মরুর বুকে বৃষ্টি পর্ব ১৩

#মরুর_বুকে_বৃষ্টি💖
#লেখিকা-Mehruma Nurr
#পর্ব-১৩

★আজ শুক্রবার, ছুটির দিন। আদিত্য আজ বাসায়ই আছে। আদিত্য বাসায় থাকলে নূরের অনেক ভালো লাগে। সারাক্ষণ আদিত্যর সাথে দুষ্টুমিতে মেতে থাকে।নানান রকম আবদারের ঝুলি খুলে বসে।আর আদিত্য স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সেগুলো পুরন করে। নূরের সাথে থাকলে আদিত্য নিজেও যেন বাচ্চা হয়ে যায়।

বেলা ১২টা
আদিত্য নূরকে সুন্দর একটা ড্রেস পরিয়ে দিয়ে, আয়নার সামনে ওকে রেডি করছে। আদিত্য এখন অনেক ভালো ভাবে নূরের সব কাজ শিখে গেছে। এখন আর কোন সমস্যা হয় না। নূরের প্রায় সব কাজই আদিত্যই করে। আর যেটা আদিত্য করতে পারে না, সেটা নিলা নাহলে মিনু আন্টি করে দেয়।
আদিত্য ড্রেসিং টেবিলের সামনে নূরকে বসিয়ে ওকে সাজিয়ে দিচ্ছে। নূর কৌতুহলী হয়ে বলে উঠলো।
–আচ্ছা হিরো আমাকে সাজাচ্ছ কেন? আমরা কি বেড়াতে যাচ্ছি কোথাও?

আদিত্য মুচকি হেসে বললো।
–না আমরা বেড়াতে যাচ্ছি না। আজ আমাদের বাসায় গেস্ট আসছে তো,তাই আমার এঞ্জেল টাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিচ্ছি। যাতে তারা আমার এঞ্জেল টাকে দেখে বলে,ওয়াও হিরোর এঞ্জেল টা কতো সুন্দর।

–সত্যিই? কারা আসছে হিরো?

–তোমার দেবর আছে না? তার মা বাবা। আর আমার চাচা চাচী।

–ওওওও,,,

নূরের সাজ শেষ হয়ে গেলে, নূর আয়নার সামনে ঘুরে ঘুরে হাসি হাসি মুখে বললো।
–ওয়াও আমাকে কত্তো সুন্দর লাগছে। তাইনা হিরো?

আদিত্য দুই হাতে নূরের মুখটা আগলে ধরে আদুরে গলায় বললো।
–আমার এঞ্জেল টা তো সবসময়ই সুন্দর। আচ্ছা শোন, গেস্ট দের সামনে কিন্তু কোন দুষ্টুমি করবেনা প্লিজ। একদম গুড গার্ল হয়ে থাকবে কেমন? তাহলে ওরা তোমাকে ভালো বলবে। নাহলে কিন্তু ওরা তোমাকে পঁচা বলবে। আর তুমি যদি গুড গার্ল হয়ে থাক, তাহলে আমি তোমাকে অনেক গুলো চকলেট দিব ঠিক আছে?

–সত্যিই? ঠিক আছে আমি একদম গুডু গুডু গার্ল হয়ে থাকবো। একদম দুষ্টুমি করবোনা প্রমিজ।

আদিত্য মুচকি হেসে নূরের কপালে একটা চুমু খেয়ে, নূরের হাত ধরে ওকে নিচে নিয়ে এলো।
আদিত্য আজ লাঞ্চে ওর চাচা চাচীকে ইনভাইট করেছে।

