মম চিত্তে পর্ব -১০+১১

#মম_চিত্তে
#পর্ব_১০
#সাহেদা_আক্তার

রাতে রওশন আরার ঘর থেকে রিয়ানের ডাক পড়ল। ওর পিছু পিছু সবাই আসতে চেয়েছিল কিন্তু রওশন আরা না করে দিলেন। তিনি রিয়ানের সাথে একলা কথা বলতে চান। তাঁর ইশারায় ঢুকেই ও দরজা মেরে দিল। ভাই বোন সবগুলো দরজায় কান পাতলো। পাছে কিছু মিস করে যায়!

– আয় দাদুভাই, আমার কোলে মাথা রেখে একটু বিশ্রাম নে।

রিয়ান ভালো বাচ্চা ছেলের মতো তাঁর কোলে শুয়ে বলল, কতদিন যেন তোমার কোলে শুই না দিদুন। খুব মিস করি। তোমার আর আম্মুর কোলে কি যে শান্তি! তিনি মাথা হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, কেমন গেল এ কদিন দাদুভাই? ও আরামে চোখ বুজে বলল, একটু পরিশ্রম তো হয়েছে। সকাল বিকাল শুধু মিটিং আর মিটিং। তিনি হেসে বললেন, ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করেছিস? এত শুকনো লাগছে।

– কি যে বলো তুমি!? সকালে ব্রেকফাস্ট, দুইবেলা খাবার। তার সাথে নাস্তা তো আছে। খেয়ে খেয়ে ভুঁড়ি বেড়ে গেছে।

– তাহলে তো আমার দাদুভাই ভুড়িওয়ালা হয়ে গেছে।

– ঠিক বলেছো দিদুন। জিম করে এই ভুঁড়ি কমাতে হবে।

– তা কমাস। দাদুভাই, একটা কথা বলব?

– বলো। তার আগে মাথাটা টিপে দাও তো। খুব ধরেছে।

রওশন আরা মাথা টিপতে টিপতে বললেন, আমি চলে গেলে কে মাথা টিপে দিবে শুনি? রিয়ান চোখ বন্ধ করে ছিল। সেভাবেই বলল, তুমি কই যাবা শুনি। তোমাকে কোথাও যেতে দিবো না। তিনি হেসে বললেন, তা কি করে হয়? আমার সময় তো বেশিদিন নেই……। রিয়ান বাঁধা দিয়ে বলল, ধুর, এসব বলার জন্য ডেকেছো?

– না রে। একটা অনুরোধ করার জন্য। আমার একটা কথা রাখবি?

– কি বলো তো।

– আমার মম মেয়েটাকে খুবই পছন্দ হয়েছে রে দাদুভাই। আমার মন বলছে ওকে বিয়ে করলে তুই অনেক সুখে থাকবি। তুই শুধু অনুমতি দে। যদি দেখার পর তোর পছন্দ না হয় তাহলে বাদ।

– দিদুন তুমিও!? ওকে, দেখো তোমরা।

– আমাদের তো দেখা হয়ে গেছে। তুই যেহেতু রাজি তাহলে কালই প্রস্তাব দেবো৷ তারপর তুই দেখে নিবি।

রিয়ান কিছু বলল না। চুপ করে শুয়ে রইল রওশন আরার কোলে। আর যাই হোক দুলের মালিককে দেখার কৌতুহল হচ্ছে খুব। কেন এই দুল ওকে এত টানছে জানা দরকার। বিয়ে হোক না হোক দুলটা দেওয়ার জন্য হলেও ওকে দেখা করতে হবে।

বাসায় ফিরতে ফিরতে সাড়ে দশটার উপরে বাজলো। শরীর এতো ক্লান্ত লাগছে মমর যে ইচ্ছে করছিল না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়তে। কলিংবেল বাজাতেই মাধুরী খালা দরজা খুলে দিলেন। ও রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখল খালা টেবিলে খাবার দিচ্ছেন। মম বসে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলল, সবাই খেয়েছে?

