্রেম করব। তখন আমরা প্রেমের মানেটাও ঠিকঠাক বুঝতে পারব।”

“তুই মহান বোন! ধরবিও না। পুরোপুরি ছেড়েও দিবি না। ঝুলিয়ে রাখবি।”

“আমি কি উনাকে জোর করব। তার বুঝে না হলে অন্য মেয়েদের সাথে প্রেম করুক। আমার কোন আপত্তি নেই। তাকে না পেলে আমি মরে যাব এমন কোন ব্যাপারই না।”

রুশমি এসে কোলে ওঠার জন্য বিরক্ত করলে মাহিমা এক ধমক দিল। মীরা মাহিমাকে ধমক দিলে সে বলল,

” আজকালকার বাচ্চা গুলা এত বেয়াদব হয়েছে কেন? খালি কোলে উঠতে চায়। ওই তোর বাপে আমারে খাওয়ায়? তোরে কেন কোলে নিমু আমি?”

মীরা ওর কথা শুনে হাসতে লাগলে মাহিমা মাথায় চাটি মারল। মীরা রুশমিকে কোলে নিলে রুশমি তোতলা কন্ঠে বলল,

“মাহি আপু পতা(পঁচা)। আলি আলি(আড়ি)।”

দুপুরটা ঘুমিয়ে কেটে বিকেলে মীরার সাথেই বেরিয়ে পড়ল মাহিমা। রাতে ভাইয়া এলে ওর সাথেও যাওয়া যেত। কিন্তু তখন আর রাতে পড়া হতো না। হাঁটতে হাঁটতে মীরা বলল,

“পরীক্ষার পর কোথায় ঘুরতে যাবি ঠিক করেছিস?”

“প্রথমে খালামুনির ওখানে যাব। পুরো সিলেট ঘুরে তারপর ফিরব। পরেও হাতে অনেক সময় থাকবে। তখন ভেবে দেখব আর কোথায় যাওয়া যায়।”

“আমি যেভাবেই হোক এবার কক্সবাজার যাবোই যাব। জীবনে যাইনি।”

“আমিও না।”

বলেই দু’জন একসাথে হাসতে লাগল। কত প্ল্যান করে রেখেছে ওরা। পরীক্ষার পর কতকিছু করবে। দু’জন এক কলেজে এডমিশন নিবে। একই ভার্সিটিতে পড়বে। এমনকি এক বাড়ির দুই ছেলেকে বিয়ে করে সারাজীবন একসাথে থেকে যাবে এটাও ভেবে রেখেছে।

“মুবিন ভাইয়ের না একটা বড় ভাই আছে।”

মীরা রাস্তার পাশে সুন্দর একটা বাড়ির ফুল গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে হাঁটছিল। মাহিমার কথা কানে যেতে মুখ বাঁকিয়ে বলল,

“ওই বদমেজাজি কাউয়ার সাথে নিরীহ কইতরির কিছুই হবে না।”

“দূর এজন্য জিজ্ঞেস করছি না। মুবিন ভাইকে তো দেখেছি। কিন্তু উনার বড় ভাইকে কোনদিন দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।”

“আমিও প্রথম দিন দেখে চিনতে পারিনি। উনি তো বাড়িতে থাকেন না। বেশি সময় ঢাকা থাকেন।

“পরেও আমরা এক এলাকার তো। এলাকার একটা ছেলেকে চিনি না এটা কেমন কথা?”

“আমরা ডিম থেকে ফুটে বের হওয়ার আগে উনি এলাকা ছেড়েছেন। কীভাবে চিনব বল তো?”

