মানলাম তুমি ভালোবাসোনি পর্ব -০৪

মানলাম তুমি ভালোবাসোনি
কলমে- মম সাহা

[৪]

মানুষ মনে প্রাণে যে কাজটা করতে চায়, সময় এবং সুযোগ আসার পর মানুষ সে কাজটা আর করতে পারে না। কেমন দ্বিধাবোধ হয়, অস্বস্তি হয় তখন। হুট করেই তাদের বিচার বুদ্ধির ক্ষমতা এতই বেড়ে যায় যে তারা বিচার করতে বসে যায়, আদৌও তাদের এই কাজটা করা উচিৎ কি-না সেটা নিয়ে। আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম হলো না। যেই পুরুষ কণ্ঠ শোনার তৃষ্ণা আমাকে মরুভূমিতে পানি বিহীন থাকা মানুষের মতন দমবন্ধকর অনুভূতি দিয়েছিল সেই কাঙ্খিত পুরুষালি কণ্ঠ শোনার পরই আমার সাজানো সব অনুভূতির বালিঘর কেমন এক লহমায় উলোটপালোট হয়ে গেলো! মানুষটা ফোনের অপর পাশ থেকে বারংবার জানতে চাইলো ‘কে আমি’ অথচ আমি বলতেও পারলাম না আমার মনের বিক্ষিপ্ত সেই যন্ত্রণার কথা। মানুষটা যখন ভীষণ বিরক্ত হয়ে ফোনটা কেটে দিলো ঠিক তখন বোধহয় আমি সম্বিৎ ফিরে পেয়েছিলাম। ভালোবাসার মানুষটার সব কিছুতেই বোধহয় একটা মুগ্ধতা, গভীর একটা ঘোর কাজ করে! যেমন ঘোরে পড়লাম আমি তার কণ্ঠ শুনে! ঘুমু ঘুমু সেই কণ্ঠ আমার হৃদয়ে উথাল-পাতাল ঢেউ তুলতে সক্ষম।

পুরো শহর যখন কুয়াশার চাদর জড়ানো আহ্লাদী শীতে গা ভাসিয়ে নিশ্চুপ হয়ে আদুরে ঘুমে মগ্ন তখন বয়ঃসন্ধির তুমুল আবেগে ঝলসে যাওয়া আমি দু-চোখ মেলে ঘুমিয়ে থাকা শহর দেখছি বারান্দার শিক গলিয়ে। মানুষটার কণ্ঠ শুনতেই মনটা পৃথিবী সমান ভালো লাগায় যেন ছেয়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল পৃথিবী এত রঙিন কেন! বেঁচে থাকা এত সুন্দর কেন! কেন? আমি সেই মুহূর্তে ভেতর ভেতর বোধহয় আরেকটু পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। যে মানুষটার কণ্ঠ আমাকে পৃথিবী সমান সুখী অনুভব করাতে পারে, সে মানুষটাকে কোনো মতেই আমি কম্প্রোমাইজ করতে পারবো না। নো। নেভার। মনে মনে শক্ত-পোক্ত একটা প্রতিজ্ঞা করলাম, যা হয় হবে, মানুষটাকে আমার চাই ই চাই।

এরপরের দিন আমার সুখটাকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়ে মানুষটা আমার রিকুয়েষ্ট এক্সেপ্ট করে ফেললো। আমার তো যেন আনন্দের সীমা রইলো না। পৃথিবীতে এত সুখ হুট করে আমার ভাগ্যে আসার কারণ আমি দেখলাম না তবে দুহাত তুলে সৃষ্টিকর্তাকে কেবল শুকরিয়া জানালাম আমাকে নতুন উদ্যমে বাঁচতে সাহায্য করার জন্য। আমি তখনও আঁচ করতে পারি নি, সৃষ্টিকর্তা আমার প্রতি ঠিক কতোটা নির্দয়,নিষ্ঠুর ছিলেন।

