মিথু পর্ব -০২

#মিথু
#সাহেদা_আক্তার
#পর্ব_২

সকালে মিথিলা উঠে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল যেন কোথায় আছে বুঝতে পারছে না। ইশিতা রুমে এসে বলল, ওমা উঠে গেছো!? সাড়ে সাতটা বাজে। সকাল সকাল ওঠার অভ্যাস আছে দেখছি। ফ্রেশ হয়ে নাও দেখি ভালো মেয়ের মতো, নাস্তা করবে। মিথিলা হাত মুখ ধুতে গেল।

ইশিতা একবার সার্চ দিয়ে দেখল মানসিক প্রতিবন্ধী সম্পর্কে। বেশির ভাগ মানুষই মনে করে থাকে মানসিক প্রতিবন্ধকতা একটা অসুখ। কিন্তু এই প্রতিবন্ধকতা কোনো অসুখ নয়, এটা অবস্থান। এই প্রতিবন্ধকতার শিকার যারা, তাদের বুদ্ধিমত্তা বয়স অনুপাতে বাড়ে না, ফলে স্বাভাবিক সমবয়সী সব ছেলেমেয়েদের থেকে সর্বক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে পড়ে। কার সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে, কখন বা কোন পরিবেশে কী বলতে হবে সেটা তারা বুঝে উঠতে পারে না। তাদের নিজেদের একটা জগৎ তৈরী হয়। যার কিনারা খুঁজে পাওয়া মানুষের পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে।

৯০ থেকে ১১০ বুদ্ধ্যঙ্ক যাদের সেই মানুষদের স্বাভাবিক বুদ্ধ্যঙ্ক বলা হয়। যদি কারো বুদ্ধ্যঙ্ক ৯০ এর নীচে এবং ৭০ এর উপরে হয় তবে সেই মানুষকে প্রান্তিক অবস্থায় আছে বলে ধরা হয়। মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই ৭০ -এর নীচে বুদ্ধ্যঙ্ক শিশুদের চারটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। যাদের বুদ্ধ্যঙ্ক ২০- ২৫ এর নীচে, তারা অতি তীব্র প্রতিবন্ধী; বুদ্ধ্যঙ্ক যাদের ২০- ২৫ থেকে ৩৫-৪০, তারা তীব্র প্রতিবন্ধকতা; বুদ্ধ্যঙ্ক ৩৫- ৪০ থেকে ৫০- ৫৫ – মধ্যম প্রতিবন্ধী আর যাদের বুদ্ধ্যঙ্ক ৫০-৫৫ থেকে ৭০, তারা মৃদু প্রতিবন্ধী।

মিথিলাকে দেখে মনে হল ওর মৃদু প্রতিবন্ধীদের মধ্যে পড়ে। ওকে কিছু বুঝিয়ে দিলে সে মোটামুটি বুঝতে পারে। তবুও ওর স্পেশাল যত্নের প্রয়োজন।

ইশিতা পাউরুটি টোস্ট করছে। এর মধ্যে মিথিলা এসে হাজির। হাত মুখ ধোয়ায় পানিতে ভিজে আছে। তাই দেখে একটা টাওয়াল এনে দিল ইশিতা। তারপর জেলি আর চকলেট দেখিয়ে বলল, কোনটা খাবে? মিথিলা দুটোই দেখিয়ে দিল দুই হাত দিয়ে। ইশিতা হেসে বলল, আচ্ছা৷ ফিফটি ফিফটি। ওকে? চারটা পাউরুটির দুটোতে জেলি আর দুটোতে চকলেট লাগিয়ে দিল ওকে। ও ইশিতার দিকে জিজ্ঞাসুদৃষ্টি দিতেই বলল, আমি খেয়ে নিয়েছি। শুনে এক কামড় দিয়ে ইহানের রুমের দিকে তাকাল৷ রুমটা এখনো আধো অন্ধকার। ইশিতা এক গ্লাস জুস এগিয়ে দিয়ে বলল, এখনো ঘুমাচ্ছে। রাত জেগে পড়েছে তো। উঠে যাবে একটু পরে। তুমি খেয়ে নাও। মিথিলা খাওয়ায় মন দিল। এক কামড় এক কামড় করে ধীরে সুস্থে খাচ্ছে মনোযোগ দিয়ে।

ইশিতাকে অফিস যেতে হবে, একটা ইম্পর্টেন্ট মিটিং আছে। মিথিলাকে নাস্তা দিয়ে দ্রুত তৈরী হয়ে নিল। ইহানের রুমে গিয়ে দেখল ও এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। ওর নাস্তাটা টেবিলেই ঢাকনা দিয়ে রেখে দিল। মিথিলা এখনো পাউরুটি খাওয়া শেষ করেনি। ইশিতা গিয়ে বলল, মিথু, আমার আসতে দেরি হবে। তুমি ভালো মেয়ের মতো থাকবে, ঠিক আছে? মিথিলা মাথা নাড়ল। ইশিতার চিন্তা হচ্ছে ওকে এভাবে রেখে যাওয়া ঠিক হবে কি না। ইহানের মন ভালো কিন্তু একবার রেগে গেলে থামানো যায় না। বলতে পারে না কি করছে। তার উপর মিথিলাকে মোটেই পছন্দ করেনি সে। তাই ভয় হচ্ছে। তবুও উপায় নেই। ইশিতা আল্লাহর উপর ভরসা করে বেরিয়ে গেল।