“আচ্ছা বাদ দে। উনারে চিনে আমাদের কাজ নেই।”

মীরা মুবিন ভাইয়ের কাছে পড়া শেষ করে আন্টির কাছে জানতে পারল জায়িন ভাই কাল চলে গেছে। উনাকে রিকশা ভাড়ার টাকাটা দেওয়া হয়নি। আর একটা ধন্যবাদ বলাও বাকি ছিল। আচ্ছা পরের বার বাড়ি এলে টাকা ধন্যবাদ দু’টোই একসাথে দেওয়া যাবে।

🌸

পরীক্ষার দিনগুলো মীরা নিজের ঘর ছাড়া বারান্দায়ও আসেনি। পুরোটা সময় টেবিলে বসে ছিল। আর নয়তো ঘুমিয়েছে। ভাইবোনদের আড্ডা বিহীন সেই কষ্টের দিনগুলো পার হয়েছে। এবার সে মুক্ত পাখি। আর কোন বাধা নেই। যতক্ষণ খুশি ঘুমোতে পারবে। যেখানে খুশি যেতে পারবে। শেষ পরীক্ষার দিনই মাহিমা ব্যাগপত্র গুছিয়ে মামার বাড়ি চলে এসেছে। মীরা মাহিমা দু’জন ইভান ভাইয়ের ঘরে গিয়ে লাউড স্পিকারে মিউজিক চালিয়ে বেডের উপর উঠে লাফাচ্ছে। যতক্ষণ পা ব্যথা না হয়েছে ততক্ষণ নেচেছে। ক্লান্ত হয়ে ধপাস করে শুয়ে পড়ে মীরা বলল,

“বড় ফুপুর বাসায় আমাদের কে দিয়ে আসবে? ছোট চাচ্চুকে বলব?”

“তোদের বাড়িতে আমাকে বেড়াতে দিবি না? অন্তত এক সপ্তাহ এখানে থাকি।”

“থাক তুই। তোকে না করেছে কেউ?”

“তুই তো খালামনির বাসায় যাওয়ার কথা বলছিস। যাব রে যাব। একটু সবুর কর।”

🌸

দুই দিন বাড়িতে ঘুমানোর পর তিন দিনের মাথায় নিজেরাই বিরক্ত হয়ে উঠল। আগে ভেবেছিল পরীক্ষার পর ঘুমিয়ে দিন পার করবে। এখন মনে হচ্ছে বাড়িতে কিছুতেই সময় কাটছে না। ছোট চাচ্চুকে ধরে অনেক রিকোয়েস্ট করে রাজি করিয়েছে ওদের ট্রেনে সিলেট নিয়ে যেতে হবে। কারণ এর আগে কেউই ট্রেনে উঠেনি। ছোট চাচ্চু রাজিও হয়েছিল। কিন্তু বাঁধ সাধলো তাদের বান্ধবী রিমু। রিমুর জন্মদিন। অনেক বড় করে পার্টি করবে। বান্ধবী কেউ একজনও না গেলে কেক কাটবে না। এ কি মুসিবত। রিমু কলে প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলেছে,

“স্কুল জীবন শেষ করে এখন কি ফ্রেন্ডশিপ ভুলে যাবি? বলেছিলি সারাজীবন ফ্রেন্ড থাকবি। এখন তো এক সপ্তাহও যায়নি ভুলে গেছিস আমাকে।”

ওর কান্নাকাটি দেখে মাহিমা মীরা ঠিক করল আচ্ছা সিলেট তাহলে দুইটা দিন পরেই যাই।
সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে দুই বান্দরকে শান্ত থাকতে দেখে ইভান জিজ্ঞেস করল,

“কি গো বইনেরা, আমনেরা সিলেট যাইবেন না?”

দু’জনই একসাথে নাবোধক মাথা নাড়ল। ইভান অবাক হওয়ার ভান করে মুখে হাত দিয়ে বলল,

“কেন গো?”

