মম চিত্তে পর্ব -১৮+১৯

#মম_চিত্তে
#পর্ব_১৮
#সাহেদা_আক্তার

রিয়ান আলমারি খুলে ছয় সাতটা শাড়ি একসাথে বের করে ফেলল একসাথে। মম বড় বড় চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে পুরো আলমারি দিয়ে দেবে। মম ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, কি করছেন? আরে আমি কি সারাজীবনের জন্য যাচ্ছি নাকি! রিয়ান ওর দিকে ফিরে বলল, কয় দিনের জন্য যাচ্ছো তবে? এবার মম দ্বন্দ্বে পড়ে গেল। ও নিজেও জানে না কখন আসবে। ভেবে বলল, আব্বু ভালো হলেই চলে আসবো।

– তাহলে সব নিয়ে যাও।

– এই না না। পাগল নাকি!

– তাহলে বলো কয়দিন পর আসবে? তিনদিন, চারদিন, পাঁচদিন, এক সপ্তাহ?

– নিক্বণ আপুকে জিজ্ঞেস করে নেবেন। এখন চলুন দেরি হচ্ছে।

রিয়ান মুখ ভার করে কোটটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, পরিয়ে দাও। মম উচ্চবাচ্য না করে পরিয়ে দিল। তা না হলে কথা বলে আরো দেরি করবে। ওরা নিচে এসে দেখল যে যার মতো বেরিয়ে গেছে। ওরাও বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। গাড়ির সিট বেল্ট লাগাতে লাগাতে মম বলল, কেন এমন আচরণ করছেন? রিয়ান গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল, কেমন? মম জানালার কাচ নামিয়ে দিয়ে বাইরে তাকাল। কালকের সামান্য বৃষ্টির পরও আকাশে এখনো কালো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। সেই দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলল, বড্ড বেশি কেয়ারিং মনে হচ্ছে। রিয়ান রাস্তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, যার জন্য অপেক্ষা করছিলাম তাকে এতদিন পরে পাওয়ার পর যত্ন করব না? মম ওর কথা বুঝতে পারল না। কিছু বলবে বলেও যেন বলতে ইচ্ছে হল না। চুপচাপ আকাশের মেঘের খেলা দেখতে লাগল।

ওরা বাসায় পৌঁছালো সাড়ে নয়টার দিকে। নক করতে বৃষ্টি দরজা খুলে ভেতরে জানান দিল ওদের আসার কথা। শুনেই রায়হান সাহেব হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। মুখে উজ্জ্বল হাসি নিয়ে ওদের বসালেন বসার ঘরে। মাধুরী খালা এক পলক উঁকি মেরে নাস্তা বানাতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। রিয়ান জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন, আব্বু? তিনি উত্তরে ভালো বলে বললেন, তোমাদের সবাই ভালো আছে?

– জ্বি।

– কই মাধুরী, নাস্তাটা দিয়ে যা।

মম রায়হান সাহেবকে থামিয়ে দিয়ে বলল, এত তাড়াহুড়োর কিছু নেই আব্বু। আমরা জিনিসগুলো রেখেই বেরিয়ে যাবো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাবি? রিয়ানও একই প্রশ্ন করতে মম অবাক হয়ে বলল, অফিস যাবো না?

– কাল না বললাম তোমার ছুটি?

– এত ঘন ঘন ছুটি নিলে অফিসের সবাই কি বলবে? আমি তো জয়েনের পর থেকে কেবল ছুটিতেই আছি।

– তাহলে আর একটা নিলে কিচ্ছু হবে না।

– আচ্ছা, আমি না হয় যাবো না, আপনি?

