#মন_ছুঁয়েছে_সে
#পর্বসংখ্যা_৪
#মৌরিন_আহমেদ
আজও একা একা ভার্সিটিতে আসতে হলো অনন্যাকে। ও ভেবেছিল আজ কানিজ আসবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ও আসলো না। ও আসবে কি না সেটা জানার জন্য কলও করলো কয়েকবার। কিন্তু রিসিভ হলো না। তাই ভীষন মন খারাপ হলো ওর। এমনিতেই আজ ওর মন খারাপ তারমধ্যে কানিজ এলো না?
অবশ্য মনখারাপের কারণটা খুব গুরুতরকিছু না। ছোট্ট একটা ব্যাপার। গত দু’দিন ভারসিটিতে আসতে- যেতে ধ্রুবের সাথে দেখা হয়েছিল তার। তাই মনের ভেতর সুপ্ত একটা বাসনা জেগেছিল যে আজও তার দেখা পাবে! কিন্তু পুরো রাস্তায় কোথাও তার দেখা পেলো না। ওদের বিল্ডিংয়ের সামনে দাড়িয়েও ছিল বেশ কিছুক্ষণ। তবুও কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটির পাত্তা নেই! ভেবেই মন খারাপ করে ক্লাসে গেল অনন্যা।
বিকেলে কানিজের বাসায় গিয়েছিল ও। সকালে কানিজের কোনো খোঁজ না পেয়ে ওর মায়ের কাছে কল দিয়েছিল। তাতেই জানতে পারলো কাল সন্ধ্যায় হঠাৎ করেই জ্বর এসেছে কানিজের। খবর পেয়ে দুপুরে খাওয়ার পর ওদের বাসায় গিয়েছিল ওকে দেখতে। বেচারি একদিনের জ্বরেই কাহিল হয়ে পড়েছে। চোখ মুখের জীর্ণ দশা। জ্বরের কারণে কিছুই খেতে পারছে না। ফলে শুকিয়ে যেন কাঠ হয়ে গেছে! চোখ- মুখ ডেবে গিয়ে একদম মলিন দশা!
সন্ধ্যা নামার আগ দিয়ে কানিজদের বাসা থেকে বেরোল অনন্যা। রিকশা নিয়ে একটু দূরে এগোতেই নজরে পড়লো ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়া ধ্রুবকে। আশে-পাশে তেমন কেউ নেই। গোধূলী বেলায় নির্জন রাস্তা দিয়ে একা একা হেঁটে যাচ্ছে সে। এমন সুন্দর পরিবেশে তার হাঁটার সঙ্গী হলে খুব খারাপ হবে? নিশ্চয়ই না। তাই ওকে উদ্দেশ্য করেই ডাক দিল,
– ধ্রুব সাহেব!
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পেছনে ঘুরে তাকালো সে। তাকাতেই রিকশায় থাকা অনন্যাকে দেখতে পেলো। ওকে তাকাতে দেখেই হাত নেড়ে ওকে থামতে ইশারা করলো অনন্যা। তারপর রিকশাটা ওর কাছে এগিয়ে আসতেই প্রশ্ন করলো,
– বাসায় যাচ্ছেন, বুঝি?
ধ্রুব একমুহুর্ত কি যেন ভেবে মাথা নেড়ে সায় জানালো। সেটা দেখে ও হঠাৎ খুশি হয়ে উঠলো। বললো,
– আমিও তো বাসায় যাচ্ছি।… চলুন, আপনাকে নামিয়ে দেই?..
ওর কথা শুনে অবাক হলো ধ্রুব। ও মেয়েটার খুব পরিচিত কেউ নয়। দু’ একদিন রাস্তায় দেখা হয়েছে, টুকটাক কথা বলেছে। তাতেই ওর সাথে এভাবে এক রিকশায় যাওয়ার আবদার করছে? ব্যাপারটা একটু কেমন হয়ে যায় না?
অবশ্য ধ্রুব এই দু’ দিনেই মেয়েটার ব্যবহার দেখে বেশ অবাক হয়ে গেছে। মেয়েটাযে ওর প্রতিকিঞ্চিৎ দূর্বল আছে, ব্যাপারটা ধরে ফেলতে একটুও সময় লাগে নি ওর!
কিন্তু নিজের মনের ভাবটা ঠিক প্রকাশ করলো না ধ্রুব। চুপ করে দাড়িয়ে থাকলো। কথাটা বলার পরপরই হুশ হলো অনন্যার। ও বুঝতে পারলো অতিরিক্ত এক্সসাইটেডমেন্টে কী বলে ফেলেছে ও! এভাবে সরাসরি ওকে রিকশায় উঠতে বলা ঠিক হয় নি। আর তাতে ধ্রুবও ওকে খুব ভালো ভাবছে না! তাই চট করে আরেকটা কাজ করে ফেললো ও। চটপট রিকশা থেকে নেমে এলো। ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে রিকশাওয়ালা টাকে বিদায় করে দিল। ধ্রুবের দিকে তাকিয়ে বললো,
– চলুন, এবারে হাঁটি?
