– ছেড়ে দেন। ব্যাথা।
– পাও ব্যাথা তাও ছাড়া যাবে না।
ইহান খুব শক্ত করে মিথিলার হাত ধরে আছে যাতে ছুটে যেতে না পারে। এদিকে মিথিলার হাতের কাচের চুড়ি ইহানের হাতের চাপে ভেঙে যাচ্ছে। আর ভাঙা অংশ ঢুকে যাচ্ছে মিথিলার হাতে। ইহানের হাত বেয়ে রক্ত ফোঁটা ফোঁটা হয়ে পড়ছে দুধের গ্লাসে। এর মধ্যে রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে দুধ যা নিয়ে এত কান্ড।
ইশিতা, ইহানের বড় বোন। রান্নাঘরে খাবারের প্লেটগুলো ধুচ্ছিলো। মিথিলার গোঙানোর আওয়াজ শুনে ইহানের ঘরে এসে দেখে এ কান্ড। সে তাড়াতাড়ি ইহানের হাত সরিয়ে বলল, কি করছিস!? ইস্ মেয়েটার হাত কতটা কেটে গেছে! এভাবে কেউ ধরে? কি হয়েছেটা কি?
– সেটা এই গুণধরকেই জিজ্ঞেস করো।
– কি হয়েছে রে মিথু?
মিথিলা গুঙিয়ে কাঁদছে। ইহান আবার তেজ দেখিয়ে বলে উঠলো, চুরি করতে এসেছে। আমি খাবার শেষ করে ওয়াশরুমে গেছি। তক্কে তক্কে ছিল। যেই আমি নেই দেখেছে এসে দুধের গ্লাসে মুখ দিয়ে দিল! কি সাহস! একে তুমি বাড়ি এনেছো ইশুবু? আজ দুধ চুরি করে খাচ্ছে কাল দেখো বাড়ির দামি জিনিস চুরি করে নিয়ে পালাবে।
ইশিতা ধমক দিয়ে বলল, এসব কি ইনু। বাচ্চা মেয়ে…। ইহান তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, কে বাচ্চা ইশুবু? এ? আঠারো উনিশ বয়সের মেয়ে কখনো বাচ্চা হয়?
– মেয়েটা উনিশ হলেও তো মনটা উনিশ না। তোর ভালো নাই লাগতে পারে তাই বলে এমন করবি মেয়েটার সাথে?
ইহান কিছু বলল না। ইশিতা মিথিলাকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ইহান ঘোলা চোখে রক্তবর্ণ দুধের দিকে তাকালো। সেখানে শুধু মিথিলার না ওর নিজের রক্তও আছে।
ইশিতা ওকে নিয়ে নিজের রুমের বিছানায় বসালো। হাতের ব্যাথায় চোখ দিয়ে পানি পড়ছে মেয়েটার। ভেজা চোখে ইশিতার কাজ দেখছে। ও একটা ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে মিথিলার সামনে বসলো। বেশ ঢুকেছে চুড়ির ভাঙা অংশ। সাবধানে ভাঙা অংশটুকু বের করে হেক্সিসল দিতেই কাটা জায়গায় যেন অসংখ্য সুই ফুঁড়ে দিলো কেউ। ব্যাথায় কান্নার বেগ বাড়ল মিথিলার। ইশিতা ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ দিতে দিতে বলল, খুব লাগছে, না? সব ঠিক হয়ে যাবে।
– খুব দুধ খেতে ইচ্ছে করছিল। বাবাই তারার দেশে চলে যাওয়ার পর কতদিন দুধ খাই না। মামনি দেয় না। খুব মারে। তানিশাকে দেয়। আমায় দেয় না।
