#মন_ছুঁয়েছে_সে
#পর্বসংখ্যা_১৮
#মৌরিন_আহমেদ
খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠে অনন্যা। আজ বেশ তৃপ্তিমত ঘুমিয়েছে ও। সচারাচর ঘুম খুব পাতলা হলেও আজ একটু গভীর ঘুমই হয়েছে তা বেশ বুঝতে পারে। হাই তুলতে তুলতে বিছানা থেকে নামে। ঝাড়ু হাতে বিছানা ঝাড়া দিয়ে, কাঁথা ভাজ করে বিছানাটাকে পরিপাটি করে নেয়। তারপর বাথরুমে যায় ফ্রেশ হওয়ার জন্য।
ফ্রেশ হয়ে এসেই কি যেন মনে হলো অনন্যার। খেয়াল করলো ব্যালকনির দরজাটা আধখোলা! ব্যাপারটা। চোখে লাগলো ওর। স্পষ্টই মনে আছে কাল নিজে হাতে ওটা লাগিয়েছিল। তাহলে খুললো কীভাবে? নাকি অন্য কেউ… ভাবতে ভাবতেই এগিয়ে এলো। নাহ্, কোথাও তো কিছু নেই! কেউ যে এখানে এসেছিল কি না সেটা বোঝা যাচ্ছে না। ব্যালকনিটা ভালো করে পরখ করলো অনু। কিন্তু কিছু না পেয়ে নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিলো, হয় তো মনের ভুলই হবে!
প্রকৃতি আজ বড্ডো উদার! তার উত্তাল সমীর ছড়িয়ে দিচ্ছে চারিদিকে। বাতাসের দমকায় জানালা-দরজার পর্দাগুলো যেন উড়িয়েই নিয়ে যাচ্ছে। ভীষন গর্বে তাদের বুক যেমন ফুলে ফেঁপে উঠছে ঠিক পরক্ষনেই আচমকা বায়ুবেগে টালমাটাল অবস্থাও হচ্ছে! প্রকৃতির হঠাৎ এমন অবস্থার কারণ বুঝলো না অনন্যা। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো সেখানে প্রবল গতিবেগে কালো মেঘের ছড়াছড়ি। গুরুগম্ভীর রূপ ধারণ করা আকাশ দেখলেই বোঝা যায় এ কোন ঝড়ের পূর্বাভাস! যে কোনো সময়েই ঝুমঝুমিয়ে ঢল নামবে ধরণীতলে!
অসময়ে বৃষ্টি নামতে পারে ব্যাপারটা নিয়ে মোটেও মাথা ঘামালো না অনন্যা। বরং পরম শান্তিতে দাড়িয়ে রইলো ব্যালকনির রেলিং ধরে। উথাল-পাথাল হাওয়ায় তার খোলাচুল উড়ে যাচ্ছে, তাতে সে বিরক্ত হচ্ছে না। কপালের চুলগুলো যখন প্রবল বেগে মুখের উপর আছড়ে পড়ছে তখন সামান্য অস্বস্তি হলেও সেটাকে বিশেষ পাত্তা দিলো না। প্রফুল্ল চিত্তে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কিছুক্ষণ পর ছয়তলার ওই বিল্ডিংটার পানেও তাকালো। যদি কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটির দেখা পায়!
_______________________
ধ্রুব এলাকায় নেই সেটা বুঝতে বেশ কিছু দিন সময় লাগে অনন্যার। যেহেতু ওর সাথে নিয়মিত দেখা সাক্ষাৎ হতো না তাই ও যে এখানে নেই সেটা সহজে মাথায় আনে না। এরপর রোজ ভার্সিটি যেতে-আসতে, এমনই কোনো কাজে বাসা থেকে বেরোতে গিয়েও যখন ধ্রুব সাহেবের পাত্তা পায় না তখনই বিষয়টা প্রথমে চোখে লাগে ওর!
ধারণা করে ধ্রুব হয় এলাকায় নেই নয় তো বাসাতেই আছে, কিন্তু বেরোচ্ছে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাসায় থাকলে লোকটা বেরোবে না কেন? এ চিন্তাও মাথায় জেঁকে বসে। ধ্রুবের পরিচিত কাউকে চেনে নাফোন নাম্বারও নেই, তাই ঠিকমতো খোঁজ করতে পারে না। শুধু চাতক পাখির ন্যয় ধ্রুবের পথপানে চেয়ে থাকে। কবে সে আসবে, কবে দেখা হবে!
ওর জন্য আজকাল সবসময়ই চিন্তামগ্ন থাকে অনন্যা। বেশি বেশি লাইব্রেরি যাতায়াত, সিনেমা হলের সামনে যাওয়া, ক্যান্টনমেন্ট, শহুরে অলিগলি সবকিছুই চষে বেড়ায় ধ্রুবের সন্ধানে! একবার ভাবে সরাসরি বাড়ি চলে যাবে। কিন্তু কোন ফ্ল্যাটে থাকে সেটাও তো জানা নেই ওর!
