মন_ছুঁয়েছে_সে #পর্বসংখ্যা_৫ #মৌরিন_আহমেদ

#মন_ছুঁয়েছে_সে
#পর্বসংখ্যা_৫
#মৌরিন_আহমেদ

ড্রইংরুমে বসে দাবা খেলা চলছে মামা-ভাগ্নির মধ্যে। আর তার ফাঁকে ফাঁকে গতরাতের বলা অসমাপ্ত গল্প গুলোই এখনও বলে চলেছেন তিনি। হঠাৎ পাখির কলকাকলির সুমধুর আওয়াজ নিয়ে ডোরবেল বেজে উঠলো। অনন্যা বিরক্ত চোখে সেদিকে তাকিয়েই কাকে যেন উদ্দেশ্য করে ডাক দিল,

– এই বেদানা…. দরজাটা খুলে দে তো!

তারপর সে আবারো তার মামার দিকে তাকিয়ে বললো,

– হ্যাঁ, মামা বলো….

মামা আবারও শুরু করলেন।

– আরে বেদানা, তুই? কবে এলি?

বেদানাকে দরজা খুলতে দেখে হাসি হাসি মুখে প্রশ্ন করে কানিজ। ও দরজার সিটকিনি টা উপরে তুলতে তুলতে বলে,

– কাইলকে সন্ধ্যায় ট্রেনে কইরা আইছি….

– লেবু মামাও এসেছে?

– হ, আমি তো তার লগেই আইছি…. জানেন না, সে কী মজাডা হইছে এইবার তাতারপুর গিয়া…

কানিজ আগে আগে হাঁটতে থাকে আর পেছনে পেছনে বেদানা আসতে আসতে তার গল্প শোনাতে থাকে।

১৭ বছরের এক তরুণী ‘বেদানা’। অনন্যাদের বাড়ির আশ্রিতা। যদিও তার আসল নাম জয়তুন্নেছা। কিন্তু অনন্যার দাদি মানে জোহরা বেগমের শাশুড়ির নাম জয়তুন্নেছা হওয়ায় তাকে এই নামে ডাকা হয় না। ও হলো লেবু মামার আবিষ্কার। বছর কয়েক আগে রেলস্টেশন থেকে ওকে নিয়ে এসেছিলেন মামা। তখন বাড়িতে সে কি হুলস্থুল কান্ড! অনন্যার বাবার ভয়ঙ্কর জন্ডিস! ওর তখন HSC চলছে। জোহরা বেগম কোনদিকে যাবেন কোনো দিশকূল পাচ্ছেন না। তখনই এই বেদানা বিবির আগমন!

ও যখন এ বাড়িতে আসে তখন বাড়িতে ‘বেদানা’র ছড়াছড়ি! যেই রোগী দেখতে আসে সেই কেন যেন এই ‘বেদানা’ ই নিয়ে আসে! এতো বেদানা দেখতে দেখতে অনেকটা হাসির ছলেই অনন্যা ওর নামকরণ করে ‘বেদানা’। ব্যস! সেই থেকেই চলছে!

– সারপ্রাইজ, লেবু মামা!

আচমকা কানিজকে দেখে বেশ অবাক হয় অনন্যা। কালই না ওর জ্বর এসেছিল? মামা ভ্রুকুটি করে কেমন যেন একটা হাসি দিয়ে বললেন,

– আরে আরে কোনাচি বেগম… কী খবর?

‘কোনাচি বেগম’ ডাকটা শুনেই মুখটা কালো করে ফেললো কানিজ। মুখ গোমড়া করে বললো,

– খবর তো ভালো।… কিন্তু তুমি আমাকে ‘কোনাচি বেগম’ বলে কেন ডাকো, লেবু মামা?

– ঠিক যে কারনে তুমি আমায় ‘লেবু মামা’ বলে ডাকো!