মীরা টোস্টে কামড় দিতে দিতে বলল,

“আমাদের ফ্রেন্ডের জন্মদিন ইভান ভাই। জন্মদিন খেয়ে পড়ে যাব।”

ইভান হাসতে হাসতে বলল,

“জন্মদিন খায় কেমনে রে রাক্ষস? বল কেক খেয়ে যাব।”

মাহিমা তার প্লেট থেকে সেদ্ধ ডিমটা টুক করে ইভান ভাইয়ের প্লেটে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

“ছোট মামী দেখার আগে টুপ করে খেয়ে ফেলো না। নইলে ছোট মামী ঠেলেঠুসে আমাকে ডিম খাওয়াবে। ইয়াক।”

আস্ত ডিমটা মুখে পুরে দিয়ে মুখ ভরে চিবোতে চিবোতে ইভান বলল,

” বান্ধবীর জন্মদিনের গিফট কেনা শেষ?”

মীরা জবাব দিল,

“না।”

“কার সাথে যাবি? মন চাইলে আমার সাথে চলতে পারিস। পিচ্চি পিচ্চি বোন বলে শুধু দয়া দেখাচ্ছি।”

“তুমি নিয়ে যাবে!”

মীরা মাহিমা দু’জনই খুশি হয়ে ইভান ভাইকে জড়িয়ে ধরল। মাহিমা বলল,

“ইভান ভাই তুমি জানো তুমি কত ভালো! আমার নিজের ভাইয়ের থেকেও ভালো। আমার ডিম আমি রোজ তোমাকে দিয়ে দিব।”

“তোমার ডিম আমি খামু না আপা। মুরগির ডিম খামু।”

ইভান এদের পাগলামি দেখে হাসছে। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে এসেছে তবুও এদের বাচ্চামি কমলো না।
গিফট কিনতে গিয়ে আরেকটা ঘটনা ঘটলো। অনেকদিন পর মুবিন ভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে গেল। মুবিনকে দেখেই মাহিমা মীরাকে কনুই দিয়ে ধাক্কা দিল। মীরা রেগেমেগে তাকাল। ওদের দেখে মুবিন নিজেই এগিয়ে এলো। ইভানকে দেখে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“কেমন আছেন ভাইয়া?”

“আরে মুবিন নাকি! কতদিন পর দেখা। আমাদের ওদিকে যাস না কেন? কী করছিস এখানে?”

“কিছু কেনাকাটা করতে এসেছি।”

“ওহ। মাঝে মধ্যে সময় পেলে আমাদের বাড়িতে যাস। এখন তো আর যাসই না।”

“সময় হয়ে উঠে না ভাইয়া।”

মুবিন মীরার দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে বলল,

“পরীক্ষা কেমন হয়েছে?”

“ভালো।”

“শুধু ভালো? এ প্লাস আসবে তো?”

“ইনশাআল্লাহ ভাইয়া।”

“আম্মু তোমার কথা মনে করে। আমাদের বাড়িতে যেও।”

ইভান আর মুবিন কথা বলতে বলতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। মাহিমা পেছন থেকে মীরার হাত টেনে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,

“আম্মু মনে করে? নাকি দুলাভাই নিজে মিস করে।”

মীরা চোখ মুখ গরম করে মাহিমার দিকে ফিরল। চাপা শাসন করে বলল,

“দুলাভাই কাকে বলছিস? উনার সাথে কি আমার বিয়ে হয়েছে। বেশি পকপক করবি তো উনার সাথে তোর বিয়ে দিয়ে দিব।”

ইভান মুবিনকে জিজ্ঞেস করছে,

“জায়িন কি বাড়ি আসে না?”

চলবে…

যারা যারা পড়ছেন কষ্ট করে রিয়েক্ট কমেন্ট করবেন।#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা

🌸

এক দোকানের সামনে বিশাল বড় একটা টেডিবিয়ার দেখে মীরা দাঁড়িয়ে পড়ল। ইভানকে ডেকে জানাল এই দোকানে যাবে। ইভান মুবিনকে বিদায় দিয়ে ওদের সাথে এসে দোকানে ঢুকলো। দু’জনই এই টেডিবিয়ারটা নিবে ইভান এদের ছেলেমানুষী দেখে হাসবে না কাঁদবে ভুলে গেছে। এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ফেলেছে এমন একটা মেয়েকে তারা জন্মদিনে টেডিবিয়ার গিফট করতে চাচ্ছে। ইভান দুইটাকে ধমকে অন্য কিছু নিতে বলল। মাহিমা বলল,