আমার ডিসেম্বরটা কেটে গেলো সাগর সমান মোহে। নীল শাড়ি পরে ছাঁদে যেতাম। আকাশ পানে তাকিয়ে রঙিন ছবি তুলতাম। নীলের গভীর রঙ চুড়ি হয়ে যখন জড়িয়ে নিতো আমার সুন্দর, কোমল হাতখানা আমি তা ক্যামেরাবন্দী করতাম। কখনো কেবল গাঢ় কাজল লেপ্টানো আমার টানা চোখ গুলো ফেসবুকের ছোটো স্টোরিতে দিতাম কখনো বা নীল চুড়িতে সাজানো গোল হাতটার ছবি। মানুষটা টুকটাক স্টোরির রিপ্লাই করতো। ছোট্ট করে বলতো ‘সুন্দর’, ব্যস্, আমি পেয়ে যেতাম পৃথিবীর সমস্ত সুখ। টানা এক দেড় বছর পর বোধহয় আমি স্বাভাবিক হওয়া শুরু করলাম। খিলখিল করে হাসার অভ্যাস আমার কোনো কালে না থাকলেও তখন সে অভ্যাসটাও হয়ে উঠলো। তবে এত কিছুর মাঝেও মানুষটা জানতো না আমি কে! আমি আসলে কী! আমার নামটা অব্দি জানতো না। আর ফেসবুকে তত কথাও আমাদের হয় নি।

সময়টা তখন জানুয়ারির আঠারো কিংবা উনিশ। আমি টেবিলে পা ঝাঁকিয়ে পড়ছি। পড়ছি বললে ভুল হবে, পড়ার চেষ্টা করছিলাম। মস্তিষ্ক ততদিনে পড়াশোনা ব্যাপারটা নিতে না পারার অভ্যাস করে ফেলেছে। পরিচিত পড়া গুলো কেমন অপরিচিত লাগতো। তবুও আমি চেষ্টা শুরু করলাম। জানুয়ারি শেষ হলেই বোর্ড পরীক্ষা শুরু, আমার যে পারতেই হবে। দুপুরে পা ঝাঁকিয়ে গভীর ধ্যানে আমি যখন পড়ায় মগ্ন তখন দরজার সামনে উপস্থিত হলো আমার মা, বেশ স্থির কণ্ঠে বললো,
“আসবো?”

আমি বই থেকে মুখ তুললাম। মায়ের দিকে তাকিয়ে মাথা কাঁত করে সম্মতি দিয়ে বললাম, “আসো।”

উত্তরটা দিয়েই আমি চোখটা নামিয়ে বইয়ে রাখলাম। আসলে ততদিনে আমি বেশ লজ্জিত অনুভব করেছিলাম। বাবা-মায়ের সাথে আমি যে বড্ড কঠিন, খারাপ আচরণ করেছিলাম! যেটা আমার উচিৎ হয় নি। যার জন্য তখন তাদের সাথে আমি তেমন মিশতাম না। বাবা-মাও আমাকে সুযোগ দিতেন। কোনো অতিরিক্ত রকমের আচরণ করতেন না।

মা আমার ঘরে ঢুকে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। কতক্ষণ আমার বইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো বিরতিহীন। আমি বুঝলাম, মা হয়তো আমাকে কিছু বলতে আসছে। মা সিরিয়াস কিছু বলার আগে সময় নেন। এদিক সেদিক তাকিয়ে ভেতর ভেতর কথাটা সাজিয়ে নেন এবং তারপর বলেন। আর আমার ফাঁ সি দেওয়া ঘটনাটার পর থেকে মায়ের এই অভ্যাসটা কঠিন হয়ে বসেছে তার অভ্যাস তালিকায়।

মা’কে চুপ থাকতে দেখে আমিই মুখ খুললাম, “মা, কিছু বলবে?”

আমার অতি রাগী মা কেমন কোমল হয়ে গিয়েছে! তখন সে রাগ দেখাতেও ভুলে গিয়েছিলো।

আমার কথার উত্তরে মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ক্ষীণ স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
“এখন ভালো আছিস, মা? সুস্থ আছিস?”