নিচে ড্রয়িং রুমে সোফায় আদিত্য, নূর আর নিলা বসে আছে। একটু পরেই বাসার কলিং বেল বেজে উঠল। একটা সার্ভেন্ট গিয়ে দরজা খুলে দিলে আদিত্যের চাচা চাচী ভেতরে এলো। সাথে আবির আর আয়াতও। আদিত্য উঠে দাঁড়িয়ে ওর চাচা চাচীর সাথে কুশল বিনিময় করে তাদের সোফায় বসতে দিল। আজকের আদিত্যকে একটু অন্যরকম লাগছে। আসলে আদিত্য ওর চাচার প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ। তাই ওর চাচাকে ও অনেক সম্মান করে। চাচার সামনে সবসময় বিনয়ী ভাবে থাকে। আদিত্য যখন নূরকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তখনও সবার আগে ও ওর চাচাকেই বলেছিল। এবং নূরের মানুষিক স্টেটেজের কথাও সব বলেছিল। ওর চাচা বলেছিল, তোমার যেটা মন চায় সেটাই করো। আমি জানি তুমি যা করবে ভেবেচিন্তেই করবে।আমার সাপোর্ট সবসময় তোমার সাথে আছে।

আদিত্যের চাচা চাচী বসার পর আদিত্য নূরের হাত ধরে আস্তে দাঁড় করিয়ে বললো।
–চাচা ও হচ্ছে নূর আপনাদের বৌমা। আপনাকে তো ফোনে সব বলেছিলাম। হঠাৎ করেই বিয়েটা করে ফেলেছি তাই কাওকে তেমন জানতে পারিনি।

নূর হাসিমুখে ওদের দিকে হাত নাড়িয়ে বললো।
–হায়য়,,

নূরকে দেখে আদিত্যের চাচা আশরাফ রহমান খুশী হলেও,ওর চাচী শরিফা বেগমের মুখে কোন খুশী দেখা গেল না। হবেই বা কি করে। উনিতো ভেতরে ভেতরে জ্বলে পুড়ে কয়লা হয়ে যাচ্ছেন। তার এতদিনের প্ল্যান সব ভেস্তে চলে গেল। তার সোনার ডিম পারা মুরগীটা যে তার হাত ফসকে বেড়িয়ে যাচ্ছে। সেতো ভেবেছিল আদিত্যের টাকায় সারাজীবন আয়েশ করবে। তাইতো কখনো আদিত্যর বিয়ে দেওয়ার কথা মুখেও আনেননি। আদিত্য যে মেয়েদের কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতো। সেটা দেখে উনি মনে মনে খুশিই হতেন। ভাবতেন আদিত্য যতো বিয়ে না করে ততই ভালো। আদিত্যর চাচা মাঝেমধ্যে বিয়ের কথা বললেও, সে কখনো সেটা এগুতে দিতোনা। এটা ওটা বলে কাটিয়ে দিত। আর আজ কিনা কোথাকার কোন পাগল মেয়েকে বিয়ে বসে আছে? শরিফা বেগমে যদি দেশে থাকতো তাহলে কখনো এই বিয়ে হতে দিতো না। সেতো আজ এখানেও আসতো না। শুধুমাত্র আশরাফ রহমানের জোরাজোরিতে এসেছে। কিন্তু নূরকে তিনি একেবারেই সহ্য করতে পারছেন না। তবুও সবার সামনে নিজের রাগ চেপে বসে আছে।

আশরাফ রহমান নূরকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন। নূর একবার আদিত্যের দিকে তাকালে, আদিত্য চোখের ইশারায় যেতে বললো। নূর এগিয়ে গিয়ে আশরাফ রহমানের পাশে বসলো। আশরাফ রহমান একজোড়া কঙ্গন বেড় করে নূরের হাতে পড়িয়ে দিয়ে বললো।
–এটা তোমার জন্য। পছন্দ হয়েছে তোমার?

নূর চুড়ি দেখে হাসিমুখে বললো।
–হ্যাঁ অনেক সুন্দর। থ্যাংক ইউ দেবরের বাবা।

আশরাফ রহমান হালকা কপাল কুঁচকে বললো।
–দেবরের বাবা?

আদিত্য বলে উঠলো।
–আসলে ও আবিরের কথা বলছে।

আশরাফ রহমান এবার ব্যাপার টা বুঝতে পেরে হেসে উঠলেন। তারপর নূরের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন।
–বেঁচে থাক মা। আল্লাহ যেন তোমাদের সুখী রাখেন।

নূর উঠে দাঁড়িয়ে আদিত্যের সামনে গিয়ে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে,উচ্ছ্বসিত ভাবে হাতের চুড়ি দেখিয়ে বললো।
–দেখ হিরো কি সুন্দর চুড়ি তাইনা?

