#মায়ায়_জড়ানো_সেই_তুমি
#পার্ট_১৮
জাওয়াদ জামী
” আমাকে ক্ষমা করেছো, বউ? ”
সাদিফের মুখে ‘বউ’ ডাক শুনে তানিশার মনে উথাল-পাথাল বাউলি বাতাসেরা ডানা ঝাপটিয়ে জানান দেয়, সে এসেছে, সে তোর জীবনে এসেছে। এবার পূর্ণ হয়েছিস তুই।
” ক্ষমা করার প্রশ্ন আসছে কেন! দোষীতো আপনি ছিলেননা। আর আপনার ওপর রা*গ করে আমি কোন কালে থেকেছি বলতে পারেন? আমার যত রাগ নিজের উপর ছিল। যা ছিল সব অভিমান। ”
সাদিফ দু’হাতে আঁকড়ে ধরে তানিশাকে। চুপচাপ কিছুক্ষণ নিজের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে রাখে। তানিশা সাদিফের বুকে মাথা ঠেকিয়ে সূদুর দিগন্তে চেয়ে থাকে। মনে মনে খুব করে চাইছে, আজ সময় এখানে থমকে যাক। হাজারো ফুলের বর্ষনে সুগন্ধি নদী বয়ে যাক।
” মাম্মাম পানি থাবো ( মাম্মাম পানি খাবো)।
তূর্ণা দৌড়ে এসে তানিশার গলা জড়িয়ে ধরে।
সাদিফ তানিশাকে একহাতে জড়িয়ে রেখে আরেক হাতে মেয়েকে জড়িয়ে নেয়। আজ সে পরিপূর্ণ। সকল সুখ আজ তার কাছে ধরা দিয়েছে। তানিশা হ্যান্ড ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে তূর্ণার মুখে ধরে।
সাদিফ লক্ষ্য করল সাইরা বাচ্চাদের নিয়ে এদিক-ওদিক দৌড়াচ্ছে। ওরা বেশ খুশি এখানে আসতে পেরে।
” বউ তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। ”
” সারপ্রাইজ! ”
” হুম, আর একটু ধৈর্য্য ধরো। ”
তূর্ণা এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করছে। সাদিফ দুচোখ ভরে মেয়েকে দেখছে। কয়েকদিন আগেও ভাবতে পেরেছিল কি আদৌও মেয়েকে দেখতে পাবে!
” তানু ” চিৎকার করে কেউ তানিশাকে ডাকে।
তানিশা পেছনে না তাকিয়েই বুঝতে পারে রিশা ডাকছে। তানিশার প্রশ্নবোধক চাহনি দেখে সাদিফ বলে, ” সারপ্রাইজ। ”
রিশা প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে ওদের কাছে আসে।
তানিশা উঠে দাঁড়িয়ে রিশাকে জড়িয়ে ধরতেই পাশে দাঁড়ানো ব্যক্তিকে দেখে আকাশ থেকে পরে!
” হ্যাল্লো, ম্যাডাম। ইট’স মি, ইশান আসওয়াদ সিদ্দিকী। মিট মাই ডিয়ার ওয়াইফি রিশা আসওয়াদ সিদ্দিকী। ”
তানিশার ইশানকে দেখে অবাক হওয়া সাদিফের চোখ এড়ায়না। সাদিফ ভুরু কুঁচকে তাকায় তানিশার দিকে।
এদিকে তানিশা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রিশার দিকে তাকায়। রিশার ঠোঁটে ইশানকে প্রশ্রয়ের হাসি।
” রিশু, তুই বিয়ে করেছিস! কবে! আমাকে জানাসনি কেন! ”
” সারপ্রাইজ দোস্ত সারপ্রাইজ। তোকে সেদিন বলেছিলামনা একটা সারপ্রাইজ আছে। এটাই সেই সারপ্রাইজ । ”
” তুই বিয়ে করেছিস ঠিক আছে। তাই বলে ইনাকে কেন! আর মানুষ ছিলনা দেশে! ”
” ম্যাডাম, এবার কিন্তি আমাকে রিতীমত অপমান করছেন। আমি অনলি ওয়ান পিস। দেশে আমার মত জামাই একটাও খুঁজে পাবেননা। এমনকি সাদিফ সাহেবও নয়। ” সাদিফের দিকে তাকিয়ে দেঁতো হাসি দেয় ইশান।
সাদিভ হতভম্ব ইশানের কথায়। রিশা হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। আর তানিশা বিরক্তি নিয়ে তাকায় ইশানের দিকে।
” বুঝেছি ম্যাডাম, আপনি সেই পাঁচশো টাকার জন্য আমাকে সবার সামনে হেয় করছেন। এই নিন আপনার সেই পাঁচশো টাকা। আজ আপনার ধার শোধ করে দিলাম। ” ওয়ালেট থেকে টাকা নিয়ে তানিশার দিকে বাড়িয়ে দেয়।
এবার হতভম্ব হওয়ার পালা তানিশার। এই লোক বলে কি! আমি টাকার জন্য তাকে হেয় করলাম কখন!
