কান্তা মনি পর্ব -২২

#কান্তা_মনি
#পর্ব_২২
#লেখনীতে_আফিয়া_অন্ত্রীশা

নিশ্চুপ হয়ে নিয়াজের লাশের খাটিয়া থেকে কিছুটা দূরে দেয়াল ঘেষে মেঝেতে বসে আছে কান্তা মনি। হঠাত কাউকে চিতকার করে কান্না করতে শুনে সেদিকে না তাকিয়েই আস্তে করে চোখ বন্ধ করে নেয় কান্তা মনি। হেতিজা এসেছে বুঝতে পেরেও তার কাছে যায়না কান্তা মনি। কাঁদুক মেয়েটা। এই পরিস্থিতিতে কান্না করাটা যে খুব দরকার। নাহলে যে বুকের ওপর জমে থাকা কষ্টের ভারী পাথর কখনো নামবেনা।

-ও ভাইজান চোখ ওঠো না ভাইজান। এই যে তোমার আলসে শেহজাদি আসছে। ও ভাইজান তোমার বোনটা তোমাকে রেখে শশুড়বাড়ি চলে গেছে তাই তুমি তাকে এভাবে ফাকি দিলে? তোমার মুখটা দেখার সুযোগটুকু পেলাম না? কারা মেরেছিস আমার ভাইজানকে? (কান্না করতে করতে অগ্নিদৃষ্টে নওশাদের দিকে তাকায় হেতিজা)

হেতিজা আস্তে করে উঠে কান্তা মনির সামনে গিয়ে বসে।
-ও ভাবিজান তুমি পারলেনা আমার ভাইজানকে আগলে রাখতে? কেন পারলে না ভাবিজান? বল না কেন পারলেনা? তোমাকে তো আমি বলেছিলাম ভাইজানকে সব বলে দাও। কেন বললে না কিছু? কেন তাকে সাবধান করলেনা? তোমার মায়ার জন্য আজ এই পরিস্থিতি ভাবিজান। (কিছুক্ষণ থেমে) ও ভাবিজান আমার ভাইজানকে ফিরিয়ে আনোনা। (কান্তা মনিকে জাপটে ধরে বলে ওঠে হেতিজা)

কান্তা মনি নিরবে চোখের জল ফেলে। তার মুখ থেকে যে এখন একটা বুলিও ফুটবেনা। আশেপাশের সবার কানে হেতিজার কথা গিয়ে বাজতেই সকলে হেতিজা আর কান্তা মনির দিকে বিস্ময়ে ভরা দৃষ্টিতে তাকায়। শাহ সুলতান মির্জা হিংস্র নয়নে হেতিজার দিকে তাকায়। তা আর কান্তা মনির দৃষ্টি এড়ায়নি। কান্তা মনিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে শাহ সুলতান মির্জা ইতস্থত হয়ে স্থান ত্যাগ করে।

শাহ সুলতান মির্জাকে ইতস্থত হয়ে স্থান করতে দেখে কান্নার মাঝেও বাকা হেসে ওঠে। এই হাসি যে বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে নিরবে বিদ্রোহ ঘোষণা করে দিল।

দেখতে দেখতে তিনদিন কেটে গেছে। পুরো গ্রাম যেন শোকের চাদরে মুড়ে আছে। তরুণ জমিদারের মৃত্যু গ্রামের প্রতিটা মানুষের বুকের মাঝে আঘাত হেনেছে। তাদের যেন একটা চাওয়া হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া।

মেহরিন এই তিন দিন ধরেই জমিদার বাড়িতেই আছে।
কিছু একটা স্বপ্ন দেখেই বেগম নূর জাহান ঘুম থেকে লাফিয়ে ওঠে। কখন যে চোখটা লেগে গেছিল বুঝতেই পারেননি বেগম নূর জাহান। পাশ ফিরে তাকাতেই চোখ-মুখ কুচকে আসে বেগম নূর জাহানের। মেহরিন পালঙ্কের পাশে দাঁড়িয়ে হাত পাখা দিয়ে বেগম নূর জাহানকে বাতাস করছে।

