#মন_ছুঁয়েছে_সে
#পর্বসংখ্যা_১৬
#মৌরিন_আহমেদ
ধলপ্রহরের আগে। ঘড়ির কাঁটায় সময় রাত তিনটা পঁয়তাল্লিশ। এখনো চারপাশ নিকষ কালো অন্ধকারে ছেয়ে আছে। বিশাল এ নগরীর গগনচুম্বী দালানগুলোর সবগুলিই এখন নিরব, নিস্তব্ধ। রাস্তায় গাড়ির আনাগোনাও কম। সেটা এখন বেওয়ারিশ কুকুরদের দখলে। কুকুর পরিবার পরম নিশ্চিন্তে এখানে স্থান করে নিয়েছে।
এই নিরব নিস্তব্ধ পরিবেশেও হঠাৎ আঘাত হানলো জিপ গাড়ির তুমুল শব্দ। একসাথে অনেকগুলো গাড়ি এসে ঢুকলো গলির ভেতর। খুব দ্রুত গতিতে সেগুলো এসে থামলো বস্তির প্রবেশদ্বারে। একের পর এক গাড়িগুলো এসে থামলো সারি করে।
প্রথম গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন একজন স্বশস্ত্র সৈনিক। পুরো শরীর কালো পোশাকের আচ্ছাদনে আবৃত। মাথায় কালো হেলমেট আর পায়ে কালো রঙের বুট জুতো। পোশাকের উপরে আলাদা আরো একটা বর্ম ধাঁচের কাপড়। এটা ওদের ব্যক্তিগত সুরক্ষার জন্য পরা। যার বুক সাইডে ও পিঠের দিকটায় বড় বড় সাদা অক্ষরে লেখা RAB-13। ডান হাতে একটা রাইফেল।
সে বেরতেই এক এক করে বাকি গাড়িগুলো থেকেও সৈনিকেরা বেরিয়ে আসতে শুরু করলো দলবদ্ধ হয়ে। ‘ধুপধাপ’ পায়ের আওয়াজে সরব হয়ে উঠলো পরিবেশ। ক্যাপ্টেন আর একমুহুর্ত দেরি করলো না। বাম হাত তুলে কি যেন ইশারা করেই দ্রুত বস্তির ভেতরে ঢুকে গেল। তার পেছন পেছন চলতে শুরু করলো বাকিরা।
ভেতরে ঢুকতে ঢুকতেই বিশাল বড় বড় দলটা ছোট ছোট আকারে ভাগ হয়ে গেল। লিডার এবং দশ-বারো জন ছুটে চলে এলো সেই ঘরটার সামনে। ভেতরে খুব আওয়াজ হচ্ছে। খুবই অশ্লীল ধরনের কথাবার্তার ছিটে ফোঁটা কানে আসছে। ক্যাপ্টেন সাহেব শুধু একমুহুর্ত কি যেন ভাবলেন। হাত তুলে কড়া নাড়তে গিয়েও থেমে গেলেন। তার ঠিক পেছনে দাড়িয়ে থাকা সৈনিকটি কে কি একটা নির্দেশনা দিয়ে সরে গেলেন সামন থেকে। সে যেন সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। চট করে এগিয়ে এসে পরীক্ষা করে নিল দরজাটার ধারণ ক্ষমতা। তারপর হাতের রাইফেলের বাট দিয়ে কষে মারলো এক ঘা।
হঠাৎ শব্দ শুনে ভেতরের সব কিছু চুপ করে গেল। নিরব হয়ে উঠলো পরিবেশ। কিন্তু শুধু সেই মুহূর্তই। দরজা দিয়ে একে একে প্রবেশ করলো ক্যাপ্টেন আর তার অধীনের স্বশস্ত্র সৈনিকেরা। আচমকা Rapid action battalion এর লোকদের দেখে চমকে উঠলো ভেতরের দুজন। দুজনেই রয়েছে বেশ আপত্তিকর পরিস্থিতিতে।
নিজের বিমূঢ়তা কাটিয়ে নিলো ওরা খুব দ্রুতই। কাঁথা টেনে মেয়েটা নিজেকে আবৃত করার চেষ্টা চালালো। কিন্তু পুরুষটি মানে বস্তির তথাকথিত মালিক মালেক হঠাৎ করে একটা বোকার মতো কাজ করলো। তড়িৎ গতিতে বিছানা ছেড়ে উঠে টেবিলের উপরে থাকা কাঁচের বোতল তুলে ক্যাপ্টেনকে আঘাত করার চেষ্টা করলো। কিন্তু লাভ হলো না। মুহূর্তেই দুজন সৈনিক ধরাশায়ী করে ফেললো তাকে।
কারখানায় কাজ চলছে। কাঁচের বোতল গুলোতে একে একে ঢালা হচ্ছে মদ। বিদেশি ওয়াইনের বোতল গুলো কার্টুনে ভরছে কয়েকজন। হুইস্কি, শ্যাম্পেন, ওয়াইন সব আলাদা আলাদা করে। তড়িৎ গতিতে কাজ চালাচ্ছে তারা। রাত পোহাবার আগেই সব সেরে ফেলার নির্দেশ আছে তাদের। আজই চালানটা দিতে হবে।
হঠাৎ ধুপধাপ আওয়াজে থেমে গেল তাদের কাজ। কীসের আওয়াজ হচ্ছে সেটা বোঝার চেষ্টা করলো ওরা। কিন্তু কিছু বোঝার আগেই ‘খট’ করে শব্দ হয়ে সামনের দরজাটা খুলে গেল। প্রথমেই দেখা গেল একজন স্বশস্ত্র সৈনিককে। তিনি রাইফেল তাক করে চেঁচিয়ে উঠলেন,
– হ্যান্ডস আপ!