আদিত্য মুচকি হেসে বললো।
–হ্যা অনেক সুন্দর। তোমাকে অনেক মানিয়েছে।

–আমি সবাইকে আমার গিফট দেখিয়ে আসি।
কথাটা বলে নূর ওখান থেকে চলে গেল,সবাইকে ওর গিফট দেখাতে।

নূর যেতেই আশরাফ রহমান বলে উঠলেন।
–তুমি ভালো সিদ্ধান্তই নিয়েছ আদি।মেয়েটা সত্যিই অনেক মায়াবী।

আশরাফ রহমানের কথায় শরিফা বেগম ফোঁড়ন কেটে বলে উঠলেন।
–এর ভেতর ভালোর কি দেখলে তুমি? কোথাকার কোন পাগলছাগল বিয়ে করে বসে আছে আদিত্য। আর তুমি কিনা বলছ ভালো করেছে? আরে দেশে কি মেয়ের অভাব পরেছে, যে এই পাগল মেয়েকে বিয়ে করতে হবে?

শরিফা বেগমের কথা শুনে আদিত্যের চরম রাগ উঠে গেল। হাতের মুঠো শক্ত করে নিজের রাগকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করলো আদিত্য। চাচার সামনে কোন বেয়াদবি করতে চায়না সে। তবে নূরকে নিয়ে কেউ কিছু বললে সেটা কখনোই সহ্য করবে না আদিত্য। আদিত্য দাঁত চেপে যথাসম্ভব নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে।
তবে আশরাফ রহমান তার স্ত্রীর প্রতিত্তোরে হালকা ধমকের সুরে বলে উঠলেন।
–আহ্ শরিফা, এসব কি ধরনের কথাবার্তা। ভুলে যেওনা নূর আদিত্যের বউ। আর সেই হিসেবে এখন সে আমাদের পুত্রবধূ। তাই কথা বলার সময় একটু ভেবেচিন্তে বলো। নূর যেমনই হোক সেটা নিয়ে তোমার মাথা ঘামাতে হবে না। আদিত্য দেখে নিবে সেটা।

শরিফা বেগম রাগে কিড়মিড় করে চুপ করে রইলেন। আদিত্য সিচুয়েশনটা সামলানোর জন্য বলে উঠলো।
–লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে। আসুন আগে লাঞ্চ করে নিন বাকি কথা পরে হবে।

আশরাফ রহমান মাথা ঝাকিয়ে বললেন।
–হ্যাঁ হ্যাঁ চলো।
__

রান্নঘরে নিজের জন্য একটু লেমন জুস বানাচ্ছিল নিলা। আবির হাত ধুতে এসে নিলাকে দেখে বাঁকা হাসি দিল। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো রান্নাঘরে কেউ নেই। আবির এই সুযোগে নিলার পেছনে গিয়ে, নিলার ঘাড়ের ওপর মাথাটা একটু ঝুকিয়ে বললো।
–কেমন আছ মিস কচি লঙ্কা? আমাকে মিস করছিলে বুঝি?

নিলা চমকে উঠে পেছনে তাকিয়ে রাগী কন্ঠে বললো।
–আপনি এখানে কি করছেন? সবাইতো খেতে বসেছে।

–সেইজন্যই তো এসেছি।

–মানে?

–মানে হলো,কালকের পর থেকে কেন যেন আমার ঠোঁটে অন্য কোন কিছু স্বাদই লাগছে না। শুধু একটা স্বাদই ঠোঁটে লেগে আছে। মনে হচ্ছে সেই স্বাদটা যদি আবার পেতাম।

আবিরের কথায় নিলার কালকের ঘটনা মনে পড়লো।রাগটা আবার বেড়ে গেল নিলার।কালকের ওই লুচ্চামির জন্য এই লোকটার কাছে কঠিন একটা বদলা তো নিতেই হবে। কথাটা ভেবে নিলা নিজের চেহারার ভাব ভঙ্গি পাল্টালো। আবেদনময়ী হাসি দিয়ে আবিরের দিকে তাকিয়ে বললো।
–তাই বুঝি আপনার আবারও ওটা চাই?

