#মন_ছুঁয়েছে_সে
#পর্বসংখ্যা_৩
#মৌরিন_আহমেদ
পরদিন সকালে ভার্সিটি যাবার জন্য বেরোল অনন্যা। গেট দিয়ে বের হতেই চোখে পড়লো ধ্রুবকে। ওও এইমাত্র বিল্ডিং থেকে বেরিয়েছে। ওকে দেখেই মনটা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলো ওর। যাক, আরেকবার কথা বলা যাবে! ধ্রুব অবশ্য ওকে দেখেনি। তাই এতক্ষণে ও অনেকটা। দূরে এগিয়ে গেছে। ও যখন হাইওয়েতে উঠতে যাবে ঠিক তখনই ওকে ডাক দিয়ে বসলো অনন্যা,
– এই যে ধ্রুব সাহেব! একটু দাড়াবেন?
ডাক শুনেই থেমে গেল ধ্রুব। মাথা ঘুরিয়ে একবার ওকে দেখেই দাড়িয়ে পড়লো। সুযোগ বুঝে অনন্যাও প্রায় ছুটেই ওর কাছে এসে উপস্থিত হলো। হাঁফাতে হাঁফাতে বললো,
– এতো সকাল সকাল কোথায় যাচ্ছেন?
প্রশ্ন শুনে সামান্য হাসলো ধ্রুব। বললো,
– যাদের কাজ থাকে না তাদের কাছে সকালই কি আর বিকেলই কি? একসময় বেরোলেই হয়…..
– ওহ্। তা কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় যাচ্ছেন না এমনি হাঁটাহাঁটি!
– যাই দেখি, কোথায় যাওয়া যায়!
অনন্যা বেশ বুঝলো ও কোথায় যাচ্ছে সেটা নিয়ে ঘেঁটে লাভ নেই। কারণ ছেলেটা সেটা বলতে চাচ্ছে না। নাহলে দু’বার প্রশ্ন করার পরও এমনভাবে এড়িয়ে যাওয়া বেমানান। হয় সত্যিই তার কাজের কোনো ঠিক নেই নয় তো যেখানে যাবে সেটা সম্বন্ধে বলতে চাচ্ছে না। ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং লাগলো ওর কাছে। আচ্ছা, ধ্রুব কেন যেন ওকে একবারও বললো না ‘ আপনি কেমন আছেন অথবা কোথায় যাচ্ছেন?’ ছেলেটা এমন কেন? নুন্যতম ভদ্রতাও নেই? একটা মেয়ে যেচে যেচে কথা বলতে আসছে আর তার সাথে ভালোমন্দ কোনো কথাও বলবে না? এটা কেমন কথা? ভাবতে ভাবতেই ধ্রুব হঠাৎ বলে উঠলো,
– ভার্সিটি যাওয়ার ইচ্ছে নেই নাকি? আমার সাথে হাঁটছেন যে?
কথাতা শুনেই অবাক হলো অনন্যা। ও যে ভার্সিটিতে যাচ্ছে সেটা এই ছেলেটাকে কে বললো? অবাক হয়ে জানতে চাইলো,
– আমি যে ভার্সিটি যাচ্ছি সেটা আপনাকে কে বললো? এটা জানলেন কি করে?
এবার বেশ শব্দ করেই হাসলো ধ্রুব। অনন্যা বোকার মতো চেয়ে থেকে সে হাসি প্রত্যক্ষ করলো। প্রিমোলার দাঁতটা বাঁকা থাকলে বুঝি সবার হাসিই এমন সুন্দর লাগে? ধ্রুব হাসতে হাসতেই বললো,
– আপনি যে রোজ সকালে ভার্সিটি যান সেটা কিন্তু আমি জানি!..
আবারও ওর অবাক হওয়ার পালা! এ খবরটাও সে অবগত? ভাবতেই সে আবারও বললো,
– আমি যে প্রশ্নটা করলাম সেটার উত্তর তো দিলেন না।.. ভার্সিটি তে যাবেন না? হেঁটে বেড়াচ্ছেন যে?
– হেঁটে বেড়ালে কি অসুবিধা? বিরক্ত হচ্ছেন?
ধ্রুব আবারও হাসলো। তবে এবার অন্য দিকে তাকিয়ে। হাসি থামিয়ে বললো,
– সমস্যা হবে কেন? সরকারি রাস্তায় যে কেউই হাঁটতে পারে। আমার তাতে অসুবিধা হওয়ার তো কোনো কারণ নেই… আর হলেও বা আপনি মানবেন কেন? আপনারও তো অধিকার আছে…
– তাহলে একসাথেই হাঁটি? কি বলেন?
