কান্তা মনি পর্ব -০১

কে জানতো গ্রামের সবচেয়ে চঞ্চল কিশোরীর উড়ে বেড়ানোর স্বাধীনতা চিরতরে বন্ধ হতে চলেছে।পা রাখতে চলেছে ভিন্ন এক অচেনা আঙিনায়। স্বয়ং জমিদার পুত্র শাহ নিয়াজ মির্জা স্বইচ্ছায় রমিজ হাওলাদারের নিকট কান্তা মনির সাথে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। যুবতির ভূবন ভুলানো রূপে বিমোহিত যুবক শাহ নিয়াজ মির্জা।

নিজ কক্ষে মাটির দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে অশ্রু বিসর্জন দিতে ব্যস্ত কান্তা মনি। নিজের সখীদের বিয়ে দেখে যে নিজেও মনের কোণে কতশত স্বপ্ন বুনেছিল। সেতো চেয়েছিল সাধারণ কোনো পুরুষকে বিয়ে করে একটা সুখের নীড় বাধতে। জমিদার বাড়ী আর জমিদার বাড়ির মানুষগুলো সম্পর্কে কতশত কথা শুনেছে যুবতি। মনের কোণে অজানা ভয় হানা দিতে লাগল।

কক্ষের ভেতরে বিরাজমান পিনপিন নিস্তব্দতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে নিয়াজ মির্জা বলে উঠল,

“আপনাদের আপত্তি না থাকলে আমি খুব তাড়াতাড়িই কান্তা মনিকে আমার স্ত্রী হিসেবে স্বসম্মানে গ্রহণ করতে চাই।”

-আমাগো আর কি আপত্তি থাকব বাবু মশাই? স্বয়ং জমিদার পুত্র আমার মাইয়ার জন্য বিয়ার প্রস্তাব নিয়া আইছে ,এ যে বিরাট ভাগ্যের ব্যাপার আমাগো জন্য।(রমিজ হাওলাদার)
– হ এত আমাগো জন্য বিরাট ভাগ্যের ব্যাপার।( ঠোটে জোরপূর্বক হাসির রেখা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলে কান্তা মনির সৎ মা রাহেলা )

মা মরা অভাগা মেয়ে কান্তা মনির জন্য স্বয়ং জমিদারপুত্র বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে শুনে রাহেলা প্রথমে ছ্যাত করে উঠে। বরাবরই কান্তার রূপের প্রশংসা শুনলে তেলে বেগুনে জ্বলেন রাহেলা ও তার মেয়ে রজনী। কান্তা মনির পরিবর্তে রজনীর সাথে বিয়ের কথা বলতেই জমিদার পুত্র কানচ করে দেন।পরে টাকা-পয়সা পাওয়ার কথা কানে আসতেই মাথায় কোনো ফন্দি এটে বসেন রাহেলা।

-আজ আমাকে উঠতে হবে।দু-তিনদিনের ভেতরেই বিয়ের সকল কাজ সম্পন্ন করতে চাই। আমি বিয়ের আয়োজকদের পাঠিয়ে দেব কালই।তারা সবকিছু আয়োজন করে দিয়ে যাবে। কোনো কিছুর দরকার হলে অবশ্যই রক্ষীদের দ্বারা জানাবেন আমাকে। আসি আজকে।

নিয়াজ মির্জা দরজা অতিক্রম করে বের হতেই আসেপাশে জমে থাকা ছোট ভীড়ে পাড়া-প্রতিবেশীদের শোরগোল লেগে গেল।

এদিকে এ বিয়েতে ঘোর আপত্তি জানিয়েছেন নিয়াজ মির্জার মা বেগম নূর জাহান। কিছুতেই কোনো দরিদ্র ঘরের মেয়েকে তার একমাত্র পুত্রের সহধর্মীনি হিসেবে আনতে রাজি নন। তিনি চান কোনো আলিশান ঘরের শিক্ষিত, যোগ্য ,সুন্দরী মেয়ে তার আদরের পুত্রের বেগম হিসেবে আসুক।

-বিয়ে যদি করতেই হয় একমাত্র কান্তা মনিকেই করব। এক্ষেত্রে কারো আপত্তি আমার নিকট গ্রহণযোগ্য নয় আম্মা।(শাহ নিয়াজ মির্জা)

বেগম নূর জাহান ছলছল চোখে নিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,
-কোন হতচ্ছারিনী আমার আদরের পুত্রকে আমার কাছ থেকে এভাবে দূরে ঠেলে দিলো? এই তোমার আমার প্রতি ভালোবাসা নিয়াজ? এই তোমার আম্মার প্রতিটা কথাকে মূল্য দাও তুমি?