ভেংচিয়ে কথাটা বলেই হঠাৎ ধমকে উঠলেন উনি,

– এই তোকে বলেছি না… আমাকে তুই লেবু মামা বলে ডাকবি না?… আমার নাম কি লেবু নাকি? হ্যাঁ?

ধমক খেয়ে চুপসে গেল কানিজ। ওর গোমড়া মুখ দেখে অনন্যা ওর হাত ধরে টেনে নিজের পাশে বসিয়ে দিলো। ও সোফায় বসতে বসতে বললো,

– কিন্তু মামা, আমার নাম তো কোনাচি নয়, কানিজ! কানিজ ফাতেমা। আর তোমার নাম তো লেবু… তাই

– চোপ! এই কে বলেছে রে আমার নাম লেবু? কে বলেছে?…. তুই জানিস আমার নাম কি?… আমার নাম সৈয়দ লুৎফর রহমান!… দেখেছিস কেমন বংশীয় নাম?… এমন সুন্দর একটা নামের সাথে তোরা ‘লেবু’র মতো বিচ্ছিরি একটা শব্দ লাগাস কি করে বলবি?

হঠাৎ ক্ষেপে উঠলেন মামা। কানিজ গোবেচারা ভাবে অনন্যার মুখের দিকে তাকালো। যেন কিচ্ছুটি বোঝে না এমন ভঙ্গিতে বললো,

– তাহলে তোমাকে কি বলে ডাকবো, লেবু মামা?

– আবার লেবু?… বললাম না আমার নাম কি?… হয় সৈয়দ মামা, নয় লুৎফর মামা বলে ডাকবি… বুঝেছিস?

এতক্ষণে মুখ খুললো অনন্যা। মুখ টিপে হাসতে হাসতে বললো,

– সৈয়দ মামা আবার একটা ডাক হলো, মামা? এর চেয়ে লেবুটাই তো পারফেক্ট?

এবারে অনন্যার বকা খাওয়ার পালা! মামা তো এতক্ষণ খেয়ালই করেন নি যে সব ক্রাইমের মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনালটাই হচ্ছে অনন্যা! ওর দিকে তাকিয়ে রাগী চোখে বললেন,

– তুই চুপ থাক!… তোকে তো বলতে বলতে আমিই শেষ হয়ে যাচ্ছি। এতো করে বলেছি আমাকে লেবু বলে ডাকবি না, তাও ডেকেই যাস! ডেকেই যাস! নিজে তো ডাকিস ডাকিস সারা দুনিয়াকেও এটাই শিখিয়ে বেড়াস! ফাজিলের চূড়ান্তে!

মামার কথা শুনে এবার বেশ জোরেই হেসে উঠলো অনন্যা। মামা রাগী কন্ঠে তাকালেন কিন্তু লাভ হলো না। সে সমস্ত রাগ উপেক্ষা করে হেসে ফেলে। অবস্হা অনুকূলে দেখে কানিজও সাহস করে উঠে এসে মামার ঠিক সামনা সামনি সোফাটায় এসে বসে। মামার এই হালকা রাগটাকে উড়িয়ে দেবার জন্যই সামনে পেতে থাকা দাবার ঘুঁটি গুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে শুরু করে। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে একটা চাল দিয়েই বলে,

– নাও, হয়েছে! তুমি চাল দাও…

মামা ওর দিকে একবার কঠিন দৃষ্টিতে তাকালেন। রাগটাকে ধরে রাখার চেষ্টা করছেন কিন্তু পারছেন না। কেন যেন উনি হাজার চেষ্টা করেও এই অসম্ভব বদমাশ মেয়ে দু’টোর উপরে বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারেন না। উনি দৃষ্টি নামিয়ে পরবর্তি চাল দিলেন। কানিজের মতলব বুঝে অনন্যাও বেদানার উদ্দেশ্যে চা অর্ডার করে মামা কে বললো,

