মরিচাধরা মনের খাঁচা পর্ব -১৭ ও শেষ পর্ব

#মরিচাধরা_মনের_খাঁচা
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
অন্তিম পর্ব

তার ছোট আম্মু সেই পছন্দ করেছে।

তয়ন ছবিটা বুকে জড়িয়ে হারিয়ে গেলো আজ থেকে ছয় বছর আগে।

২৯
নিঝুম সেদিন অয়নকে মাফ করে দিলেও পরিক্ষা পর্যন্ত সিলেট ছিলো আর অয়ন ঢাকা চলে আসে। অয়ন মাঝে মাঝে চলে যেতো নিঝুমের কাছে কিন্তু তয়নের আর যাওয়া হয়নি। অয়ন ফেরার পর আবার পড়াশোনার জন্য চলে গিয়েছিলো সিডনি কিন্তু সাথী যেনো তার জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত দখল করে নিয়েছিলো। এক মুহুর্তের জন্য ভুলতে পারেনি সেই মুখ। এভাবেই কেটে যায় ছয় মাস। ছোট তিথি একটু একটু করে হাঁটতে শিখেছে কেবল। বিকেলে তিথিকে নিয়ে সাথী আর নিঝুম ছাঁদে যায়। বৃষ্টির মৌসুম তাই ছাঁদে শেওলা পরে পিচ্ছিল হয়ে গেছে।

নিঝুম সাথীর উদ্দেশ্যে বললো, দেখে পা ফেলিস খুব পিচ্ছিল হয়েছে। তিথিকে কোলেই রাখ।

সাথী মুচকি হেসে বললো, ঠিক আছে।

আজ একটু রোদের দেখা মিলেছিলো তাই অনেক কাপড় ধুয়ে শুকাতে দিয়েছে ছাদে। সেগুলো নিতেই ছাদে আসা দুজনের। তিথিকে রেখে আসতে চেয়েছিলো কিন্তু মেয়ে তো কেঁদে অস্থির, তাই সাথে এনেছে। ছাদের কাছেই একটা কদম গাছ, তাতে ফুল ফুটেছে। তিথি সেগুলো দেখিয়ে এনে দিতে বলছে আর কাঁদছে।

নিঝুম মুচকি হেসে বললো, তুই ওকে কোলে নিয়ে দাঁড়া আমি দেখি নাগাল পাই কিনা।

ওখানটাতে পিচ্ছিল বেশি মনে হচ্ছে, যেতে হবে না আর রেলিংও নেই ছাদে।

কিছু হবে না তুই দাঁড়া।

সাথীর কথা না শুনে নিঝুম হাত বাড়িয়ে ফুল ধরার চেষ্টা করতে লাগলো কিন্তু একটুর জন্য নাগাল পাচ্ছে না। অনেকটা সময় চেষ্টা করার পরও হাতে আসছে না দেখে নিঝুম আর একটু এগিয়ে গেলো। নিঝুম পারছে না দেখে সাথী মেয়েকে কোল থেকে নামিয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে নিঝুমের দিকে এগিয়ে গেলো। সাথী নিঝুমের কাছাকাছি যেতেই হঠাৎ নিঝুম নিজের ব্যালেন্স হারিয়ে পরে যেতে নেয়। সাথী নিঝুম হাত ধরে টান দিয়ে সরিয়ে আনলেও নিজেকে সামলাতে পারলো না। পা পিছলে গেলো সাথীর, নিঝুম হাত ধরতে গিয়েও পারলো না, হাতে কেবল একটু ছোঁয়া লাগলো। নিঝুম আকস্মিক ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে গেলো। কী হয়েছে বুঝতে পারলে সাথী বলে চিৎকার করে উঠলো কিন্তু ততক্ষণে সাথী নিচের শক্ত পাথরে গিয়ে আছরে পড়েছে। নিঝুম উপর থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো সাথী যেনো তার দিকে তাকিয়ে আছে আর মাথার নিচ থেকে লাল রক্তের স্রোত বয়ে চলেছে। নিঝুমের চোখ থেকে টপ করে এক বিন্দু পানি গড়িয়ে পড়লো। তখনই পেছন থেকে কেঁদে উঠলো তিথি। বেলকনিতে বসে চা খাচ্ছিলো সেলিনা আর নিয়াজ। সেলিনা বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলো তাই পড়তে দেখেছে সাথীকে। হাত থেকে চায়ের কাপ নিচে পরে কয়েক টুকরে ভাগ হয়ে গেলো। চায়ের কাপ পড়ার আগে ভারী কিছু পরার শব্দে বাইরে তাকিয়েছিলো নিয়াজ। কাপ ভাঙার শব্দ আর নিঝুমের চিৎকার একসাথে কানে এলো নিয়াজের। কিছু মুহূর্তের জন্য সবাই যেনো জ্ঞানশূন্য হয়ে গেলো, কী করার উচিত ভুলে গেলো। তারপর হঠাৎই নিয়াজ উঠে দৌড়ে বাইরে সাথীর কাছে গেলো। শ্বাস চলছে তাই দ্রুত হসপিটালে নেওয়া হলো।