-ভুল বুঝবেন না আম্মা। আসছি।(শাহ নিয়াজ মির্জা)
-আমিও দেখি ওই মেয়ে কিভাবে আমার একমাত্র পুত্রের বেগম হিসেবে জমিদার বাড়িতে টিকতে পারে।

নির্জন রাত…

চারপাশে ঝিঝি পোকার ডাকে গমগম করছে। আকাশে একফালি রূপালি চাদ বিরাজমান। যুবক বালিশে মাথা ঠেকিয়ে জানালার বাইরের রাতের সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে ব্যস্ত। চোখ বুজলেই এক যুবতির রিনঝিনে হাসি এসে হানা দেয় তার বুকের মাঝে।

কিছুদিন আগেই নিয়াজ মির্জা রক্ষীদের সাথে নিয়ে গ্রাম দর্শনে বের হয়েছিল। হঠাত কোথা থেকে এক মেয়েলি কন্ঠের রিনঝিনে হাসির শব্দ আসতেই যুবকের চোখ চলে যায় মাথার ওপর থাকা আম গাছের মগডালের দিকে।
কোমরে শাড়ির আচল গুজে মগডালে বসে আম ছিড়তে ব্যস্ত এক যুবতি। ক্ষানিক বাদে বাদেই সখীদের সাথে তাল মিলিয়ে হেসে উঠছে।

-গাছে কে কে আছে?
হঠাত পুরুষালী কন্ঠ পেয়ে কান্তা নিচের দিকে তাকালো।গাছের নিচে কিছু পুরুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আচমকা ক্ষানিকটা কেপে উঠল কান্তা।

-আ…আমরা।(কান্তা)
-নিচে নেমে এসো।(নিয়াজ)

গাছ থেকে নেমে আসতেই নিয়াজ একবার কান্তাকে পা থেকে মাথা অব্দি পর্যবেক্ষণ করে বলে উঠল,
-শাড়ি পড়ে গাছে উঠেছো পড়ে গিয়ে হাত-পা ভেঙ্গে গেলে তো বাবা-মা আর বিয়ে দিতে পারবেনা।
-অত চিন্তা আপনার করতে হবেনা। আগে বলেন কেডা আপনি।(কান্তা)
যুবতীর এমন প্রশ্নে চোখ-মুখ শক্ত করে তাকালো নিয়াজ।পেছন থেকে একটা মেয়ে কান্তাকে খোচা মেরে বলল,
-কান্তারে জবানে তালা দে। ইনি হইলেন গিয়া জমিদারের পুত্র শাহ নিয়াজ মির্জা।
এমতাবস্থায় যুবতি থতমত খেয়ে ভয়ার্ত চোখে নিয়াজের দিকে তাকিয়ে কাপা কন্ঠে বলে উঠল,
-আজ্ঞে বাবু মশাই ক্ষমা করবেন আমারে। আসলে আমি আপনারে চিনতে পারিনাই।
যুবক মুচকি হেসে বলে উঠল,
-নাম কি তোমার রূপসী?
-কান্তা মনি।(কান্তা)
-বাহ বেশ সুন্দর নাম তো! (নিয়াজ)
-দেরি হইয়া যাইতাছে।আমি এহন আসি।(কান্তা)
বলেই দৌড়ে ছুটে পালালো কান্তা।

-এই মেয়ের সম্পর্কে সব তথ্য খুজে বের করো।কোথায় থাকে,বাবার নাম কি।সব তথ্য চাই আমার।(নিয়াজ)
-যথা আজ্ঞা।

