মরিচাধরা মনের খাঁচা পর্ব -০১

১.
আমার স্বামী তার প্রাক্তন প্রেমিকার হাত ধরে বসে আছে আর আমি বসে আছি ঠিক তাদের সামনের চেয়ারে। আজ অয়নের ঠোঁটের কোণের হাসিটা তৃপ্তি নিয়ে দেখছি আমি। কারণ বিয়ের দেড় বছরে আমি কখনো হাসতে দেখিনি তাকে। আজ সে প্রাণ খোলে হাসছে নিজের ভালোবাসাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে আর আমি যন্ত্রণার আগুনে দাউদাউ করে পুড়ছি, আমার ভালোবাসার মানুষটাকে হারানোর সন্নিকটে দাঁড়িয়ে। অয়ন যেনো ভুলে গেছে তার সামনে তার বিবাহিতা স্ত্রী বসে আছে, প্রাক্তনে সে এতোটাই মগ্ন হয়ে গেছে। আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি অয়নের দিকে, তবে তাদের কোনো কথা আমার মস্তিষ্কে যাচ্ছে না। অয়নের প্রাক্তন নয়নার দৃষ্টি আমার দিকে যেতেই সে কপাল কুঁচকে ফেললো। অয়নের দিকে তাকিয়ে থাকাটা তার ভালো লাগেনি। অয়নও নয়নার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো আমার দিকে আর আমি থতমত খেয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম।

অয়ন একবার নয়নার দিকে তাকিয়ে আবার নিঝুমের দিকে তাকালো আর মুচকি হেঁসে বললো, সরি নিঝুম তোমার কথা একদমই ভুলে গিয়েছিলাম।

নিঝুম অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো অয়নের দিকে। সামনে বসে থাকা মানুষটাকে এক মুহুর্তে ভুলে গেছে অয়ন। তাহলে নিঝুম তার চোখের আড়াল হলে নিশ্চয়ই চিরতরে ভুলতে খুব একটা সময় লাগবে না অয়নের। কিন্তু নিঝুম তো পারবে না এই মানুষটাকে কোনোদিন ভুলতে। চোখে নোনাজলের অস্তিত্ব অনুভব করলে নিঝুম দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। কিন্তু টেবিলের উপর রাখা হাতে কারো কোমল স্পর্শে কেঁপে উঠে সামনে তাকালো আবার। টেবিলের উপর রাখা হাত দুটোর উপর হাত রেখেছে অয়ন। নিঝুম একবার সেদিকে তাকিয়ে অবাক চোখে তাকালো অয়নের দিকে। এর আগে অয়নের এতো কোমল স্পর্শ ভাগ্যে জুটেনি নিঝুমের।

অয়ন কৃতজ্ঞতার স্বরে বললো, অসংখ্য ধন্যবাদ নিঝুম।

অয়নের এতো কোমল গলায় বলা কথাও নিঝুমকে অবাক করছে। কারণ এর আগে অয়ন যতবার নিঝুমের সাথে কথা বলেছে তার কণ্ঠে ছিলো বিরক্তি অথবা তীব্র রাগ। অয়নের প্রত্যেকটা ব্যবহার আজ নিঝুমকে অবাক করছে। নিঝুমের ভাবনার জগতে আবার ব্যাঘাত ঘটালো অয়নের কণ্ঠস্বর।//লেখনীতে তাহমিনা তমা //

আমি সারাজীবন তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো নিঝুম।

নিঝুমের ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ফোটে উঠলো, হাসিটা তার নিজের উপর। কতটা ব্যর্থ স্ত্রী হলে নিজের স্বামীকে তার প্রাক্তন প্রেমিকার হাতে তুলে দিতে পারে। তবে আজ সে নিরুপায়। সবসময় মুখে কথার খই ফোঁটা মেয়েটার মুখে আজ কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। শব্দগুলো গলায় কুন্ডলী পাকিয়ে আঁটকে যাচ্ছে যেনো।

নিঝুম নিজের সাথে যুদ্ধ করে একটু আওয়াজ বের করলো গলা থেকে, আপনারা তাহলে কথা বলুন আমি বরং আসছি।

