মানলাম তুমি ভালোবাসোনি
কলমে~মম সাহা
[৩]
জীবনে বেঁচে থাকাটা যে খুব কঠিন- তা নিজেকে না দেখলে বুঝতামই না। দ্বিতীয় বারের মতন আমি বেঁচে গেলাম। ভাগ্য আমার সহায় হলো। আমি বুঝলাম, মৃত্যু এত সহজ না। বাবা-মা নিশ্চুপ হয়ে গেলেন কেমন যেন, স্তব্ধ হয়ে গেলেন তারা। আমিও নিজেকে একবারে ঘরকুনো করে ফেললাম। দুই তিন দিনেও ঘর ছেড়ে ড্রয়িং রুমে পা ফেলতাম না। তার মাঝে টেস্টের ফল প্রকাশ হলো, আমি দুই তিন সাবজেক্টে খুব বাজে ভাবে ফেইল করেছি। আর যে গুলোতে পাশ করেছি তা ও খুব নগন্য নাম্বার পেয়ে। এবার বাবা-মায়ের সাথে সাথে স্কুল, প্রাইভেটের টিচারদের মাথায় হাত। রজনীর মতন এত ব্রিলিয়ান্ট মেয়ে ফেইল করবে? অসম্ভব, অবিশ্বাস্য। অথচ এই অসম্ভব কাজটাই সম্ভব হয়ে গিয়েছিল। আমি অবশ্য জানতাম এমন কিছুই হবে তবুও খারাপ লেগেছিল। নাইন্টি নাইন মার্কস্ পাওয়া আমিটাও যে দিনশেষে বিগ জিরো বের হবো কে জানতো?
বাবা-মা ছুটলেন আবার পামেলা মেডামের কাছে। আমার এখনো মনে আছে, তখন ডিসেম্বরের মাখো মাখো শীত। চারদিকে তুমুল কুয়াশা সাথে শীতের রিক্ততা। আমার বিষন্নতা তখন দাঁড়িপাল্লায় মাপলে পৃথিবী সমান বোধহয় পাওয়া যেতো। পামেলা মেডাম এলেন আমাদের বাড়িতে। সুন্দর, উচ্ছ্বাসে পরিপূর্ণ এক নারী সত্তা। তাকে দেখলেও কেমন হৃদয় শান্তি শান্তি লাগতো। পৃথিবীতে সুখী মানুষ কিছুটা মরীচিকার ন্যায়। তাই দু একটা সুখী মানুষ দেখতে পেলে সবারই ভালো লাগে। আমারও লাগতো।
বারান্দার মৃত টব গুলোর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। অনেক গুলো মাস যত্ন না নেওয়ায় আমার আদুরে ফুল গাছ গুলো প্রায় মৃত। আমি তাদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখলাম। তার মাঝেই পামেলা মেডাম হাসতে হাসতে ঘরে এলেন। আমার কাঁধে চাপড় দিয়ে বেশ ফুড় ফুড়ে মনে বললেন,
“শুনলাম রজনীগন্ধা নাকি নতুন প্রেমে টেমে পড়েছে? তাও বেশ ভয়ঙ্কর রকমের প্রেম? কথাটা কী সত্যি?”
আমি চমকে গেলাম। আমার এত ছোটো জীবনের এত গোপনীয় সত্যিটা কেউ জেনে যাবে আমি ভাবতে পারি নি। আর অবাক করা ব্যাপার হলো, পামেলা মেডামের বেশ চমকে দেওয়ার ক্ষমতা ছিলো। কিন্তু আমার এত গোপনীয় সত্যিটা নিয়ে কেউ আমাকে চমকে দেক তা আমি চাই নি কখনো। তাই কথা ঘুরানোর জন্য বলেছিলাম,
“না তো, কে বলেছে এসব!”