পুরনো কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আনমনে হেসে উঠল নিয়াজ। ষোল-সতের বয়সের এক মেয়ের প্রেমে পড়েছে সে! হঠাত বিছানা ছেড়ে উঠেই গায়ে দামি শাল জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল কোনো গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

জানালার সাথে মাথা ঠেকিয়া আকাশের পানে তাকিয়ে আছে কান্তা।চোখের পানি নীরবে গাল বেয়ে পড়ছে।হঠাত বাইরে থেকে কিছুর আওয়াজ আসতেই কান্তা বাইরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। হঠাত জানালার পাশ ঘিষে এসে দাড়ালো সুঠামদেহি এক পুরুষ। চাদের আলোয় পুরুষের অবয়বটা কিছুটা চেনা চেনা লাগছে।আতকে উঠল কান্তা।

-কান্তা মনি ভয় পেয়ো না আমি নিয়াজ।
-আপনি এখানে কেন ?
-তোমাকে খুব দেখতে মন চাইছিল তাই চলে এলাম।
-কান্তা ভয় এবং লজ্জায় কিছুটা দূরে সরে গেল জানালার কাছ থেকে।
চাদের স্নিগ্ধ আলোয় কান্তা মনি যেন মণি-মুক্তার মতো জ্বলজ্বল করছে।যুবক কিছুক্ষণ কান্তামনির দিকে তাকিইয়ে থেকেই স্থান ত্যাগ করল।যুবতি যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।

-সব পরিকল্পনায় পানি ঢেলে দিলো শাহ নিয়াজ মির্জা। এতেই দমে যাব তাতো হবেনা। দ্বিতীয় পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।(কথাগুলো বলেই মানব হাতে থাকা গ্লাসটি কিছুটা জোরে শব্দ করেই পাশে থাকা ছোট চৌপায়ার ওপর রাখল)

-শশুড় বাড়ি যাইয়া আমাগো ভুইলা যাইস না কান্তা। (রজনী)
-তোদের ভুলব কেন আর তোদের ঋণ কি আমি ভুলতে পারুম বল? আজীবন মনে থাকবে আমার। (আড়চোখে রাহেলা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল কান্তা)
রাহেলা বেগমকে ইঙ্গিত করেই কথাগুলো বলা হয়েছে বুঝতে পেরেই তিনি কান্তার চুলের মুঠি ধরে বলে ওঠেন,
-কি বলতে চাচ্ছিস তুই? একটু খোলাসা কইরা বলতো। কি বোঝাতে চাচ্ছিস এই বিয়ে আমার লাভের জন্য হতে দিচ্ছি আমি?
ব্যথায় কুকড়ে উঠে মুখ থেকে ‘আহ’ শব্দটি উচ্চারণ করেই পরমুহূর্তে বলে উঠল,
-আমি কি তা একবারও বলছি? ছোটবেলায় আম্মা মারা যাওয়ার পর আব্বায় তোমারে বিয়া কইরা নিয়া আসছে। তারপর দিয়া তুমি আমার সব সুখ কাইড়া নিছো। কি দোষ আমার বলো মা? আমি কি একটু ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না? আমিতো জমিদার বাড়িতে বিয়ে করে যাইতে চাইনা। কেন তুমি আমার একটা ইচ্ছারও দাম দেও না মা? কি ক্ষতি করছি আমি তোমার?

-কি বললি তুই? আমি তোর সুখ কাইড়া নিছি? (রাহেলা)
রাহেলা আর কিছু বলার আগেই বাড়িতে রমিজ হাওলাদারের উপস্থিতি টের পেয়েই সংযত হয়ে যান।

বিয়ের কাজ সম্পন্নের পরে পালকি চড়ে যুবতি রওনা হলো নতুন জগতে পদার্পণের উদ্দেশ্যে। সে কি পারবে সেখানের সবকিছুর সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে? কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পরেই বাকা হেসে উঠল কান্তা। সামনে কি আছে দেখা যাবে কিন্তু সৎ মায়ের অমন নিষ্ঠুর অত্যাচার থেকে তো মুক্তি মিলেছে অবশেষে।

চলবে…
#কান্তা_মনি
#সূচনা_পর্ব
#লেখনীতে_আফিয়া_অন্ত্রীশা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here