আবিরের হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো খুশী হলো।আবির আবালের মতো মাথা ঝাকিয়ে বললো।
–হ্যাঁ হ্যাঁ চাই চাই।

নিলা লাজুক ভঙ্গিতে বললো।
–তাহলে চোখ বন্ধ করো। নাহলে আমার লজ্জা করে।

আবির একগাল হেসে সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে নিল। ঠোঁট জোড়া উঁচু করে নিলার আগমনের অপেক্ষায় রইল। নিলা সেটা দেখে সয়তানি হাসি দিল। তারপর একটা কৌটা থেকে মরিচের গুঁড়ো আঙুলে নিয়ে আবিরের দুই ঠোঁটে ইচ্ছামত মাখিয়ে দিল।আবির প্রথমে ব্যাপার টা বুঝতে না পেরে চোখ খুলে তাকালো। যতক্ষণে টের পেল ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। বেচারা ঝালের তাড়নায় চোখ বড়বড় করে যেই চিল্লানি দিতে যাবে, ওমনি নিলা আবিরের মুখ চেপে ধরে বললো।
–একদম চিল্লাবেন না। নাহলে কিন্তু আমি জিজুকে বলে দিবো আপনি আমার সাথে কি করেছেন। অনেক শখ না সেই স্বাদ পাওয়ার? আজকের পর থেকে শুধু এই ঝালের স্বাদ ছাড়া আর কোন স্বাদই আপনার মনে থাকবে না। আর ভবিষ্যতে আর কখনো আমার সাথে পাঙ্গা নিতে আসবেন না।
কথাগুলো বলে নিলা এটিটিউট দেখিয়ে চুলগুলো ঝামটি মেরে চলে গেল।
বেচারা আবিরের ঝালে করুন অবস্থা। ও বেসিনে গিয়ে মুখে পানি দিতে লাগলো। আর ঝালে কাতরাতে লাগলো।

খাবার টেবিলে সবাই লাঞ্চ করতে বসেছে। আদিত্য বরাবরের মতো নূরকে খাইয়ে দিচ্ছে। আর এটা দেখে শরিফা বেগম ফুলে লুচি হয়ে যাচ্ছে। মনে মনে বলছে, হুহ্ যতসব আদিখ্যেতা। ঢং দেখে আর বাচিই না। একটা পাগল মেয়েকে এতো মাথায় নিয়ে নাচার কি আছে?

লাঞ্চ শেষে সবাই সোফায় বসে কথা বার্তা বলছে। তখনই আদিত্যর একটা ফোন আসে। আদিত্য ওখান একটু সরে গিয়ে ফোনে কথা বলতে থাকে। নূর ওর বিড়াল ছানাকে কোলে নিয়ে বসে বসে খেলছিল। হঠাৎ বিড়াল ছানাটা নূরের কোল থেকে নেমে একদিকে দৌড় দেয়। আর নূরও বিড়াল ছানাকে ধরার জন্য ওর পিছনে ছুটতে লাগলো। তখনই একটা সার্ভেন্ট ট্রেতে করে সবার জন্য কোল্ড ড্রিংক নিয়ে আসলো। সবাই যার যার কোল্ড ড্রিংক হাতে নিচ্ছে। শরিফা বেগম যখন নিজের কোল্ড ড্রিংক হাতে নিচ্ছিল সেই মুহূর্তে নূর ওর বিড়াল ছানাকে ধরতে গিয়ে হঠাৎ শরিফা বেগমের হাতের সাথে ধাক্কা লেগে কিছু কোল্ড ড্রিংক শরিফা বেগমের গায়ের ওপর পড়ে যায়। এতক্ষনে জমে থাকা ক্ষোভটা এবার বিস্ফোরণ হয়ে বেড়িয়ে আসে। শরিফা বেগম এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে নূরের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে জোরে ধমকানোর সুরে বলে উঠলেন।
–এই পাগল মেয়ে কি করলে এটা তুমি?দেখে চলতে পারো না ? আমিও কাকে কি বলছি, একটা পাগলের কাছ থেকে আর কি আশা করা যায়। যতসব পাগলের কারখানা।