আমার লুকানোর নড়বড়ে উপায় দেখে মানুষটা সেদিন বেশ হেসে ছিলেন। দু-হাত আড়াআড়ি বুকের মাঝে দিয়ে বেশ ঠাট্টা করে বললেন,
“আহা বো কা মেয়ে, মনের ডাক্তারের কাছ থেকে মনের রোগ লুকাচ্ছো! সত্যিই তুমি বড্ড বোকা।”
আমি বুঝেছিলাম আর লুকিয়ে লাভ নেই। আর আহ্লাদ পেয়ে সেদিন আবেগ গুলোও বেশ টগবগে হয়ে গিয়েছিল, অতঃপর জীবনের যে সত্যিটা তুমুল গোপন থাকার কথা ছিলো, সে সত্যিটাই উগড়ে ফেললাম বিশ্বস্ত একটা মানুষ পেয়ে। পামেলা মেডাম সবচেয়ে অসাধারণ, মনোমুগ্ধকর শ্রোতা হয়ে শুনলো আমার ভারসাম্যহীন হওয়ার গল্প। মানুষটার কথা বলতে গিয়ে অনেক কাঁদলাম, হাসলাম, বিষন্ন হলাম আবার আনন্দে ঝলমল করলাম। পামেলা মেডাম দেখলেন সবটাই। কথা থামলো, সময় নিরবে অতিবাহিত হলো। পামেলা মেডাম আমার গায়ের চাদরটা ভালো ভাবে গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“জানো রজনী, তুমি বেশ বড়সড় একটা অন্যায় করে ফেলেছো।”
হাসিখুশি মানুষটাকে গম্ভীর হতে দেখে অস্বস্তি হলো, মাথা নত করলাম, বিব্রতবোধ করলাম। পামেলা মেডাম হয়তো বুঝেছিলেন আমার অনুভূতি, তাই তো খিলখিল করে হেসে আমাকে নিজের অস্বস্তি থেকে মুক্তি দিলেন। গালে হালকা করে মিষ্টি চ ড় দিয়ে বললেন,
“ভালোবাসা হলো পৃথিবীর সব অনুভূতির মাঝে সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি। কাউকে যখন তুমি ভালোবাসবে, তখন তোমার হাসতে ইচ্ছে করবে, সাজতে ইচ্ছে করবে, উড়তে ইচ্ছে করবে, বাঁচতে ইচ্ছে করবে। অথচ এতশত ইচ্ছের মাঝে তোমার কি-না মরতে ইচ্ছে করলো? ভালোবাসাকে কলঙ্কিত করো না মেয়ে, ভালোবাসাকে দৃষ্টান্ত হিসেবে রাখো। তোমার গল্প শুনলে তো মানুষ ভালোবাসতে ভয় পাবে, অতঃপর পৃথিবী তার সৌন্দর্যতা হারাবে। তাই না বলো?”
এই প্রথম বোধহয় কোনো একটা কথা আমার আর বিরক্ত লাগলো না বরং ভালো লাগলো। আমার আগ্রহ জাগলো। আমি আগ্রহী কণ্ঠে বললাম,
“তবে কী করবো আমি?”
“যাকে ভালোবাসো, তাকে জানিয়ে দেও। সর্বপ্রথম কাজ তোমার এটা।”
আমি চমকালাম, থমকালাম, অবাক হলাম। পামেলা মেডামের মতন বুদ্ধিমতী নারী কি-না এই কথা বলছেন? যেখানে সে জানে আমার ভালোবাসার মানুষটা স্বয়ং আমার আপুর হবু স্বামী। আমি অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
“কী বলছেন! এটা কীভাবে সম্ভব। উনি তো অন্যকারো।”
“কে কার সেটা জানার কোনো প্রয়োজন নেই। তুমি কাকে মন দিয়েছো, সেটাই বর্তমানের সব থেকে বড়ো ব্যাপার। যতদিন তুমি নিজের ভেতর ভেতর রাখবে ব্যাপারটা, ততদিন তুমি ভালো থাকতে পারবে না। তোমাকে কিছু একটা গলা চেপে ধরবে। মেরে ফেলতে চাইবে। আর পৃথিবী থেকে এক আকাশ আফসোস নিয়ে চলে যাওয়ার কোনো কারণ আছে? তুমি একজনকে পাগলের মতন ভালোবাসো অথচ এটা অপরপক্ষের মানুষটা জানেই না, এই আফসোস নিয়ে চিরদিন বেঁচে থাকাটা বড্ড কঠিন। ক্ষনস্থায়ী জীবনে দুঃখটা কেন দীর্ঘস্থায়ী হবে শুনি? আর তাছাড়া শুনেছি তোমার বোনের নাকি এরেঞ্জ ম্যারেজ। তাহলে তো তেমন একটা বাঁধা কাজ করার কারণ নেই। তুমি কোনো আশা না রেখে তাকে কেবল মনের কথাটা জানাও। তার উত্তর যা-ই হোক, সেটা মেনে নেওয়ার ক্ষমতা নিয়েই অবশ্য জানাবে। যদি মরেও যাও তবে তোমার আফসোস থাকবে না। বুঝলে?”