আটটার দিকে ইহান উঠে হাই তুলল। কালকে ফিজিক্স পড়ছিল রাতে। এখনো আইন্সটাইনের সূত্র মাথায় ঘুরছে। বিড়বিড় করতে করতে ওয়াশরুম গেল। ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হলো খানিকবাদে। দেখল মিথিলা পাউরুটির শেষ অর্ধেক খাচ্ছে টেবিলে বসে। বিরক্তিতে ভ্রূ কুঁচকে গেল তার। আশেপাশে তাকিয়ে বুঝল ইশিতা বেরিয়ে গেছে। দরজার কাছে গিয়ে দেখল হুক লাগানো নেই। ইহান মনে মনে বলল, আসলেই মেয়েটার কান্ড জ্ঞান নেই। ইশুবুটা যাওয়ার পর দরজাটা পর্যন্ত মারেনি। বেশ বিরক্ত হয়ে ও নিজের নাস্তা নিয়ে রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। তখন টেবিলে একটা চিরকুট চোখে পড়ল। সেখানে ইশিতা বলেছে মিথিলার খেয়াল রাখতে। ইহানের বয়েই গেছে এই আধা পাগলের খেয়াল রাখতে। চেনা নেই জানা নেই উটকো এক ঝামেলা ঘাড়ে চেপে বসেছে।

নয়টায় ইহান তৈরী হয়ে নিল। কলেজ বন্ধ হয়ে গেছে কিন্তু কোচিং এখনো খোলা। ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে ইশিতার রুমে উঁকি দিল। মিথিলা সেখানে বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। চুলগুলো খোলা। বাতাসে হালকা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে চুল৷ ওর বেশ মজা লাগছে ব্যাপারটা। বাচ্চাদের মতো উপভোগ করছে৷ ইহান একমুহূর্ত তাকিয়ে থেকে সরে এল। দরজায় তালা মেরে বেরিয়ে গেল। এই উটকো ঝামেলার জন্য কোনোভাবেই কোচিং মিস দেওয়া যাবে না। কখনোই না।
.
.
.
.
দুইটায় কোচিং শেষ হলো। টানা চার ঘন্টা ক্লাস। বের হয়ে একটা আড়মোড়া ভাঙল ইহান। বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না। বাসায় ঐ মেয়েটা। ইহানের একেবারেই মেয়েটাকে সহ্য হয় না। ভালো লাগে না ওর। তাই কতক্ষণ বন্ধুদের সাথে পড়া নিয়ে আলোচনা করল। এদিক ওদিক গেল। চারটায় বাসার দরজার সামনে দাঁড়ালো। চাবি ঢুকালো তালায়। দরজাটা কেমন যেন রহস্যজনক ভাবে শব্দ করে খুলল। ভেতরে ঢুকতেই কেমন সুনশান নীরবতা। যেন কেউ নেই। ইশিতা সব সময় এটা ওটার জন্য বাইরে থাকতো বলে ইহানকে প্রায়ই একলা থাকতে হতো। কিন্তু আজ তো মেয়েটা আছে তাও এত নীরব দেখে ইহানের কেমন যেন লাগছে। ও ব্যাগটা রেখে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। ইশিতার রুমে উঁকি দিয়ে দেখলো নেই কেউ। সারা বাসা খুঁজে দেখল নেই। কয়েকবার এই মেয়ে এই মেয়ে করে ডাকল। সাড়াশব্দ নেই। ভয় পেয়ে প্রথম ডাকল, মিথু? তাও কেউ বেরিয়ে এল না। হঠাৎ চোখ পড়ল ডাইনিং টেবিলের দিকে মেঝেতে। সেখানে একটা কাচের গ্লাস ভেঙে পড়ে আছে। টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে আশেপাশে। সাথে রক্ত জমাট বেঁধে আছে মেঝেতে৷ বেশ খানিকটা। ইহানের ভয় লেগে উঠল। মেয়েটার কিছু হয়নি তো! অনেক খোঁজাখুঁজির পর পাওয়া গেল মিথিলাকে। সোফার পেছনে বেহুশ হয়ে আছে। ইহান তাড়াতাড়ি কোলে নিয়ে সোফায় শোয়ালো। পানি এনে ঝাপটা দিতেই আস্তে জ্ঞান ফিরলো। চোখ পিটপিট করে কতক্ষণ তাকিয়ে হঠাৎ ইহানের হাত চেপে ধরল। ইহান বুঝল মেয়েটা ভয় পেয়েছে অনেকটা। জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে? মিথিলা ভয় পাওয়া গলায় বলল, মাকড়শা।

– কোথায়?

ও টেবিলের দিকে ইশারা করল। ইহান বলল, মাকড়শা তো কি হয়েছে?