– আব্বু গেছে। আমি গিয়ে কি করব? আজকে কব্জি ডুবিয়ে শ্বশুরবাড়িতে ভোজ করব।

মম বোকার মতো তাকালো। রায়হান সাহেব হেসে বললেন, বেশ বলেছো জামাই। আজকে ভালো করে খাওয়া দাওয়া করাতে হবে। রিয়ানও মাথা নাড়িয়ে বলল, ঠিক বলেছেন আব্বু। আপনার মেয়েটা কিচ্ছু বোঝে না। দুইজনে মিলে হাসতে লাগল। মম মুখ গোমড়া করে দুইজনের কথা শুনতে লাগল। এমন ভাবে কথা বলছে যেন দুইজনে এককালে বন্ধু ছিল। মাধুরী খালা নাস্তা টেবিলে রাখলেন। রিয়ান তো খুশি হয়ে বলল, কত খাবার! মম দেখল বাসায় যা ছিল সব দিয়ে দিয়েছে। পাঁচ সাত রকমের ফল, মিষ্টি, রসগোল্লা, চানাচুর আরো কত কি! চা আর বিস্কিট দেওয়া বাকি। এই জামাই মানুষটারই ভাগ্য ভালো। যত রকমের বাহারি খাবার এর কপালেই থাকে। আর মেয়েদের যত জ্বালা। নিজের ঘর ছেড়ে পরের ঘরে গিয়ে সংসার করতে হয়। ঘরে যা খাবার দাবার বানানো হবে সব মেহমানদের; না হয় জামাই আসলে খাবে। নিজে বানালেও খাবার কপালে থাকে এক কোণা। এসব ভাবতে ভাবতে মম রিয়ানের দিকে চোখ ছোট করে তাকালো। রিয়ানের খেয়াল হতে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, কি? হিংসে হচ্ছে? মম ডোন্ট কেয়ার ভাব করে রান্নাঘরে রওনা দিল। এজন্য বোধহয় ছেলেদের ভুঁড়ি এত তাড়াতাড়ি বাড়ে। ভেবে মুচকি হাসতে হাসতে চুলার সামনে এসে দাঁড়ালো। চা হচ্ছে ওখানে। কাপে চিনি আর দুধ নিতে নিতে নিজেকে বলল, নিনিটাকে দেখছি না আজকেও। কালও হুট করে উধাও হয়ে গিয়েছিল। কোথায় এখন কে জানে। বর্ষা উঁকি মেরে বলল, তুই এখানে? যা সোফায় গিয়ে বোস। আমি চা নিয়ে আসছি।

– আরে চাই তো। আমি নিতে পারব। আচ্ছা নিনি কোথায় গো বর্ষাপু?

– ও……? আছে তো…। বাইরে কোথাও ঘুরতে গেছে।

– বাইরে!? ও তো বাইরে যায় না। আজ হঠাৎ!?

– ঐ আর কি। দরজা খোলা পেয়ে বেরিয়েছে। ভাবলাম বাসা থেকে তো বের হয় না তেমন থাকুক একটু বাইরে।

মমর বর্ষার কথা শুনে কেমন যেন লাগল। কি যেন লুকাচ্ছে মনে হচ্ছে। কেমন নকল হাসি দিচ্ছে। নিজে ব্যাপারটা বোঝা দরকার; ভাবতে ভাবতে চা নিয়ে বসার রুমে এল। দেখল বৃষ্টিও ওদের সাথে আড্ডায় বসেছে। মাধুরী খালা খাবার টেবিল গুছিয়ে রাখছেন। মম চা দিয়ে এসে একবার ভাবল নিনির কথা জিজ্ঞেস করবে কিন্তু তার আগেই রিয়ান এসে বলল, মম, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে।

– তো?

– চলো ভিজবো।

– পাগল? তাছাড়া বাসার সবাই কি ভাববে?

– আরে কি আর ভাববে? চলো তো।

রিয়ান ওর হাত ধরে দরজা খুলে সোজা চলে এল ছাদে। আসলেই ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। তার মাঝেই ওকে টেনে নিয়ে এল। মম প্রথমে আপত্তি করলেও পরে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে রইল। এভাবে কবে শেষ ভিজেছে মনে পড়ছে না। অনেক আগে একবার একজনের সাথে ভিজেছিল। কত হাসি কত মজার ছিল দিনগুলো। ভেজা শেষে মায়ের হাজার একটা বকা খাওয়ার পরও দুজনে খিলখিল করে হেসেছিল রুমে গিয়ে। দিনগুলো মনে পড়লে চোখ ভিজে আসল ওর। গড়িয়ে পড়া নোনতা পানি বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে গেল। ওকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রিয়ান জিজ্ঞেস করল, কিছু হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?