“টেডিবিয়ার দিলে সমস্যা কি ভাইয়া? রিমুর তো টেডিবিয়ার পছন্দ।”

“সমস্যা কিছু না। লোকে তোদের গাধা বলবে। আর আমাদের বংশকে কিপ্টা বলবে।”

মীরা মনোক্ষুণ্ণ হয়ে বলল,

“গিফট কি দাম দেখে দেয় মানুষ? পছন্দ হওয়াটা বড় কথা।”

“বোনেরা আমার তোদের যা খুশি নে। তবে তাড়াতাড়ি কর।”

মাহিমা মীরা নিজেদের দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিল। ইভান ভাইকে সহজে পাওয়া যায় না। পুরো সপ্তাহ অফিস করে। এক শুক্রবারের দিন একটু বাড়ি থাকে। আজ যখন পেয়েছে তাহলে এত সহজে ছাড়বে না। ইভানের তাড়া থাকলেও বোনদের আবদার মিটাতে হলো। গিফট কিনা শেষে আইসক্রিম খেল। মাহিমা মীরার জোড়াজুড়িতে ওকেও খেতে হলো।

“তোরা কি আমাকে বাচ্চা পেয়েছিস! তোদের সাথে এখন আমার আইসক্রিম খেতে হবে!”

“আইসক্রিম ফ্যাক্টরির মালিক কি আইসক্রিম বানানোর সময় বলে দিয়েছে এটা শুধু বাচ্চারাই খাবে। বড়রা খেলে জরিমানা হবে।”

মীরা কথা শেষ করলে মাহিমা বলল,

“আর আমরা বাচ্চা না। এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ফেলেছি। কয়দিন পর কলেজে যাব।”

ইভান ওদের কথা শুনে হাসতে হাসতে বলল,

“না তোরা বাচ্চা হতে যাবি কেন? তোরা তো বুড়ি। আমার দাদী নানী।”

🌸

জন্মদিনের পার্টিতে কী পরে যাবে এটা নিয়ে দুপুর থেকে ভাবছে। তবুও এখনও কিছু ঠিক করে উঠতে পারছে না। মীরা আলমারির সব কাপড় নামিয়ে বেডের উপর রেখে বসে আছে। রুশমি কাপড়চোপড় এলোমেলো করছে। ফ্লোরে ফেলছে। মাহিমা গালে হাত দিয়ে বলল,

“কতদিন ধরে শপিং করি না! একটা নতুন কাপড়ও নেই।”

“আমার তো পুরান কাপড়ও নেই।”

তনি রুমে ঢুকে রুমের এই অবস্থা দেখে হতাশ হয়ে কতক্ষণ দুই গাধার দিকে তাকিয়ে রইল। ফ্লোরে পড়ে থাকা কাপড় পা দিয়ে সরিয়ে ভেতরে ঢুকলো।

“তোরা দুই জঙ্গল ঘরটাকে জঙ্গলে পরিণত করেছিস কেন?”

মীরা মাহিমা দু’জনই তনি আপুর দিকে তাকাল। মাহিমা গালে হাত দিয়ে বসে মন খারাপ করা গলায় বলল,

“আমাদের কোন ড্রেস নেই আপু।”

তনি চোখ ঘুরিয়ে পুরো রুমটা দেখে নিল। বিছানা, মেঝেতে কাপড়ের ছড়াছড়ি। তবুও এরা বলছে কাপড় নেই! তনি চোখ বড়ো বড়ো করে বলল,

“এতগুলো তো কাপড় না৷ গাছের ছাল। আদিম যুগের মানুষের মতো তোদের এখন গাছের ছাল পরিয়েই রাখা উচিত। না শোকর বান্দা।”