আমি বুঝলাম হয়তো কিছু। তাই তো বুঝদার মানুষের মতন মাথা দুলিয়ে সেটা জানান দিলাম। পামেলা মেডাম তখন বারান্দা ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আমি মুখ ফসকে বলে ফেললাম,
“আমার কিন্তু লুকানো একটা চাওয়া সবসময় থেকে যাবে।”
পামেল মেডাম কৌতুহলী দৃষ্টি নিয়ে জানতে চাইলেন কী সেটা। আমি বাহিরে কুয়াশা মাখা বিরাট শহরের দিকে তাকিয়ে আনমনে বললাম,
“আমার বৃষ্টির দিনে হলুদ ছাতা এগিয়ে দেওয়ার ব্যাক্তিটা যেন সে হয়।”
পামেলা মেডাম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। যেতে যেতে বলে গেলেন,
“পূর্ণতা পেলে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো। আর অপূর্ণ থাকলে তুমি ভেবে নিও মেয়ে, পৃথিবীতে সব পাওয়া পূর্ণতা পেতে নেই। জীবনের রোমাঞ্চতা তাহলে শেষ হয়ে যাবে।”
আমি উপর উপর ঘাড় নাড়ালেও, ভেতর ভেতর মানতে চাচ্ছিলাম না যে আমার চাওয়া টা অপূর্ণ থাকুক। জানিনা পামেলা মেডাম সেদিন কী বললো মাকে। সেদিন রাতেই আমি বেশ দামী একটা ফোন হাতে পেলাম। রেজাল্ট খারাপ নিয়ে অনেক বকাঝকা করার কথা থাকলেও বাবা মা সেটা করলেন না। হয়তো তারা আতংকিত হয়ে পড়ে ছিলেন। যদি আমি আবার খারাপ কিছু করার চেষ্টা করি!
নতুন মোবাইল পেতেই আমি সবার প্রথমে ছদ্মনামে একটা আইডি খুললাম। পরিচিত সেই মানুষটাকে এড পাঠালাম। সারা রাত আমার কেমন একটা ছটফটে কাটালো। তার সাথে অনেক কথা বলার ইচ্ছে নিয়েই আমি হয়তো সে দিন গুলো বেঁচে ছিলাম।
এড পাঠানোর ঠিক দু’দিন পাড় হলো কিন্তু আমার রিকুয়েষ্ট এক্সেপ্ট হলো না। আমি অধৈর্য হয়ে গেলাম। ক্ষণে ক্ষণে ফোন চ্যাক করতাম। এই বুঝি রিকুয়েষ্ট এক্সেপ্ট হলো। এই বুঝি সে আমাকে ম্যাসেজ দিলো। কিন্তু হলো না তেমন কিছুই। আবার পামেলা মেডামের বলা কথাটাও ভাসছিলো কানে। যাকে ভালোবাসো, তাকে বলে দেও।
অতঃপর চতুর্থ দিন বাবার হোয়াটসঅ্যাপ থেকে বাবার হয়ে ম্যাসেজ করে তুলি আপুর থেকে উনার নাম্বার টা নিলাম। দুরুদুরু বুক, হৃদপিণ্ড প্রচন্ড কাঁপছিলো। মনে হচ্ছিলো ভুল করছি, আবার নিজেই নিজেকে বুঝিয়েছি, প্রেমে শেষ অব্দি চেষ্টা না করলে প্রেমিকা হওয়া যায় না।
ফোন নাম্বার নেওয়ার পরই আমার উত্তেজনা ক্রমাগত বাড়লো। অপেক্ষা করলাম সঠিক একটা সময়ের। এরপর অপেক্ষা করতে করতে আমার সঠিক সময় এলো। শীতের রাত তখন দু’টো। চারপাশে প্রকৃতি প্রয়োজনের তুলনায় বেশি নিশ্চুপ। আমি সঠিক সময় ভেবে কল লাগিয়ে দিলাম। হৃদপিন্ডের গতি ক্রমাগত বাড়ছেই। গতি চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যেতেই ফোনটা রিসিভ হলো। ঘুমু ঘুমু কণ্ঠে অপর পাশ থেকে আমার কাঙ্খিত সেই পুরুষের কণ্ঠ ভেসে এলো,
“কে বলছেন?”
#চলবে
(