আমি হাসলাম। আমি কতটা বিধ্বস্ত হয়ে গেছি যে আমাকে চোখের সামনে সবসময় দেখেও এমন একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলো! আমি হাসলাম, হেসে উত্তর দিলাম,
“ভালো আছি, মা। কি বলবে, বলো না।”

মা কিছুটা সময় নিয়ে বললো,
“তুমি কী এবারের পরীক্ষাটা স্কিপ করবে? পরের বছর না-হয় ভালো ভাবে পড়ে দিও। এ বছর তুমি সুস্থও না। তুমি যদি নিজেকে এস্টাবলিশ মনে না করো এখন পরীক্ষার জন্য তবে ইট’স ওকে। আমার আর তোমার বাবার তেমন আপত্তি নেই।”

আমি দরজার দিকে তাকালাম খুব গোপনে। পর্দার আড়ালে বাবার স্থির পা জোড়া নজরে এলো। আমি হাসলাম। বাবা-মা কতটা ভালোবাসেন আমাকে! কতটা ভাবেন আমাকে নিয়ে! আমার কষ্ট হবে ভেবে তারা তাদের অতি প্রিয় পড়াশোনাটাও আমাকে বর্তমানে ছেড়ে দিতে বলছে!

আমি মাকে ভরসা দিলাম, ভরসা দিয়ে বললাম,
“চিন্তা করো না, মা। আমি পারবো। এতটুকু বিশ্বাস রাখতেই পারো।”

মা মুচকি হেসে চলে গেলেন। কিন্তু আমার মাথায় ঘুরতে থাকলো বাবা-মায়ের সেই চিন্তিত মুখ গুলো। আহারে জীবন! আহারে প্রেম! একটা শান্তশিষ্ট, সবার চোখে অসাধারণ মেয়েটাকে টেনে কোথায় নামিয়ে ফেলেছে যে বাবা-মা অব্দি ভয় পায় আমার গতিবিধি!

হুড়মুড় করে চলে গেলে জানুয়ারির বাকি সময়টাও। বলবো বলবো করে আর বলা হলো না তাকে। ফেব্রুয়ারী শুরু হলো, ব্যস্ত সময় পাড় করছি। পরীক্ষা চলছে, নাকে-মুকে বোধহয় পড়ছিলাম। দেখতে দেখতে তিনটে পরীক্ষাও চলে গেলো। অতঃপর ঘটলো আমার জীবনের সর্বশেষ বিপর্যয়।

আগামী শনিবারে গনিত পরীক্ষা। বোধহয় সেদিন বুধবার ছিলো, আমি পরীক্ষা দিয়ে এসে পড়তে বসেছি। মা ছুটে এলেন। হাসি হাসি মুখ তার। আমি মাকে এত খুশি দেখে নিজেও হাসলাম। কৌতুহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
“কী হয়েছে, মা? এত খুশি যে!”

আমি যদি ঘুণাক্ষরেও টের পেতাম মা আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে তিক্ত সত্যিটা শুনাবে তাহলে বোধ করি কখনোই সেটা জিজ্ঞেস করতাম না।

আমার প্রশ্নের উত্তরে মা বললো,
“তোর তুলি আপুর এই শুক্রবারে বাগদানের অনুষ্ঠান। আমাদের যেতে বলেছে। এখন বাগদান হবে আর এপ্রিলের দিকে বিয়ে। ছেলেটা কী ভালো জানিস না! আমাদের বেশ পছন্দ। আমরা যাবো শুক্রবারে বুঝেছিস। দুই তিন ঘন্টা থেকে চলে আসবো। তোর কোনো সমস্যা হবে না তো, মা?”

আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। যাকে নিয়ে আমি এত রঙিন স্বপ্ন সাজালাম আমার মা তার বাগদানের অনুষ্ঠানেই আমাকে আমন্ত্রণ জানাতে এসেছেন! মা কী একবারেও বুঝতে পারে নি, এই খবরটা আমাকে জ্যান্ত মে রে ফেলবে! আমার যে বুক ভার হয়ে কষ্টরা আন্দোলন চালাচ্ছে, এটা কী মা টের পাবে?

আমাকে চুপ থাকতে দেখে মা আমার বাহু ধরে সামান্য ধাক্কা দিলো। ব্যস্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কিরে যাবি তো?”