সবাই একে অপরের দিকে বোকার দৃষ্টিতে তাকালো। দেখতে দেখতেই বিশাল সে ঘরটা ভরে উঠলো কালো পোশাকধারীতে। বাধ্য হয়েই হাত তুলে নিজেদের স্যারেন্ডার করলো ওরা। সামনে পেছনে রাইফেল উঁচিয়ে লাইন করে, ওদের বাইরে নিয়ে এলো সৈনিকেরা।
একে একে পুরো বস্তিবাসীর ঘর চেক করলো rab এর লোকজন। যে যে অবস্থাতেই ছিল সে অবস্থাতেই ধরা পড়ে গেল। সব কুকীর্তি সব অপকর্মের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের ধরে ফেলা হলো। যারা চালাকি করার চেষ্টা করেছিল তারাও রাইফেলের দু এক ঘা খেয়ে সোজা হয়ে গেল।
ভোরের আলো ফোটার আগেই অপারেশন সাকসেসফুল হলো। অপরাধীদের হ্যান্ডকাপ পরিয়ে, কোমরে মোটা দড়ি বেঁধে একে একে বাইরে আনা হলো। এরই মধ্যে হাজির হয়েছে অপরাধীদেরনিয়ে যাওয়ার জন্য আরেকটা বড় জিপ। একজন অফিসার উঠে গিয়ে সেটার দরজা খুলে দিল। তারপর লোকগুলোকে তুলে মুখের উপর ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিল।
এরই মধ্যে ধুলো উড়িয়ে চোখের সামন দিয়ে চলে গেল ক্যাপ্টেনের গাড়িটা। তারপর বড় জিপটা আর বাকি গাড়িগুলো। এখন সৈনিকদের সকলের মনেই আনন্দ। একটু আগেও প্রত্যেকের বুকের মাংসল পিন্ডটা থরথর করে কাঁপছিল। তুমুল উত্তেজনায় নিশ্বাস আটকে গিয়েছিল। তবে এখন শান্তি! অপারেশন সাকসেসফুল! এতো প্রতীক্ষিত অপারেশন!
_______________________________
ঘুম থেকে ওঠার পরেই হৈ চৈ কান্ড শুনলো অনন্যা। এলাকায় নাকি RAB এসেছিল। পুরো ব্যাটালিয়ন নিয়ে রেট করেছে বস্তিতে! হেরোইন, মদ আরও বেশ কিছু বন্দী নারীদেরউদ্ধার করেছে ওখান থেকে। অতর্কিত হামলা করার কারণে পালাতে পারে নি কেউই। সব কটাকে ধরে নিয়ে গেছে!
– বেশ হয়েছে!.. আমি তো ভাবতেই পারি না.. আমাদের এলাকায় কী না মাদক ব্যবসা?.. উচিৎ হয়েছে!
উচ্ছসিত হয়ে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করলেন লেবু মামা। দৃষ্টি তার টিভি স্ক্রিনে। বস্তির বর্তমান অবস্থাকে লাইভ টেলিকাস্ট করা হচ্ছে এখন। সকাল থেকে শুরু হয়ে সাংবাদিক আর ক্যামেরাম্যান দের আনাগোনা চলছে। মামা উচ্ছ্বসিত হয়ে একের পর এক মন্তব্য করে যাচ্ছে কিন্তু অনন্যা কিছু বলছে না। বরং খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে পানসে মুখে বসে আছে। সকাল থেকে এলাকায় কি কি হয়ে গেছে কিছুই জানতো না ও। বাড়ির পেছনের বস্তিতেই যে মাদক ব্যবসায়ীদের আঁখড়া সেটা কখনো আন্দাজও করতে পারে নি ওরা। আজ টিভিতে খবর শুনে সব জানতে পারলো।
বেশ কয়েকটা রেপও না কি হয়েছিল বস্তিতে। অসহায় দুস্থ, শিশু আর মেয়েদের টাকার লোভ দেখিয়ে আনা হতো ওখানে। তারপর সুযোগ বুঝে বিদেশে পাচার করে দিত। আর মাদক চোরাচালান? এরা যেমন বিদেশি ড্রাগস ডিলিং করতো, সাথে নিজেরাও উৎপাদন করে। কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার-স্যাপার! ভাবতেই শিউরে ওঠে শরীর!