– মামা, বাকিটা বলবে না? শুরু কর…

খেলা প্রায় শেষের দিকে। বোর্ডে কানিজের অবস্থা বেশ শোচনীয়। তার রাজা ছাড়া আর কেউই নেই অবশিষ্ট! মামাও ক্রমাগত চেক দিয়েই যাচ্ছেন। এতে অবশ্য ওর মন নেই। কারণ মনের ভেতর যদি অন্য কথা ঘুরপাক খায় তবে খেলায় মন বসে কী করে? কথাটা মামাকে বলতে চাইছে কানিজ। কিন্তু বলতে পারছে না। কিছুক্ষন আগেই মামা যেমন রেগে গেলেন আবার যদি রেগে যান? তাই কথাটা বলবে কী না তাই ভাবছে।

অবশেষে জয় হলো মনের। সংকোচ কে পাশ কাটিয়ে বললো,

– একটা কথা বলি, মামা?

– কী?

ভ্রূকুটি করলেন মামা। কানিজ বোর্ডের দিকে কিছুটা ঝুঁকে গিয়ে মামার মুখের কাছে মুখ এনে নিচু স্বরে বললো,

– লতিফা মামির খবর কি, মামা?… এবার গ্রামে গিয়ে দেখা হয়েছিল?

কথাটা শুনেই সূক্ষ চোখে কানিজের দিকে তাকালেন তিনি। ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে বললেন,

– বেতমিজ লারকি! বাসায় কিছু শিখিস নি?… মামার সম্ব ন্ধে মানুষ এভাবে কথা বলে?

তারপর অনন্যার দিকে তাকিয়ে বললেন,

– এই অনু এই, তোর এই বেয়াদব বান্ধুবি টা এসব কি বলছে, হ্যাঁ? লতিফা কে রে? হুম্, কে এই লতিফা বানু? তাকে মামি বলে ডাকিস কেন? আমি কী তাকে বিয়ে করেছি? …. বিয়েই বা করবো কী করে? আমি কি তাকে চিনি?

– এখন চিনবেই বা কি করে, মামু?… তার তো এখন বিয়ে হয়ে গেছে।… যখন মাখো মাখো প্রেম ছিল তখন ঠিকই চিনতে!

বলেই কানিজের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে। কানিজও নিজের চুপসে যাওয়া মুখ বদলে ফিক করে হেসে ফেলে। মামা যেন চরম রেগে ওঠেন। চিৎকার দিয়ে বলেন,

– অনু!

অনন্যা হাসতে হাসতেই মামার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে,

– তা বললে না তো মামু, লতিফা বানুর সাথে দেখা হয়েছিল না কি?… কানিজ বেচারি তো জানতে চাচ্ছে… বলো না…

– তোদের কি ধারণা আমি লতিফা বানুর সাথে দেখা করতে গ্রামে যাই?….. এই তোরা জানিস না তার বিয়ে হয়ে গেছে?….. তার শ্বশুর বাড়ি কি ওই গ্রামে, যে আমি গেলেই দেখা হয়ে যাবে?

– তার শ্বশুর বাড়ি কোথায় মামু? ওখান থেকে কত দূর?

বেশ ঢং করেই জিজ্ঞাসা করে কানিজ। মামা প্রচণ্ড রাগ করে কিছু একটা বলতে যাবেন তার আগেই ঘটনাস্থলে প্রবেশ করলেন অনন্যার বাবা জয়নাল আবেদীন। তাকে দেখে মুহূর্তে মধ্যেই কোলাহলরত পরিবেশ হয়ে গেল একদম শান্ত, স্থির! যেন মহাসমুদ্রের উচ্ছ্বল কল্লোল কে কেউ জাদুর ছোঁয়ায় থামিয়ে দিয়েছে!

অফিসের কোট-টাই পরা গম্ভীর মানুষটি ভারিক্কি চালে পকেটে হাত রেখে সবার দিকে তাকালেন। কানিজের দিকে তাকাতেই সে হঠাৎ ভীষণ ভীত দৃষ্টিতে তাকালো। ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,

– আ-আ-আসসালামু আলাইকুম, আ-আংকেলল!… ভা-ভালো আছেন?