এদের ঘ্যানঘ্যান শুনে তনি আপু শাড়ি পরার আইডি দিল। শাড়িতে কেউই অভ্যস্ত না। কিন্তু শখও তো কম না। দু’জনই নাচতে নাচতে রাজি হয়ে গেল। কিন্তু সমস্যা একটা। দু’জনের কারোরই শাড়ি নেই। তনি আপু তার নিজের দুইটা শাড়ি দু’জনকে পরিয়ে দিল। মাহিমা আবেগের চোটে বলে উঠল,

“তুমি কত ভালো তনি আপু। তোমাকে বিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠাব না। সারাজীবন আমাদের কাছেই রেখে দিব।”

মীরা মাহিমাকে চোখ টিপলো। ভুল করে মুখ ফসকে বলে ফেলেছে। কিন্তু তনি কিছু মনে করল না। উল্টো হেসে ওদের সুন্দর করে সাজিয়ে দিল।
সেজেগুজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেরাই নিজেদেরকে চিনতে পারছে না। মীরা কালো কালারের জর্জেট শাড়ি পরেছে। মাহিমা খয়েরী রঙের। দু’জনকেই অসম্ভব সুন্দর লাগছে। মীরা মাহিমাকে দেখে বলল,

“কইতরি তোরে যে কী সুন্দর লাগছে রে!”

“মীরাবাঈ তোমাকেও হেবি সুন্দর লাগছে।”

মামী, চাচীকে বলে ওরা বেরুবার সময় রুশমি বায়না ধরল সে-ও সাথে যাবে। ওকে কাঁদিয়ে রেখে আসতে হয়েছে। মাহিমা বাইরে বেরিয়ে বলল,

“বাচ্চাগুলা দিনদিন বড় বেয়াদব হচ্ছে। তুই ছোট মানুষ তুই জন্মদিনের পার্টি কী বুঝিস? চুপচাপ মা’র কোলে বসে ফিডার খা। তা না, সে বড় বোনদের সাথে জোড়া ধরে।”

🌸

রিমুদের বাড়ি বেশি দূরে না৷ এক এলাকায় হলেও রিমুদের বাড়ি এলাকার শেষ সীমানায়। সন্ধ্যার পরে ওরা বেরিয়েছে। রাতে কেক কাটা হবে। মীরা রিমুর জন্য সেই টেডিবিয়ারটাই নিয়েছে। এত্ত বড় টেডিবিয়ার কোলে নিয়ে আসার সময় সবাই তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। মাহিমা রিমুর জন্য স্পেশাল একটা গিফট এনেছে। সে সাবধানে সেই বক্সটা হাতে নিয়ে হাঁটছে। রিমুদের বাড়ির সামনে এসে রিকশা থেকে নেমে মাহিমা ভাড়া নিয়ে ঝগড়া শুরু করে দিল। মীরা বারবার বলেও ওকে পুরো ভাড়াটা দেওয়াতে পারল না। এইটুকু জায়গা আসার জন্য রিকশাওয়ালা একটু বেশিই ভাড়া চাচ্ছে। মাহিমা কিছুতেই ন্যায্য ভাড়ার বেশি এক টাকাও দিবে না। মীরা মেয়েটার উপর বিরক্ত হয়ে ওকে রেখেই রিমুদের বাড়ির ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। সে টেডিবিয়ারটাকে কোলে নিয়ে গেট দিয়ে ঢোকার সময় অন্যমনস্ক হয়ে বারবার পেছনে তাকানোর ফলে একটা লোকের সাথে ধাক্কা খেল। এবং ধাক্কা খেয়েই থেমে থাকল না। হিল জুতো দিয়ে লোকটার পা মাড়িয়ে দিয়ে নিজেও পড়ে যেতে নিল। কিন্তু লোকটা তাকে পড়তে দিল না। শক্ত দু’টো হাত তার কোমর জড়িয়ে ধরল। অপ্রত্যাশিত এই স্পর্শে মীরার গায়ে কাটা দিয়ে উঠল। সে মানুষটাকে গালি দেওয়ার জন্য মুখ খোলার আগে সামনে থেকে টেডিবিয়ার সরিয়ে যাকে দেখল, তাকে দেখে ওভাবেই পাথরের মতো কঠিন হয়ে রয়ে গেল। তার জীবনে যত অঘটন আছে সব কি জায়িন ভাইয়ার সামনেই ঘটতে হয়!
কুকুরের দৌড়ান। পড়ে গিয়ে কোলে ওঠা। এখন ধাক্কা খেয়ে পা মাড়িয়ে দেওয়া। ইশ লজ্জা!
জায়িন শান্ত চোখে মীরার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে না সে বিরক্ত বা ব্যথা পেয়েছে। এই লোকের সবসময় এতটা স্বাভাবিক থাকাই মীরার কাছে অস্বাভাবিক লাগে। মীরা তাড়াহুড়ো করে জায়িনের থেকে সরে দাঁড়াতে চাইল। এবং তখন আরেকটা অঘটন ঘটলো। মীরার শাড়ি জায়িনের পায়ের নিচে থাকায় মীরা সরতে গেলে তার কুঁচিই খুলে গেল। মীরা আর্তনাদ করে উঠে শাড়ির কুঁচি চেপে ধরল। এবার জায়িনের চেহারায় সামান্য ভাব পরিবর্তন লক্ষ করা গেল। যাক লোকটা পাথর না। রিয়েক্ট করতে জানে। মীরাই তাড়াহুড়ো করে আগে বলে উঠল,