– ভয়।

– মাকড়শা কেউ ভয় পায় নাকি আবার?

মিথিলা শব্দটা শুনেই ভয়ে কাঁপছে। ইহান একবার ভাবলো মাকড়শা দিয়ে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেয় একে। পরে ভাবলো এমনিতেই ভয়ে জবুথবু হয়ে গেছে। আরো কিছু হলে খারাপ হতে পারে। তবে ব্যাপারটা মাথায় রাখবে। পরে কাজে লাগতে পারে।

ইহান ফাস্ট এইড বক্সটা নিয়ে এল। এই নিয়ে একই হাত দুইবার কাটল। ভাঙা গ্লাস ধরে খুব বাজেভাবে কেটে নিয়েছে ডান হাত৷ হেক্সিসল দিতেই কান্না করতে লাগল। ইহান সাবধানে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে বলল, খেয়েছো কিছু? ও মাথা নাড়ায়। ইহান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আজকে ওর জন্য দেরি করে এসেছে না হলে রান্না করে নিতো এতক্ষণে।

– তুমি বসো আমি খাবার দেই।

যেতে লাগলে হাতে বাঁধা পেল। মিথিলা এখনো হাত ধরে আছে ওর। ও হাত ছাড়িয়ে নিতেই জড়োসড়ো হয়ে সোফার কোণায় বসে রইল। ইহান ওকে একটা পাউরুটি ধরিয়ে দিল খাওয়ার জন্য। তারপর চলে গেল রান্না ঘরে। ইশিতা সব রান্না করে দিয়ে যায় সকাল সকাল। ইহান শুধু ভাতটা রান্না করে। ভাত তুলে দিয়ে এসে দেখল এখনো পাউরুটি হাতে নিয়ে বসে আছে। ইহান বলল, খাওনি কেন এখনো?

– ব্যাথা।

– এখন কি খাইয়ে দিতে হবে?

মিথিলা কিছু বলল না। ইহান সামনে বসে পাউরুটি মিথিলার মুখের সামনে ধরল। ও বুঝতে পেরে এক কামড় দিল। ইহানের বেশ বিরক্ত লাগছে। এখন বসে বসে একে খাওয়াতে হচ্ছে। এদিকে পড়াশোনাটাও হচ্ছে না আর নিজেও কিছু খায়নি। ভাবনার মাঝে মিথিলা এক পিস পাউরুটি কখন যে ওর মুখে ঠেসে ধরেছে বুঝতে পারেনি। তাই চেঁচিয়ে উঠে বলল, কি এটা? ওর চেঁচানো দেখে মিথিলা বেশ ভয় পেয়ে যায়। তাই আরো সরে বসে ওর থেকে। ইহান ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ওর বোন যে কি ঝামেলায় ফেলল ওকে!
.
.
.
.
কলিংবেলের শব্দে ইহানের ঘুম ভাঙল। তাকিয়ে দেখলো মিথিলা ওর হাত জড়িয়ে এখনো ঘুমিয়ে আছে। সন্ধ্যার পর কতক্ষণ ওর পেছন পেছন ঘুরেছিল। আজ আর কিচ্ছু বলেনি ইহান৷ সেও জ্বালায়নি। ও পড়ল কিছুক্ষণ তারপর তাকিয়ে দেখল মিথিলা ঘুমিয়ে পড়েছে ওর বিছানায়। কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। সেই সময়টাতেই ঘুমের মধ্যে হাত ধরে ফেলেছিল মিথিলা আর কি যেন বিড়বিড় করে বলছিল। বোঝা গেল না। হাতের টানে ওর পাশে হেলান দিয়ে বসায় কখন যে ঘুমিয়ে গেছে খেয়াল নেই। আবার কলিংবেল বাজতেই সাবধানে হাত ছাড়িয়ে দরজা খুলতে গেল৷ ন’টা বাজে। ইশিতা আজও তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। প্রত্যেকদিন ঠিক দশটায় আসতো। ঢুকেই ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে বলল, মিথু কেমন আছে?

– ভালো।

– কই ও?

– আমার রুমে। ঘুমায়।

ইশিতা ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হয়ে নিল। হাত মুখ মুছতে মুছতে বলল, খেয়েছিস দুটোয়? ইহান রুমে যেতে যেতে বলল, হুম। ইশিতাও পেছন পেছন ঢুকল। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। হঠাৎ হাতের দিকে নজর পড়তেই বলল, কাটল কি করে ওর হাত?

– গ্লাস ভেঙে কেটে গেছে।

– ইস্, খেয়াল রাখবি না?

– আমি কোচিংয়ে ছিলাম।

শুনেই ইশিতা অবাক হয়ে বলল, তুই আজ কোচিং গেছিস? ওকে একলা রেখে? ইহান মাথা নাড়ালো। ইশিতা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি জানি তুই পড়াশোনা কেন করিস। তাই বলে অমানুষ হয়ে যাস না ভাই। একটা অসহায় মেয়ে যার মানসিকতা বাচ্চাদের মতো। তাকে এত অবহেলা দিস না। কাল থেকে কোচিংয়ে গেলে ওকে নিয়ে যাবি।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here