মরিচাধরা মনের খাঁচা পর্ব -০৩

মরিচাধরা মনের খাঁচা
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ০৩

জানলার পর্দা ভেদ করে সূর্যের আলো অয়নের চোখে লাগতেই ঘুম ভেঙে গেলো তার। চোখ বন্ধ করেই আশপাশ হাতড়ে ফোন খোঁজে হাতে দিলো। স্কিনে তাকিয়ে সময়টা দেখে লাফ দিয়ে উঠে বসলো। আটটা বাজতে খুব একটা সময় বাকি নেই। সারারাত বৃষ্টি হওয়ার পর সকালে স্বচ্ছ আকাশে সূর্যের অস্তিত্ব আজ তীব্র। গতরাতে অনেক দেরি করে ঘুমানোর জন্য উঠতেও দেরি হয়ে গেলো। তবে প্রতিদিন নিঝুম এসে ফজরের সময় ডেকে দেয় আর অয়নও উঠে নামাজটা পড়ে নেয়। মনে হয় এই তো সেদিনই নিঝুম এবাড়িতে এলো।

৬.
নিঝুম বাসর রাতে দু’রাকাআত নফল নামাজ পড়তে বললে অয়ন বলে, যে বিয়েই মানি না তার জন্য আবার নফল নামাজ আদায় করবো ?

নিঝুম কিছু একটা ভেবে বললো, আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি যেদিন আমাকে মেনে নিবেন, সেদিন আবার বিয়ে করে নফল নামাজ আদায় করে নতুন জীবন শুরু করবো।

অয়ন তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, সেদিন কখনোই আসবে না।

নিঝুম হাসি মুখে বললো, আসবে আসবে, এমন একদিন অবশ্যই আসবে ইনশাআল্লাহ। সেদিন আমার থেকেও আপনি বেশি ভালোবাসবেন আমাকে।

সেটা তোমার স্বপ্নে।

স্বপ্ন ঠিক আছে, তবে একদিন বাস্তবেও হবে। আচ্ছা বাদ দিন সেসব কথা। এখন ছেড়ে দিচ্ছি তবে ফজরে কিন্তু উঠিয়ে ছাড়বো।

আমি সাতটার আগে ঘুম থেকে উঠি না।

সেটা সকালেই দেখা যাবে। কিন্তু এখন বলুন আমি ঘুমাবো কোথায় ? আপনার বেডে ঘুমাতে দিবেন না সেটা ভালো করেই বুঝে গেছি। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে তাড়াতাড়ি বলুন কোথায় ঘুমাবো।

তুমি কোথায় ঘুমাবে তার আমি কী জানি ?

বলুন, নাহলে কিন্তু বেডে শুয়ে পড়বো।

একদম বেডে আসবে না, তুমি ঐ সোফায় ঘুমিয়ে পড়ো।

অয়নের বলতে দেরি হলেও নিঝুমের শুয়ে পড়তে দেরি হলো না। কিছু চেঞ্জ না করেই শুয়ে পড়তে দেখে অয়ন নাক কুঁচকে ফেললো। নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লো, কখন ঘুমিয়ে গেছে টেরই পায়নি। সকালে কেউ মুখে পানি ছুঁড়ে মারলে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। কী হলো বুঝতে অনেকটা সময় লাগলো অয়নের। দু’হাতে মুখের পানি মুছে সামনে তাকিয়ে দেখলো একহাতে মগ নিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে, মিটিমিটি হাসছে নিঝুম। রাগে মুখ লাল হয়ে গেলো অয়নের। বুঝতে বাকি রইলো না কাজটা কার। উঠে গিয়ে নিঝুমের হাত পেছনে মুচড়ে ধরলো।

দাঁতে দাঁত চেপে বললো, এটা কী ধরনের অসভ্যতামি ?

নিঝুম ব্যাথায় কুঁকড়ে গিয়ে বললো, সেই কখন থেকে ডাকছি আপনি শুনছিলেন না, তাই এভাবে জাগাতে হলো।

তোমাকে কেউ বলেছিলো আমাকে জাগাতে ?

যাহ্ বাবা, না জাগালে নামাজটা পড়তেন কীভাবে ? এখন জান নামাজটা পড়ে নিন। দেখুন আমি শাওয়ার নিয়ে নামাজও পড়ে ফেলেছি।

অয়ন এবার খেয়াল করলো রাতের সাজে নেই নিঝুম। শাওয়ার নিয়ে একটা সবুজ রঙের শাড়ি পড়েছে। দেখতে অনেকটা স্নিগ্ধ লাগছে।

অয়ন শয়তানি হাসি দিয়ে বললো, তুমি শাওয়ার নিয়েছো ?