– হ।

– আব্বু আজকে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল মনে হচ্ছে। আগে তো এগারটা পর্যন্ত খেলা দেখে তারপর ঘুমাতো।

– হ, শরীরটা একটু ভালা না মনে হয়। বুকে নাকি হালকা ব্যাথা করতেসিলো।

– ওষুধ খেয়েছে?

– আমি নিজে দিসি আইজকা।

– ভালো করেছো। আব্বুর প্রেশারটা ক’দিন ধরে বেশিই আপ ডাউন করছে। ডাক্তার দেখাতে হবে।

মাধুরী খালাও একমত হলেন। মম খাওয়া দাওয়া সেরে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। নিনিটা পাশে বসে ম্যাঁও ম্যাঁও করছে। ও হাত দিয়ে মাথায় আদর করতে লাগল। ভাবছে আগামী শুক্রবার রায়হান সাহেবকে ডাক্তার দেখাবে; কেন এমন হচ্ছে জানা দরকার।
.
.
.
.
সকালবেলা রায়হান সাহেবের ফোনে একটা কল এলো। তিনি ধরতেই অপর পাশ থেকে একটি পুরুষ কন্ঠ বললেন, মি. রায়হান বলছেন? তিনি প্রতিউত্তরে হ্যাঁ বলতেই অপরজন বললেন, আমি রাকিব হাসান বলছি। মম যে কোম্পানিতে আমি সেখানকার এমডি।

– ও আচ্ছা; মমকে খুঁজছেন? ও এই মাত্রই বেরিয়ে গেল।

– না, আমি আপনাকেই খুঁজছিলাম। আপনার সাথেই কিছু কথা বলার ছিল।

– জ্বি বলুন।

মম অফিসে ঢুকে প্রথমে ফাইল নিয়ে রাকিব হাসানের রুমে গেল। কাল অনেকক্ষণ একটানা কাজ করে ফাইলগুলো শেষ করেছে। এগুলো গুরুত্বপূর্ণ দেখে আগে এই নয়টা ফাইল দেখে রিপোর্ট টাইপ করে নিয়েছে। এখনো আরো ফাইল বাকি। আজ শেষ করতে হবে। হয়ত শেষ করতে করতে আরো ফাইল জমা হবে। কাজের শেষ নেই।

নক করতে রাকিব হাসান প্রবেশের অনুমতি দিলেন। ঢুকে ও বলল, স্যার, রিপোর্ট আর ফাইল গুলো। তিনি কম্পিউটারে কাজ করতে করতে বললেন, ঐ শেলফে জায়গা মতো রাখো। মম শেলফের সামনে গিয়ে খুঁজে খুঁজে জায়গা মতো রাখতে লাগল আর হামি দিতে লাগল। কালকে নিনি তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গিয়েছিল। রাত তিনটার সময় এসে ওকে জ্বালাতন করছিল খেলার জন্য। বাধ্য হয়ে এক ঘন্টা খেলে আবার ঘুম। সাতটায় আবার নিনির অত্যাচারে ঘুম থেকে উঠে যেতে হয়েছে। এখনো বেশ ঘুম পাচ্ছে। রুম থেকে বের হয়ে সোজা কফি আনতে যেতে হবে। মম চলে যেতে লাগলে রাকিব হাসান ডেকে বললেন, তোমার আজকে দুপুর থেকে ছুটি।

– কিসের ছুটি স্যার?

