#মন_ছুঁয়েছে_সে
#পর্বসংখ্যা_১৩
#মৌরিন_আহমেদ
একা একা নদীর পাড়ে হাঁটছে ধ্রুব। সামনেই একটা কাশবনের ঝোপ। সেখানে ফুটে আছে থোকায় থোকায় সাদা কাশফুল। ও একহাতে ফুলগুলোয় হাত বুলাচ্ছে আর নদীর স্বচ্ছ পানির দিকে তাকিয়ে আছে। খানিকটা অন্যমনস্ক। বাইরের দিকে আপাদত মন নেই। কারণ মস্তিষ্কে চলছে জটিল একটা জট খোলার প্রচেষ্টা। ও জানে না সে জট খুলতে পারবে কি না। আর সে জট সমাধান করে ও শেষ পর্যন্ত বাঁচবে কি না। তবুও কাজটা ওকে করতে হবে! কারণ এটা ওর দায়িত্ত্ব। যেটা পালন না করলে ওর কাজের সাথে হবে বেইমানি। দেশের মাটির সাথেও!
ধ্রুব তার নিজের চিন্তায় এতটাই ডুবে ছিল যে কখন যে পেছনে এসে কেউ দাড়িয়ে গেছে সেটা খেয়ালই করেন নি। যখন বুঝতে পারলো পাশে কেউ আছে ততক্ষনাত সজাগ হয়ে গেল ওর কান। পেছনে না ফিরেই তীক্ষ্ণ ভাবে বোঝার চেষ্টা করল অজ্ঞাত ব্যক্তির মতিগতি। সে চুপ করে আছে। একটুও নড়ছে না। তারমানে এটা আক্রমণের পূর্বলক্ষণ। ভেবেই একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল মেরুদন্ড বেয়ে। চট করে ঘুরে শত্রুকে আক্রমণ করতে গিয়েই অবাক হতে হলো ওকে! দ্রুতবেগে চলমান হাতটা থেমে গেল। অজ্ঞাত ব্যক্তি কোনো পুরুষ নয় নারী। মেয়েটা অনন্যা!
ওকে দেখেই বিস্ময়ে স্থির হয়ে গেল ধ্রুব। অবাক স্বরে বললো,
– আপনি এখানে?
প্রশ্ন শুনে এক গাল হাসলো অনন্যা। হাত তুলে একটা দিকে কী যেন দেখালো। ধ্রুব সেদিকে তাকিয়েই দেখতে পেল ওখানে একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে। সে নিজের ফোনে ছবি তোলায় ব্যস্ত। অনন্যা ওকে দেখিয়ে বললো,
– কানিজের সাথে এদিকটায় যাচ্ছিলাম। তাতেই আপনাকে দেখে চলে এলাম….
এতক্ষণে কারণটা বেশ বোঝা গেল। ম্যাডাম তবে এজন্য এখানে এসেছেন। আর ধ্রুব কি না কি ভেবে বসেছিল! যাক, বাঁচা গেল! ভাবতেই একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। অনন্যার দিকে তাকিয়ে মেকি হাসি দিয়ে তাকাতেই ও বললো,
– কেমন আছেন?
– ভালো।
খুব ছোট করেই উত্তর করলো ধ্রুব। ভদ্রতা অথবা সৌজন্যতার খাতিরেও পাল্টা জিজ্ঞেস করল না যে ও কেমন আছে। মানুষ তো এ ক্ষুদ্র ভদ্রতা করেই! কিন্তু ও তার ধারে কাছেও গেল না। সেই জিনিসটা চিন্তা করেই যেন একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় অনন্যা। ছেলেটা কী ওর ব্যবহারে বিরক্ত হচ্ছে? তাই ওর সাথে সামান্য ভদ্রতা টুকুও করতে চাইছে না? তাহলে কি ও ভুল করছে? অহেতুক একটা মানুষকে বিরক্ত করছে? তাই ইতস্তত করে বললো,
– আপনি কি কোনো জরুরি কিছু করছিলেন?… আমি এসে কি বিরক্ত করে ফেললাম?