– না। ভেজা হলে ঘরে চলুন।

– মাত্র তো এলাম। কি হয়েছে বলতো।

– পুরানো দিনের কিছু রঙিন স্মৃতি মনে পড়ল।

– তাই নাকি? কি শুনি।

– পরে শুনবেন। এখন নিচে চলুন৷ যা ভিজেছেন তাতেই ঠান্ডা লেগে যাবে।

মম পিছন ফিরে রওনা দেওয়ার আগে রিয়ান ওকে জড়িয়ে ধরল। সাথে সাথে কেঁপে উঠল ও। রিয়ান আবদারের সুরে বলল, থাকি না কিছুক্ষণ। মম কিছু না বলে চোখ বন্ধ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কেমন অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করছে ওর মাঝে। এই ভালাে লাগার কি নাম দেওয়া যায়!?

ওর ভাবনার মাঝে কারো ছবি তোলার শব্দ হলো। ও চোখ খুলে দেখল বৃষ্টি দাঁত দেখিয়ে হাসছে। হাতে ফোন। মম লজ্জায় সাথে সাথে রিয়ানকে সরিয়ে দিয়ে বলল, নিচে চলুন। সবার সামনে আমাকে একেবারে লজ্জায় মিশিয়ে ফেলবেন দেখছি। ও দ্রুত নিচে রওনা দিল। রিয়ানও হেসে ওকে অনুসরণ করল।

বাসায় এসে দেখল বর্ষা আর বৃষ্টি ফিসফিস করে কথা বলে হাসছে। মাধুরী খালা রান্নাঘরে দুপুরের খাবারের আয়োজন করছেন। রায়হান সাহেব নিজের রুমে। মম দ্রুত কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে বদলে এল। রিয়ান এসে ওর রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। মম বের হয়ে বলল, আপনি কাপড় বদলে এসে বসুন আমি চা করে দেই। টাওয়ালটা দিয়ে মাথাটা মুছে নিন। কাপড় তো আনেননি।

– কে বলেছে? ঐযে লাগেজ।

মম তাকিয়ে দেখল ওর ব্যাগের সাথে একটা ছোট লাগেজ। আগে খেয়াল করে নি। মম মনে মনে ভাবল, আগে থেকেই তাহলে তৈরী হয়ে ছিল। মম লাগেজ এগিয়ে দিয়ে বলল, তাহলে আর কি। কাপড় নিয়ে পরে ফেলুন।

– আমার হাত ভেজা। নিয়ে দিন।

মম বেশ বিরক্ত হয়ে লাগেজ খুলল। একটা সেট বের করতে বলল, আরে এটা না। ঐযে হালকা আকাশিটা। মম বিরক্তিভরা কন্ঠে বলল, এটায় কি সমস্যা? ওটা নিতে গেলে সব কাপড় এলোমেলো হয়ে যাবে৷ রিয়ান জেদি বাচ্চাদের মতো বলল, আমার ঐটাই লাগবে৷

– কেন? ওটাতে কি আছে?

– তোমার সাথে মিলবে।

মম এবার খেয়াল হলো। ও হালকা আকাশি একটা শাড়ি পরেছে। রিয়ানের জামা কাপড় দেখে যা মনে হচ্ছে সে মমর সাথে মিলিয়ে জামার সেট এনেছে। রিয়ানের দিকে না তাকিয়ে কাপড়ের সেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমি রান্নাঘরে গেলাম চা গরম করতে। তখন তো খাননি। রিয়ান কাপড় নিতে নিতে বলল, লজ্জায় তোমার কান লাল হয়ে আছে মম। ও কিছু না বলে দ্রুত রান্নাঘরের দিকে গেল।

