কান্তা মনি পর্ব -০২

#কান্তা_মনি
#পর্ব_২
#লেখনীতে_আফিয়া_অন্ত্রীশা

বিয়ের কাজ সম্পন্নের পরে পালকি চড়ে যুবতি রওনা হলো নতুন জগতে পদার্পণের উদ্দেশ্যে। সে কি পারবে সেখানের সবকিছুর সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে? কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পরেই বাকা হেসে উঠল কান্তা। সামনে কি আছে দেখা যাবে কিন্তু সৎ মায়ের অমন নিষ্ঠুর অত্যাচার থেকে তো মুক্তি মিলেছে অবশেষে।

রমিজ হাওলাদার মেয়ের বিদায়ের পরমুহূর্তে টলতে টলতে নিজ কক্ষে প্রবেশ করেন। রাহেলা বাকা হেসে রমিজ হাওলাদারকে অনুসরণ করে কক্ষে প্রবেশ করেন। বাবার জন্য মনটা ভিষণ বিষন্নতায় ছেয়ে গেল কান্তা মনির। সে না থাকলে বাবাকে কে তার মতো ছোট শিশুর মতন আগলে রাখবে? ভারাক্রান্ত মুখ নিয়ে পালকির পর্দা হালকা সরিয়ে সদ্য বিবাহিত লালটুকটুকে কনে চিরচেনা বাবার ভিটের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।

আকাশ ঘন অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। জমিদারবাড়ির সিংহদ্বারের সামনে এসে পালকি থামার কিছুক্ষণ পর নিয়াজ পালকির ভেতর পর্দা ভেদ করে হাত বাড়িয়ে দেয় কান্তা মনির দিকে। কান্তামনি কিছুক্ষণ নিস্তব্দ হয়ে বসে থেকে কাপা কাপা হাতখানা নিয়াজ মির্জার হাতের ওপর ভর দিয়ে পালকি থেকে নেমে আসে। যুবক ঠোটে বিজয়ের হাসি ফুটিয়ে রেখে প্রিয়তমাকে সাথে নিয়ে জমিদার শাহ জাহাঙ্গির মির্জা এবং চাচা শাহ সুলতান মির্জার সহিত সিংহদ্বার দিয়ে জমিদার বাড়িতে প্রবেশ করে। ইতোমধ্যে সদ্য বিবাহিত দম্পতির আগমনের খবর চারদিকে ছড়িয়ে যেতেই জমিদার বাড়ি আমেজে ভরপুর হয়ে উঠল।

নিয়াজ মির্জা অন্দরমহলে প্রবেশ করে আবেগ মাখা কন্ঠে তার প্রিয় আম্মাজান নূর জাহানকে ডাকতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নিয়াজ মির্জা তার নবাগত বেগমকে নিয়ে জমিদারবাড়িতে পা রেখেছে তা বেগম নূর জাহানের কর্ণগোচর হতেই তিনি সেই যে দ্বার দিয়েছেন তা আর খোলার নাম-গন্ধ নেই। আদরের পুত্রের আবেগমাখা ডাকেও তার মন বিন্দুমাত্র গলেনি।

অশ্রুজলে চোখ ঘোলাঘোলা হয়ে গেছে কান্তা মনির। মাথা নুয়ে দাঁড়িয়ে আছে কান্তা মনি। হঠাত এক মেয়েলি মিষ্টি কন্ঠ কানে এসে পৌছাতেই ছলছল চোখে মুখ তুলে তাকায়। মেয়েলি কন্ঠের অধিকারীনির কন্ঠে বেশ পরিপক্কতা অনুভব করা যায়। কান্তা মনির সামনে চল্লিশ-পয়তাল্লিশ বছর বয়সী এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। পরোনে সাদামাটা শাড়ি। মুখে বেশ কোমলতা ফুটে আছে।