-এই তুমি আমার কক্ষে কি করো? বের হয়ে যাও। আমার চোখের সামনে থেকে সরে যাও। (ক্ষেপে গিয়ে বলে ওঠেন বেগম নূর জাহান)
-এমন করছেন কেন খালা? (বোকা বোকা ভাব নিয়ে)
-চুপ একদম। একদম চুপ। আমাকে খালা ডাকবিনা। তুই আমার পুত্রের হত্যার সাথে জড়িয়ে আছিস। বল আর কে কে জড়িয়ে আছিস? বল? (বেগম নূর জাহান)

-এইযে আমি। (হঠাত বেগম নূর জাহানের কক্ষে কেউ প্রবেশ করে)
-তুমিও? ছি। একটু হাত কাপেনি তোদের? বল আর কে কে জড়িয়ে আছিস? কেন করলি এমন? (বেগম নূর জাহান)
-এই পুরো জমিদার বাড়ির দখল চাই। জমিদারী দায়িত্ব চাই আমাদের। (বলেই কক্ষে প্রবেশ করে শাহ সুলতান মির্জা)
-তুমিও? তাহলে আমার পুত্র মারজান সরদারকে সন্দেহ শুধু শুধু করতো না। তোরা সবাই জড়িয়ে আছিস এতে। ছি। বিশ্বাসঘাতক তোরা। না জানি উনি এই কোথা জানতে পারলে কি করবেন। (কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে ওঠে বেগম নূর জাহান)
-তা আদরের পুত্র কিভাবে হত্যা হলো শুনবেন না খালা? (মেহরিন)

বেগম নূর জাহান নির্বাক হয়ে নিজের আদরের পুত্রের হত্যার বর্ণনা শুনে গেলেন। চোখে যেন অশ্রুরা এসে টলমল করছে। বুকের মাঝে কে যেন গলিত লাভা ঢেলে দিয়েছে অনুভব হতেই চোখ খিচে বন্ধ করে নেন।

-একটা কে ও ছাড়ব না আমি। তোদের সবগুলোকে শাস্তি পেতেই হবে। (ফুসে উঠে বলে উঠেন বেগম নূর জাহান)

বেগম নূর জাহানের কথা শুনে সকলে একে অপরের দিকে একবার তাকিয়ে একসাথে হেসে ওঠে।

ছেলের মৃত্যুর শোকে কাতর মা। গলা দিয়ে কি খাবার নামে? এশার নামাজ শেষ করে জগ হতে পানপাত্রে পানি ঢেলে নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে পালঙ্কের ওপর এসে বালিশে মাথা ঠেকিয়ে শুয়ে পড়েন বেগম নূর জাহান। ঘন্টাখানেক পরেই গলা-বুক-পেট জ্বালাপোড়া শুরু হয়ে যায় বেগম নূর জাহানের। নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছে। গলা এবার বিষ ব্যথা ধারণ করছে। ছটফট শুরু করেন বেগম নূর জাহান। বুঝে গেছেন পেটে বিষাক্ত কিছুই পড়েছে। সারাদিনে তো কিছুই খাননি। শুয়ে পড়ার আগে পানি খেয়েছিলেন। তাহলেই কি পানিতেই কিছু মিশিয়ে রাখা ছিল? কাদের কাজ বুঝতে বাকি নেই। প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করছে তারা। ইতোমধ্যে নাক-মুখ থেকে রক্ত বের হওয়া শুরু হয়ে গেছে। বেগম নূর জাহান ধরে ধরে পালঙ্ক থেকে নেমে কাগজ আর কলম নিয়ে তাতে কিছু একটা লিখে কাগজটা ভাজ করে আলমারির তাকে রাখেন। আলমারি বন্ধ করেই আলমারি ঘেষে মেঝেতে বসে পড়েন বেগম নূর জাহান।নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। মৃত্যু অনিবার্য তা অবগত হয়ে গেছেন তিনি। হাতরিয়ে পানি এনে পান করার সাধ্য টুকু হারিয়েছেন বেগম নূর জাহান। ধীরে ধীরে শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছে। হঠাত কক্ষের দ্বার খুলে যায়। বেগম নূর জাহান নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে নিজের সন্দেহকে সত্য প্রমাণ করেন।