রিয়ান ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এল। টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে মমর রুম দেখতে লাগল। ভেজা জামা কাপড়ের পানিতে রুমে বন্যা বয়ে গিয়েছিল। এখন দেখছে শুকনো। কেউ মুছে গেছে। রিয়ান খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রুম পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। রুমের এক কোণায় দুইজন শুতে পারে এমন একটা বিছানা। তাতে লাল গোলাপের বিছানার চাদর বিছানো। বিছানায় দুটো বড় বালিশ আর একটা ছোট কুশন। সাইডে একটা পাশবালিশ। তার পাশে একটা শেলফ৷ সেখানে নানা রকমের বই। তারপাশে পড়ার টেবিলটা ঠিক জানালার সাথে। অপরপাশে বারান্দা থাকায় বৃষ্টির পানি রুমে ঢুকতে পারছে না। ওয়াশরুমের দরজার পাশে ড্রেসিং টেবিলটা। সেখানে মমর সাজার সরঞ্জামগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল রিয়ান। খুব আহামরি কিছু নেই৷ যা আছে তাও খুব একটা পরতে দেখেনি মমকে। সাথে দিয়ে ওর আলমারির দরজা হা হয়ে আছে। তাড়াহুড়োয় হয়ত মারা হয়নি ঠিক মতো। সেই ফাঁক দিয়ে একটা কোট দেখা যাচ্ছে। রিয়ানের কেমন চেনা চেনা লাগল। ওর কোট হতে পারে আন্দাজ করে আলমারির দরজায় হাত দিতেই নাকে কেমন যেন সুড়সুড়ি লাগল। খানিকের মধ্যে হাঁচি শুরু হয়ে গেল। ঠান্ডা লাগল নাকি ভাবতে ভাবতেই পায়ের কাছে কি যেন নড়ছে অনুভব হলো। সেই জিনিসটা ঘষে ঘষে এ পা থেকে ও পা করছে। রিয়ান ভয়ে ভয়ে তাকাতেই একটা চিৎকার দিয়ে উঠল।

রিয়ানের চিৎকারে সবাই দৌঁড়ে চলে এল মমর রুমে। দেখল রিয়ান ফ্লোরে পা মেলে বসে আছে। হাঁচতে হাঁচতে নাক মুখ লাল হয়ে গেছে। আর নিনি আরাম করে ওর কোলে বসে পা চাটছে। বর্ষা তাড়াতাড়ি নিনিকে সরিয়ে নিল। মম রিয়ানকে উঠিয়ে বিছানায় বসিয়ে বলল, কি হয়েছে? রিয়ানের হাঁচি তখনো কমেনি। বর্ষা নিনিকে রায়হান সাহেবের রুমে রেখে এসে বলল, ওর বিড়ালে এলার্জি আছে। বিয়ের দিন আদ্রিতা আমাকে বলেছিল। মম রিয়ানের দিকে তাকাল। বেচারার নাক মুখ ফুলে গেছে। হাঁচিটা কিছুটা কমেছে৷ মম তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করল, কোনো ওষুধ আছে? রিয়ান আস্তে করে বলল, লাগেজের সাইড পকেটে। ও গিয়ে ওষুধ এনে দিল৷ দশ মিনিট পর অনেকটা কমে এল সব। মম রাগের সুরে বলল, এতই যখন এলার্জি তো এসেছেন কেন?

– আমি কি জানি নাকি এখানে বিড়াল আছে?

সবাই চুপ করে রইল। মম বলল, তাহলে দুপুরে খেয়ে বাড়ি চলে যান। এখানে থাকলে আবার শরীর খারাপ করবে। নিনি যেভাবে বসে ছিল কোলে দেখে মনে হচ্ছে আপনাকে পছন্দ করেছে। সুযোগ পেলে কাছে এসে ঘুর ঘুর করবে। রিয়ান অভিমানের সুরে বলল, দেখলেন আব্বু? বিড়াল পর্যন্ত আমাকে পছন্দ করে কাছে এসে বসে থাকে। আর আপনার মেয়ে আমাকে বাসা থেকে চলে যেতে বলছে। আমাকে একটুও পছন্দ করে না। মম ভ্যাবাচেকা খেয়ে ওর দিকে তাকাল। কি থেকে কি বলল! রায়হান সাহেব ওর পক্ষ নিয়ে বলল, কি রে তুই! জামাইটা আজকে প্রথম এল। আর তুই চলে যেতে বলছিস।

– কিন্তু……

– নিনিকে কেউ রাখলেই তো হলো। তাহলে জামাইর কাছে সে আসবে না।

মম কি বলবে বুঝতে পারল না। সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। মম যেতে লাগলে রিয়ান হাত ধরে টেনে বিছানায় বসিয়ে বলল, তুমি যাচ্ছো কোথায়?
#মম_চিত্তে
#পর্ব_১৯
#সাহেদা_আক্তার

মম চা আনার কথা বলতেই রিয়ান বাঁধা দিয়ে বলল, এখন চা খাবো না। আমার মাথাটা টিপে দাও। হাঁচি দিতে দিতে মাথাটা ধরে গেছে। সকালের কথা মনে উঠতেই মুখ লাল হয়ে গেল। বলল, আপনি বালিশে মাথা রাখুন আমি টিপে দিচ্ছি।