প্রশ্ন শুনে সরু চোখে তাকালো ধ্রুব। বোঝার চেষ্টা করলো হঠাৎ মেয়েটার এই চিন্তাধারা হওয়ার কারণ কি। বুঝতে না পেরে বললো,
– বিরক্ত হই নি মোটেই। সরকারি জায়গা আসতেই পারেন.. তবে মনোযোগ ক্ষুন্ন হয়েছে, প্রকৃতির মাঝে থেকে ভাবছিলাম তো!
– ভাবছিলেন? কী ভাবছিলেন? আপনি কি লেখক গোছের কেউ?
হুট করেই প্রশ্নটা মাথায় আসে অনন্যার। ও খেয়াল করে দেখেছে ধ্রুব ছেলেটা সবসময় যেমন একা একা হাঁটে তেমনই হাঁটার সময় কি যেন চিন্তা করে। তার কাঁধের ব্যাগটায় একটা নোট প্যাডের মতো খাতাও আছে। হাঁটতে হাঁটতেই টুকটুক করে কী যেন লিখে ফেলে ও। সেই থেকেই প্রশ্নটা মাথায় এসেছে। ধ্রুব কোনো লেখক বা গবেষক গোছের কেউ!
হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠলো ধ্রুব। অনন্যা মুগ্ধ চোখে সে হাসি দেখতে গিয়ে কী কী কথা সাজিয়ে রেখেছিল সব গুলিয়ে ফেললো। আশ্চর্য! ছেলেটার হাসি দেখলেই সব গুলিয়ে যায় কেন? ও হাসতে হাসতেই বললো,
– ম্যাডাম তবে আমায় রাইটার ভেবেছিলেন? হা হা হা… শুনুন, আমি ও জাতের কেউ নই। রাইটার হতে বুদ্ধি লাগে, ধৈর্য লাগে আমার ওসব নেই। আর নেই বলেই আজ আমি ভবঘুরে। যাকে বলে ভ্যাগাবন্ড! হা হা হা!
অনন্যা বিমোহিত দৃষ্টিতে চেয়ে বললো,
– আপনি ভীষন অন্যরকম একজন মানুষ! আপনার কাজকর্ম, চিন্তাধারা সব অন্যরকম!.. আচ্ছা, আপনি কি বিয়ে করেছেন?
অনেকদিন ধরেই প্রশ্নটা করি করি করেও করা হচ্ছিল না। ধ্রুব বিবাহিত কি না। অথচ কিছুতেই করা হয়ে উঠছিল না! এই কথাটা ওকে জিজ্ঞেস করতে বলেছে কানিজ। কারণ কানিজের ধারণা ধ্রুব ছেলেটা কোন বড়লোক বাবার সন্তান, যে কি না কোনো কাজকর্ম না করে ভবঘুরে জীবন যাপন করে। ভবঘুরে হওয়ার পেছনে কোনো মেয়েজনিত ঘটনাও থাকতে পারে। নাহলে এমন উদাসী হওয়ার আর কারণ কি?
যদিও এ ব্যাপারটা নিয়ে খুব একটা ভাবে নি অনন্যা। কারণ কানিজ সেই শুরু থেকেই ধ্রুবকে সহ্য করতে পারে না। কোনো শত্রুতা নেই অথচ ওর সম্পর্কে এমন বিদ্বেষী মনোভাবের কারণ কী সেটাই ভেবে পায় না ও!
আবারও হাসলো ধ্রুব। ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
– এমন ভ্যাগাবন্ড টাইপের মানুষের কখনো বিয়ে হয়, শুনেছেন?… আর বাংলাদেশের কোন বাবা আছে যে তার মেয়েকে এমন ছেলের সাথে বিয়ে দেবে?.. আপনার বাবা কি দেবে?
