মুগ্ধতায় তুমি পর্ব ২৪

#মুগ্ধতায়_তুমি
#পর্বঃ২৪
#Saiyara_Hossain_Kayanat

আমি কি স্বপ্ন দেখছি এটা নাকি আমার মনের কল্পনা!! সবাই কি পাগল হয়ে গেছে নাকি আমি একাই পাগল হয়ে গেলাম। এটা নিশ্চয়ই আমার হ্যালুসিনেশন হুম হুম তা-ই হবে হয়তো। নাহ আমিই হয়তো পাগল হয়ে গেছি। উফফ কি সব ভাবছি আমি!

—”কিরে কি এতো ভাবছিস সাইন কর তাড়াতাড়ি প্রচুর ঘুম পাচ্ছে আমার।”

ভাইয়ার কথা শুনে মাথা উঁচু করে তাকালাম। সবাই তাকিয়ে আছে আমার দিকে তাদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে আমি এখন তাড়াতাড়ি সাইন করলেই তারা এই মুহূর্তে নিস্তার পাবে। আর শুভ্র ভাই উনি তো এসে কোনো কথাই বলেননি আমাদের সাথে। দোলনায় বসে ওনার সাথের লোকটাকে তাড়াতাড়ি করে বললেন-

—”চাচা তাড়াতাড়ি কাগজ বের করেন আমি খুব ক্লান্ত এখনই ঘুমাতে হবে।”

তারপর লোকটাও কাগজ বের করে ওনার হাতে দিলেন আর উনিও খুব দ্রুত সাইন করে দোলনা থেকে উঠে দাড়িয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন-

—”আমি নিচে যাচ্ছি ঘুমাবো কেউ যেন ডিস্টার্ব না করে। আর হ্যাঁ অনন্যর দিকটা তোমরা ম্যানেজ করে নিও দ্রুত।”

এই কথা বলেই উনি দ্রুত পায়ে গটগট করে চলে গেলেন। আর আমি বেক্কেলের মতো দাঁড়িয়ে শুধু তার কান্ড দেখছিলাম। সব কিছু মাথার একশ হাত উপর দিয়ে গেছে কিছুই বুঝতে পারিনি। ভাইয়ার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করার পর বললো শুভ্র ভাই না-কি আমাদের বিয়ের কাবিননামায় সাইন করে গেছে আর এখন আমার সাইন বাকি আছে এটাই না-কি ওনার গিফট। এই কথা শুনে আমি যেন অনুভূতি শূন্য হয়ে গেলাম থমকে গেলাম আমি। বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে ছিলাম ছাদের দরজার দিকে। এভাবে হঠাৎ করে এসব কি হচ্ছে!! আমার ভাবনার মাঝেই ভাইয়া বিরক্তি প্রকাশ করে বলল-

—”অনু তাড়াতাড়ি কর প্লিজ…. দেখ তো প্রায় দুইটা বাজে।”

আমি মাথা তুলে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম-

—”ভাইয়া এটা কাবিননামা??”

—”কেন তোর কি এখনও সন্দেহ আছে?? কাগজটা পড়ে দেখিস নি!!”

আমি ভাবলেশহীন ভাবে আবারও জিজ্ঞেস করলাম-

—”আচ্ছা এই কাবিননামায় সাইন করলে কি আমার বিয়ে হয়ে যাবে??”

আমার এমন প্রশ্ন শুনে ভাইয়া, আম্মু, আব্বু, মামুনি আর আংকেল তাদের বিরক্তিভাবকে বিদায় দিয়ে উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। আমি এখনও মূর্তির মতো বসে আছি নিস্তব্ধ হয়ে। পাশের লোকটা আমাকে দেখে নিরাশ হয়ে বললেন-

—”ভাইজান মেয়েটা মনে হয় শক খেয়েছে শুভ্রর এমন কাজে। শক খাওয়ারই কথা ছেলেটা আসলেই পাগল তা না হলে মধ্যরাতে কেউ বিয়ে করে তা-ও আবার এভাবে!!”