ডক্টর জানালো মাথার পিছনে গভীর আঘাত লেগেছে। দুদিন পর জ্ঞান ফিরে সাথীর কিন্তু অবস্থা ভালো নয়। অয়ন সেদিনই চলে এসেছিলো নিঝুমের থেকে খবর পেয়ে।

অয়ন আর নিঝুম বাইরে বসে ছিলো তখনই ডক্টর এসে বলে, নিঝুম কে এখানে ?

নিঝুম ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ডক্টর আমিই নিঝুম। কী হয়েছে, সাথী ঠিক আছে তো ?

রোগীর জ্ঞান ফিরেছে আর আপনার সাথে কথা বলতে চাইছে। উনার হাতে বেশি সময় নেই।

ডক্টরের কথা শুনে এক কদম পিছিয়ে গেলো নিঝুম। অয়ন শক্ত হাতে ধরে ফেললো নিঝুমকে।

নিঝুম অয়নের দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বললো, আমার জন্য হয়েছে এসব ?

অয়ন নিঝুমের চোখ মুছে দিয়ে বললো, সবই আল্লাহ তাআলার ইচ্ছে। সাথী অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।

নিঝুম এগিয়ে গেলো আইসিইউর দিকে। দরজা ঠেলে ভেতরে গিয়ে দেখলো লম্বা লম্বা শ্বাস নিচ্ছে সাথী। মুখে অক্সিজেন মাস্ক তবু যেনো অক্সিজেনের বড্ড অভাব তার কাছে। দুদিনে ফর্সা মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে সাথীর। নিঝুমের সারা শরীর কাঁপছে তবু এগিয়ে গেলো বেডের দিকে। পাশে গিয়ে চেয়ারে বসে কাঁপা হাতে সাথীর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিলো নিঝুম। নিভু চোখে তাকালো সাথী আর নিঝুমকে দেখে জোর করে হাসি টানলো ঠোঁটের কোণে।

অক্সিজেন মাস্ক খুলে ভেঙে ভেঙে বললো, আপু।

নিঝুম আর কান্না আঁটকে রাখতে পারলো না কাঁদতে কাঁদতে বললো, কেনো বাঁচাতে গিয়েছিলি আমাকে ?

সাথী হাসিটা বজায় রেখে অনেক কষ্টে বললো, আমার মতো এতিম আর অসহায় মেয়েকে তুমি একটা পরিবার দিয়েছো। আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছো। আমি যে তোমার কাছে অনেক ঋণী আপু।

নিঝুম হেঁচকি তুলে কাঁদছে সাথীর দিকে তাকিয়ে। সাথী এতটুকু বলে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। বড্ড কষ্ট হচ্ছে তার কথা বলতে, বারবার গলা শুকিয়ে আসছে।

তোমাকে একদিন বলেছিলাম সুযোগ পেলে একটু হলেও ঋণ শোধ করবো তোমার। তুমি আমার মেয়েকে আমার কোলে নিরাপত্তা দিয়েছো আর আমি আজ তোমাকে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিলাম।

নিঝুম কাঁদতে কাঁদতে বললো, এবার যে তুই আমাকে ঋণী করে দিলি।

সাথী শক্ত করে নিঝুমের হাতটা ধরে বললো, আমার কাছে তোমার কোনো ঋণ নেই আপু। শুধু আজ থেকে আমার মেয়েকে নিজের মেয়ে মনে করে মানুষ করো। আজ থেকে ভুলে যাও তিথির সাথে আমার কোনো সম্পর্ক আছে। আমি চাই আমাকে তুমি তোমার বোন হিসাবে মনে রাখো তিথির মা হিসাবে নয়। আজ থেকে তিথির মা শুধুমাত্র তুমি।