ধ্রুবকে নিয়ে ওর এমন পাগলামিতে চরম বিরক্ত হয় কানিজ। বিরক্ত কণ্ঠে বলে,
– অনু এই পাগলামি বন্ধ করবি তুই?
অনন্যা রাগী চোখে তাকায়। আজ পাঁচ সাত দিন ধরে এই একটা কথাই বলে যাচ্ছে কানিজ। পাগলামি বন্ধ কর, মাতামাতি বন্ধ কর, লাফালাফি বন্ধ কর। কেন? কেন ও ধ্রুবকে দেখতে পারে না? কেন ধ্রুবের কথা শুনলেই এমন করে? কেন ওর মনের কথা বুঝতে চায় না? ও না অনুর বেস্ট ফ্রেন্ড? তবে কেন ওর মন খারাপের সময়ে ওকে সান্ত্বনা না দিয়ে, ওর কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেবে? কেন?
অনন্যা কঠিন গলায় জবাব দেয়,
– না!.. বন্ধ করবো না। আমি ধ্রুবের কাছে যাবো!
– তো যা!.. আমার মাথা কেন খাচ্ছিস?.. দেখ, আমি তোকে বারবার বলছি এই ছেলেকে তুই ভুলে যা! ভুলে যা।.. তাও কথা কেন শুনছিস না?
– কেন ভুলে যাবো?
চিৎকার করে ওঠে অনন্যা,
– আচ্ছা, কানিজ। তুই আমাকে বলবি তুই কেন ওকে ভুলে যেতে বলছিস? কেন ওকে তুই দেখতে পারিস না?.. নাকি আমি ওকে ভালবাসি বলে তুই ওকে মেনে নিতে পারছিস না? তুই কি চাচ্ছিস, আমি ওকে না পাই? ওকে না পাওয়ার কষ্টে আমি ধুকে ধুকে মরে যাই?.. তুই আসলে আমার বন্ধুই না, কানিজ! তুই আমার শত্রু!.. তুই চলে যা। চলে যা, এখান থেকে।
বলতে বলতে বিছানায় বসে পড়ে অনন্যা। রাগ আর অভিমানে ওর চোখে পানি চলে এসেছে। ও দুহাতে মুখ ঘষে কপালে তোলে। শক্ত করে চেপে নিজের চুল নিজেই খামচে ধরে। মাথা নিচু করে ফোঁপাতে থাকে। কানিজ হঠাৎ কি করবে ভেবে পায় না। ধীর পায়ে ওর দিকে এগিয়ে যায়। কাঁধে আলতো করে হাত রেখে বললো,
– অনু!
– আমাকে ধরবি না তুই।…যা এখান থেকে!
ঝটকা মেরে ওর হাতটা সরিয়ে দেয় অনন্যা। নিজের দুঃখে কাঁদতে থাকে। ওর ব্যবহারে হঠাৎ যেন আহাম্মক হয়ে যায় কানিজ। বুঝতে পারে নিজের ভুলটা। ওকে এভাবে বলা উচিত হয় নি। বেচারি খুব কষ্ট পেয়েছে।
হাঁটু মুড়ে ওর সামনে এসে বসে। খুব ধীরে ধীরে ওর হাত দু’ টো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
– তুই আমাকে ভুল বুঝছিস, দোস্ত!.. আমি মোটেই তোর খারাপ চাই না। কখনোই চাই নি। আর আজও চাইবো না।.. শুধু বলবো যা করবি ভেবে চিন্তে করবি!
– আমি যা করি, ভেবেই করি।
কাঁদতে কাঁদতেই জবাব দেয় অনন্যা। কানিজের তাতে কিছু যায় আসে বলে মনে হয় না। ও বেশ শান্ত গলায় বললো,
– না, করিস না। যদি করতি তাহলে এমন ছাগলের মতো কাঁদতি না।
ওর কথা শুনে অনন্যা রাগী চোখে তাকায়। এ দৃষ্টি কে বলে অগ্নিদৃষ্টি। চোখ দিয়ে তাকিয়েই যাকে ভস্ম করা যায়। কঠিন কণ্ঠে বললো,
– আমি ছাগলের মতো করে কাঁদি? তারমানে কি আমি ম্যা ম্যা করি? আমি ছাগল?
– তা নয় তো কী? জানিস, তোকে কেমন লাগছে? একদম ছাগলের মতো!… লম্বা লম্বা চুলওয়ালা ছাগল!.. আচ্ছা, আরেকটু কাঁদ তো, আমি একটা পিক তুলে নেই। কাঁদ না, ফেসবুকে আপলোড দিলে তো একেবারে ভাইরাল হয়ে যাবি!