– তোমার বাবা আমার কাছে ছুটি চেয়েছেন তোমার জন্য।

– আচ্ছা।

কি বলবে বুঝে না পেয়ে মম বেরিয়ে এল। হঠাৎ রায়হান সাহেব ওর জন্য ছুটি চাইলেন কেন!? বুঝতে পারছে না কিছু। ভাবতে ভাবতে কফি বানিয়ে নিজের জায়গায় এসে দেখল রাসেল ওর টেবিলের দিকে কেমন বাঁকা হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে। এটা ওটা দেখছে। ওকে খেয়াল হতে বলল, তোমার তো দেখি এখনো কাজ শেষ হয়নি। কতগুলো ফাইল এখনো বাকি। মম কফির কাপ রেখে বলল, জ্বি।

– স্যারের গুলো শেষ?

– জ্বি।

রাসেল ওর পিঠের মাঝ বরাবর চাপড় দিতে দিতে বলল, গুড গুড। এগুলোও তাড়াতাড়ি শেষ করো। দেখবে স্যার খুব খুশি হবে। তা এক কাপ কফি খাবে? চলো তোমাকে খাওয়াবো৷ মম ওর কফি দেখিয়ে বলল, আমি কফি এনেছি।

– দেখেছো আমি খেয়ালই করিনি। তাহলে দুপুরে একসাথে লাঞ্চ করব। কাছেই একটা হোটেল আছে।

– সরি, দুপুরে আমি বাসায় চলে যাবো। স্যার ছুটি দিয়েছেন।

সে আবার ওর কাঁধে হাত দিয়ে বলল, সমস্যা নেই। তাহলে অন্য একদিন হবে। মন খারাপ করো না। বলে ওকে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে চলে গেল। মন খারাপ তো দূরের কথা মমর ঘৃণায় গা গুলিয়ে উঠল। এই লোকটার আসলেই চরিত্র খারাপ। কথায় কথায় শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হাত দেয়। তৌসিফার কাছে শুনেছিল একটা মেয়েকে হ্যারাস করেছিল খুব বাজে ভাবে এক পার্টিতে। তারপর মেয়েটা অভিযোগ করতে গেলে রাসেল বুদ্ধি করে মেয়েটাকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করে। ‘যত সব খারাপ লোকজনগুলো আমার পেছনে লাগা শুরু করেছে একসাথে,’ ভাবতে ভাবতে কাজে মন দিল।

দুপুরে কাজ শেষ করে রওনা দিল বাসায়। মাথায় অনেক কিছু ঘুরছে। কিসের ছুটি নিল তা ভাবতে ভাবতে বাসায় পৌঁছে গেল। নক করতে বর্ষা দরজা খুলল। ওকে দেখে বলল, কি রে, আজও তাড়াতাড়ি এলি!? ও জুতো রাখতে রাখতে বলল, আব্বু ফোন দিয়ে ছুটি নিয়েছে আমার জন্য। সিরিয়াস কিছু কি? বর্ষা ওকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বলল, জানি না। আজ খালু অফিসে যায়নি দেখলাম। ফোন দিয়ে ছুটি নিয়েছেন হঠাৎ। সকাল থেকে রুমের রকিং চেয়ারে বসে আছেন। পর্দা টানা। রুম একটা অন্ধকার। মম ফ্রেশ হয়ে রায়হান সাহেবের রুমে গেলেন। দরজা ভেজানো। আস্তে ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। ভেতরটা কেমন ঘুটঘুটে অন্ধকার৷ ও গিয়ে পর্দা সরিয়ে দিতেই চারপাশে আলোয় ভরে গেল। রায়হান সাহেব চোখ মেললেন৷ ওর দিকে এক পলক তাকিয়ে থেকে বললেন, এসেছিস? মম কাছে এসে হাঁটুর কাছে বসে বলল, তা তো এসেছি। তোমার কি হয়েছে? অফিস যাওনি!? শরীর খারাপ? রায়হান সাহেবের কোলে নিনি ঘুমাচ্ছে। তিনি নিনির গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, না, আমি ভালো আছি৷

– তাহলে? হঠাৎ আমার অফিস থেকে ছুটি চেয়ে নিলে? নিজেও ছুটি নিলে।

– তোর সাথে কিছু কথা বলতাম।

– কি এমন জরুরি কথা আব্বু যে অফিস থেকে ছুটি নিতে হলো!