নিঝুম ব্যস্ত গলায় বললো, তোর কিছু হবে না। আমরা আজই তোকে ঢাকায় নিয়ে যাবো আর বড় হসপিটালে চিকিৎসা করাবো। তুই একদম ভালো হয়ে যাবি।

সাথীর নিশ্বাস আগের থেকেও ভারী হয়ে গেছে। সে জোরে জোরে শ্বাস ছেড়ে বললো, আমার হাতে সময় নেই আপু তুমি কথা দাও আমার এই ইচ্ছেটা তুমি পূরণ করবে।

নিঝুম নাক টেনে বললো, কথা দিলাম।

সাথী যেনো এতো অস্থিরতায় একটু স্বস্তি পেলো। চোখের কোণ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। সাথী জানে তার মেয়ের জন্য নিঝুমের থেকে ভালো মা হয়তো সে নিজেও হতে পারবে না।

সাথী আবার বললো, ঐ লোকটাকে কখনো আমার মেয়ের কাছে ঘেষতে দিও না আপু। লোকটার ছায়াও যেনো না পরে আমার মেয়ের উপর।

নিঝুম সাথী গালে হাত দিয়ে পানি মুছে দিয়ে বললো, আমার বুকে আগলে রাখবো আমার মেয়েকে।

নিঝুমের কথা শুনে মুচকি হাসলো সাথী আর জোরে একটা শ্বাস নিলো। তারপরই সব কেমন নিরবতায় ছেয়ে গেলো। নিঝুম অনুভূতিহীন হয়ে তাকিয়ে রইলো সাথীর নিষ্প্রাণ মুখটার দিকে। চোখদুটো এখনো তাকিয়ে আছে তার দিকে, যেনো কত কথা বলছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে নিঝুমের, বড্ড বেশি কষ্ট হচ্ছে। মেয়ের জ্ঞান ফিরেছে শুনে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে নিয়াজ আর সেলিনা। আইসিইউতে একজনের বেশি ঢোকার অনুমতি নেই তবু জোর করে ঢোকে গেলো তারা। কিন্তু ভেতরে গিয়ে যা দেখলো তাতে পা থেমে গেলো। সেলিনা সেখানেই বসে পড়লো আর কাঁপা পায়ে এগিয়ে গেলো নিয়াজ। সাথীর খোলা চোখদুটো বন্ধ করে দিলো।

কথায় আছে, “এক গাছের ছাল কখনো অন্য গাছে লাগে না ” কিংবা “পর কখনো আপন হয় না”।

তবে সন্তান হারানোর কষ্ট তো কিছু কম হচ্ছে না নিয়াজ বা সেলিনার। চোখের সামনে ভাসছে মেয়েটার হাজারো দুষ্টুমি। সেলিনার চোখে ভাসছে যেদিন নিঝুম তাকে প্রথম বাসায় নিয়ে এসেছিলো সেদিনের কথা। মনে হচ্ছে এই তো সেদিনই। মেয়েটা মনে হয় দিনে নিঝুমের চাইতে হাজার বার বেশি মা ডাকতো সেলিনাকে। সেসব স্মৃতি যে আজ মায়ের মন পুড়িয়ে ছাই করছে। অয়নের কোলে তিথি, সে ধীর পায়ে ভেতরে এলো। ছোট তিথি কী বুঝে মাকে দেখে কেঁদে উঠলো চিৎকার করে। তিথির কান্না শুনে নিঝুম ঘুরে তাকালো। উঠে আসতে গেলে টান লাগলো সাথীর শক্ত করে আঁকড়ে ধরা হাতটায়। হাত টার দিকে তাকিয়ে চোখ ঝাপ্সা হয়ে গেলো নিঝুমের। হাতটা ছাড়িয়ে নিলো তবু, এগিয়ে গেলো তিথির দিকে।

অয়নের কোল থেকে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো, আজ থেকে তুই শুধু আমার মেয়ে। পূরণ করবো আমি আমার বোনের শেষ ইচ্ছা।