লোকটার কথা সবার হাসি আরও বেড়ে গেল কিন্তু আমার মধ্যে বিস্ময় ছাড়া তেমন কোনো অনুভূতি নেই। সবাই আবারও আমাকে তাড়া দিতে লাগলো। আংকেল আমার মাথায় হাত রেখে বললেন-

—”মা রে রাত পাড় হয়ে যাচ্ছে তো তাড়াতাড়ি সাইন টা করে দে।”

পাশ থেকে আব্বুও বলে উঠলো-

—”অনু তাড়াতাড়ি করে দে না আমাদের ঘুম পাচ্ছে।”

আমি আহত দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছি। এ কেমন ফ্যামিলি!! বলা নেই কওয়া নেই শুভ্র ভাই বললেন আর ওনারাও পাগলের মতো এই মধ্যরাতে ছাদে চলে আসলেন আমাদের বিয়ে করানোর জন্য। আম্মু আর মামুনিও কিছুক্ষণ বোঝালেন। কি আর করার তাদের কথা অনুযায়ী সাইন করে দিলাম। সাথে সাথেই যেন তারা সবাই হাঁপ ছেড়ে বাচলো। বিশ্বজয়ী হাসি দিয়ে সবাই নিচে চলে যেতে লাগলেন। আর আমি এখনও স্তব্ধ হয়ে বসে আছি হচ্ছেটা কি আমার সাথে!! অপ্রত্যাশিত একটা মুহূর্তে অপ্রত্যাশিত বিয়ে!! আমাকে আগের ন্যায় বসে থাকতে দেখে ভাইয়া আবার পিছন ফিরে আমার কাছে এসে হাত ধরে দাড় করিয়ে বললো-

—”সারা রাত এখানে থাকবি নাকি চল।”

আমি কিছু না বলে ভাইয়ার হাতে একটা চিমটি কাটলাম। সাথে সাথে ভাইয়া ব্যথায় আর্তচিৎকার করে উঠলো। হাত ঘষতে ঘষতে রাগী কন্ঠে বললো-

—”দিব এক থাপ্পড় বেয়াদব মেয়ে। শুধু শুধু চিমটি দিলি কেন?”

আমি বিস্ময়ের দৃষ্টিতে ভাইয়ার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে নরম গলায় বললাম-

—”এগুলো তাহলে আমার হ্যালুসিনেশন না?? সত্যি সত্যি আমার বিয়ে হয়েছে!!”

ভাইয়া মুচকি হেসে আমার মাথায় চাটি মেরে বললো-

—”তোর ভাগ্য দেখেছিস অনু! কি সাংঘাতিক ভাবে তোর বিয়ে হলো। তোর এই বিয়ের কথা তো ইতিহাসের পাতায় লেখায় উচিত। ভাবতে পারছিস তুই রাত দুটায় যেখানে ভূত প্রেতের ঘুরো ঘুরি করার কথা সেখানে তোর বিয়ে হয়েছে। অবশ্য তুই পেত্নী বলেই তোর বিয়ে এই মধ্যরাতে হয়েছে তা-ও আবার ছাদে। কখনো কোন মানুষের বিয়ে এভাবে হতে দেখেছিস বল!!”

ভাইয়ার কথায় রাগ হলাম না বরং কথা গুলো ভাবার মতোই বলেছে। আমি ভাবুক দৃষ্টিতে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ের কন্ঠে বললাম-

—”এটা কি সত্যিই বাস্তব ভাইয়া??”