“সরি ভাইয়া। এক্সট্রিমলি সরি। আমি দেখিনি। সত্যি বলছি, একটুও বুঝে পাড়া দিইনি।”

মীরা হয়তো জায়িনের শার্ট খামচে ধরেছিল। তাই কুঁচকে গেছে। জায়িন শার্টের ভাজ ঠিক করতে করতে গম্ভীর গলায় বলল,

“হু।”

তখনই মাহিমা আসে। মীরাকে কারো সাথে কথা বলতে দেখে পেছন থেকেই ডাকে।

“কে রে মীরা? কার সাথে কথা বলছিস?”

মাহিমা ওদের কাছে এসে দাঁড়াল। জায়িনকে দেখে চেনা চেনা মনে হলেও ঠিক মনে করতে পারল না। তবে ছেলেটা যে-ই হোক ভীষণ হ্যান্ডসাম। হিল জুতা পরেও লম্বাতে ওরা কাঁধের সমান হতে পারছে না। মাহিমা চলে আসায় মীরা ফের একবার অপরাধী কন্ঠে বলল,

“সরি ভাইয়া।”

যেতে যেতে কয়েকবার পেছনে ফিরে মাহিমা জায়িনকে দেখতে দেখতে প্রশ্ন করল,

“ছেলেটা কে রে মীরা? আর তুই সরি বলছিলি কেন?”

মীরা তার তৃতীয় তম গাধামির কথা মনে করে ফোঁস করে দম ফেলল। হতাশ গলায় বলল,

“মুবিন ভাইয়ের বড় ভাই।”

মাহিমা অবিশ্বাস্য গলায় প্রায় চেঁচিয়ে বলল,

“ইনি জায়িন ভাই! সেজন্যই তো চেনা চেনা লাগছিল। উনাকে আমি চিনি। ছোট বেলায় কত দেখেছি। ভাইয়ার বন্ধু। কতবার ভাইয়ার সাথে আমাদের বাড়িতে গেছে। ইশরে, দেখলি জায়িন ভাইকে চিনতে পারলাম না। এজন্যই এলাকার ছেলেপিলে গুলোকে এলাকাতেই থেকে যেতে হয়। বাইরে গেলেই অচেনা হয়ে যায়। তা উনাকে সরি বলছিলি কেন?”