বলে মেয়েটা কাঁদতে লাগল। মিথিলার বিয়ের বয়েস হয়েছে ঠিকই কিন্তু ভেতরটা ঠিকই বাচ্চা রয়ে গেছে। যাকে বলে মানসিক প্রতিবন্ধী। এই জগত সংসারের জ্ঞান বড়োই কম। মা ছোটবেলায় ছেড়ে চলে গিয়েছিল। বাবার আদরে বেড়ে উঠেছিল স্বর্ণলতার মতো। কিন্তু বাবা নামক গাছটার মৃত্যুর পর লতা নুইয়ে গেছে। তারপরই দ্বিতীয় মায়ের আসল রূপ খোলাসা হয়েছে। বাবার আদরের মিথু অনাদরে ঘরের এক কোণায় অবহেলায় পড়ে ছিল। খাবার পর্যন্ত খেতে দেয়নি অনেক বেলা। সেই মেয়েকেই চল্লিশ বছরের বুড়োর সাথে বিয়ে দিয়ে বিদায় করতে চেয়েছিল আজ টাকার টানাপোড়েনে। কিন্তু রিতা খালা তা হতে দেয়নি। বাসায় কাজ করতো আর মিথিলার দেখভাল করার জন্য ছিল সে। ফাঁক পেয়েই মিথিলাকে বলেছিল পালিয়ে যেতে। হায়নার আখড়া থেকে বের করে এনেছিল। কিন্তু পথিমধ্যে তাকেও হারিয়ে দিশেহারা মিথিলা এক টুকরো আশ্রয় খুঁজচ্ছিল এই বিশাল জগত সংসারে। পেয়েও গেল।
আজকে তাড়াতাড়ি কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েছিল ইশিতা। বয়স কম হয়নি। ত্রিশ পেরিয়েছে আজ তিন বছর। সামনে চৌত্রিশে পড়বে৷ কিন্তু বিয়েটা আজও করে ওঠা হয়নি। বাবা মা হারা ভাইটাকে যে মানুষ করতে হবে। সেই দিকে নজর দিতে দিতে ইশিতার নিজের দিকে তাকানোর সময় হয়নি।
মধ্যবিত্তদের বাসই একমাত্র যাতায়াত ব্যবস্থা যা দিয়ে কষ্ট হলেও কিছুটা টাকা সঞ্চয় করা যায়। কিন্তু বর্তমানে বাসের ভাড়াও পাঁচ দশ টাকা বেশি না নিলে তাদের পোষায় না। তবুও বাসটাই সম্বল। ইশিতা বাসের জন্যই দাঁড়িয়ে ছিল। তখনই একটা মেয়েকে দেখলো, গায়ে বিয়ের লাল বেনারসি শাড়ি। মুখে কনের সাজ। গয়না তেমন একটা নেই বললেই চলে। গলায় একটা লম্বা চেইন আর হাতে ক’গাছি কাচের চুড়ি। দেখতে পুতুলের মতো। এদিক ওদিক হন্নে হয়ে তাকিয়ে কাউকে যেন খুঁজছে। মানুষজন চেয়ে আছে তার দিকে যেন আজব চিড়িয়া। মানুষের এই এক অদ্ভুত স্বভাব, আশপাশ থেকে কিছু ভিন্ন হলেই দেখতে হবে তাকে। না হলে যেন তার সারা জনম বৃথা! কিছু খারাপ লোকও কুনজরে তাকিয়ে অশ্লীন সব কথা বলে চলেছে। মেয়েটার সেদিকে হুশ নেই। সে একটা জায়গায় বসে বাচ্চাদের মতো পা দোলাচ্ছে আর চারদিকে তাকিয়েই চলেছে। ইশিতা গিয়ে জিজ্ঞেস করল, নাম কি তোমার?
– মিথু…
.
.
.
.
কলিংবেল বাজছে। একবার না দুইবার না। একাধারে বেজেই চলেছে। ইহান সন্ধ্যায় পড়তে বসেছিল। সামনেই এইচএসসি এক্সাম। একদম সময় নেই। আর মাত্র দু মাস। একটা ম্যাথ নিয়ে অনেক ঝামেলায় আছে এর মধ্যে একটানা বেলের শব্দে মেজাজটা গরম হয়ে গেল। কোন অসভ্য বাচ্চা এমন বাজাচ্ছে! ইশিতার আসার সময় আরো পরে। এখন কে এল!? ইহান মাথাটা গরম করে দরজা খুলে বলল, কি হয়েছেটা…… আরে ইশুবু? আজ এত তাড়াতাড়ি?
– হুম কাজ শেষ হয়ে গেল তাই চলে এলাম।
মিথিলা এখনো মনের আনন্দে কলিংবেলটা টিপে চলেছে। অন্যরকম ভালো লাগা। ইহান ধমক দিয়ে বলল, এই মেয়ে, কি সমস্যা তোমার? পাগল নাকি? এত বড়ো মেয়ে অযথা কলিংবেল টিপছো কেন? মাথাটা ধরিয়ে দিল। যাও তো যাও এখান থেকে। বলেই দরজা মেরে দিল। ইশিতা বলল, আরে কি করছিস? মেয়েটা আমার সাথে এসেছে। ও গিয়ে দরজা খুলে মিথিলাকে ভেতরে নিয়ে এল।
– কে ইশুবু?