ভাইয়া আমার কাধে হাত দিয়ে বললো-

—”এখন এতো কিছু ভাবতে হবে না নিচে চল।”

আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ভাইয়া আমাকে গরুর মতো টেনেহিঁচড়ে নিচে নিয়ে গেল।

————————

এই বিয়ের কথা ভাবতে ভাবতে সারা রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দিলাম। শুধু শুধু শুয়ে থাকতে ভালো লাগছিলো না তাই নিচে বাগানে চলে আসলাম। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করার পর দোলনায় বসে ভাবতে লাগলাম রাতের কথা। এভাবে কি কারও বিয়ে হয় আমার তো জানা ছিলো না। মধ্য রাতে সবাইকে ঘুম থেকে তুলে হঠাৎ করেই বিয়ে তা-ও আবার ছাদে। আর শুভ্র ভাই এতো দিন পর আসলেন অথচ আমার সাথে একটা কথাও বলেনি। এটা কেমন বিয়ে যেখানে বর সাইন করে সাথে সাথেই ঘুমাতে চলে গেল আরেকজনের সাইন করার জন্য অপেক্ষাও করলো না!! উফফফ আল্লাহ আমি পাগল হয়ে যাব এইসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে। মাথায় হাত দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বসে আছি তখনই পেছন থেকে কেউ আমার মাথায় এক চাটি মারলো। আনমনে বসে থাকার কারনে হঠাৎ করে এমন হওয়ায় পরে যেতে নিয়েও কোনো রকম নিজেকে সামলিয়ে ঠিক হয়ে বসলাম। ঘাড় বাকিয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম শুভ্র ভাই ফরমাল ড্রেসআপে বেশ ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে এক বিশ্বজয়ী হাসি লেগে আছে। হাল্কা ভেজা চুল গুলো কপাল লেপ্টে আছে। হয়তো গোসল করেছে বেশি সময় হয়নি। আজব এতো সকাল সকাল এই লোকটা এমন সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছে কেন!! উনি দোলনায় আমার পাশে বসে স্বাভাবিক ভাবেই বললেন-

—”কিরে সকাল সকাল এখানে বসে কি ভাবছিস? আর এই পনেরো দিনে নিজের কি হাল করেছিস শুকিয়ে গেছিস ডায়েট করিস না-কি!! আগের থেকে ফর্সাও হয়ে গেছিস দেখা যাচ্ছে। কারও প্রেমে পরেছিস নাকি অনন্য!! মেয়েরা প্রেমে পরলে নাকি নিজেকে সুন্দর করে তুলতে পছন্দ করে।”

আমি ওনার কথা শুনে চোখ গোলাকার রসগোল্লার মতো করে তার দিকে তাকিয়ে আছি। এই লোকটা এতো স্বাভাবিক কিভাবে??? রাতের কথা কি ওনার মনে নেই!! ঘুমের ঘোরে সব করেছে না-কি!! আচমকাই শুভ্র ভাই আমার দিকে ঘুরে আমাকে খুব শক্ত করে জরিয়ে ধরলেন। মনে হচ্ছে আমার হাড়গোড় সব ভেঙ্গে ফেলার ধান্দায় আছে এই অসভ্য লোক। উনি আমার কানের কাছে মুখ এনে খুব শান্ত গলায় বললেন-

—”জানি এভাবে তোমাকে জড়িয়ে ধরা আমার ঠিক হয়নি তবে এভাবের মতো মাফ করে দাও। নেক্সট টাইম সম্পূর্ণভাবে তিনবার কবুল বলে বিয়ে করেই ধরবো তার আগে না প্রমিজ বলছি। জানো তো এই কয়টা দিন তোমাকে খুব মিস করেছি। প্রতিটা মূহুর্ত নিজের ভাবনায় তোমার মুগ্ধতায় মুগ্ধ হয়ে বিভোর ছিলাম। প্রতিটা রাত নির্ঘুম কাটিয়েছি কাল খুব বেশিই মিস করছিলাম। তাই তো নিজেকে আর সামলাতে না পেরে সকল কাজ রেখেই রাতে ছুটে এসেছি আর তোমাকে একদম নিজের করেই শান্তিতে ঘুম দিয়েছি। আমি বুঝতে পারছি এভাবে বিয়ে হওয়াতে তুমি খুব অবাক তবে এটাই ভালো জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত আমাদের বিয়ের এই স্মৃতিটাই সবাইকে খুব মুগ্ধ করার মতো হয়ে থাকবে। জানো অপ্রত্যাশিত সব কিছুই মানুষের স্মৃতিতে জায়গা দখল করে রাখে দীর্ঘ সময়ের জন্য। আর আমাদের বিয়ে তো অপ্রত্যাশিত সময়ে অপ্রত্যাশিত জায়গায় অপ্রত্যাশিত ভাবে হয়েছে তা-ই তো আমাদের বিয়ে এতোটা মনোমুগ্ধকর। অনন্যময়ি নামের এই মুগ্ধতা এখন থেকে পুরোপুরি এই মুগ্ধ প্রেমিকের। তোমার মুগ্ধতার বিনিময়ে এই মুগ্ধ প্রেমিক এক শুভ্র আকাশের সমান ভালোবাসা দিয়ে এই অনন্যময়িকে কিনেছে।”