রায়হান সাহেব ইতস্তত করতে লাগলেন। নিনি জেগে উঠে মমর কোলে চলে এল। মম ওকে আদর করতে করতে তাঁর দিকে তাকালেন। তাঁকে অনেক নার্ভাস লাগছে। মম তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল, কি হয়েছে আব্বু? কিছু বলবে? বলো। আমি শুনছি। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তোর জন্য একটা বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। মম চুপ করে থেকে বলল, কে দিয়েছে? তিনি একটু সাহস নিয়ে বললেন, তোর বান্ধবী আদ্রিতার বড় চাচা তোকে তার ছেলের জন্য চাইছেন।

– আব্বু তুমি চাও আবার তোমার হিরে অযত্নে অবহেলায় হারিয়ে যাক!?

– আমার বিশ্বাস তারা তোকে যত্নে রাখবে। আচ্ছা তুই শুধু একবার দেখ। যদি পছন্দ না হয় তো বাদ দিয়ে দিস।

– আমাকে সময় দাও আব্বু।
#মম_চিত্তে
#পর্ব_১১
#সাহেদা_আক্তার

মম নিনিকে নিয়ে রায়হান সাহেবের রুম থেকে বেরিয়ে এসে মাথা ঝুলিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। নিনিটা চুপ করে ওর ঘাড়ের কাছে মুখ গুঁজে দিল। মন খারাপেও হেসে ফেলে বলল, নিনি, সুড়সুড়ি লাগছে। তারপর কাছে নিয়ে একটা আদর দিয়ে বলল, এবার যদি বিয়ে হয় তাহলে তোকে নিয়ে যাবো। কিন্তু …… বিয়েটা করছে কে? আমি করবো না। এমনিতেই করব না। তার উপর ঐ খচ্চরটা আছে বাড়িটাতে। তাই না বল নিনি? ঐ খচ্চরটা থাকলে তুই রাজি হতি? নিনি ম্যাঁও করল একবার। মম নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তুই একমাত্র আমার দুঃখ বুঝিস নিনি। আর কেউ বুঝে না। ও নিনিকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজল।

বৃষ্টির ডাকে ঘুম ভাঙল। তাকিয়ে দেখল রুমে আলো জ্বলছে। বাইরে অন্ধকার হয়ে গেছে। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে বুঝতে পারল না। নিনিটাও নেই পাশে। বৃষ্টি বলল, ওঠ নাস্তা করবি। দুপুরেও তো কিছু খাসনি। খাওয়ার কথা বলতে ওর পেট কো কো শব্দ করে উঠল। ও উঠে ওয়াশরুম চলে গেল ফ্রেশ হতে। বর্ষা টেবিলে নাস্তা আনছে। মাধুরী খালা পাকোড়া ভাজি করছে। রান্নাঘর থেকে তেলের আওয়াজ আসছে। ও বসার রুমে আসতেই নিনিকে দেখতে পেল। কি নিয়ে যেন খেলা করছে। গিয়ে দেখল একটা বল নিয়ে খেলছে। ওর সাথে খেলতে যাচ্ছিল। বৃষ্টি ওকে টেনে টেবিলে বসিয়ে বলল, আগে খেয়ে নে। ও বসে বলল, আব্বু কোথায়? মাধুরী খালা রান্নাঘর থেকে এসে বললেন, খালু তো রুমে শুয়ে আছেন। তুমি খাইয়া নাও মা। মম চুপচাপ খেয়ে উঠে গেল। রায়হান সাহেবের রুমে গিয়ে দেখল তিনি মুখের উপর হাত রেখে শুয়ে আছেন। কিছু বলবে বলবে করেও না বলে চলে এল। এসে বর্ষাকে বলল, আপু, একটু আব্বুকে জিজ্ঞেস করবে যে শরীর খারাপ লাগছে কি না।

– তুই গিয়ে জিজ্ঞেস কর। হঠাৎ আমাকে বলছিস!?