বেশ রাত এখন। মারজান সরদারের অসুস্থতার বাহানা দিয়ে জমিদার বাড়ি ছেড়েছে মেহরিন। ভয়ে ঘামছে মেহরিন। আশপাশের ঝোপ-ঝাড়ের দিকে তাকিয়ে ভয়ে কুকড়ে ওঠে সে। কিন্তু এই মুহূর্তে জমিদার বাড়িতে থাকার চেয়ে এই অন্ধকার পথ ধরে বাড়ি ফেরাই উত্তম মনে হয় মেহরিন। রমনীর ধারণাই নেই যে পেছনে হয়তো কেউ তাকে অনুসরণ করছে।

কান্তা মনি অন্ধকারের মাঝে ধীর পায়ে মেহরিনকে অনুসরণ করে চলেছে। কাধে থেকে ব্যাগটার ওপর হাত রাখছে কিছুক্ষণ পর পর যে, সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা। মুখ ঢেকে রাখা কালো কাপড়টা আরো শক্তপোক্ত করে বেধে নেয় কান্তা মনি।

গ্রামের বড় বটগাছটার নিকট আসতেই কারও ডাকে আতকে উঠে পেছনে ফিরে তাকায় মেহরিন। চাদের মৃদু আলো আর হারিকেনের পিটপিট আলোয় কান্তা মনির হাস্যজ্জ্বল মুখখানা দেখে সারা শরীরে কম্পন উঠে যায় মেহরিনের। শুকনো একটা ঢোক গিলে মুখে জোর পূর্বক হাসি ফুটিয়ে তুলে মেহরিন বলে ওঠে,
-কান্তা মনি তুমি? এত রাতে এই অবস্থায় বেরিয়েছো কেন?
জবাবে হেসে ওঠে কান্তা মনি।

-এই মুহূর্তে আমাকে এখানে আশা করোনি তাইনা মেহরিন? তা এত রাতে পালিয়ে আসলে কেন? কাল সকালেও তো আসতে পারতে। সত্যি বল তো কোনো জট পাকিয়ে রেখে এসেছো বুঝি? তাই এত রাতে মিথ্যা বাহানা দিয়ে পালিয়ে এলে। (কান্তামনি)

-কি সব বলছো কান্তা মনি। আমার আব্বাজান অনেক অসুস্থ। আমাকে তাই এখনই বের হতে হয়েছে। (মেহরিন)

-আরে এত তাড়া কেন। তোমার যাওয়া লাগবে না। তোমার আব্বাই না হয় আসবে। তুমি বরং আগে গিয়ে এক বিশেষ জায়গায় অপেক্ষা করো। তোমার আব্বাকেও সেখানে তোমার কাছে পাঠানোর দায়িত্ব আমার। এখন বিদায়। (বলেই কাধের ব্যাগে থাকা ছুরিটা বের করে মেহরিনের পেটে ঢুকিয়ে দেয় কান্তা মনি)

বিকট শব্দে আর্তনাদ করে ওঠে মেহরিন।

-আমার আব্বাজানকে যেন কিভাবে ছুরি দিয়ে থেতলে দিয়েছিলি? দাড়া তোর ওপর ও ওই পদ্ধতি প্রয়োগ করি।

মেহরিন ব্যথায় কুকড়ে উঠে মাটিতে বসে পড়ে।

-কান্তা মনি আমাকে মেরো না দোহায় লাগে। আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি বড্ড অন্যায় করেছি। (মেহরিন)
-বিপরীত মানুষের কঠোরতা আর মৃত্যুর কাছে সবাই কাবু দেখেছিস। মানুষ ভুল করার পর ঠিকটা বুঝতে পারে। কিন্তু তুই এবং তোরা ক্ষমার অযোগ্য। একে একে সবগুলোকে সরিয়ে দেব। আমার আব্বাজানকে মেরেছিস আমার স্বামীকে মেরেছিস তোরা। আমার সন্তানকে পৃথিবীতে আসার আগেই পিতৃহারা করেছিস। শাস্তি তো তোদের পেতেই হবে। তোরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিস।(কান্তা মনি)
-কান্তা…
মেহরিনকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ছুরি দিয়ে বারবার তার শরীরে আঘাত করতে থাকে কান্তা মনি।

-তোদের একটাকেও ছাড়ব না।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here