বলেই ভ্রু নাচালো ধ্রুব। সেটা শুনেই লজ্জা পেয়ে মাথা নামিয়ে নিলো অনন্যা। আচ্ছা, ছেলেটা এ কথাটা কেন বললো? তারমানে কি সেও ওকে পছন্দ করতে শুরু করেছে? ভেবেই আরও লজ্জা পেল। ওর লজ্জিত লাল আভায় ছেয়ে যাওয়া গাল দু’টো দেখে বেশ মজা পেল ধ্রুব। বললো,
– আপনি লজ্জা পাচ্ছেন।.. আপনাকে এখন কেমন দেখাচ্ছে জানেন? ঠিক নতুন বউয়ের মতো!..
বলেই ঠোঁট টিপে হাসলো। অনন্যা হঠাৎ বোকা বোকা চেহারায় বললো,
– আমি তো বিয়ে করি নি, তাহলে নতুন বউয়ের মতো লাগবে কি করে?
– আপনি সত্যিই ভীষন বোকা!
এবার হো হো করে হেসে উঠলো ধ্রুব। ওর হাসি দেখেই নিজের বোকামিটা বুঝতে পারলো অনন্যা। আসলে ও কিন্তু বোকা নয়। অথচ এই ছেলেটার সামনে আসলেই ও বোকা হয়ে যায়। নিজের সাজানো- গোছানো সব কথা গুলিয়ে ফেলে ইতস্তত করে। আবার হুট করেই এমন বোকা মার্কা কথা বলে লজ্জায় নুইয়ে পড়ে। এটা কেন হয় সে জানে না। এটাকেই কী ভালোবাসা বলে?
হাসি থামিয়ে কিছুটা ধাতস্থ হলো ধ্রুব। অদূরে দাড়িয়ে থাকা কানিজকে দেখিয়ে বললো,
– আপনার বান্ধবী কানিজ অপেক্ষা করছে.. সে বিরক্ত হচ্ছে না?
এতক্ষণে কানিজের কথা মনে পড়লো ওর। ধ্রুবের কাছে আসার জন্য ওকে যখন বলেছিল তখনই না করে দিয়েছিল ও। অনেক কিছু বলে, ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে দুমিনিটের কথা বলে এখানে এসেছে। আর সেখানে এসে দাড়িয়ে দাড়িয়ে হাসাহাসি করলে ও ক্ষেপবে না বুঝি?
তাই ভাবলো ওর কাছে যাওয়া উচিত। কিন্তু ধ্রুবের সঙ্গও ওর ভালো লাগছে। এখনি এখান থেকে চলে যেতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে আরও কিছুক্ষণ থাকতে পারলে ভালো হতো!
কি করবে ভেবে দ্বিধান্বিত হলো ও। কানিজের কাছে না গেলে ও রাগ করবে আবার ধ্রুবকে ছেড়ে গেলে ওর নিজেরই ভালো লাগবে না, তবে কী করা উচিৎ? অনেক ভেবে শেষ পর্যন্ত নিজের মনকেই জয়ী করলো ও। ফোন হাতে নিয়ে চট করে মেসেঞ্জারে ঢুকলো।টুপ করে একটা মেসেজ সেন্ড করে দিয়ে ধ্রুবের দিকে তাকিয়ে বললো,
– ও বিরক্ত হবে না.. কিছুক্ষণ পর চলে যাবে…
– সে কি! আপনি একা যাবেন?
কী যেন ভাবলো অনন্যা। তারপর বললো,
– এরপর আপনি কোথায় যাবেন? ফ্ল্যাটে না?
– যাবো হয় তো।.. ঠিক করি নি…
কথাটা শুনেই মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর। খুশি হয়ে বললো,
– তাহলে তো আপনার সাথেই যেতে পারবো, কি আমাকে সাথে নেবেন না?