– এমনি। দেখো না। কেন শুয়ে আছে।

– তা না হয় জিজ্ঞেস করব। তোর আর খালুর মধ্যে কি কিছু হয়েছে?

– না না।

– তাহলে দুইজন এভাবে চুপ হয়ে আছিস?

– আরে কিছু না। আমি রুমে যাচ্ছি।

মম রুমে চলে এল। ওর পেছনে পেছনে নিনিও এল। ও নিনিকে কোলে নিয়ে বলল, নিনি, আমার সাথে কেন এমন হচ্ছে বল তো? বিয়ে করা কি এতই জরুরি? আব্বুটা কেমন যেন হয়ে রয়েছে। নিনি……। মম ওর গায়ে গাল ঘষতে লাগল।

হঠাৎ মমর ফোনে কয়েকটা ম্যাসেজের শব্দ হল। ও তাকিয়ে দেখল একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে ওর হোয়াটস অ্যাপে ম্যাসেজ আসছে। মম নিনিকে রেখে ফোন হাতে নিল। এর মধ্যে তিন চারটা ম্যাসেজ চলে এসেছে। ও ওপেন করে দেখল ম্যাসেজ দিয়েছে, কেমন আছো; কি অবস্থা; সবাই ভালো আছে? মম ম্যাসেজ করে জানতে চাইল, আপনাকে কি আমি চিনি?

– মম, আমি আলিফ।

– আমার নাম্বার পেয়েছেন কোথায়?

– আদ্রিতার ফোন থেকে।

– ও দিয়েছে না চুরি করে নিয়েছেন?

– মম…

– কেন ম্যাসেজ দিচ্ছেন? আমাকে তো ঠকিয়েছেন এখন কি বউকেও ঠকানোর ইচ্ছে হচ্ছে?

– মম তোমার সাথে একবার দেখা করতে চাই।

– আমার ইচ্ছে নেই।

– প্লিজ একবার। আর বলব না। শুধু একবার দেখা করো।

মম কি ভেবে বলল, কালকে অফিসের লাঞ্চ আওয়ারে কথা বলব। তবে দশ মিনিট। আলিফ তাতেই রাজি হয়ে বলল, তাতেই হবে। মম একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফোন লক করে বিছানায় ফেলে দিল। একে তো বিয়ের প্যারা তার উপর এই প্যারা। ভালো লাগছে না।

রাতে খাওয়ার সময়ও রায়হান সাহেব আগে আগে খেয়ে শুয়ে পড়লেন। মমর ব্যাপারটা মোটেই ভালো লাগছে না। কালকে ছুটি নেওয়া যাবে না। সবে জয়েন করে পর পর দুই দিন ছুটি গেছে অফিসে। এভাবে ঘন ঘন ছুটি নিলে ব্যাপারটা খারাপ দেখা যায়। নাহলে কালকে ছুটি নিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে আনতো তাঁকে। কি সমস্যা হল কে জানে। রাতে ঘুমানোর আগে রায়হান সাহেবের রুমে একবার চক্কর কেটে এল। তাঁকে দেখে মনটা আপনিই খারাপ হয়ে গেছে। আম্মুটা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বাবাকে ছাড়া একটুও থাকতে চাইতো না ও। আর আজ বাবাকে অসুস্থ দেখে আরো মন টানছে। তাঁকে ছেড়ে কি করে যাবে!? মম সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। কালকে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিবে বলে নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল।
.
.
.
.
আজকে রায়হান সাহেব ঘুম থেকে উঠলেন না। মম জিজ্ঞেস করতেই মাধুরী খালা বললেন, আমি ডাকসিলাম, খালু কইলো পরে উঠবো। তাই আমি আর কিসু কই নাই। ও নাস্তা করতে এসে দেখল বর্ষা আর বৃষ্টি রেডি হয়ে খেতে এসেছে। ওদের দেখে বলল, রেডি হয়ে কোথায় যাচ্ছো!? বর্ষা নাস্তা করতে করতে বলল, তোমার ভাই না খেতে পেয়ে মরে যাচ্ছে। তাই যেতে হচ্ছে। মম খানিকটা হেসে বলল, কখন যাচ্ছো?