– বালিশে কেন? কোথায় বলবা, আসো আমার কোলে মাথা রাখো; তা না।

– যা বলেছি তা করুন না হলে নিনিকে এনে কোলে বসাবো।

রিয়ান মুখ ভার করে বলল, ব্ল্যাকমেইল করছো? হুহ। লাগবে না মাথা টিপে দেওয়া। বলে অপর পাশ ফিরে শুয়ে গেল। মম দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওর মাথার কাছে এসে বসল। মাথা টিপে দিতে লাগল। রিয়ান তাও যেভাবে ছিল ওভাবেই রইল। ওর দিকে ফিরল না৷ মমর মাথা টিপে দিতে অসুবিধা হচ্ছে। ওর দিকে ফেরার কথা বলার জন্য মুখ খুলতেই ফোনে নোটিফিকেশনের শব্দ হলো। মম ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল বৃষ্টি একটা ছবি দিয়েছে। ওর আর রিয়ানের। রিয়ান যে বৃষ্টিতে পেছন থেকে ওকে ধরে ছিল। মাথা টেপা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রিয়ান আড়চোখে মমর দিকে তাকালো। ওকে লজ্জায় ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হুট করে ফোনটা নিয়ে বলল, দেখি কি দেখছো। মম ওর হাত থেকে ফোন নিয়ে নিতে চাইল। কিন্তু রিয়ানের সাথে পারল না। তার আগেই রিয়ান দেখে ফেলল। দেখে খুশি বলল, বাহ্! আমার শালি তো দারুণ ছবি তোলে! দাঁড়াও ওকে তাহলে ছবি তোলার কাজ দিতে হবে। মম অপর পাশ ফিরে মাথা নিচু করে বসে রইল। হাত দিয়ে শাড়ি নাড়াচাড়া করছে। রিয়ান ওর কাঁধে চিবুক রাখতেই মম নড়ে উঠল খানিকটা। বলল, তোমাকে সুন্দর লাগছে ছবিটায়। মম সাথে সাথে ফোনটা কেড়ে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চাটা পাঠিয়ে দিচ্ছি। খেয়ে নিন। নাহলে ঠান্ডা লেগে যাবে। তারপর রুম থেকে বেরিয়ে গেল। রিয়ান মুচকি হেসে আবার শুয়ে পড়ল। তখনই নজর গেল দেয়ালে ফ্রেমে বাঁধানো একটা ছবির দিকে।

হাতে হাতে কাজ করায় দুপুরের আগেই রান্না শেষ হয়ে গেল। রুমে যাবে কি যাবে না করতে করতে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো মম। ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখল রিয়ান ঘুমাচ্ছে। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রুমের দিকে পা বাড়াতেই বর্ষার ডাক পড়ল। বর্ষার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি?

– বোস। তোর সাথে আর কবে কথা হয় না হয়।

– কেন?

– দুপুরে খেয়ে বেরিয়ে যাবো।

– এত তাড়াতাড়ি! আরো ক’টা দিন থাকো।

– না, আমার শাশুড়ী আসবে বিকালে। তার জন্য রান্না করতে হবে।

– এক কাজ করো। এখান থেকে নিয়ে যেও।

– ছিঃ ছিঃ। কি বলিস! আরে আমার বেশি সময় লাগবে না রান্না করতে।

– ধুর বিয়ে জিনিসটাই একটা জ্বালা। কত কিছু মেনে চলতে হয়।

– তা তো যেকোনো পরিবারে থাকলেই চলতে হয়। কোথাও কম কোথাও বেশি। কোথাও নিময়বিহীন জায়গা পাবি না। এখন বল শ্বশুর বাড়ি কেমন।

– ভালোই।

– ভালো হলেই ভালো। আর সে…

– কার কথা বলছো? ও…। আজকে সকালের নাস্তা ছাড়া আর চোখের সামনে আসেনি৷ হয়ত অস্বস্তিতে না হয় অনুশোচনায়। বিয়ের আগে একবার দেখা করেছিল। ক্ষমা চেয়েছে।

– করেছিস ক্ষমা?