আবার কেঁদে উঠলো নিঝুম আর অয়ন দু’জনকে একসাথে জড়িয়ে ধরলো। অয়ন তাকালো সাদা বেডে পরে থাকা নিথর মুখটার দিকে।

মনে মনে বললো, তোমার কাছে সারাজীবনের জন্য ঋণী হয়ে গেলাম। আমার ভালোবাসাকে বাঁচিয়েছো নিজের জীবনের বিনিময়ে আবার আমাদের জীবনের একটা বড় শূন্যতা দূর করে গেলে। আমি যে কৃতজ্ঞ তোমার কাছে বোন, দোয়া করি ওপারে ভালো থাকো।

সাথীর নিথর দেহ নিয়ে ঢাকা ফিরে আসে সবাই। নিঝুমদের পারিবারিক কবরস্থানে কবর দেওয়া হয় তাকে। সাথীর মৃত্যুর পাঁচদিন পর দেশে ফিরে তয়ন। বাড়ি ফিরে অহনার কাছে সবই শুনে। দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যায় তার, ভেবেছিলো দেশে ফিরে সাথীকে নিজের মনের কথা বলে দিবে তারপর যা হবে দেখা যাবে। কিন্তু সাথী তাকে সেই সুযোগ দেয়নি, চলে গেছে না ফেরার দেশে। তয়নের ভালোবাসা রয়ে গেলো সারাজীবনের জন্য অপ্রকাশিত সুপ্ত অনুভূতি হয়ে। সাথীর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে বড্ড অভিমান হয়েছিলো তয়নের কিন্তু তার মান ভাঙানোর মানুষটা আর কখনো আসবে না। তনয় আর থাকতে পারেনি এখানে আবার চলে যায় এদেশ ছেড়ে। তারপর কেটে গেছে ছয়’টা বছর। সাথীর সেই মায়াবী মুখ আজও তারা করে বেড়ায় তনয়কে আর ভালোবাসতে পারেনি অন্য কাউকে। ছয় বছরে আরো অনেক কিছু পাল্টে গেছে। তিথি বলে আজ আর কেউ নেই, আছে অয়ন আর নিঝুমের একমাত্র সন্তান অয়নি আহমেদ। অয়নি সাথীকে চিনে নিজের খালামুনি হিসাবে। নিঝুমের বাবা রিটায়ার্ড হয়েছে দু’বছর আগে, এখন নিজেদের বাড়িতেই থাকে। অয়নের বাবা টাকার পিছনে ছুটতে ছুটতে হারিয়েছে নিজের প্রাণপ্রিয়া স্ত্রীকে। সাথীর মৃত্যুর এক বছর পরে অহনাও এই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেছে। তোফায়েল আহমেদ স্ত্রীকে হারিয়ে তার মর্ম বুঝতে পেরেছে। সময়গুলো খুব কঠিন ছিলো নিঝুম আর অয়নের জন্য। সামলে উঠতে সাহায্য করেছে একে অপরকে। সাথী চলে যাওয়ার পর নিঝুমকে অয়ন সামলে নিয়েছে তবে অহনার মৃত্যু দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিলো অয়নকে। নিঝুম তখন নিজেকে শক্ত করে অয়নকে সামলেছে।

স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তোফায়েল আহমেদ বন্ধ করে দিয়েছে টাকার পিছনে ছুটে চলা। এখন ছেলে, ছেলের বউ আর প্রিয় নাতনিকে ঘিরে তার জীবন।

৩০.
ছোট আব্বু তুমি রেডি হয়েছো ? সবাই ওয়েট করছে তো তোমার জন্য।

অয়নিকে দেখে সাথীর ছবিটা আড়াল করে ফেললো তয়ন। তারপর কোলে তুলে নিলো আদরের ভাতিজিকে।

গালে চুমু এঁকে দিয়ে বললো, আমার মামুনিটাকে একদম প্রিন্সেসের মতো লাগছে।

আর তোমাকে আজ একদম হিরো হিরো লাগছে।

কেনো এতদিন হিরো হিরো লাগতো না ?

অয়নি নাক কুঁচকে বললো, একদমই না।

তয়ন চিন্তিত হয়ে বললো, কেনো কেনো ?