নয়না ব্যস্ত হয়ে বললো, তা কেনো ? তুমি বরং আমাদের সাথে লাঞ্চ করে তারপর যাও।

নিঝুম উঠে দাঁড়িয়ে নিজের পার্সটা হাতে নিয়ে বললো, আপনাদের অনেকদিন পর দেখা। অনেক পার্সোনাল কথা থাকতে পারে আমি থেকে সেখানে বাঁধার সৃষ্টি করতে চাই না।

একবার অয়নের দিকে তাকিয়ে বললো, আর যাইহোক কারো বিরক্তির কারণ হতে চাই না আমি।

কথাটা বলে দাঁড়ালো না নিঝুম। এলোমেলো পা ফেলে বের হয়ে গেলো রেস্টুরেন্ট থেকে। বাইরে দুপুরের ভ্যাপসা গরম, তবে রোদ নেই। আকাশে মেঘের আনাগোনা বেড়েছে আর বাতাসে তাপের মাত্রা। নিঝুম রিকশায় না উঠে সামনে হাঁটতে লাগলো। অয়ন যতক্ষণ নিঝুমকে দেখা গেলো ততক্ষণ তাকিয়ে রইলো। নয়না তার একটা হাত আঁকড়ে ধরলে নয়নার দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসি টেনে নিলো ঠোঁটের কোণে। তবে কেনো যেনো আর মন বসাতে পারলো না নয়নার প্রতি। তবু নয়নাকে খুশি করার জন্য তার সঙ্গ দিতে লাগলো।

২.
নিঝুম হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ পায়ের জুতো ছিঁড়ে গেলো। একবার পায়ের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো নিঝুম। জুতো জোড়া খুব প্রিয় ছিলো নিঝুমের, কারণ অয়নের থেকে খুব বায়না ধরে জুতোটা কিনেছিলো সে।

জুতোর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো, প্রিয় মানুষটাই যেখানে রইলো না, সেখানে তুই আর থেকে কী করবি ? //লেখনীতে তাহমিনা তমা//

জুতো জোড়া খুলে আবার হাঁটতে লাগলো। রাস্তার ছোট ছোট ইট পাথরের টুকরো বড্ড লাগছে পায়ে। সেসব উপেক্ষা করে হাঁটছে মেয়েটা। পায়ে তীব্র ব্যাথা অনুভব হলে উফফ করে উঠলো নিঝুম। নিচে তাকিয়ে দেখলো পায়ের নিচে রক্ত দেখা যাচ্ছে। পা একটু উঁচু করে দেখলো ভাঙা কাঁচের টুকরো গেঁথে গেছে। টকটকে লাল রক্ত বিন্দু টপটপ করে কংক্রিটের ফুটপাতে পড়ছে। নিঝুম অনুভব করার চেষ্টা করলো কোনো যন্ত্রণাটা বেশী। বুকের ভেতর যেটা হচ্ছে নাকি বাহ্যিক যন্ত্রণাটা। বুঝতে পারলো ভেতরের ক্ষতের কাছে এই ক্ষত কিছুই নয়। কাঁচের টুকরো টান দিয়ে তুলতেই মুখ কুঁচকে গেলো নিঝুমের। সামান্য আঘাতে বাড়ি মাথায় তোলা মেয়েটার আজ এতো সাহস কীভাবে হলো নিজেই ভেবে পেলো না নিঝুম। একবার ফুলদানি থেকে শুকনো গোলাপ ফুল সরাতে গিয়ে একটা কাঁটা ফোটে গিয়েছিলো নিঝুমের হাতে। সেই কাঁটা বের করতে গিয়ে পুরো বাড়ি মাথায় তুলেছিলো৷ হাতের কাছে সূচ আনলেই চিৎকার শুরু করছিলো। নিঝুমের মা মেয়ের কান্ডে বিরক্ত হয়ে গেলেও, মেয়েকে আদর করে বুঝাচ্ছিলো নিঝুমের বাবা। শেষে নিঝুমের বাবা কথায় কথায় ভুলিয়ে রাখে আর তার মা কাঁটা বের করে দেয়। মিষ্টি অতীতের কথা মনে হতেই চোখে পানি নিয়ে ফিক করে হেঁসে দিলো নিঝুম। পরক্ষণে বাবার কথা মনে করে মুখ থমথমে হয়ে গেলো।