শরিফা বেগমের এমন ধমকে নূর সাথে সাথে কেঁপে উঠল। ভয়ে জড়সড় হয়ে গেল। শরিফা বেগমের কথার ধাজে নূরের চোখ দিয়ে পানি চলে এলো।
আদিত্য সেটা কিভাবে সহ্য করবে।ও শরিফা বেগমের সব কথাই শুনেছে। আর সাথে সাথে ওর মাথায় দপ করে আগুন জ্বলে উঠলো। এবার আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না আদিত্য।চোখ জোড়ায় লাল লালিমা ভেসে উঠে, কপালের রগ ফুলে নিল হয়ে উঠেছে। হাতের মুষ্টি আরও শক্ত করেও কোন লাভ হচ্ছে না। আদিত্য দাঁতে দাঁত চেপে যথাসম্ভব নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে শরিফা বেগমের সামনে এসে দাঁড়াল। আদিত্য আসতেই নূর আদিত্যের পেছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়লো।ভয়ে আদিত্যের পিঠের শার্ট খামচে ধরে আদিত্যের পিঠের সাথে লেগে দাঁড়িয়ে রইলো।

আদিত্য শরিফা বেগমের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে রাগী তবে শান্ত গলায় বলে উঠলো।
–চাচী প্লিজ, নূরের সাথে এভাবে কথা বলবেন না। ও কোন ভুল করে থাকলে আপনি আমাকে যা খুশী বলুন। আমি কিছুই বলবো না। তবে নূরের সাথে মিসবিহেব করলে আমি সহ্য করতে পারবো না। হয়তো কোন অনৈতিক কাজ করে বসবো।

নূরের সাথে শরিফা বেগমের এমন ব্যবহারে সবাই কমবেশি রেগে আছে। আবিরের ওর মায়ের ওপর চরম রাগ লাগছে। নিজের বোনের সাথে এমন ব্যবহার হতে দেখে নিলারও খুব খারাপ লাগছে। একটু আগে বিহানও একটা কাজে এখানে এসেছিল। তখন শরিফা বেগমের কথা শুনে রাগে তার মাথা গরম হয়ে গেছে। এমনিতেই বিহান এই মহিলাকে একদম সহ্য করতে পারে না। তার ওপর আজকে নূরের সাথে এমন ব্যবহারে ওর আরও জ্বলছে। এইকয়দিনে নূরের প্রতি ওর আলাদা একটা টান এসে গেছে। নূর যখন ওকে ভাইয়া বলে ডাকে, তখন নূরকে সত্যিই নিজের ছোট বোন মনে হয় বিহানের। তাইতো নূরের সাথে এমন ব্যবহারে ওর প্রচুর রাগ লাগছে। আর আয়াত সেটা বুঝতে পেরে বারবার অপরাধী চোখে তাকাচ্ছে বিহানের দিকে।

এদিকে আদিত্যের কথায় শরিফা বেগম তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বললেন।
–তুমি কি আমাকে হুমকি দিচ্ছ হা? বাসায় কি আমাদের অপমান করার জন্য ডেকেছ?
শরিফা বেগম আশরাফ রহমানের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো।
–দেখেছ তো, এই হলো তোমার আদরের ভাতিজা। যার জন্য তুমি এতকিছু করলে। তার প্রতিদান সে এইভাবে দিচ্ছে। বাহ্ খুবই ভালো।

আদিত্য এবার আশরাফ রহমানের সামনে এসে হাত জোর করে বিনয়ী সুরে বললো।
–আই এ্যাম সরি চাচা। কোন বেয়াদবি করে থাকলে মাফ করে দিবেন। আপনি চাইলে আমাকে যা খুশী তাই বলতে পারেন। তবে আমি নূরের সাথে খারাপ ব্যবহার কিছুতেই সহ্য করবো না। কখনোই না। সে যেই হোক না কেন।