এতদিন তো তোমাকে ভিলেন ভিলেন লাগলো। ইয়া বড় বড় দাড়ি আর চুলে।

তয়ন অয়নির নাক টেনে বললো, পাকনা বুড়ী একটা।

তয়নের কথা শুনে খিলখিল করে হাসলো অয়নি আর তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তয়ন। অয়নির হাসিটা একদম সাথীর মতো।

ছোট আব্বু জানো আজ না আমার খুব খুশী লাগছে।

তনয় দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, কেনো মা ?

এখন শুধু স্কুলে না, বাড়িতেও মিসের সাথে খেলতে পারবো আমি।

মিসকে এতো কেনো ভালো লাগে তোমার ?

মিস কতো ভালোবাসে আমাকে জানো তুমি ? প্রতিদিন আমাকে কত চকলেট দেয়, আদর দেয়।

হুম জানি তুমি এখন যাও, আমি আসছি রেডি হয়ে।

অয়নি দৌড়ে তার দাদুর কাছে চলে গেলো আর তয়ন সাথীর ছবিটা বের করে বললো, ভাবি বলে অয়নিটা নাকি তোমার মতো দুষ্টু হয়েছে। সারাদিন বাড়ির সবাইকে মাতিয়ে রাখে। তুমি দেখতে পেলে না। তোমাকে সবাই এখনো অনেক ভালোবাসে আর আমি ? থাক, আমারটা আজও নাহয় তোমার অজানাই থাক।

তনয় রেখে দিলো সাথীর ছবিটা আর রেডি হয়ে নিলো। অয়নির স্কুলের মিস তুলির সাথে আজ বিয়ে তয়নের। খুব বড় করে আয়োজন করা হয়নি কারণ তয়ন রাজি হয়নি তাতে। অনেকদিন ধরেই তয়নকে সবাই বিয়ের কথা বলছিলো কিন্তু সে রাজি হয়নি। কিন্তু অয়নি হঠাৎ বায়না ধরলো তার ছোট আম্মু লাগবে আর সেটা মিস তুলিই হতে হবে। তয়ন শেষমেশ হার মানলো অয়নির কাছে।

ছোটখাটো আয়োজনেই বিয়েটা সম্পন্ন হলো। ঘড়ির কাটা রাত এগারোটার মধ্যে গিয়ে পৌঁছেছে। তনয় খুব স্বাভাবিক ভাবেই নিজের রুমে প্রবেশ করলো। তুলি লম্বা ঘোমটা টেনে বসে আছে বেডে। তয়নকে দেখে উঠে এসে সালাম করলো। তনয় পকেট থেকে একটা গিফটের বক্স বের করে তুলির হাতে দিলো।

ভাবি বললো কিছু একটা দিতে হয়।

তুলি সেটা হাতে নিয়ে মুচকি হাসলো ঘোমটার আড়ালে।

তয়ন সোফায় গিয়ে বসে বললো, বিয়ের আগেই আমি তোমাকে সব জানিয়েছি। আমার একটু সময় লাগবে।

তুলি নিচু গলায় বললো, আমি অপেক্ষা করবো আপনার জন্য।

তুমি মনে হয় ক্লান্ত, তাহলে ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।

দু’রাকাআত নফল নামাজ তো আদায় করতে পারবেন আজকের রাতে। সেটার জন্য নিশ্চয়ই সময়ের প্রয়োজন নেই।

তয়ন মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। তুলি মুচকি হাসলো তা দেখে। দুজনে নামাজ পরে নিলো।

তুলি তয়নের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো, তার জায়গা নিবো না আমি। তবে নিজের জন্য একটা জায়গা তৈরি করবো ইনশাআল্লাহ।

অহনার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছে তোফায়েল। চোখের পানিতে ভিজে ঘোলাটে হয়ে গেছে চশমা।

তোমার সংসার আজ পূর্ণ হয়েছে আর তুমি সব ছেড়ে চলে গেলে ? অহনা একবার ফিরে এসো আর অবহেলা করবো না তোমাকে। টাকার পেছনে ছুটতে ছুটতে তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি আমি। একটা সুযোগ দাও আমাকে, ফিরে এসো। এখন তোমার একাকীত্ব বুঝতে পারি আমি, কতটা কষ্ট পেয়েছো বুঝতে পারি। কিন্তু আজ আর কিছুই করার নেই।

লালন শাহ খুব সুন্দর এক গান বেঁধেছিলো, সময় গেলে সাধন হবে না।

ঘুমন্ত অয়নির দিকে তাকিয়ে আছে নিঝুম। মেয়েটা দিনদিন মায়ের মতো হয়ে উঠছে দেখতে। মায়ের মতো চেহারা আর দুষ্টুমি পেলেও জেদ হয়েছে নিঝুমের মতো আর রাগ অয়নের মতো।

অয়ন নিঝুমের উপর দিয়ে ঝুঁকে অয়নির দিকে তাকিয়ে বললো, কী দেখছো ?