– এই তো খেয়ে দশ মিনিট পর বের হয়ে যাবো।

– আচ্ছা। সাবধানে যেও।

– হুম।

দ্রুত নাস্তা সেরে তৈরী হয়ে নিল মম। ওর দেরি হয়ে যাচ্ছে। লেট হয়ে গেলে ঢুকতে দেবে না। জুতো পরে একবার রায়হান সাহেবের রুমের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেল।

আজকে পাঁচ মিনিট আগে এসে পৌঁছালো। কালকের বাকি ফাইলগুলো শেষ করতে করতে আরো কাজ এসে জমেছে। নতুন ডিলের কাজ চলছে। সবাই ব্যস্ত সময় পার করছে গত দুইদিন। মম কফিতে চুমুক দিয়ে খেতে খেতে কাজে মন দিল।

নয়টার সময় রিয়ান অফিসে এল। সবাই দাঁড়িয়ে স্বাগতম জানালো। কেউ কেউ কনগ্রেচ্যুলেশন জানাতে লাগল এত বড় ডিল ফাইনাল হওয়ার জন্য। মম এতই কাজে ডুবে ছিল যে রিয়ানের উপস্থিতি খেয়াল করেনি। পাশ থেকে তৌসিফা ওকে গুঁতো দিয়ে বলল, মম, এই মম। মম না তাকিয়ে বলল, হুম।

– স্যার এসেছেন।

– হুম তো?

– আরে দাঁড়িয়ে কনগ্রেচ্যুলেশন জানা।

– কেন?

– কা……

রিয়ান তৌসিফাকে চুপ করিয়ে দিয়ে ওর টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে রইল। ওকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। কিন্তু ও কাজে এতই মনোযোগী যে রিয়ানকে খেয়ালই করছে না। রিয়ান গলা ঝেড়ে বলল, মিস মম? গলা খেয়াল করে তাকাতেই ও উঠে দাঁড়িয়ে বলল, জ্বি বলুন কি সাহায্য করতে পারি? তৌসিফা পেছন থেকে আবার গুঁতো দিয়ে বলল, আমাদের ছোট স্যার। মম বুঝতে পেরে বলল, সরি স্যার। আমি নতুন তাই চিনতে পারিনি। রিয়ান হেসে বলল, ইট’স ওকে। বসে কাজ করুন। মম খেয়াল করল রিয়ান হাসলে ডান পাশে টোল পড়ে।

দুপুরের লাঞ্চ ব্রেক হতেই মম বেরিয়ে পড়ল। অফিসের লাঞ্চের জায়গায় যাওয়াটা সুবিধাজনক নয়। আলিফের সাথে দেখে কে কখন কি মনে করে। কুৎসা রটাতে মানুষ সময় নেয় না। এ কান ও কান করে দ্রুত ছড়িয়ে যায়। আলিফ অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল ওর জন্য। ওকে নিয়ে বাইরের একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসল। লোকেশনটা অফিসের কাছেই। বসার পর আলিফ জিজ্ঞেস করল, কি খাবে?

– এখানে খেতে আসি নি। যা বলার বলুন।

– একটা রেস্টুরেন্টে এসেছি অথচ না খেয়ে চলে যাবো!? খারাপ দেখায় না?

– এক কাপ কফি।

– ওকে। আর?

– আর কি? যা বলার সরসরিই বলুন। এত ভণিতা ভালো লাগছে না। কি বলতে চান?