সাদিফ দাঁড়িয়ে থেকে শুধু তীক্ষ্ণ চোখে এসব দেখছে। ওর মনে ঝাঁক বেঁধে প্রশ্নেরা ভীর করছে। ইশান কেন তার বউয়ের সাথে এভাবে কথা বলবে? তানিশা কেন ইশানকে দেখে বিরক্ত হবে? তানিশার সাথে আহলাদ, প্রশ্রয়, আবদার, অনুরোধের সুরে একমাত্র কথা বলবে সে। আর কেউ নয়। আর তানিশার সকল, ভালোবাসা, রাগ,অভিমান, বিরক্তি সব থাকবে একমাত্র সাদিফের উপর। তানিশা কি আগে থেকেই ইশানকে চেনে?
রিশা মুখ হা করে ইশানের দিকে তাকিয়ে আছে। এসব হচ্ছে কি তার বোধগম্য নয়।
” আপনার টাকা আপনিই রাখুন, না হওয়া এসপি। এই টাকা দিয়ে আপনি বরং আরেকদফা মিষ্টি কিনে খেয়েন। ”
তানিশার মুখে না হওয়া এসপি শব্দটা শুনে রিশা হো হো করে হেসে উঠে। সাদিফ পুরা তব্দা খেয়ে যায়। আর ইশানের মুখটা দেখার মত হয়েছে।
এত বছর পর সেই কথা মনে করিয়ে দিয়েছে তানিশা। “এই মেয়ের কি আক্কেল নেই! কখন কি বলতে হয় তা জনেনা! আমার নতুন বউয়ের সামনে কিভাবে বাঁশ দিল! ছি ইশান, কি লজ্জা, কি লজ্জা। ” মনে মনে গজগজ করছে।
রিশাকে হাসতে দেখে তানিশাও হেসে উঠে। হাসতে হাসতে একপর্যায়ে চোখ যায় সাদিফের দিকে। সাদিফ ওর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে। কিন্তু তার চোখেমুখে রা*গে*র ছটা স্পষ্ট।
তানিশা ফাঁকা ঢোক গিলে হাসার বৃথা চেষ্টা করে কিন্তু ব্যর্থ হয়।
সবাই খুব হৈ-হুল্লোড়, মজা করছে। বাচ্চাদের সাথে সাথে ইশানও সবার সাথে মজা করতে ব্যস্ত। সাদিফ কিছুতেই তানিশার সাথে ইশানের পরিচয় মেনে নিতে পারছেনা। সবার সাথে হেসে কথা বললেও তানিশার সাথে কথা বলার সময় গম্ভীর মুখে আছে। তানিশা বেশ বুঝতে পারছে সাদিফের মনোভাব। তবে বেশ মজা পাচ্ছে সাদিফের অবস্থা দেখে।
সারাদিন অনেক আনন্দ করে কাটানোর পর সন্ধ্যায় ওরা বাসার দিকে রওনা দেয়। ফিরতি পথে সাদিফ তানিশার সাথে তেমন একটা কথা বলেনা।
” বাব্বাহ, রা*গ কত মশাইয়ের! একটা কথাও বলছেনা! নাকের ডগায় রা*গে*রা সব সময়ই নাচানাচি করে। ” মনে মনে নিজের সাথে আলোচনা করছে তানিশা। তবে বেশিক্ষণ চিন্তা না করে মেয়ের সাথে খুনসুটিতে মেতে উঠে।
সাইরাও বাচ্চাদের নিয়ে মেতে আছে।
বাসায় ফেরার পথে বাচ্চারা সবাই ঘুমিয়ে পরে। তানিশা ওর মেয়েকে কোলে করে ভেতরে আনে। আর নিরো-নোয়েলকে সাইরা, সাদিফ দুজনে মিলে ভেতরে নেয়।
তানিশা মেয়েকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ফ্রেশ হয়ে শ্বশুর-শ্বাশুড়ির কাছে আসে। তাদের জিজ্ঞেস করে রাতে খেয়েছে কি না। শায়লা চৌধুরী হ্যাঁ সূচক জবাব দেয়। তাদের সাথে কিছুক্ষণ কাটিয়ে রুমে আসে। সাদিফও ফ্রেশ হয়ে শুয়ে গেছে। তানিশা সাদিফের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। সাদিফের রা*গ দেখে ওর খুব হাসি পাচ্ছে। টবে গন্ধরাজ ফুটে আছে, তারই গন্ধে চারপাশ ম ম করছে। তানিশা প্রতেকটা ফুলে হাতের ছোঁয়া দিয়ে তবেই তৃপ্ত হয়।
হঠাৎই হ্যাঁচকা টানে ওর মনযোগে বিঘ্ন হয়। সাদিফ ওকে টেনে নিজের কাছে এনেছে। কোমর শক্ত করে ধরে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তানিশার পানে। সাদিফের সেই দৃষ্টিতে কি আছে তা জানেনা তানিশা কিন্তু ওর বুক দুরুদুরু করতে থাকে।