আশরাফ রহমান বলে উঠলেন।
–তোমার কোন দোষ নেই আদি।তোমার মাফও চাইতে হবে না। বরং আমি তোমার চাচীর ব্যবহারের জন্য লজ্জিত। ওর পক্ষ থেকে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি।

শরিফা বেগম জ্বলে উঠে কিছু বলতে নিলে, আশরাফ রহমান হাত উঠিয়ে শরিফা বেগমকে থামিয়ে দিয়ে বললো।
–আর একটা কথাও না। একদম চুপ থাকবে তুমি। তোমার সাথে আমি বাসায় গিয়ে কথা বলবো।
আশরাফ রহমান আবার আদিত্যের দিকে তাকিয়ে বললো।
–আমরা এখন আসছি আদি। পরে আবার দেখা হবে।

আদিত্য মাথা ঝাকিয়ে সায় জানালো। তারপর আশরাফ রহমান আর তার ফ্যামিলি চলে গেল।
___

নূর বেডের ওপর মন খারাপ করে বসে আছে। কোলের ভেতর থাকা টেডিটার পশম টেনে টেনে তুলছে। আদিত্যের চাচীর পাগল বলাটা নূরের একদম ভালো লাগেনি। সেটা ভেবে ভেবেই মন খারাপ হচ্ছে ওর। একটু পরে আদিত্য আস্তে করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। আদিত্যকে কেমন বিধ্বস্ত লাগছে। চুলগুলো এলোমেলো চোখ জোড়া লাল।শার্টের ওপরের দুই বোতাম খোলা। আদিত্য কেমন ক্লান্ত ব্যক্তির মতো বেডের ওপর এসে বসলো। বেডে বসে দুই হাতে মাথার চুল টেনে ধরে মাথা নিচু করে রইলো।

আদিত্যকে এভাবে দেখে নূরের বুকের ভেতর কেমন যেন লাগলো। কিন্তু ও বুঝতে পারছে না। বুকের ভেতর কেমন যেন চিনচিন ব্যাথা অনুভব করলো। আদিত্যকে এভাবে দেখে নিজের মন খারাপ ভুলে গেল নূর। কোলের টেডিটা সরিয়ে রেখে, হাঁটু ভর দিয়ে ধীরে ধীরে আদিত্যের কাছে এসে বসলো। দুই হাতে আদিত্যের মুখটা ধরে উপরে তুললো। তারপর অনুনয়ের চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো।
–কি হয়েছে তোমার হিরো? উনি কি তোমাকেও বোকা দিয়েছে?
আদিত্য চুপ করে শুধু মায়া ভরা ছলছল দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকিয়ে আছে।
নূর এক হাতে নিজের কন্ঠনালী ধরে বললো।
–সত্যিই বলছি হিরো, আমি একটুও দুষ্টুমি করিনি।তোমার কথামতো একদম গুড গার্ল হয়ে ছিলাম। কিন্তু তখন বেবিটাকে ধরতে গিয়ে হঠাৎ ওমন হয়ে গেল। সত্যিই বলছি আমি ইচ্ছে করে করিনি। তবে তুমি বললে আমি এখুনি ওই আন্টির কাছে গিয়ে সরি বলে দিব। তবুও তুমি মন খারাপ করোনা। তোমাকে এভাবে দেখে আমার ভালো লাগছে না। একদম পঁচা পঁচা লাগছে।

নূরের কথায় এবার আদিত্যের চোখ থেকে দু ফোটা অশ্রু বিন্দু গড়িয়ে পড়লো। সেটা দেখে নূর আরও অস্থির হয়ে গেল। দুই হাতে আদিত্যের চোখের পানি মুছে দিতে দিতে অস্থির ভাবে বলতে লাগলো।
–এই এই কাদছ কেন? কাদছ কেন? কেদনা প্লিজ। আমার কিন্তু ভালো লাগছে না। বললাম তো সরি বলে দিব। দুই কান ধরে সরি বলে দিব। কেদনা প্লিজ। দেখ তুমি কাঁদলে কিন্তু আমিও কেঁদে দিবো। কেঁদোনা না,,
বলতে বলতেই নূর প্রায় কান্না কান্না ভাব হয়ে গেল।