আমি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে কোনোরকমে উত্তর দিয়ে ছিলাম, “আমি পড়ছি, মা। তোমরা যাও।”

মা আরও কয়েকবার গুনগুন করলো কিন্তু আমি আর জবাব দেওয়ার অবস্থানেই রইলাম না। মা সুবিধা করতে না পেরে চলে গেলেন অথচ আমার ভেতর তখন আকাশ সমান যন্ত্রণা। এই মুক্ত পৃথিবীতে আমি যেন স্বাধীন ভাবে তখন শ্বাসও নিতে পারছিলাম না। অল্প বয়সের আবেগ যে এতটা ভয়াবহ তা আমার জীবন দিয়ে আমি হারে হারে টের পাচ্ছিলাম। আমি মানতেই পারছিলাম না আমি যাকে ভালোবাসি সে আমাকে রেখে অন্য কারো সাথে ঘর বাঁধবে।

চারপাশে তখন আমি হাহাকার দেখছি। একটু বাঁচতে চাওয়ার আশায় আমি দিকশূন্য তখন। আমার শ্বাসের গতি অস্বাভাবিক হচ্ছিলো। বুঝলাম, অনাকাঙ্খিত খবরটা আমার মস্তিষ্ক নিতে পারছে না। আমি পাগলের মতন ঘরে ছুটতে লাগলাম। চোখের সামনে ফোনটা পেতেই কল লাগালাম পামেলা মেডামের ফোনে। সেদিন আমার ভেতরে নিজেকে বাঁচানোর তাগিদ ছিলো। আমি চাচ্ছিলাম আমার আবার প্যানিক অ্যাটাক না হোক। আমি অন্যকিছু চাচ্ছি আমার জীবনে। এই মৃত্যু খেলা আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না।

পামেলা মেডাম কল ধরলেন তৎক্ষনাৎ। সে কল ধরতেই আমি কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়লাম। হাউমাউ করে চিৎকার করে বলতে লাগলাম,
“আমার তাকে লাগবে, আমার তাকে লাগবে।”

অন্যকেউ হলে হয়তো আমার সেই আর্তনাদে বিচলিত হতো, দিশেহারা হতো কিন্তু পামেলা মেডাম এসব কিছুই হলো না। বরং ধীর কণ্ঠে বলেছিলেন,
“তুমি বড্ড দুর্বল রজনী। তোমার এই লাগবে অনুভূতিটাই তোমার সমাপ্তির কারণ হয়ে না দাঁড়ায় দেখো।”

আমি শুনলাম না তার কথা, বুঝলাম না। বারংবার বলছিলাম,
“কিছু করুন, কিছু করুন মেডাম।”

পামেলা মেডাম বললো আমাকে তৈরী হতে। সে আমাকে নিতে আসবেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম কোথায় যাবো, কেন যাবো কিন্তু সে তার কোনো জবাব দিলো না। তবুও একরাশ আশার আলো নিয়ে আমি তৈরী হলাম। ততদিনে আমার ভিতরে একটা ধারণার জন্ম হয়েছিল যে পামেলা মেডাম চাইলেই সব করতে পারবেন। আর আমার সেই ধারণা থেকেই আমি আশার আলো পেলাম।

পামেলা মেডাম নিজের কথা রাখলেন। ঠিক ঘন্টা তিনেক পর আমাকে নিতে এলেন। মা কোনো কৈফিয়ত চান নি। বরং আমাকে অবাক করে দিয়ে সেদিন আমাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। মায়ের কান্নার কারণ বুঝলাম না কিন্তু সে যে নিজেকে বড্ড অসহায় অনুভব করছিলেন তা তার চোখ-মুখেই প্রকাশ পেয়েছিল। পামেলা মেডামও সেদিন গম্ভীর মুখে আমাকে হাত ধরে ঘর থেকে নিয়ে গেলেন। সেই হাতটা ধরেই আমার জীবনে সবচেয়ে বড়ো এবং সবচেয়ে শেষ বদলটা হয়। এরপরই আমার জীবন নদী স্রোত বদলায়। পথ ধরে অন্য ঠিকানায়।

#চলবে

[আগামী তথা শেষ তথা সবচেয়ে রোমাঞ্চকর পর্ব খানা দেওয়া হবে বৃহস্পতি কিংবা শুক্রবার। আপনাদের রেসপন্সের উপর নির্ভর করে।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here