” এত অপেক্ষা করাও কেন। কেন এত যন্ত্রণা দাও। যেখানে তোমার দেয়া ফুলের আঘাত সইতে পারিনা সেখানে আমাকে কাঁটার বিছানায় কেন শোয়াও বারবার। আমি যে আর আমাতে নেই সে কি বোঝনা। ” সাদিফের এই আবেগভরা আকুলতায় তানিশার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে। তার দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি এতটুকুও অবশিষ্ট নেই। এত মাদকতা কেন এই আওয়াজে! যা মুহূর্তেই ভেঙে দেয় তানিশার সকল বাঁধ।
সাদিফের কথার কোন জবাব না দিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকে। আজ এই ক্ষনে ওর সাথে কথারাও অনশন করছে! কিন্তু বেশিক্ষণ এভাবে থাকতে পারেনা। ঢলে পড়ে সাদিফের বুকে। সাদিফ যেন তৈরীই ছিল। সযতনে ওকে বুকে আগলে নেয়।
সকালে সাদিফের ঘুম ভাঙ্গলো শরীরে সুখের আবেশ নিয়ে। পাশ ফিরে দেখল বিছানা ফাঁকা। মুচকি হেসে পুনরায় চোখ বন্ধ করে। এবং প্রায় সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পরে।
তানিশার রান্না শেষ হলেও সাদিফ নিচে নামেনা।
” এই লোকটা কি আজ অফিসে যাবেনা। ”
রহিমা খালার কাছে রান্নাঘরের দ্বায়িত্ব দিয়ে উপরে এসে দেখে সাদিফ এখনো ঘুমাচ্ছে। তানিশা এদিকওদিক খুঁজে টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে ঢেলে দেয় সাদিফের মুখে।
ঠান্ডা পানির ছোঁয়ায় ধরফরিয়ে উঠে বসে সাদিফ।
” কি সমস্যা তোমার! মাথার স্ক্রু কি খুলে পড়েছে কোথাও! এভাবে কেউ আ*ক্র*ম*ণ করে! এত অ*ত্যা*চা*র কিছুতেই করতে পারোনা কিন্তু। ” ঘুম জড়ানো গলায় সাদিফের বিস্ময়।
” এক গ্লাস পানি ঢেলে দেয়ার নাম আ*ক্র*ম*ণ, অ*ত্যা*চা*র! বাপের জন্মে এমন কথা শুনিনি। ”
” তুমি এই ছোট্ট জীবনে অনেক কিছুই শোনোনি বউ। তা কি মনে করে সকাল সকাল এভাবে আপ্যায়ন করলে? ”
” এভাবে পরে পরে ঘুমাচ্ছেন কেন? অফিস যাবেন কখন? ”
” আমার ঘুম না হওয়ার কারন আমাকে জিজ্ঞেস করছে ঘুমাচ্ছেন কেন! হাহ্ বড়ই হাস্যকর। আজ রাত থেকে একা ঘুমাতে হবে দেখছি। ”
সাদিফের এমন লজ্জাহীন কথায় লজ্জায় কুঁকড়ে যায় তানিশা।
” লজ্জা পেলে তোমাকে একদম রসগোল্লার মত লাগে। মনে টুপ করে খেয়ে ফেলি। কাছে এসো তো একটু খেয়ে দেখি। ”
” এই আপনি উঠবেন। নাকি এখন এক বালতি পানি এনে ঢালব? ”
” আহা, রা*গ করেনা বউ। চিন্তা করে দেখলাম আজ অফিসে যাবনা। তোমাকে নিয়ে দূরে কোথাও হারাবো। যাও ফটাফট রেডি হয়ে নাও। আর হ্যাঁ একট্রা বেশ কয়েকটা কাপড় নিও। আরেকটা কথা সাইরাকেও বল। সেও যাবে আমাদের সাথে। ওকেও এক্সট্রা কাপড় নিতে বল। ”
” এক্সট্রা কাপড় নিব! কোথায় যাবো আমরা? ”
” ওটা সারপ্রাইজ থাক। সাইরা আমাদের সাথে গেলে তোমার আপত্তি থাকবেনা তো? ”
” আপত্তি থাকবে কেন! আমার বরং ভালই লাগবে। বাচ্চরা থাকলে আনন্দ দ্বিগুণ হয়। আমি সাইরাকে তৈরী হতে বলে আসছি। ”
তানিশা একপ্রকার ছুটে বেড়িয়ে যায়। সাদিফও উঠে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে।
চলবে….