______________________________
পড়ন্ত বিকেলের রোদ এসে পড়েছে রাস্তায়। ধ্রুব সে পথে হাঁটতে হাঁটতে বস্তির দিকে যাচ্ছে। সারা সকালে অনেক কাহিনী হয়ে গেছে ওখানে। rab এর রেট পড়েছে, অনেক লোক ধরা পড়েছে আবার মেয়েগুলোকেও উদ্ধার করা হয়েছে। তাই এখন একবার ওখানে যাওয়ার খুব দরকার মনে হচ্ছে ওর। RAB এর হেডকোয়ার্টারে গিয়ে খোঁজ নিয়ে এসেছে। কিন্তু মিনারার খোঁজ পায় নি।
তাই ধারনা করছে হঠাৎ করে RAB দেখে কোথাও লুকিয়ে পড়েছে ও। ভীড় কমলেই ধরা পাওয়া যাবে। ওর খোঁজ পেলেই সাথে করে নিয়ে যাবে। ওদের গ্রামে গিয়ে হাজির হবে। মেয়েটা বলেছিল ওর মার খুব অসুখ, গ্রামে যেতে হবে। এখন ওকে ওখানেই দিয়ে আসা উচিত!
ধ্রুব বস্তির ভেতরে ঢুকলো। চারদিকে কেমন নিরব-শান্তপরিবেশ! গা ছমছম করছে। ও দ্রুত পায়ে হেঁটে মিনারাদের থাকার ঘরটার সামনে চলে এলো। ওর নাম ধরে ডাকলো,
– মিনু! এই মিনু! ঘরে আছিস? বেরিয়ে আয়… আমি ধ্রুব…
ভেতর থেকে কেউ সাড়া দিল না। ধ্রুব ধীর পায়ে হেঁটে দরজার কাছে এলো। ওটা হালকা ভেজানো আছে। কড়া ধরে আওয়াজ করতে করতে ডাকলো,
– মিনারা!
দরজা ‘ক্যাচ ক্যাচ’ শব্দ করে খুলে গেল। ভেতরে শুধুই আঁধার। কালোরা সব ধোঁয়াশা করে আছে। ধ্রুব অবাক চোখে ডাক দিলো,
– মিনু!
অন্ধকারে ওর কথারই প্রতিধ্বনি ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাওয়া গেল না।
পুরো বস্তিতে মিনারাকে খুঁজে বেরালো ধ্রুব। হন্নে হয়ে খুঁজেও কোনো দিশকুল পেল না। বুঝতে পারলো মিনু এখানে নেই। পাচারকারীরা ওকে অন্যকোথাও পাচার করে ফেলেছে!
হঠাৎ নিজেকে খুব অসহায় মনে হলো ওর কাছে। মনে হলো এ দুনিয়াতে ওর কেউ নেই! মিনারা নামের চোদ্দ বছরের কিশোরীটি ওকে কী গভীর মায়াময় করে ‘ভাইজান’ বলে ডাকতো!
মনে পড়লো ওর সাথে শেষবার দেখা হওয়ার সময় কি করুণ আকুতিই না করেছিল মেয়েটা! বাড়ি যাবার জন্য। অসুস্থ মাকে দেখার জন্য।
হঠাৎ নিজের কাছেই নিজেকে খুব ছোট মনে হতে লাগলো। বড্ডো অসহায়, ব্যর্থ, অভাগা লাগলো। মেয়েটা ওর কাছে শুধু আবদার করে ছিল গ্রামে যাবার জন্য, কিন্তু ও তার সেই আবদারটা রাখতে পারে নি। মিনুকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যেতে পারে নি। পারে নি নিজের কথা রাখতে!
সন্ধ্যা নামার আগে আগেই বস্তি থেকে বেরিয়ে এলো ধ্রুব। আজ আর কোত্থাও যাবে না সে। মনটা খারাপ। খারাপ মন নিয়ে কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না।
ফ্ল্যাটে ঢুকেই সোজা নিজের ঘরে চলে গেল। কোনমতে ফ্রেশ হয়ে এসে শুয়ে পড়ল বিছানায়। এখন একটু ঘুম দরকার! গভীর ঘুম!
#চলবে——-