– আগেই বলেছি রাস্তা সরকারি.. চাইলেই যেতে পারেন…
অনন্যার উজ্জ্বল মুখটা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে আরো কিছুক্ষণ ওর সাথে থাকতে পারবে ভেবে। মাথা ঘুরিয়ে কানিজের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল সে রক্তিম মুখে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। মানে মেসেজটা পেয়ে সে যে মহা ক্ষেপা ক্ষেপেছে সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে! ও অনন্যার দিকে তাকিয়ে রাগে বিড়বিড় করে কি যেন ইশারা করে চলে গেল গটগটিয়ে। ভীত চোখে সেদিকে তাকিয়ে আবারও ধ্রুবের দিকে চোখ ফেরালে ও। বললো,
– শুধু কি দাড়িয়েই থাকবেন, না একটু হাঁটাহাঁটিও করবেন?
– তা বেশ চলুন।
বলে ওরাও কানিজের পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করলো। হাইওয়েতে উঠেই একটা রিকশা নিয়ে বাড়ির পথে চলে গেল কানিজ। যাবার সময় অনুর দিকে তাকিয়ে আরেকবার চোখ রাঙানিতেও ভুললো না। সেটা দেখে মনে মনে যথেষ্ট ভীত হলেও নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করলো অনন্যা। কারণ বন্ধুর রাগের চেয়ে প্রিয় মানুষের সঙ্গ অনেক বেশি সুখের।
ও ফোনটা ব্যাগে ঢুকাতে ঢুকাতে কী যেন ভেবে বললো,
– আচ্ছা, আপনার ফেসবুক আইডি-টাইডি নেই? কি নামে আছে?
কথা শুনে সরু চোখে তাকালো ধ্রুব। চট করে বললো,
– ওসব জিনিসে আমার আগ্রহ নেই।…
– তাহলে হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্ট্রা?
– উহুম।
মাথা নাড়ল ধ্রুব। নিভে যাওয়া প্রদীপের মতো ‘দপ’ করে আলো হারালো অনন্যার মুখ। নিরস মুখে বললো,
– তাহলে ফোন নাম্বারটা তো দেবেন?… নাকি সেটাও নেই?
ধ্রুব শব্দ করে হাসলো। ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
– আমি ফোন ইউজ করি না।
– কীহ?
হঠাৎ আঁতকে উঠল ও। এ যুগে কেউ ফোন ইউজ করে না, এটাও কি বিশ্বাস যোগ্য?
– জ্বি। ফোন জিনিসটাকে আমার কাছে বিরক্তিকর লাগে। শুধু শুধু সবজায়গায় ওটাকে বয়ে বেড়ানো!…
– তাহলে মানুষের সাথে যোগাযোগ করেন কীভাবে?… আর আপনার আত্মীয় স্বজনরাই আপনার খবর পায় কী করে?
– আত্মীয়-স্বজন থাকলে তো যোগাযোগ করবে?.. আমার তেমন কেউই নেই… তাই খোঁজ নেয়ার দরকারও নেই…
– কেউ নেই মানে? আপনার বাবা-মা?
– গত হয়েছেন। আজ পাঁচ সাত বছর হবে।
হুট করে মনটা খারাপ হয়ে গেল অনন্যার। ওকে কথাটা ওভাবে জিজ্ঞেস করা উচিত হয় নি। ছেলেটা নিশ্চয় মন খারাপ করেছে! ভেবেই মাথা নিচু করে বললো,
– আমি বুঝতে পারি নি… সরি!
ওর মন খারাপের ব্যাপারটা অগোচর থাকলো না ধ্রুবের কাছে। ও কী যেন একটা ভেবে বললো,
– সরির কিছু নেই। দশ- বারো বছর আগে কেউ মারা গেলে তার জন্য কষ্ট পেতে নেই… আমি পাই না। ভাবিও না তাদের কথা…
হাসার চেষ্টা করলো ছেলেটা। অনন্যা অপ্রতিভ চাহনিতে ওর দিকে তাকালো। তার মলিন হাসির তালে নিজেও হাসলো। দুজনেই হেঁটে চললো গন্তব্যের দিকে।
#চলবে——-