নিঝুম ঘোরের মাঝেই বললো, সাথী বেঁচে থাকলে আজ হয়তো সব অন্যরকম হতো।

অয়ন দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, হয়তো।

নিরবতায় কেটে গেলো কিছুটা সময়। নিঝুমকে মনমরা দেখে অয়ন উঠে দাঁড়িয়ে তাকে কোলে তুলে নিলো।

নিঝুম ব্যস্ত গলায় বললো, আরে কী করছেন ?

আমার বউয়ের মন ভালো করছি।

অয়ন নিঝুমকে কোলে নিয়ে বেলকনিতে গিয়ে নামালো। অয়নির বায়নায় খুব সুন্দর একটা দোলনা রাখা হয়েছে সেখানে। নিঝুমকে সেখানে বসিয়ে অয়নও পাশে বসলো। অয়ন পাশে বসতেই তার কাঁধে মাথা এলিয়ে দিলো নিঝুম। সেদিনের পর অয়নের জন্য কখনো চোখে কষ্টের পানি আসেনি নিঝুমের, এসেছে তবে সেটা সুখের পানি।

নিঝুম অয়নের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো, তাদের মাফ করা উচিত যারা সত্যি অনুতপ্ত হয় মন থেকে। হয়তো জীবন পাল্টে যেতে পারে। সেদিন আমি কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেইনি।

অয়ন বললো, কী দেখছো ?

আমার সুখ, মরিচাধরা মনের খাঁচায় বন্দী অপরুপ এক পাখির ডানা ঝাপটানো দেখছি। খাঁচার দরজা খোলা তবু নিজের ইচ্ছায় বন্দী সে।

অয়ন মুচকি হেসে বললো, আর সারাজীবন থাকবে। তোমার সুখের কারণ হয়ে।

কৃত্রিম আলোর নাগালের বাইরে আকাশের অর্ধচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে রইলো দু’জন কপোত-কপোতী। নিরবতায় হাজারো কথা বলছে যেনো তারা। মনে মনে করছে একে অপরকে সুখে রাখার প্রতিজ্ঞা।

একটা ছাদের নিচেই চলছে তিনটা জীবনের গল্প। কারো জীবনের সাথে মিল নেই কারো জীবনের। এমন হাজারটা গল্প লুকিয়ে আছে শহরের প্রত্যেকটা বন্ধ দরজার উপরে। কারো মরিচাধরা মনের খাঁচায় সুখ ঢেলে দিয়েছে উপরওয়ালা আবার কারো পরে আছে খালি।

আপন মানুষ কাছে থাকতে তাদের কদর করো, একবার হারিয়ে গেলে হাজার কেঁদেও ফিরে পাবে না। আবার কিছু ভালোবাসা হয়তো অপ্রকাশিত থেকে যাওয়াটা ভালো। সারাজীবন সুপ্ত অনুভূতি হয়ে থাকে মনের কোণে। কখনো সুখ দেয়, তো কখনো কষ্ট। কিছু ভুলের ক্ষমা হয় না আবার কিছু ভুলের ক্ষমা জীবন পাল্টে দিতে পারে। বিচিত্র এই দুনিয়া, বড়ই বিচিত্র।

—————————–সমাপ্ত————————

জানি না গল্পটা কেমন লেগেছে আপনাদের কাছে। আমি চেষ্টা করেছি আমার পক্ষে যতটা সম্ভব হয়েছে। দিনদিন লেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছি। কপিবাজদের জন্য আর লিখতে ইচ্ছে করে না। আমার কোন গল্পটা কপি হয়নি সেটাই বলা মুশকিল। নিজের কষ্টের সৃষ্টির পাশে অন্যকারো নাম মেনে নেওয়া কখনোই সহজ নয়। আগামী গল্প দিতে লেট হবে। এতদিন পাশে থাকার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। সবাই ভালো থাকবেন, আল্লাহ হাফেজ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here