– আদ্রিতা আর বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে করে দিয়েছি। কিন্তু যদি আমার জীবনে ফের অশান্তি ডেকে আনে ক্ষমা তো দূর থাকুক মুখও দেখবো না।

বৃষ্টি দরজায় উঁকি দিয়ে বলল, আমাকে ছাড়া গল্প করে ফেলছো? মম হেসে বলল, আরে না। মাত্র বসলাম। আয় বোস। তা কি খবর? পড়ালেখার কি অবস্থা? অনার্স তো শেষ। বৃষ্টি মুখে হাতাশা এনে বলল, তা তো শেষ।

– শেষ তো চেহারা এমন করে আছিস কেন?

বর্ষা মুখ টিপে হেসে বলল, বিয়ের প্রস্তাব আসছে যে তাই। বৃষ্টি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমাকেও তোমাদের দলে ফেলার জন্য পিড়াপিড়ি চলছে। মম বলল, তাহলে তো ভালোই। আমি দেখবো নাকি ছেলে? আমার শ্বশুর বাড়ির ঐ দিকে কেউ আছে কি না।

– খোঁজ খোঁজ। জামাইবিহীন আমি একেবারে মরে যাচ্ছি।

দুইজনে ওর কথা শুনে হাসতে লাগল। হাসি শেষে মম বলল, ওকে, ডিল ডান। আজই খোঁজা শুরু করব। বৃষ্টি বলল, ওখে। খোঁজ। ঠিক তোর জামাই টাইপ। রোমান্টিক হবে। মম ওর কথা শুনে কিছু না বলে চুপ করে গেল। বৃষ্টি ওকে গুঁতো দিয়ে বলল, হয়েছে, আর লজ্জা পেতে হবে না। আপু সব গুছিয়ে নিয়েছো?

– হ্যাঁ।

– ওকে, চলো চলো। দুটো বাজে; খেয়ে বেরিয়ে পড়ি। মম, যা, ভাইয়াকে ডেকে তোল। আসার সময় তো দেখলাম উল্টে পরে ঘুমাচ্ছে। নিনি গিয়ে উপস্থিত হলে খবর হয়ে যাবে।

মম উঠে গেল। আসলেই ঠিক কথা। নিনিটাকে কোনো বিশ্বাস নেই। যাকে পছন্দ হবে তার পায়ে পায়ে ঘুরবে সবসময়। মম রুম বেরিয়ে দেখল নিনি ওর রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। লাফ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিছানায় ওঠার জন্য। মম দ্রুত গিয়ে ওকে ধরতে ম্যাঁও করে করুণসুরে ডাক দিল। ও ফিসফিস করে বলল, ওখানে যাওয়া নিষেধ তোর। বুঝলি? যা আব্বুর কাছে যা। নিনিকে রায়হান সাহেবের রুমে ছেড়ে দিয়ে আবার রুমে আসল। রিয়ান এখনো ঘুমাচ্ছে। কি নিষ্পাপ লাগছে! চুলগুলো একটু বড় হয়ে গেছে। কাটতে বলতে হবে৷ এখন পুরো কপাল ডেকে আছে। ও হাত দিয়ে আলতো করে চুল সরিয়ে দিল। সাথে সাথে রিয়ান পিটপিট করে তাকালো। মম বোকার মতো বলল, ঘুমাননি?

– তোমার বিড়ালটা আসতেই তো নাকটা চুলকানো শুরু করে ঘুমটা ভেঙে দিল। ভালোই হয়েছে। তুমি যে নিজ থেকে এসে আমাকে ছুঁয়েছো তাতো আমার ভাগ্য।

– মজা না করে উঠুন। খেতে হবে।

– উফ! উঠতে ইচ্ছে করছে না। আরো ঘুমাতে ইচ্ছে করছে। বিছানায় তোমার ঘ্রাণ পাচ্ছি।

মম চোখ সরু করে বলল, মশকরা করছেন আমার সাথে? আজকে নতুন বিছানার চাদর পেতেছে খালা। আর মজা করলে নিনিকে এনে কোলে বসিয়ে দেবো৷ উঠুন। রিয়ান গড়িমসি করে বলল, এমন করো কেন? সত্যিই ঘুম পাচ্ছে। মম ডাক পাড়ল, নিনি…। রিয়ান দ্রুত উঠে বসে বলল, পেয়েছো একটা। বাড়িতে চলো না। তখন জ্বালানি কাকে বলে দেখাবো। মম ভেংচি কেটে বলল, নিয়ে যাবো নিনিকে। সারাদিন রুমে বসে থাকবো ওকে নিয়ে। তখন দেখবো জ্বালান কি করে। ও বেরিয়ে গেল রুম থেকে। রিয়ান হেসে ফ্রেশ হতে গেল।