ধ্রুবও আর কিছু না বলে মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। দু’জনেই পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো ফুটপাত দিয়ে।
পাশাপাশি হাঁটছে ঠিকই কিন্তু মনে মনে ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে অনন্যা। কারণ একটু আগে ও যেভাবে ধ্রুবকে রিকশাতে উঠতে বলেছে তাতে যে ছেলেটা ওর সম্পর্কে অনেক উল্টোপাল্টা কথা ভেবে ফেলেছে তা ও নিশ্চিত! ইসস! এভাবে বলা উচিত হয় নি। ভেবেই লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে ওর। ধ্রুবের সাথে অনেক কথা বলারই ইচ্ছে ছিল ওর কিন্তু কেন যেন আর বলতে পারছে না। মুখ খুলতে গেলেই মনে না জানি আবার কী বলে বসে!
– লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। আমি আপনার কথায় কিছুই মনে করি নি।… একজন মানুষ আরেকজন মানুষের সাহায্য করতে চাইতেই পারে! সেটা তো স্বাভাবিক ব্যাপার, তাই না?
কথাটা কানে আসতেই অবাক চোখে ওর দিকে তাকালো অনন্যা। ও ঠিক সামনের দিকে তাকিয়েই হাঁটছে। ওকে তাকাতে দেখে একবার ওর দিকে তাকালো ধ্রুব। মুচকি হেসে বললো,
– আমার দিকে তাকিয়ে হাঁটলে রাস্তার ইটের সাথে হোঁচট খেয়ে পড়বেন!… আবার ফুটপাত থেকে পড়ে পা মচকেও যেতে পারে!… দেখে শুনে হাঁটুন!…
কথাটা শুনেই চমকে উঠলো অনন্যা। হঠাৎ স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার মতো করে সামনের দিকে তাকিয়েই দেখতে পেলো ওর কয়েক কদম সামনেই বড় একটা ইট পরে আছে। না দেখে হাঁটতে গিয়ে এখনই ওটার সাথে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেত ও! আর তাতে যে ওর আঙুলের মাথা ফেটে রক্ত ঝরতো সেটা ভেবেই আঁতকে উঠলো সে।
সেটা খেয়াল করে এবার বেশ জোরেই হেসে উঠলো ধ্রুব। ওর হাসির শব্দ শুনে ভাবনার সুতো কেটে গেল অনন্যার। আড়চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ওর মুগ্ধ করা হাসিটা দেখতে লাগলো। ধ্রুব হাসতে হাসতেই বললো,
– আপনি বড্ডো বোকা!
অনন্যা দারুন লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিলো। পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবছে। তার চারদিকে তাই লালচে আভায় ছেয়ে গেছে। নীড়ে ফেরা পাখিরা সব ঝাঁকে ঝাঁকে কুলায় ফিরছে।
সন্ধ্যার আঁধার আর গোধূলির সোনালী আলো পরিবেশে এক অন্যরকম আলোছায়ার সৃষ্টি করেছে। মুগ্ধময় আবেশে, নির্জন পথ ধরে হেঁটে চলেছে দুই তরুণ-তরুণী। সুন্দর আবহাওয়ার সাথে খাপ খাইয়েই যেন প্রকৃতি তাদের তৈরি করেছে! কী সুন্দর ভঙ্গিমায় তারা পথ চলছে আর ছুঁয়ে দিচ্ছে প্রকৃতিকে!
_____________________
বাড়িতে এসে হুট করেই খুব খুশি হয়ে উঠলো অনন্যা। বাসায় ওর ছোট মামা এসেছেন। ওর মায়ের একমাত্র ছোট ভাই ‘লেবু মামা’। বয়সে ওর চেয়ে খুব বেশি হলে সাত- আট বছরের বড় হবেন। কিন্তু কোনো চাকরি- বাকরি করেন না। বেকার। অনন্যার নানা মারা যাওয়ার পর থেকে লেবু মামার স্থায়ী আবাসস্থল হয় ওদের বাড়ি। এখানেই বড় হয়েছেন উনি।
মামার বিয়ে-শাদী কোনো কিছুতেই আগ্রহ নেই। তাই বয়স হয়ে যাবার পরও তিনি বিয়ে করছেন না। এ নিয়ে অবশ্য জোহরা বেগমের চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই! বরং তিনি প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে গত পাঁচ বছর ধরে একটার পর একটা মেয়ে দেখেই যাচ্ছেন, দেখেই যাচ্ছেন! কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এখনও কাউকেই তার পছন্দ হয় নি!