– তুমি রিয়ানকে বিয়ে করতে রাজি?

– কেন? আপনি চান না বিয়ে হোক?

– ঠিক তা নয়। রিয়ান বেশ ভালো ছেলে। তোমার সাথে ভালো মানাবে। তুমি বিয়ে করতেই পারো।

– তাহলে জিজ্ঞেস করছেন কেন? কোন অধিকারে জানতে চাইছেন?

– আমাকে মাফ করে দাও মম। আমার তোমাকে এভাবে ছেড়ে যাওয়া উচিত হয়নি।

– হঠাৎ এক বছর পর এই কথা? মাফ করে দেওয়ার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এখন চাওয়ার কোনো মানে হয় না।

– প্লিজ মম। আমার আর আদ্রিতার সংসার ভেঙো না। আমার মেয়েটা আমাকে অনেক ভালোবাসে।

– এসব বলার মানে কি? তোমাদের সংসার আমি ভাঙবো কেন; অদ্ভুত!

– দেখো ও আমাদের কথা কিছুই জানে না। জানলে ও খুব কষ্ট পাবে।

– দেখুন মিষ্টার আলিফ, আমি আপনার মতো কুরুচিপূর্ণ মানুষ নই। আমার কমন সেন্স বলে একটা ব্যাপার আছে। ওর সাথে আমার সম্পর্ক আপনার থেকে বেশি। তাহলে ওর ভালো খারাপের চিন্তাটাও আমার আপনার থেকে বেশি। আমি এমন নই যে আমার কলেজ ফ্রেন্ড নিজের অজান্তে আমার প্রাক্তনকে বিয়ে করেছে বলে আমি তার সংসার ভেঙে দেবো বা হিংসে হচ্ছে। এমন ধারণা আপনার মাথায় আসাই সম্ভব। বললে আমি অনেক আগেই বলতে পারতাম। কিন্তু যারা নিজেদের মধ্যে ভালো আছে তাদের ঘর জ্বালানোর ইচ্ছে অন্তত আমার নেই। আর আমার জীবনে ফারদার কোনো ইন্টারফেয়ার না করলে খুশি হব। আর যদি করেন তাহলে আমি কি কি করতে পারি সে ব্যাপারে আপনার আইডিয়া থাকা উচিত। আপনার দশ মিনিট শেষ।

মম উঠে চলে গেল। আলিফ মাথা নিচু করে বসে রইল। কফিটা আসতেই ও তাতে চুমুক দিয়ে বাইরে আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে কালো মেঘ দেখা যাচ্ছে।

মম নিজের টেবিলের কাছে আসতেই রিয়ানকে দেখতে পেল। সে টেবিলে থাকা মমর ফ্যামিলি ফটোটা দেখছিল হাতে নিয়ে। ও আসতেই ওকে লক্ষ্য করে একটা হাসি দিল। মম কাছে এসে বলল, কিছু বলবেন স্যার?

– হুম। ফলো মি।

মম রিয়ানের পিছু পিছু গিয়ে ওর রুমে উপস্থিত হল। ওর টেবিলে খাবার সাজানো। রিয়ান নিজে চেয়ারে বসে মমকে বসতে বলল। মম চুপচাপ এসে বসল চেয়ারে। রিয়ান বলল, খাওয়া শুরু করো।

– এত খাবার আমি খাবো?

– ওমা! আমাকে বাদই দিয়ে দিলেন!? ভালো। এবার খাবার নিয়ে খাওয়া শুরু করুন।

মম বুঝতে পারছে না তাকে এত আতিথিয়েতার কারণ। ও সংকোচ নিয়ে খাবার প্লেটে নিল। প্রথম চামুচ মুখে দিতেই রিয়ান প্রশ্ন করে বসল,আলিফ ভাইয়ের সাথে আপনার কি সম্পর্ক?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here