– হাঁটুন।.. কিন্তু শেষে ভার্সিটি যেতে না পারলে তার জন্য আমি দায়ী নই!…
সে কথায় একগাল হাসলো অনন্যা। সামনের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতেই বললো,
– সমস্যা নেই। মাঝেমাঝে দু’ একটা ক্লাস মিস দিলে তেমন কিছুই হয় না। আর আমি ক্লাস মিস দেবোও না!.. হাঁটতে হাঁটতে ভার্সিটি অবধি যাবো!
– কিন্তু আমি তো ওই রাস্তায় যাবো না। তাহলে?
– যতদূর যাবেন ততদূরই যাবো!.. তারপর রিকশা নিয়ে নেব! ব্যস!
এ কথা শোনার পর আর কিছু বলার থাকে না ধ্রুবের। তবে ও কোনোভাবেই চাচ্ছে না অনন্যা ওর সাথে যাক! হাঁটাহাঁটি করার সময় পাশে কেউ থাকলে সেটা খারাপ লাগে না। বরং ইনজয় করা যায়। কিন্তু কাজের কোনো জায়গায় যাওয়ার সময় কাউকে সাথে নেয়া অবশ্যই ঝামেলাদায়ক! এবং সেটা সমস্যার। কিন্তু অনন্যার কথা শুনে মনে হচ্ছে না ও ওর সাথে শেষ অবধি যাবে। আবার এটাও মনে হচ্ছে না যে ওকে মাঝপথে রেখে ভার্সিটি চলে যাবে। কারণ ও যে কোনো জরুরী কাজে যাচ্ছে ব্যাপারটা তো আর ও জানে না। ভাবছে উদ্দেশ্যহীন ঘুরাফেরা। হতেও তো পারে ভার্সিটির ক্লাস ছেড়ে উদ্দেশ্যহীন ঘোরাফেরার প্রতি আগ্রহী হয়ে গেল! তখন তো পিছে লেগে যাবে ওর! উঠতি বয়সের মেয়েদের তো এমন কতশত আগ্রহই দেখা যায়!
আসলে ধ্রুব যেটা ভাবছিল সেই একই কথা অনন্যাও চিন্তা করছিল। ও বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল ঠিকই ভার্সিটি যাবার জন্য, কিন্তু ধ্রুবকে দেখার পর মন থেকে সে চিন্তা বেরিয়ে গেছে। এখন ভাবনা হচ্ছে কোন একটা কজ দেখিয়ে ধ্রুবের সাথে হেঁটে বেড়ানো। ওর সাথে ভাব জমানো! মাঝে মাঝে এমন উদ্দেশ্যহীন হতে তো ভালই লাগে!
কিন্তু সে চিন্তা সফল হলো না ওর। ধ্রুব একটু দূরে এগোতেই জানিয়ে দিল যে ওখান থেকে ওর পথ ভিন্ন। ও এখন অন্য রাস্তায় হাঁটবে। আর যেদিকে যাচ্ছে সেদিক দিয়ে অনন্যা তার ভার্সিটি তে যেতে পারবে না!
তাই বাধ্য হয়েই ধ্রুবের সঙ্গ ত্যাগ করতে হলো ওকে। ব্যাপারটা নিয়ে ভীষণ মন খারাপ হলো ওর। এভাবে সাথছাড়া করলো ওকে? ও যে ধ্রুবের সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করছে ব্যাপারটা কী ও বুঝলো না? মনটা এভাবে ভেঙে দিতে পারলো?
মন খারাপ করে ভার্সিটিতে এলো অনন্যা। আজ ওর আগে থেকেই এসে বসে আছে কানিজ। ওর মুড খারাপ দেখে অবাক হয়ে জানতে চাইলো ঘটনা কি। অনন্যা ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছিল না। কারণ ঘটনাটা শুনলেই ও হাসতে শুরু করে দেবে! নয় তো বিরক্ত হয়ে বলবে,
– এতো মাতামাতি কেন করিস তুই?