শুভ্র ভাই আমাকে ছেড়ে দিয়ে আমার চুল গুলো ঠিক করতে করতে বললেন-

—”এখন আবার চলে যাবো আমি তবে অল্প কিছুদিনের জন্য। নিজের একদম অযত্ন করবি না মনে রাখিস তুই এখন থেকে আমার সম্পত্তি। তোকে অর্ধাঙ্গিনী বলবো না কারন তোর মাঝেই আমার পুরোটা জীবন আটকে আছে তুই হলি আমার সম্পূর্নাঙ্গিনী। আর হ্যাঁ ঠিক মতো খেয়ে নিজেকে একটু যত্ন কর। নিজের কোনো ক্ষতি বা অবনতি ঘটানোর আগে এই শুভ্ররের কাছে পারমিশন নিতে হবে। তা না হলে খুব ভয়ংকর শাস্তি হবে তোর। আর শোন তোর রুমে কিছু জিনিস রেখে এসেছি যখন আমাকে অনেক বেশি মনে করবি তখন ওই গুলা পরে নিস।”

আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম। শুভ্র ভাই আমার হাতে একটা শুভ্র সাদা গোলাপ দিয়ে হাতটা ধরে কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন-

—”ভালোবাসি ভালোবাসি খুব বেশিই ভালোবাসি তোমার মুগ্ধতায় মুগ্ধ হতে। আর সারাজীবন এভাবে তোমার মুগ্ধতায় নিজেকে মুগ্ধ করবো। কারন আমার সকল মুগ্ধতায় তুমি।”

এই কথা বলেই আমার কানে হাল্কা ঠোঁট ছুয়ে দিলেন। ওনার স্পর্শ পেয়ে আমার শরীরে মনে হলো শীতল হাওয়া বয়ে গেছে পুরো শরীর কেঁপে উঠেছে। উনি কিছুটা দূরে সরে আমার হাত উঁচু করে নিজের ঠোঁট ছুয়ে দিয়ে একটা বিশ্বজয়ী হাসি দিয়েই চলে গেলেন। আর আমি এখনও তার কথা গুলো মাঝেই থমকে আছি। ভালোবাসি?? শুভ্র ভাই ভালোবাসি বলেছেন!! এখনও ওনার বলা প্রতিটা কথা আমার কানে বেজে উঠছে বার বার। ওনার কথা গুলো মনে পরতেই অদ্ভুত এক লজ্জা এসে যেন সারা শরীর কাপিয়ে দিয়ে গেল। খুবই ভয়ংকর ভাবে লজ্জা এসে আমাকে আঁকড়ে ধরেছে।

চলবে….

(আজকের পর্বটা বড় করে দিলাম আপনাদের জন্য। কেমন লাগলো ধামাকা বিয়ে?? নেক্সট নেক্সট না লিখে গঠনমূলক মন্তব্য করবেন আশা করছি। ধন্যবাদ আর অনেক গুলো ভালোবাসা সবাইকে।❤️🖤)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here