-এতুটুতেই ভেঙ্গে পড়লে চলবে? সামনে তো অনেক লড়াই বাকি আছে। কষ্ট পেয়োনা তুমি নূর জাহান ভাবিজান একটু মনে দুঃখ পেয়েছেন। তুমি নিজের যোগ্যতা দিয়ে ভাবিজানের মন জয় করে নিতে পারবে আমি জানি। কারণ আমাদের বাঘ তো নিজের জন্য একটা বাঘিনীই খুজে আনবে জানা কথা।
কান্তা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। এতক্ষণে ভরসাযোগ্য কাউকে খুজে পেলো সে। মুখ থেকে টু শব্দটি না করে মহিলাটির কথার সাথে তাল মিলিয়ে মাথা নাড়ালো কান্তা।
-আমি নিয়াজের ফুফু মেহেরুন্নেছা। নাম কি তোমার মেয়ে?
কাঁপা কাঁপা কন্ঠে কান্তা জবাব দিতে নিতেই নিয়াজ বলে উঠল,
-কান্তা মনি।
মেহেরুন্নেছা এক গাল হেসে নিয়াজের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে উঠলেন ,
-বাবা তুই এ কাকে নিয়ে এসেছিস! এতো যেন রূপকথার সেই শুভ্রপরী!
-বুঝতে হবে ফুফুমনি, শাহ নিয়াজ মির্জা কাউকে পছন্দ করেছে অবশ্যই তা সবচেয়ে বিশেষ হবে।(নিয়াজ মির্জা)
-হুম তা ঠিক। (মেহেরুন্নেছা)
-ফুফুমনি যা বলেছিলাম সব ঠিকঠাক তো?(নিয়াজ মির্জা)
-হুম ভাইজান যা যা বলেছিলে সব ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে।(কথা বলে মুচকি হেসে এগিয়ে এলো নিয়াজ মির্জার একমাত্র ছোট বোন হেতিজা)
প্রিয় বোনের গাল টেনে দিয়ে নিয়াজ বলে উঠল,
-শুকরিয়া বোন আমার।
-হুম হয়েছে হয়েছে।এবার আমার হাদিয়া দাও ভাইজান।(হেতিজা)
-হাদিয়া! গিয়ে দেখ তোর পালঙ্কের ওপর রাখা আছে।(নিয়াজ মির্জা)

ভাই-বোনের এমন দুষ্টু-মিষ্টি ভালোবাসা দেখে মুচকি হাসল কান্তা।
নিয়াজের সাথে এক কারুকার্য খচিত দ্বারের সামনে এসে দাড়িয়েছে কান্তা। রক্ষীগণ দ্বার খুলে দিতেই কক্ষের ভেতর প্রবেশ করে নিয়াজ ও কান্তা। বিশাল পালঙ্কের ওপর চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন বৃদ্ধা নূর নাহার। পাশেই তার খেদমত করতে ব্যস্ত এক দাসী। বৃদ্ধার চোখে-মুখে কঠিন ব্যাধির রেখা ফুটে আছে বৃদ্ধার।

নিয়াজ মৃদু কন্ঠে তার দাদীজানকে ডাকতেই ধীরে ধীরে চোখ খোলেন নূর নাহার।
-দাদীজান দেখুন আপনার বাঘ তার বেগমকে নিয়ে আপনার সামনে উপস্থিত।
বহু কষ্টে মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলেন বৃদ্ধা। হাত দিয়ে ইশারা করে কান্তাকে পাশে বসতে বলেন নূর নাহার। কান্তা মনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ইশারা দিয়ে মাথা নোয়াতে বলেন নূর নাহার। কান্তা মাথা নোয়াতেই তার কপালে অধরোষ্ঠ ছুয়ে দেন নূর নাহার।

মেহেরুন্নেছার হাত ধরে ফুলে সজ্জিত এক কক্ষে প্রবেশ করে কান্তা মনি। ফুলের মাতাল করা সুবাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কক্ষের আনাচে কানাচে। পালঙ্কের মাঝ বরাবর কান্তা মনিকে বসিয়ে বড়সড় ঘোমটা টেনে দিয়ে কক্ষ ত্যাগ করলেন মেহেরুন্নেছা ও হেতিজা। ভয় ও সংকোচে হাত-পা থরথর করে কাপছে যুবতির।
কিছুক্ষণ বাদে নিয়াজ মির্জা কক্ষে প্রবেশ করে। নিয়াজের উপস্থিতি টের পেয়ে হালকা কেপে ওঠে কান্তা।
নিয়াজ ধীর পায়ে ফুলে সজ্জিত পালঙকে কান্তার মুখোমুখি বসে সন্তপর্ণে ঘোমটা তোলে। কান্তা মনি লজ্জায় চোখ খিচে বন্ধ করে নেয়। যুবক তা দেখে মুচকি হাসে।
-আমার প্রিয়তমাকে যে অপূর্ব লাগছে। তা সারাদিন তো মুখে কিছু তোলোনি। ক্ষুদা লাগেনি?
লজ্জায় মাথা নুয়ে দুপাশে মাথা নাড়িয়ে ‘না’ সূচক ইঙ্গিত দেয় কান্তা মনি। যুবক মুচকি হাসে।
-এত লজ্জা পেলে হয়? (নিয়াজ মির্জা)
নিয়াজ বাইরে গিয়ে কাউকে ডেকে কিছু বলে পুনরায় কক্ষে প্রবেশ করে। দাসীকে খাবার আনতে পাঠিয়েছি। নিচে গিয়ে খেতে হবেনা, এখানেই খাবার দিয়ে যাচ্ছে।