নিঝুম নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, সেই কখন নিয়েছি। আপনার মতো নাকি, পড়ে পড়ে ঘুমাবো।

অয়ন কিছু না বলে নিঝুমকে কোলে তুলে নিলো হুট করে। নিঝুম অয়নের হঠাৎ এমন কাজে ভয় পেয়ে অয়নের টিশার্ট আঁকড়ে ধরলো।

আরে আরে কোলে তুললেন কেনো ? আছাড় দিয়ে আমার কোমর ভাঙার প্ল্যান করেছেন নাকি ?

অয়ন কিছু না বলে শয়তানি হাসি দিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যেতে লাগলো।

ওয়াশরুমে কেনো যাচ্ছেন ? আরে বাবা আপনার দরকার আপনি একা যান না।

অয়ন চুপচাপ ওয়াশরুমে গিয়ে পানি ভড়া বাথটবে ছুঁড়ে ফেললো নিঝুমকে। অয়নের কাজে নিঝুম পুরো হতভম্ব হয়ে গেলো।

রেগে বললো, এটা কী করলেন আপনি ? একটু আগেই শাওয়ার নিয়েছি আমি।

অয়ন নিঝুমের দিকে একটু ঝুঁকে বললো, সকাল সকাল আমাকে ভেজানোর শাস্তি এটা।

নিঝুম খপ করে অয়নের টিশার্ট আঁকড়ে ধরলো আর বললো, বউয়ের সাথে গোসল করার শখ হয়েছে আগে বললেই হতো।

অয়ন কিছু বুঝে উঠার আগেই নিঝুম টান দিয়ে অয়নকেও ফেলে দিলো। অয়ন গিয়ে পড়লো সোজা নিঝুমের উপর আর ভিজে জবজবে হয়ে গেলো মুহূর্তে।

নিঝুম মুচকি হেসে বললো, এখন কেমন লাগছে মিস্টার অ্যাটিটিউট উপস সরি মিস্টার হাসবেন্ড ?

অয়ন বাথটাবের দুপাশে ধরে নিঝুমের উপর থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, তোমাকে আমি দেখে নিবো।

অয়ন রেগেমেগে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে গেলে নিঝুম উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো। অয়ন বের হয়ে নিজের পোশাক নিয়ে অন্য রুমের ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য বের হয়ে গেলো। নিঝুম উঠে আবার শাড়ি চেঞ্জ করে নিলো।
এরপর থেকে নিঝুম নানা টেকনিক ব্যবহার করে অয়নকে ঘুম থেকে তুলতো। প্রথমদিকে অয়ন প্রচন্ড বিরক্ত হলেও পরবর্তীতে ভালো লাগতো। কিন্তু নিঝুমকে কখনো বুঝতে দিতো না, নিঝুমের আড়ালে মুচকি হাসতো তার কান্ডকারখানা দেখে। অয়নের অভ্যাস হয়ে গেছে ফজরের সময় উঠা, তবু ঘুমের ভান ধরে নিঝুমের ডাকের অপেক্ষা করতো এরপর থেকে।

৭.
আজ নিঝুমও ডাকেনি আর অয়নেরও ঘুম ভাঙেনি।নিঝুম কেনো তাকে ডাকেনি ভাবতেই গতকালের কথা মনে পড়ে গেলো। নিঝুমের পা কেটে গেছে সে হাঁটতে পারলে তো তাকে ডাকবে। অয়ন তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলো। নিঝুমের কী অবস্থা দেখতে হবে। অয়ন রেডি হয়ে নিচে নেমে দেখে খুশি ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে। প্রতিদিন সেটা নিঝুম আর অহনা করে।

অয়ন একটা চেয়ার টেনে বসে বললো, মা কোথায় খুশি ?

খুশি গম্ভীর গলায় বললো, ভাবিরে ডাক্তার দেখতে আইছে, খালাম্মা ভাবির রুমে আছে।

অয়ন খানিকটা বিরক্তি নিয়ে বললো, সামান্য পা কাঁটার জন্য ডক্টর ডেকে আনতে হবে ?

ভাবির জ্বর হইছে, খালাম্মা সারারাত ভাবির কাছে ছিলো।

অয়ন অবাক হয়ে বললো, কীহ্ নিঝুমের জ্বর হয়েছে ?