আপা আপনের পা থেকে তো অনেক রক্ত বের হইতাছে।

পাশে থেকে কেউ কথাটা বলে উঠলে নিঝুম তাকালো তার দিকে। সতেরো বা আঠারো বছরের একটা মেয়ে, হাতে বিভিন্ন ধরনের ফুলে ভড়া টুকরি দেখেই বুঝা যাচ্ছে ফুল বিক্রেতা।

নিঝুম আবার পায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, তেমন কিছু না।

আপা কী কন ? কীভাবে রক্ত বার হইতাছে, আপনে চলেন আমার সাথে এই ফার্মেসিতে।

নিঝুমের উত্তর না শুনেই মেয়েটা নিঝুমের এক হাত ধরলো। নিঝুম খানিকটা অবাক হলো মেয়েটার কাজে। আসলে আল্লাহ যাদের সম্পদ দেননি তাদের দিয়েছেন বিশাল একটা মন আর মানুষের সম্পদের পরিমাণ যত বাড়তে থাকে তাদের মনটা যেনো ততই ছোট হতে থাকে। নিঝুম মেয়েটার সাহায্যে ফার্মেসিতে গেলে ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দিলো আর সাথে কিছু মেডিসিন। নিঝুম পার্স থেকে টাকা বের করে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।

মেয়েটা বললো, আপা আপনে দাঁড়ান আমি একটা রিকশা ডাইকা দেই।//লেখনীতে তাহমিনা তমা //

নিঝুম মুচকি হেঁসে বললো, তোমার নাম কী ?

মেয়েটা মুখ ভর্তি একটা হাসি দিয়ে বললো, সাথী।

মাশাআল্লাহ তোমার মতো তোমার নামটাও খুব সুন্দর। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আমাকে সাহায্য করার জন্য। তবে রিকশা ডেকে দিতে হবে না আমি সামনের এই পার্কে যাবো একটু।

সাথী হাসি মুখে বললো, ঠিক আছে চলেন আমি নিয়া যাইতেছি।

সাথী আবার নিঝুমের এক হাত ধরলে নিঝুম খুঁড়িয়ে চলছে। সাথীর এবার খেয়াল হলো নিঝুমের পায়ে জুতো নেই।

অবাক কণ্ঠে বললো, আপা আপনের জুতা কই ?

নিঝুম ব্যাথায় মুখ কুঁচকে বললো, ছিঁড়ে গেছে তাই ফেলে দিয়েছি।

খালি পায়ে তো আপনের কষ্ট হইতাছে। আগে জুতা কিনা লন, টাকা না থাকলে আমি কিনা দেই।

নিঝুম বিস্ময় নিয়ে তাকালো সাথীর দিকে। নিজের পেট চালানোর জন্য এই বয়সে মেয়েটা ফুল বিক্রি করছে আবার সে নিঝুমের জন্য জুতো কিনে দিতে চাইছে।

নিঝুম নিজের বিস্ময় কাটিয়ে বললো, টাকা আছে তবে আজ জুতো পড়তে ইচ্ছে করছে না আর বাসায় অনেক জুতো আছে তাই নতুন করে কেনা মানে অপচয়।

সাথী হতাশ গলায় বললো, আপনার পায়ে তো বেশি ব্যাথা করবো আরো।

নিঝুম আনমনে বললো, আমি তো চাইছি ব্যাথা লাগুক। যাতে বাহিরের ব্যাথার জন্য ভেতরের ব্যাথাটা একটু হলেও কম অনুভব হয়।

সাথী বুঝলো না নিঝুমের কথা তাই মানে জিজ্ঞেস করলো, তবে নিঝুম এড়িয়ে গেলো। সে সাথীর পরিবারের কথা জিজ্ঞেস করলো। //লেখনীতে তাহমিনা তমা //

তোমার বাড়িতে কে কে আছে ?

সাথী মাথা নিচু করে মলিন হেসে বললো, ছয় মাসের একটা মাইয়া আছে আর বৃদ্ধ মা।

নিঝুম অবাক হয়ে তাকালো সাথীর দিকে। এতো ছোট একটা মেয়ের নাকি আবার একটা বাচ্চাও আছে।

তোমার স্বামী কোথায় ?