ড্রইংরুমে বসে টিভি দেখছিলেন লেবু মামা। অনন্যাকে আসতে দেখেই এক গাল হাসলেন। বললেন,
– আরে অনু, কোথায় গিয়েছিলি তুই?…. আমি সেই কখন এসে বসে আছি। আয়, আয়, গল্প করি….. এইবার গ্রামে গিয়ে কী হয়েছে, জানিস?….
নিজের গল্পের আগ্রহী শ্রোতা পেয়ে খুব খুশি হলেন মামা। তিনি বেশ ক’দিন যাবৎ বাড়ি ছিলেন না। গিয়েছিলেন গ্রামের বাড়ি তাতারপুর। তার পৈতৃক নিবাস সেখানেই। প্রতি বছর একবার করে হলেও তিনি বাড়ি গিয়ে বাড়ি-ঘর দেখে আসেন। আর প্রতিবার আসার সময় সাথে করে নিয়ে আসেন তার মজার মজার সব অভিজ্ঞতার গল্প! আর সেগুলো গভীর আগ্রহের সাথে বসে থেকে শোনে অনন্যা। রাতভর চলতে থাকে মামা-ভাগ্নির সেসব গল্প!
_________________________
ধ্রুবের বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। সন্ধ্যার দিকে অনন্যার সাথে বাড়িতে এসেছিল একবার। বাড়িতে কিছু কাজ ছিল সেগুলো সেরে নিয়েই আবারও বাইরে গিয়েছিল। আর ফিরতে ফিরতে বাজলো সাড়ে বারোটা!
ডাইনিং টেবিলের এককোণে বসে একা একা খাবার খাচ্ছে ধ্রুব। পাশেই দাড়িয়ে আছেন করিম চাচা। ঘুমে তার চোখ ঢুলুঢুলু। তবুও ঘুমাতে না গিয়ে দাড়িয়ে আছেন উনি। ধ্রুব অবশ্য বারকয়েক বলেছে তাকে চলে যেতে। কিন্তু তিনি যাচ্ছেন না। উনি থাকতে ছেলেটা একা একা কষ্ট করবে সেটা হতেই পারে না! বড্ডো ভালোবাসেন এই ছেলেটাকে! তাকে কষ্ট না দেয়ার জন্যই খুব দ্রুত খাওয়া শেষ করলো ধ্রুব।
টাওয়ালে হাত মুছতে মুছতে নিজের ঘরে এলো ধ্রুব। বেশ রাত হয়েছে। এখন একটু বিছানায় গা এলিয়ে দিতে হবে। তাই রোজকার নিয়ম অনুযায়ী একটা বই হাতে নিয়ে বিছানায় উঠে এলো।
দুই পৃষ্ঠা পড়তেই হঠাৎ ফ্ল্যাটের কলিংবেল বেজে উঠলো। ধ্রুব একমুহুর্ত কি যেন ভাবলো। ঘড়ি দেখল রাত ১:৩৯ মিনিট। এতো রাতে কে এলো? ভাবতেই আবারও বেল বেজে উঠলো। আবারও। এবার উঠতেই হলো ওকে।
দরজা খুলতে যাবার আগে একবার করিম চাচার ঘরে গেল। সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তার ঘুমের যেন কোনো ব্যাঘাত না ঘটে সেভাবেই চুপিসারে দরজা ভেজিয়ে সরে এলো। খুবই সন্তর্পনে ফ্ল্যাটের দরজাটা খুলতেই দেখতে পেলো বাহির ফাঁকা। কেউ নেই ওখানে!
চিন্তায় ভাঁজ পড়ল ওর কপালে। মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে একটা কথা ‘এতো রাতে কে এলো?’। খানিক্ষণ এদিক ওদিক উঁকিঝুঁকি করে দরজাটা আবারও লাগিয়ে দিলো ধ্রুব। পাশ ফিরে ঘরে ঢুকে যেতেই চোখে পড়লো দরজার নিচে কি যেন একটা রাখা ভাজ করা কাগজ। সেটা দেখেই কপালের ভাঁজ সরে গেল ওর। কাঙ্ক্ষিত জিনিসটার দেখা পাওয়া গেছে! ভাবতেই ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো বাঁকা হাসি। দরজার নিচ থেকে চিরকুটটা তুলে নিয়েই হাঁটা লাগালো নিজের ঘরের দিকে।
#চলবে—-