“গেট দিয়ে ঢোকার সময় ধাক্কা খেয়ে পা মাড়িয়ে দিয়েছি। দেখ কত উঁচু হিল পরেছি। পা মনে হয় কানা হয়ে গেছে।”

“ইশশ! কী করলি এটা? আহা, অনেক ব্যথা পেয়েছে হয়তো।”

হঠাৎ লোকটার প্রতি মাহিমার এত দরদ দেখে মীরা চোখ মুখ বাঁকিয়ে মাহিমার দিকে দেখল।

“হঠাৎ উনার জন্য তুই এত দরদ দেখাচ্ছিস কেন?”

“ওমা, আমার ভাইয়ের বন্ধু। এলাকার সিনিয়র ভাই। তোর স্যারের বড় ভাই। দরদ দেখব না! কিন্তু উনি এখানে কী করছেন? রিমুর আত্মীয় টাত্মীয় হয় নাকি? উনাকেও দাওয়াত দিয়েছে?”

🌸

রিমুর সাথে দেখা করে ওকে টেডিবিয়ারটা ধরিয়ে দিয়ে মীরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। হাত দু’টোকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল,

“তোর এই গিফট নিয়ে আসতে আসতে আমার হাত ব্যথা হয়ে গেছে।”

মাহিমাও তার আনা গিফটটা রিমুকে দিয়ে দিল। সাবধানী বাণী আওড়িয়ে বলল,

“খবরদার যদি মানুষের সামনে খুলেছিস! এখন খুলবি না। সবাই চলে গেলে একা রুমে খুলবি।”

রিমু চোখে মুখে সন্দেহ নিয়ে জানতে চাইল,

“কী আছে এর ভেতরে?”

“আছে। অনেক দামী একটা গিফট। এখন খুলে দেখলে আসল মজা পাবি না।”

“রিমু আমার সাথে একটু রুমে আসবি? শাড়ি খুলে গেছে। কুঁচি ঠিক করে দিবি।”

রিমু হাসতে হাসতে বলল,

“তোরা শাড়ি পরতে গেলি কেন? অবশ্য শাড়িতে তোদের অনেক সুন্দর লাগছে। কিন্তু মানুষের সামনে বারবার কুঁচি খুলে গেলে তো ইজ্জতের দফারফা হয়ে যাবে।”

রুম থেকে শাড়ি ঠিক করে ওরা লনে চলে এলো। লনেই পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। অনেক মানুষ এসেছে। মীরা মাহিমা রিমুর কাছে দাঁড়িয়ে আছে। মাহিমার চোখ দূরে দাঁড়ানো জায়িনের উপর পড়তেই সে কৌতূহলে ফেটে পড়ে বলল,

“জায়িন ভাই তোদের কী হয় রিমু? উনিও এসেছেন! তোদের আত্মীয়?”

মাহিমার দেখাদেখি মীরা রিমু দু’জনই জায়িনের দিকে তাকাল। জায়িন কয়েকজন ছেলের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তার কানে ফোন। ফোনে কারো সাথে কথা বলছে হয়তো। রিমু হেসে বলল,

“জায়িন ভাই আসবে না! তোর জন্মদিনে তোর চাচাতো ভাই না এসে থাকবে?”

মীরা মাহিমা দু’জনই অবিশ্বাস্য চোখে রিমুর দিকে তাকাল। জায়িন ভাই রিমুর চাচাতো ভাই। মাহিমা হতভম্ব গলায় বলল,

“জায়িন ভাই তোর চাচাতো ভাই! আগে তো বললি না।”

“আপন চাচাতো না। আমার আব্বুর চাচাতো ভাইয়ের ছেলে। তবে আপন চাচাতো ভাইয়ের থেকেও বেশি।”

মীরা জায়িনকে দেখছে। নখ উলটে ফেলার ওই ঘটনার পরে জায়িন ভাইয়ের সাথে আর দেখা হয়নি। তিনি চলে গিয়েছিলেন। মীরাও পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। উনি এখনও রিকশা ভাড়ার টাকা আর একটা ধন্যবাদ পাওনা মীরার কাছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here