তারপর একগাদা লেকচার শুনিয়ে দেবে! তবুও শেষ পর্যন্ত ওর চাপে পড়ে সমস্ত ঘটনা খুলে বলতে বাধ্য হলো সে। অবশ্য না বলেও বা করবে কি? কলিজার বন্ধু, কোন কথাশেয়ার না করলে পেট ফেটে মরে যাবে না? কিন্তু সবটা শুনে সত্যিই খুব হাসাহাসি করলো কানিজ। টিটকারী মেরে বললো,
– এতো কিছু বললি, বোঝাবার চেষ্টা করলি তবুও তোর হিমু তোকে পাত্তাই দিলো না? আসলেই, তোর হিমু একটা বলদ! ব-ল-দ! কিচ্ছুটি বোঝে না! হা হা হা!
কথাগুলো শুনতে একটুও ভালো লাগে না অনন্যার। বরং মনে মনে খুব খারাপ লাগে। তবে সেটা বুঝতে দিতে চাইলো না ওকে। কারণ কানিজ ব্যাপারটা ধরতে পারলে আরো বেশি করে ক্ষেপাতে শুরু করে দেবে! তাই রাগ দেখিয়ে বললো,
– হয়েছে তোর ঢং করা? এবার চল ক্লাসে যাই?
– দাড়া আরেকটু হেসে নেই!.. হা হা হা
– নাহ্, খবরদার আর হাসবি না!
বলেই বাহু ধরে টানতে টানতে নিয়ে এলো ক্লাসে।
অনন্যাকে বিদায় দিয়ে মনে খুব শান্তি পেল ধ্রুব। সত্যি কথা হলো ও আসলেই অনন্যাদের ভার্সিটির দিকে যাচ্ছিল। সেখানেই ওর কাজ আছে। কিন্তু সেটা জানতে দিতে চায় নি ওকে! নয় তো ও ঠিক ঠিক ওর সাথে ভার্সিটি অবধিই চলে আসতো। আর ওর সাথে গেলে নিশ্চয় ও এখানে কী করছে ব্যাপারটা সম্বন্ধে জানার চেষ্টা করতো? সেটা অবশ্যই ওর পক্ষে ভালো হত না!
_____________________
ব্রেক টাইমে ক্যান্টিনে বসে আছে অনন্যা আর কানিজ। দু’জনের হাতেই দুটো রোল। রোল খেতে খেতে টুকটাক গল্প হচ্ছে ওদের। হঠাৎ কথা বলতে বলতে খেয়াল হলো ক্যান্টিনের পাশেই দাড়িয়ে আছে দু’টো পরিচত মুখ। দু’টো ছেলে পাশাপাশি দাড়িয়ে থেকে কথা বলছে। তাদের মধ্যে একজন ওদের ক্লাসের ছেলে, নাম সিয়াম। আর অন্যজন ধ্রুব!
ওকে দেখেই অবাক হয়ে গেল অনন্যা। সকালে না বললো এদিকে আসবে না ও? তবে এখন যে ভার্সিটিতেই এসে বসে আছে? ওকে মিথ্যে কেন বললো ছেলেটা? ভার্সিটিতেই যখন এলো তখন ওর সাথে এলো না কেন? ভালোই তো হতো দু’জনে গল্প করতে করতে আসতে পারতো! নাকি ধ্রুব ইচ্ছে করেই এমনটা করলো? ও কী চায় নি অনন্যা ওর সঙ্গে হেঁটে হেঁটে এতদূর আসুক?
ভাবতে ভাবতেই কথা শেষ হয়ে গেল ওদের। অনন্যা দেখতে পেলো ধ্রুব হাসি হাসি মুখ করে সিয়ামের সাথে হ্যান্ডশেক করলো। তারপর হাতটা বুকে ঠেকিয়ে কি যেন বলতে বলতেই বিদায় নিল ওর কাছ থেকে। ক্যান্টিনের ওপর পাশের রাস্তা ধরেই হেঁটে হেঁটে চলে গেল!
ও চলে যেতেই সিয়ামও এদিকেই আসতে লাগলো। ওদেরকে ক্রস করে চলে গেল ক্লাসে। নেক্সট ক্লাস শুরু হয়ে যাবে দেখে ওদের কেউ উঠতে হলো। কানিজ কে সাথে নিয়েঅনন্যাকেও যেতে হলো ক্লাসে। তাই ধ্রুবকে নিয়ে ভাবার জন্য অবকাশটা। আর হয়ে উঠলো না। তবে ওর সাথে আবারো দেখা করার এবং কথা বলার ইচ্ছেটা মনের ভেতর চাপিয়েই রাখলো সে। ছেলেটার প্রতি একটা আগ্রহ জন্মেছে ওর। সে আগ্রহ মেটাতেই হবে!
#চলবে—-