খাবার টেবিলে হরেক রকম পদ। নতুন জামাই এসেছে বলে কথা। খেতে খেতে সবাই গল্প জুড়ে দিয়েছে। রায়হান সাহেব পেয়েছেন মন মতো একজন গল্পের সঙ্গী। সারাক্ষণ এটা ওটা নিয়ে রিয়ানের সাথে আলোচনা সমালোচনা চলছে। খাওয়া শেষ হতেই দুইজন সোফায় গিয়ে বসল। মাধুরী খালা রান্নাঘরে চলে গেলে সব পরিষ্কার করতে। জাবেদ খালু খেয়ে নিচে চলে গেছেন। মম বৃষ্টি আর বর্ষার সাথে রুমে এল। ওরা যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগল। মম জিজ্ঞেস করল, আবার কবে আসবে? বর্ষা হেসে বলল, দেখি। এখন তো তোর সাথে হুটহাট দেখা করা যাবে না। বৃষ্টি বলল, দেখবি আমি হুট করে একদিন তোর বাসায় চলে গিয়ে সারপ্রাইজ দিয়ে দিয়েছি। মম হাসল। লাগেজ নিয়ে রুম থেকে বের হতেই রায়হান সাহেব বললেন, কি হল? চলে যাচ্ছো!? আরো ক’টা দিন থেকে যাও।

– না খালু। বাসায় কাজ আছে। বৃষ্টিরও মাস্টার্স পরীক্ষা সামনে।

– আচ্ছা, সময় সুযোগ করে আবার এসো।

– আচ্ছা।

দুইজনে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল। মম ভাবল বিছানায় একটু পিঠ লাগাবে তার আগেই রিয়ান হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকে বলল, তৈরী হও। মম জিজ্ঞেস করল, কেন? কোথায় যাবো? রিয়ান আলমারি খুলে শার্ট নিতে নিতে বলল, আদ্রিতারা বিদেশে চলে যাচ্ছে। মম অবাক হয়ে বলল, হঠাৎ?

– আলিফ ভাইয়ের নাকি কি জরুরি কাজ পড়ে গেছে তাই আজই চলে যাচ্ছে।

মম কিছু বলল না। রিয়ান ওকে ডেকে বলল, দেখো তো কোনটা পরব। মম প্রতিউত্তরে বলল, যেটা ভালো লাগে। ও একটা সাদা শার্ট বের করে বলল, এটা? মম হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। সায় পেয়ে ও একটা সাদা শাড়ি বের করে দিয়ে বলল, এটা পরে নাও। মম প্রশ্নসূচক মুখ করে বলল, একই দেখতে পোশাক পরতেই হবে!?

– আমার ভালো লাগে। তোমার লাগে না?

মম বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না। রিয়ান ওর সামনে পোশাক পরিবর্তন করতে লাগলে মম হালকা চেঁচিয়ে উঠে বলল, কি করছেন? এখানে শার্ট খুলছেন কেন? রিয়ান ওর দিকে তাকিয়ে বলল, তো কি হয়েছে? আমার বউয়ের সমানেই তো। মম পড়ল বিপদে। সবসময় আমার বউ আমার বউ করে। শুনতে ভালো লাগে আবার লজ্জাও লাগে। কিন্তু তাই বলে এমন করবে? মম শাড়ি হাতে নিয়ে ওয়াশরুম রওনা দিল আর মনে মনে বলল, বিয়ের পর লোকটা আসলেই বাচ্চা হয়ে গেছে।

মম শাড়ি পরে বের হয়ে দেখল রিয়ান তৈরী হয়ে গেছে। সবই ঠিক ছিল। শুধু একটা ব্যাপার ছাড়া। ঐদিনের পাওয়া কোটটা পরে আছে রিয়ান। মম জিজ্ঞেস করল, আপনি এই কোটটা পরেছেন কেন?

– কোটটা সুন্দর না?

– আমি সেটা বলিনি। অন্য কারো কোট আপনি পরেছেন কেন?