বলেই নিজের ফোনটা হাতে নেয় কানিজ। ছবি তুলবে এমন ভঙ্গি করে বললো,
– নে, নে শুরু কর।.. বল,” ও আমার ধ্রুব গো!.. তুমি কই গেলা গো!.. ও আমার হিমু গো!”
অনন্যা ভয়ঙ্কর রাগ করে ওকে মারতে যায়। দু’ হাতে মারমুখী করে বলে,
– তবে রে, আজ তোর হচ্ছে!
কানিজ দুহাতে নিজের মুখ ঢেকে ফেলে। অন্য দিকে তাকিয়ে গলা ফাঁটিয়ে ডাকে,
– হিমু ভাইজান, বাঁচান!… আপনার রূপা আমাকে মেরে ফেললো!.. হিমু ভাইজান গো!
কানিজ কে ইচ্ছেমত পিটিয়ে তবেই ক্ষান্ত হয় অনন্যা। কানিজও যে ছেড়ে দেয় তাও নয়। দু’ জনে ইচ্ছেমত মারামারি করে ক্লান্ত হয়ে বসে। কানিজ একগ্লাস পানি খেতে খেতে বললো,
– বুঝলি, অনু। তুই তো ওই হিমুর শোকে রাক্ষস হয়ে গেছিস! কী জোরে জোরে খামচে দিয়েছিস আমায়! মাগো মা, এখনো জ্বলছে!
– জ্বলার জন্যই দিয়েছি! হুহ!
বলেই মুখ ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকায় অনন্যা।
– বুঝছি!… তোরে ওই হিমুপাগলার কাছে না পাঠালে তুই আমাকেই মেরে ফেলবি।.. যে রাক্ষসী হয়ে উঠেছিস না! কোনদিন যে মানুষ খুন করবি কে জানে!… কিন্তু কথা হলো হিমু গেল কই? ওকে আগে খুঁজে বের করতে হবে!…
– খুঁজে দে না!..
আবদারি সুরে বলে ওঠে ও। কানিজ একবার ওর দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবতে শুরু করে। অনন্যা অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে ওর মুখের দিকেই তাকিয়ে থাকে। পলকও ফেলে না। ব্যাপারটা খেয়াল করে বিরক্ত হয় কানিজ। চোখ মুখ কুঁচকে বললো,
– ডিস্টার্ব করবি না তো, অনু। ওদিকে তাকা… আমাকে আমার মতো ভাবতে দে!
অনন্যা মুখ ফুলিয়ে ওর সামন থেকে উঠে যায়। ভাবুক ভাবুক স্টাইলে সারা ঘরময় পায়চারি শুরু করে।
– পেয়েছি!
হঠাৎ আনন্দে চিৎকার করে ওঠে কানিজ। সেটা কানে যেতেই ও লাফ দিয়ে ছুটে আসে ওর কাছে। উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলে,
– কী পেয়েছিস?.. বল, তাড়াতাড়ি বল!
কানিজ কিছু বলতে যাবে তার ঠিক আগেই পাশের ঘর থেকে অনন্যার মা জোহরা বেগমের কণ্ঠ শোনা যায়। উনি ও ঘর থেকে বলে ওঠেন,
– তোদের কী হয়েছে রে?.. এতো চেঁচামেচি কীসের?
– কিছু না, মা!
মায়ের উদ্দেশ্যে কথা বলেই ওর দিকে তাকিয়ে নিজের ঠোঁটে আঙ্গুল দেয়। দু পাশে ঘন ঘন মাথা নাড়িয়ে আস্তে কথা বলার নির্দেশ দেয়। কানিজও নির্দেশমতো নিজের ঠোঁটে আঙ্গুল ধরে একইভাবে মাথা নাড়ায়। কিছুক্ষণ পর অনন্যা খুব ধীরে উত্তেজিত ভঙ্গিতে ওর সামনে বসে বলে,
– এই, কী পেয়েছিস?
– ধ্রুবকে পেয়েছি!.. শোন, ও যে বিল্ডিংয়ে থাকে সেখানে তো আমরা যেতে পারি!.. চিনি তো ওটা!..
– গিয়ে?
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে প্রশ্ন করে ও। কানিজ তার বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা নিয়ে উত্তর দেয়,
– গিয়ে ওখানকার ওয়াচম্যান কে ধরবো।.. বলবো, ধ্রুব সাহেব কোন ফ্ল্যাটে থাকে বলে দেন!..
– ওখানে কোনো ওয়াচম্যান নেই!
হতাশ কণ্ঠে ঘোষণা করে অনন্যা। কানিজের বুদ্ধিটা ভালো ছিল। কিন্তু সেটা কাজে লাগবে না। গেটে ওয়াচম্যান না থাকলে কার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে ধ্রুব কোথায়?
– ধ্যাত! কিপ্টে বাড়িওয়ালা একটা ওয়াচম্যানও রাখতে পারে নি!
শ্রাগ জানায় কানিজ।
#চলবে——-