-আপনার আম্মা খুব রাগ করছে। সেও তো মনে হয় কিছু মুখে তোলে নাই তাইনা?(কান্তা মনি)
-হ্যা। আম্মার খুব রাগ।অনেকবার ডেকেছি সাড়াই দিচ্ছেন না। আজ আর তাকে কোনোভাবে কক্ষ থেকে বের করা যাবেনা। আব্বা এসে বুঝালে একটু শান্ত হবে। খুব সহজে তোমাকে মেনে নেবেন না। তোমাকে লড়াই করে তার মন জয় করে নিতে হবে। আর আমি জানি তুমি পারবে।(নিয়াজ মির্জা)
-চেষ্টা করুম।(কান্তা মনি)
যুবক অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।
-আগে তোমাকে সকল আদব-কায়দা শিখতে হবে। এইযে কথা বলার ধরণ পরিবর্তন করতে হবে। কাল সকালেই আমি হেতিজাকে বলে দেবো তোমাকে যেন সব কিছু শিখিয়ে দেয় আর আমিতো আছিই। আর শোনো খুব সাবধানতা অবলম্বন করে চলবে এখানে। অনেকেই তোমাকে জমিদার বাড়ি থেকে তাড়াতে ষড়যন্ত্র করবে। কখনো কোনো পরিস্থিতিতে ভেঙ্গে পড়বেনা কারণ তুমি শাহ নিয়াজ মির্জার বেগম। (নিয়াজ)
কান্তা মাথা নাড়ায় । চেহারায় তার অভিমানের ছাপ স্পষ্ট।

-কান্তা মনি খাবারটা খেয়ে নাও। (নিয়াজ মির্জা)
-আমি খাইতাম না। (কান্তা মনি)
-জেদ দেখিয়ো না। খেয়ে নাও। (নিয়াজ মির্জা)
-বললাম না খাইতাম না আমি। (কান্তা মনি)
নিয়াজ চেহারায় কঠোরতা ফুটিয়ে তুলে শক্ত গলায় বলে উঠল,
-তুমি নিয়াজ মির্জার কোমলতা দেখেছো কঠোরতা দেখোনি কান্তা মনি। আমাকে কঠোর হতে বাধ্য করোনা। (নিয়াজ)
যুবতি ভয়ার্ত চোখে নিয়াজের দিকে তাকিয়ে একটা ঢোক গিলে খাবারের থালা হাতে নিলো।

পালঙ্কের ওপর গুটিসুটি মেরে বসে আছে কান্তা মনি। তার সম্মুখেই নিয়াজ মির্জা গম্ভির মুখে বসে আছে।
-আমি বুজেছি তুমি আমার ওপর অভিমান করে আছো কান্তা মনি।আমার উচিত ছিল তোমাকে একটু সময় দেওয়ার। কিন্তু আমার কাছে কোনো উপায় ছিল না। আম্মা এক আলিশান ঘরের মেয়েকে আমার সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আম্মাকে ওই মেয়ের বংশের লোকদের কর্ম সম্পর্কে বললেও তিনি প্রমাণ ছাড়া কিছু বিশ্বাস করেননি। আমার হাতে এখন পর্যন্ত কোনো প্রমাণ নেই তাদের বিরুদ্ধে। আর আমিও আমার কান্তা মনির জায়গায় অন্য কাউকে বসাতে পারতাম না। এভাবে রেগে থেকোনা কান্তা মনি। (নিয়াজ মির্জা)
যুবকের আবেগ মাকা কন্ঠে উচ্চারিত প্রতিটা বাক্য যুবতির রাগকে গলিয়ে পানিতে রূপান্তরিত করছে। এমতাবস্থায় কান্না ছাড়া কান্তামনির মুখ থেকে বুলি ফুটছেনা। সে কি তার স্বামীকে কষ্ট দিয়ে ফেলছে? তার সখীরাও তো তাদের স্বামীকে কতটা মহব্বত করে কতটা মান্যগণ্য করে। নাহ সে বুঝেছে সে ঘোর অন্যায় করে ফেলছে। তাছাড়া জন্ম ,মৃত্য, বিয়ে , সবই তো মহান সৃষ্টিকর্তার হাতে।