– ওয়ালাইকুম আসসালাম। কখন এলে তুমি? নাস্তা দিয়েছে তোমায়?

বেশ গম্ভীরতার সাথেই কথা বললেন জয়নাল সাহেব। কানিজ নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু কেন যেন পারছে না। এই লোকটাকে দেখেই কেন যেন ভীষণ ভয় পেয়ে যায় সে। কেন পায় তা সে জানে না। ও আগের মতো করেই বললো,

– জ-জ্বী… আংকেল। একটু আগেই এসেছি। নাস্তাও করেছি….

– ওহ্, আচ্ছা।…তোমরা তবে থাকো আমি অফিসে যাচ্ছি…

বলেই জায়গা থেকে ততক্ষনাত প্রস্থান করলেন জয়নাল আবেদীন। উনি যেতেই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো সবাই! তার দরজা লাগানোর শব্দ শুনে সেদিকেই উঁকি দিলো অনন্যা। উনি যে একেবারেই বেরিয়ে গেছেন ভেবেই একটা প্রশান্তির নিঃশ্বাস বেরোল ওর বুক চিরে!

জয়নাল আবেদীন। একটা বিদেশী কোম্পানির সিইও। সদা শান্তিপ্রিয়, গম্ভীর একজন মানুষ। বেশ সময়নুবর্তী, জীবন ঘড়ির কাঁটায় বাঁধা। সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে যান ঠিক ৯: ৩০ এ। আর রাতে ফিরে আসেন ১০:৩০ মিনিটে। স্ত্রী-সন্তান কেন অফিসের কর্মচারী থেকে শুরু করে কাঁচা বাজারের দোকানিদের সাথেও তার এক কথার জায়গায় দু’ কথা হয় না। আশ্চর্য শীতল একজন মানুষ!

আসলে সৃষ্টিকর্তা কিছু কিছু মানুষ কে বিশেষভাবে বিশেষ কাজের জন্য তৈরি করেছেন। কোন বড় প্রতিষ্ঠানের সিইও টাইপ মানুষ গুলো কেন যেন আচার-আচরণেও অন্যরকম হয়। তাদের গলায় স্বর এসির বাতাসের মতো ঠান্ডা। মেজাজ এতটাই ঠান্ডা যে সেই মেজাজের সামনে দাঁড়ালে বুকের রক্তও শীতল হয়ে যায়!

এ বাড়িতে সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন মানুষ হলেন জয়নাল সাহেব। বাড়িতে কখন কি হয় সে খবর তিনি রাখেন না। রাখার সময় পান না। রাখতে জানেন না। তিনি শুধু জানেন টাকা রোজগার করতে। এছাড়া তার আর কোন কাজ নেই!

লতিফা বানু। তাতারপুর গ্রামেরই অধিবাসী। লেবু মামা এমএ পাশ করে দুমাসের জন্য সেবার গ্রামে বেড়াতে গেলেন। সেখানেই গিয়ে প্রেম হয়ে গেল লতিফা বানুর সঙ্গে! বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন। অনুর মা জোহরা বেগম সানন্দে প্রস্তাব নিয়ে গেলেন। কিন্তু বাঁধ সাধলেন কনেপক্ষ! কী একটা পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে মামলার রেশ ধরেই তারা প্রস্তাবটা নাকচ করে দিলেন। আর এর ঠিক দুই মাসের মধ্যেই লতিফা বানুর অন্য আরেক জায়গায় বিয়ে দিয়ে দেয়া হলো!

লেবু মামা তার জীবনের প্রথম থেকেই চাকরি বিরোধী, বিয়ে- সংসার বিরোধী! কিন্তু কী করে যেন লতিফা বানুর জন্য নিজের মন বদলে ছিলেন। শেষ অবধি সেটাও যখন টিকলো না তখন তিনি বড়ই হতাশ হলেন। এখন তার সিদ্ধান্ত চিরকাল একা থাকার!

#চলবে—-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here