রিয়ান কোটের দিকে তাকিয়ে বলল, অন্য কারো!? কার হতে পারে বলো তো। বলে রিয়ান মমকে জড়িয়ে ধরে বলল, বলতে পারো কার কোট হতে পারে? মমর নাকে একটা মিষ্টি ঘ্রাণ লাগল। ঘ্রাণটা রিয়ান থেকে আসছে। এই ঘ্রাণ আগে কোথাও পেয়েছে ও। হুট করে মনে পড়ল এই ঘ্রাণই কোটটাতে পেয়েছিল। ভাবতে ভাবতে মম ওর বুকে মুখ গুঁজে দিল। কেন যেন ভালো লাগছে এভাবে থাকতে। অন্য রকম শান্তি। রিয়ান মাথা নিচু করে ওর কানে ফিসফিস করে বলল, এভাবে থাকলে আদ্রিতাদের বিদায় জানাতে পারব না। মম কথাটা শুনে ওর থেকে সরে এল। রিয়ান দুইপাশে হাত উঠিয়ে বলল, তোমার যদি এভাবে থাকতে ভালো লাগে তাহলে রোজ এভাবে জড়িয়ে ধরে বসে থাকব। মম কিছু না বলে ড্রেসিং টেবিলের কাছে চলে গেল। ও যে লজ্জা পাচ্ছে তা দেখানো যাবে না। তা নাহলে আবার কিছু না কিছু বলে বসবে। বিয়ের পর থেকে কেবল লজ্জায় সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে ও। কেন যে হঠাৎ এত লজ্জায় ধরল ওকে বুঝতে পারছে না।

মম চিরুনির দিকে হাত বাড়াতে রিয়ান এসে চিরুনিটা নিয়ে বলল, বসো, আমি বেঁধে দেই। মম ওর দিকে না তাকিয়ে বলল, আপনি পারবেন? ও জোর করে মমকে টুলে বসিয়ে বলল, দেখো না কি পারি। না পরলে শিখিয়ে দিও। রিয়ান ওর চুলের জট ছাড়িয়ে মাথা বাঁধার চেষ্টা করতে লাগল। খোঁপা বাঁধা হচ্ছে না ওর। তাই বেণী করার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু কোনদিক থেকে কোন প্যাঁচ দিবে বুঝতে পারছে না। রিয়ান মন দিয়ে ওর চুল বাঁধার চেষ্টা করছে আর মম আয়নায় একদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে ওর অজান্তেই ওর ছোট ছোট স্বপ্নগুলো এক এক করে পুরণ করে দিচ্ছে রিয়ান। ওর ভাবনার মাঝে রিয়ান বলল, শেষ। মম বেণীটা দেখে হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না। চুলকে তিন ভাগ করে কোনো রকমে পেঁচিয়ে দিয়েছে ও। হাসিটাই বেশি পেল মমর। সেই বেণীকে ঘুরিয়ে খোঁপা করে কাঁটা আটকে দিল। রিয়ান কোমরে দুই হাত দিয়ে মাথা উঁচু করে বলল, কেমন করলাম? মম হেসে বলল, খুব ভালো করেছেন।

– দেখতে না কে করেছে।

মম কোটটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, এটা তাহলে আপনার কোট। ঐদিন আপনার সাথে দেখা হয়েছিল তাহলে। কোথায় বলুন তো? মনে পড়ছে না আমার। রিয়ান আয়নার সামনে গিয়ে নিজের চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল, তুমি বিদ্যুৎ চমকানোয় ভয়ে একটা হোটেলের সামনে কুঁকড়ে ছিলে। আমার ঐদিন মিটিং ছিল ওখানে। বিড়ালের এলার্জির কারণে বেরিয়ে এসেছিলাম বাড়ি যাবো বলে। তখন তোমাকে দেখলাম ভিজে অবস্থায় মাথা নিচু করে ভয়ে কাঁপছো। তাই কি ভেবে কোটটা তোমার উপর দিয়েছিলাম। রিয়ান ওর দিকে ফিরে বলল, দেখো তো তোমার জামাইকে হ্যান্ডসাম লাগছে কি না। মম হ্যাঁ বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ‘তোমার জামাই’ শব্দটাতে এত লজ্জা আগে জানতো না মম।

চলবে…
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here