নিয়াজ আস্তে করে তার প্রিয়তমার হাতখানা তার মুঠোর মধ্যে নিয়ে তাতে অধরোষ্ঠ ছোয়ায়।
-ওহে আমার কান্তা মনি! কি আছে তোমার ওই মায়াবী মুখে? একটা মুহূর্ত কেন তোমাকে না ভেবে থাকতে পারিনা? এই পুরুষের মনে যে আর দ্বিতীয় কোনো নারী প্রবেশ করতে পারবেনা। এই মনে শুধু আমার প্রিয়তমার বসবাস।

পাশ থেকে ছোট একটা সিন্দুকের ভেতর থেকে একটা সোনার ভারী হার কান্তা মনির গলায় পরিয়ে দেয় নিয়াজ মির্জা। কান্তা মনির থুতনি উচু করে যুবক বলে ওঠে,
-অপরূপ লাগছে আমার বেগম।
কান্তা মনির ইচ্ছা করছে লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে।
হঠাত নিয়াজ মির্জা কান্তা মনির কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন,
-ভালোবাসি প্রিয়তমা।
কান্তা মনি বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে নিয়াজ মির্জার বুকে মুখ লুকায়।
-আমারে একটুখানি সময় দেন বাবু মশাই। আমি ঠিক মানায়ে নেবো সব কিছু সাথে। (কান্তা মনি)
নিয়াজ মির্জা একগাল হেসে বলে ওঠে,
-শুধু বাবু মশাই বাবু মশাই করো কেন কান্তা মনি? আমি তোমার স্বামী হই। আর বাবু মশাই ডাকবেনা।
-যথা আজ্ঞা স্বামী।
যুবক মুচকি হাসে।

হারিকেনের আলো নিভিয়ে জ্যোস্নাবিলাস করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সদ্য বিবাহিত দম্পতি।

ভোরবেলা কান্তা মনি নামাজ পড়ে উঠেই বাইরে থেকে শোরগোল শুনতে পেলো। জানালা থেকে উকি দিয়ে কি হচ্ছে বাইরে তা দেখার চেষ্টা করতে লাগল কান্তা মনি। নিয়াজ মির্জাকে ক্রধান্বিত হয়ে হনহন করে সিং হদ্বার হতে বের হতে দেখে কান্তা বিচলিত হয়ে পড়ল।
কক্ষ থেকে বের হয়েই একজন দাসীর কাছে শুধালো বাইরে এত হট্টগোল কেন?
-বেগম যতটুকু শুনেছি আবারও নাকি কারা একজন পাইককে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে। পাইকের মৃতদেহ ভেসে নদীরঘাটের কাছে আসার পর কিছু জেলেরা উদ্ধার করেছে। দাসী ফিসফিসিয়ে বলল, এ নিয়ে তিনজন পাইকের মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে বেগম।
দাসীর মুখে হত্যার কথা শুনে ভয়ে কেঁপে উঠল কান্তা মনি।
-এতেই ভয় পেয়ে গেলেন বেগম ? এমন ঘটনাতো অহরহ ঘটে চলেছে এখানে।
আর কোনো কথা না বাড়িয়ে স্থান ত্যাগ করে কক্ষে এসে ঢকঢক করে কয়েক দফা পানি পান করল কান্তা মনি। ভয়ে কপাল হতে ঘাম চুয়ে চুয়ে পড়ছে তার।

খাবারে থালা হাতে বেগম নূর জাহানের কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কান্তা মনি। তার পাশ ঘেষেই দাঁড়িয়ে আছে নিয়াজ মির্জা।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here