আদিত্য এবার নূরকে বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। নূরকে জড়িয়ে ধরে কান্না জড়ানো কন্ঠে বলে উঠলো।
–আমাকে ছেড়ে যাসনা কখনো এঞ্জেল। তোকে ছাড়া বাঁচব না আমি। তুই ছাড়া যে কেউ নেই আমার পৃথিবীতে। তুইই আমার সব। তোকে ছাড়া আমি নিশ্ব।

নূরও আদিত্যেকে জড়িয়ে ধরে বললো।
–যাবোনাতো, গড প্রমিজ। কখনো যাবোনা। সবসময় তোমার কাছে থাকবো। আর কাদেনা হ্যাঁ?

নূরের এমন বাচ্চাদের মতো কান্না থামানো দেখে আদিত্য একটু হেঁসে দিল। তারপর নূরকে ছেড়ে মুচকি হেসে বললো।
–আরে আমি কাদছি নাতো।

–তাহলে তোমার চোখে পানি কেন ছিল?

–আরে ওটাতো এমনি। একটু মাথা ব্যাথা করছিল তো তাই।

–তোমার মাথা ব্যাথা করছিল বুঝি? জানো আমারও না মাঝে মধ্যেই মাথায় অনেক ব্যাথা করে। তখন আম্মু আমার মাথা টিপে দিত। আর আমার আরাম লাগতো। আসো আমি তোমার মাথা টিপে দেই হ্যাঁ? দেখবে তোমারও আরাম লাগবে।
কথাটা বলে নূর একপাশে পা ভাজ করে বসে আদিত্যর হাত টেনে ধরে আদিত্যের মাথাটা নিজের কোলে রাখলো। তারপর নিজের নরম কোমল হাত দিয়ে আদিত্যর চুল নেড়ে নেড়ে আদিত্যের মাথা টিপে দিতে লাগলো।

আদিত্যের চোখে মুখে এক অসম্ভব সুখের প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়লো। আদিত্য মায়া ভরা চোখে নূরের দিকে তাকিয়ে রইলো। নূরকে আজ সত্যিকারের বউ বউ মনে হচ্ছে। যে তার স্বামীর জন্য চিন্তায় ব্যাকুল হচ্ছে,স্বামীর কষ্টে নিজেও ব্যাথিত হচ্ছে,স্বামীর সেবা করছে। কথাগুলো ভাবতেই নিজেকে সর্বসুখী মনে হচ্ছে আদিত্যের। এতক্ষণ ধরে মনের ভেতর থাকা কষ্টটা এই সুখের সামনে হার মেনে পালিয়ে গেছে। হ্যাঁ, তখন শরিফা বেগমের কথাগুলোই আদিত্য অনেক কষ্ট পেয়েছিল। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল ওর জন্যই নূরকে এতকথা শুনতে হলো। এসব ভেবে ভেবেই কষ্ট হচ্ছিল। তবে এখন আর কোন কষ্ট নেই। ও এখন ওর এঞ্জেলের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। এরথেকে সুখের আর কি হতে পারে। আমার এঞ্জেল থাকতে আর কারোর দরকার নেই আমার। কারোর না।

আদিত্যের মাথাটা সত্যিই একটু ব্যাথা করছিল।তবে এখন অনেক শান্তি লাগছে। নূরের কোমল হাতের ছোঁয়ায় সব দূর হয়ে গেছে। আদিত্য নূরের দিকে কাত হয়ে এক হাতে নূরের কোমড় জড়িয়ে ধরে আরামে চোখ বন্ধ করে নিল। নূরের হাতের ছোঁয়ায় আদিত্য একসময় আরামে ঘুমিয়ে পড়লো। নূর যতক্ষণ পাড়লো মাথা টিপে দিল। তারপর একসময় নিজেও আদিত্যের মাথার ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো।

চলবে…..
(বাসায় কারেন্ট ছিল না। তাই গল্প দিতে একটু দেরি হয়ে গেছে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here