সাথী দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, মাইয়া হইছে দেইখা সে আরেক বিয়া কইরা আমারে তালাক দিয়া দিছে।

নিঝুম চমকে উঠে বললো, কী বলো ? তুমি কিছু করোনি ?

আমরা গরীব মানুষ আপা, কী করুম ? মাইয়া নিয়া মায়ের কাছে চইলা আইছি। ফুল বেইচা যা পাই তা দিয়া তিন জনের কোনোমতে চইলা যায়।

তোমার আর ভাইবোন নেই ?

বড় ভাই আছে দুইজন, তারা বউ নিয়া বাসায় থাকে। তাদের কাছে জায়গা হয় নাই আমাগোর।

নিঝুম দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। পৃথিবীতে প্রত্যেকের জীবনে একটা গল্প থাকে। কারো জীবনের গল্প সুখের তো কারো কষ্টে জড়ানো। সাথীর সাহায্যে পার্কের নিরিবিলি জায়গায় একটা বেঞ্চে বসলো নিঝুম। তার বড্ড ক্লান্ত লাগছে আজ, শারীরিক মানসিক দু’দিক থেকেই।

আপা আপনি এইহানে বসেন আমি দেখি কয়ডা ফুল বেচা পারি নাকি।

নিঝুম মুচকি হেঁসে সম্মতি জানালে সাথী চলে গেলো সামনের দিকে। মেয়েটার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলো নিঝুম। এই একটু সময়ে নিঝুমের মনে একটা দাগ কেটে গেলো মেয়েটা। দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে পিছনে মাথা এলিয়ে দিলো নিঝুম। চোখ বন্ধ করতেই চোখের কোণ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে গেলো তার। বুকের বা পাশটার ব্যাথাটা একটু একটু করে বাড়ছে। মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। চোখ বন্ধ করতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো দেড় বছর আগে অয়নের সাথে প্রথম দেখা হওয়ার সেই স্মৃতি।

৩.
দুপুরের তপ্ত গরমে ঘেমে একাকার হয়ে ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরেছে নিঝুম। ক্লাসের পড়া শিখে না যাওয়ায় স্যার আজ অনেক কথা শুনিয়েছে তাকে। সে নিয়ে মাথায় আগুন জ্বলছে তার। সে কী এখন স্কুলের বাচ্চা মেয়ে নাকি যে পড়া না পারলে এভাবে কথা শুনাবে। দু’বার কলিংবেল বাজানোর পর যখন দরজা খুললো না তখন দরজায় জোরে জোরে দুটো আঘাত করলো নিঝুম। তৃতীয় আঘাত করার আগেই দরজা খোলে গেলো আর নিঝুম নিজের ব্যালেন্স হারিয়ে সামনে ঝুঁকে কারো গায়ের উপর পড়লো। বিরক্তি নিয়ে সরে এসে কিছু কথা শুনানোর জন্য সামনে তাকিয়ে থমকে গেলো। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। মায়াবী মুখে চাপদাড়ি, চশমা চোখে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে নিঝুমের দিকে। লম্বায় নিঝুমের থেকে অনেকটা বেশি হওয়ায় নিঝুম মাথা উঁচু করে তাকিয়ে দেখলো ছেলেটার মুখের দিকে। লম্বা চওড়া পেটানো শরীরে নিঝুমের প্রিয় কালো রঙের শার্ট গায়ের সাথে সেঁটে আছে। অসম্ভব সুদর্শন দেখতে ছেলেটার উপর ছোট খাটো একটা ক্রাশ খেয়ে ফেললো নিঝুম।//লেখনীতে তাহমিনা তমা //

ছেলেটা বিরক্তি নিয়ে গম্ভীর গলায় বললো, কাকে চাই ?

এবার নিঝুমের কপাল কুঁচকে গেলো। তার বাড়িতে দাঁড়িয়ে তাকে বলছে কাকে চাই ?

নিঝুম নিজের ক্রাশ খাওয়া বালি চাপা দিয়ে তেতে উঠে বললো, কাকে চাই মানে ? আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমাকে বলছেন কাকে চাই ? এই কে আপনি হ্যাঁ আর আমার বাড়িতে কী করছেন ?

চলবে,,,,, ?

#মরিচাধরা_মনের_খাঁচা
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ০১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here