– রাস্তায় ঘুরছিল। নিয়ে এসেছি তাই। সৎ মা জোর করে বিয়ে দিচ্ছিলো তাই পালিয়ে এসেছে।
– তুমি আগের মতো সহজ সরলই রয়ে গেলে ইশুবু। দেখো কোনো চক্রের সাথে হাত আছে। তোমাকে ভোলা ভালা পেয়ে হাত করেছে।
– ইনু, এমন করে বলিস না। ও আমাদের মতো স্বাভাবিক না। দেখে তো বুঝতে পারছিস।
– আমার এত বুঝে কাজ নেই৷ এই মেয়ে শুনো, আমার রুমের আশেপাশে যাতে তোমাকে না দেখি। আমার আশেপাশেও যেন না আসো। আসলেই বের করে দেবো।
বলে ইহান চলে গেল। মিথিলা বুঝলো না তাকে বকার কারণ৷ সে কাঁদো কাঁদো হয়ে ইশিতার দিকে তাকাতেই ও হেসে বলল, আমার ভাইটা একটু রাগি কিন্তু মনটা ভালো। দেখবে কদিন গেলে সব ঠিক হয়ে গেছে। মিথিলা মাথা নাড়ালো।
রাতে খাবার টেবিলে এল না ইহান। এটা মোটামুটি একমাস ধরেই হচ্ছে। পড়াশোনায় ব্যস্ত অনেক। ইচ্ছে আছে মেডিকেল পড়ে ডাক্তার হওয়ার। বাবা মাকে বাঁচাতে পারেনি চিকিৎসার অভাবে। মা মারা গেল ক্যান্সারে আর বাবা এক্সিডেন্টে। তখন থেকে ওর ইশিতা বুবুই ওকে একা হাতেই মানুষ করে চলেছে। নিজে না খেয়ে ওকে খাইয়েছে পড়িয়েছে। টিউশনি করিয়ে নিজের আর তার পড়াশোনার খরচ যুগিয়েছে। চাকরী যোগার করেছে। কারো সাহায্য পায়নি। বাবা মা চলে যাওয়ার পর সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তাই ডাক্তার হয়ে সব কষ্ট ঘুচিয়ে দেবে বোনের। এজন্য মন দিয়ে পড়ালেখা করছে। যেকোনো মূল্যে ডাক্তার হতেই হবে ওকে।
মিথিলা ইশিতার সাথেই খেলো। খাওয়ার থেকে ছড়ালো বেশি। এমন করছে দেখে ইশিতা নিজ হাতে খাইয়ে দিলো। বাবা চলে যাওয়ার পর কত দিন কেউ এমন ভালোবেসে খাইয়ে দেয় না। মিথিলার চোখে পানি চলে এল। ইশিতা জিজ্ঞেস করল, কোথাও কষ্ট হচ্ছে? মিথিলা মাথা নাড়ায়।
ইহান খাবারটা রুমে বসেই খেয়েছে। ইশিতা দুধ দিয়ে গেছে একটু আগে। হাত ধুতে গিয়েছিল ওয়াশরুমে। এসে দেখলো মিথিলা গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে। মুখে দুধ লেগে আছে। ইহানকে দেখে পালাতে গিয়েছিল আর তখনই ধরে ফেলে ওর হাত। তারই ফলাফল এই বর্তমান।
মিথিলার মুখটা সুন্দর করে পরিষ্কার করে নিজের একটা থ্রিপিস দিলো ইশিতা। তারপর নিজের বিছানায় বিছানা করে দিল ওর জন্য। মিথিলা বাচ্চা মেয়ের মতো চুপ করে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ল। ও ঘুমিয়ে পড়তেই ইশিতা ড্রিম লাইট দিয়ে বেরিয়ে এল। ইহানের রুমে লাইট জ্বলছে। সেখানে গিয়ে দেখল ও পড়ছে। ইশিতা হেসে ফার্স্ট এইড বক্সটা নিয়ে বসল ইহানের কাছে। ডান হাতটা টেনে নিতেই বলল, লাগবে না ইশুবু। ইশিতা হেসে বলল, আমার মিষ্টি ভাইটার রাগ হয়েছে বুঝি বুবুর উপর? তোর হাতও যে ওর কাচের চুড়িতে কেটেছে। দেখেছি আমি।
– তাহলে তখন আসোনি কেন?
– মেয়েটা যে বড্ড অসহায় আমাদের মতো। রাগ করিস না ভাই।
– লাগবে না ওষুধ। এমনিই ঠিক হয়ে যাবে।
– ইস্, সামনেই তো পরীক্ষা। হাতটাকে ভালো না রাখলে যদি পরীক্ষা খারাপ হয়!? দে তো।
কথায় কাজ হলো। ইহান আর আপত্তি করল না। ইশিতা ব্যান্ডেজ করে দিয়ে বলল, শুয়ে পড়। দরজার কাছে যেতেই ইহান বলল, কদিন থাকবে? ইশিতা হেসে বলল, যদি বলিস তো সারাজীবন রেখে দেই পুতুলটাকে? বলেই হাসতে হাসতে চলে গেল। ইহানের মোটেই পছন্দ হলো না মজাটা। রাগ উঠছে কেন যেন মেয়েটার উপর। ইহান ভাবতে চায় না। সে পড়ায় মন দিল, ই ইকুয়েলস টু এম সি স্কয়ার।
#মিথু
#সাহেদা_আক্তার
#পর্ব_১