খুশির উত্তরের অপেক্ষা না করেই অয়ন উঠে নিঝুমের রুমের দিকে পা বাড়ালো। নিঝুমের সহজে জ্বর হয় না কিন্তু যখন হয় দশ পনেরো দিনের আগে আর ঠিক হয় না। তখন নিঝুমের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়।

অয়ন নিঝুমের রুমে গিয়ে দেখে ডক্টর কিছু লিখছে আর বলছে, শরীরে এখনো অনেক জ্বর। শুধু মেডিসিনের দিকে না, খাবারের দিকেও কড়া নজর রাখতে হবে। খাবার ঠিক মতো খেলে খুব বেশি দুর্বল হয়ে পড়বে না। আজে বাজে খাবার দিবেন না শুধু পুষ্টিকর খাবার দিবেন।

অহনা নিঝুমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, আমি ওর খেয়াল রাখবো ডক্টর।

প্রেসক্রিপশন অহনার হাতে দিয়ে বললো, এখানে মেডিসিন লিখে দিয়েছি সময়মতো সব দিবেন। আর পায়ের ব্যাথাটা কমার জন্যও কিছু মেডিসিন দিয়েছি। তবে কাটা জায়গায় যেনো পানি না লাগে। আমি তাহলে এখন উঠি মিসেস রাজিব।

অহনা উঠে দাঁড়িয়ে বললো, সরি ডক্টর আপনাকে এতো সকালে বিরক্ত করার জন্য।

না না সমস্যা নেই, এটা আমার ডিউটি।

অয়ন দরজার সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ডক্টর তার পাশ কাটিয়ে বের হয়ে গেলো। অহনা পুনরায় নিঝুমের মাথার কাছে বসলো।

অয়ন এগিয়ে এসে গম্ভীর গলায় বললো, মা এতো কিছু হলো আর তুমি আমাকে একবার ডাকলে না ?

অহনা শান্ত গলায় বললো, তোমাকে কেনো ডাকবো ?

অয়ন অবাক হয়ে বললো, আমাকে কেনো ডাকবে মানে ? ওর এমন একটা অবস্থায় তুমি একা একা সব করছো।

অহনা এবারও বেশ শান্ত গলায় বললো, নিঝুম তার জীবনের কোনো বিষয়ে তোমাকে জড়াতে চায় না আর।

অয়ন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো ক্লান্ত হয়ে শুয়ে থাকা নিঝুমের দিকে। এই কী সেই মেয়ে ? যে মেয়েটা সামান্য গা গরম হলেও অয়নকে নাকানিচুবানি খাইয়ে ছাড়তো।

অহনা গম্ভীর গলায় বললো, খুশি ব্রেকফাস্ট দিয়েছে হয়তো। খেয়ে অফিসে চলে যাও, তোমার লেট হচ্ছে।

নিজের মায়ের ব্যবহারেও আজ অবাক অয়ন। অনেকটা ঘোরের মাঝেই বের হয়ে গেলো নিঝুমের রুম থেকে। ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসতেই খুশি খাবার এগিয়ে দিলো। পরোটা , সবজি, ডিম ভাজা, ফলের জুস। সব খাবার যেনো তেলে ডুবে আছে। অয়ন অয়েলি খাবার পছন্দ করে না, আর ব্রেকফাস্টে তো একদমই না। খাবার দেখেই বুঝতে পারলো আজ সব খাবার খুশি বানিয়েছে। তাই আর না খেয়েই উঠে চলে গেলো কিছু না বলে। খুশি শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো। অয়ন গাড়িতে গিয়ে বসতেই পকেটে থাকা ফোনটা কেঁপে উঠলো। বের করে স্কিনে নয়নার নাম্বার দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে উঠলো।

৮.
যে মেয়ে জন্ম দেওয়ার অপরাধে স্বামীর বাড়িতে সাথীর জায়গা হয়নি আজ সে মেয়েকেই কেড়ে নেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে তারা। এর কারণ জানা নেই সাথীর আর সে জানতেও চায় না। ছয় মাসের ফুটফুটে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে কেঁদে চলেছে সাথী। মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে তাকিয়ে দেখলো নিজের অসুস্থ মাকে।

ব্যস্ত গলায় বললো, তুই উঠে এলি কেনো রে মা ? তোর কিছু দরকার হইলে আমারে বলতি। আজ তোর শরীরটা বেশি খারাপ হইয়া গেছে।

সাথীর মা জমিলা বেগম দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, মাইয়ার জীবনের এমন দুর্দশা দেইখা কোন মা ভালো থাকবো রে ?

সাথী একহাতে মাকে জড়িয়ে ধরে বললো, আমি তো আমার মাইয়া নিয়া বাঁচতে শিখা গেছিলাম। ওরা এহন আবার আমার মাইয়াডারে কাইড়া নিতে চাইতাছে কেন, বল না রে মা ?

চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here