#মৃত_কাঠগোলাপ- ১১
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
আয়েশী ও মৃদুলের গল্পটি সেদিন-ই সমাপ্তি টেনেছিল। বরং রচিত হয়েছিল এক ভিন্ন ধ্বংসাত্মক ভালোবাসার। সে প্রেমলীলার সূচনা করেছিল, ধ্রুব স্বয়ং। ধ্রুব সবার অলক্ষে দাবার গুটি নাড়ছিল। গল্পের সবাই শুধু ধ্রুবর সেই বিচক্ষণ চালমত নিজেদের কাজ করছিল। অথচ তারা জানতে পারলো না, কে আছে এ সকল ধ্বংসলীলার পেছনে। হয়তো গল্পের প্রতিটা চরিত্র দেখতে চলেছিল, ইতিহাস তৈরী করতে সক্ষম এক ভয়ংকর ভালোবাসা!
প্রায় ছ ঘণ্টা অজ্ঞান থাকার পর অবশেষে জ্ঞান আসে আয়েশীর। দু নয়ন ক্লান্তিতে অবশ হয়ে আসছে। সারা গায়ে আলস্য চেপে বসেছে যেমন। হাত পা জুড়ে কি মারাত্মক চিনচিনে ব্যথা! চোখের নিচের ত্বকে এখনও জলের বিন্দু জ্বলজ্বল করছে। মনের আয়নায় মৃদুলের থেতলে যাওয়া রক্তাক্ত মুখখানা দৃষ্টিগোচর হলে, এক উত্তাল পাত্তাল কান্না বয়ে গেল আয়েশীর বুকের ভেতর। আয়েশী তাৎক্ষণিক চোখ খুলে তাকাল। তাকে ঘিরে কক্ষের চারপাশে অনেক আত্মীয় দাঁড়িয়ে আছেন। সবার চেহারায় চিন্তার ছাপ। মেয়েটি শেষমেশ এই ভয়ংকর ঝড়কে কাটিয়ে উঠতে পারবে তো ?
আয়েশী সবার থেকে চোখ সরালো। মস্তিষ্ক সচল হতেই সর্বপ্রথম মাথায় এল, মৃদুল, মৃদুল কোথায়?
আয়েশী সঙ্গেসঙ্গে চট করে উঠে বসল। যার ফলে আয়েশীর হাতে থাকা স্যালাইনের ক্যানুলা খুলে গেল। হাত বেয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুতেই আয়েশীর বাবা সেই কাঁটা জায়গা হাত দিয়ে চেপে ধরলেন। আয়েশীর হাত ফুলে গেছে, ব্যাথায় হাতের কাঁটা জায়গা উষ্ণ হয়ে গেছে। অথচ আয়েশী নির্বিকার। সে পাগলের মত আশপাশে মৃদুলকে খুঁজে চলেছে। কামরুল হাসানের থেকে হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে লাগল। বাবার হাত ধরে জিজ্ঞেস করছে,
‘ বাবা, বাবা। আমার মৃদুল কোথায়? হ্যাঁ? চুপ করে আছ কেন, বাবা? বলো না বাবা, মৃদুল কোথায়? ‘
কামরুল হাসানের চোখের কোনে জল চিকচিক করছে। মেয়েটার এই কষ্ট আর চোখে দেখা যাচ্ছে না। কামরুল হাসান মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বাবার আদুরে স্পর্শ পেয়ে আয়েশীর চোখ আরামে বুজে এল। আয়েশী যখন কষ্ট পেত, মৃদুল এমন করেই আয়েশীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিত। বলা হয়, বাবার পরে স্বামীর স্থান। মৃদুলকে ভালোবাসার পর থেকে আয়েশী মনেপ্রাণে তাকে স্বামী হিসেবে মেনে এসেছে। এত বছর ধরে মৃদুলকে নিজের করে পাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করেছে। আজ যখন তাদের অপেক্ষার পূর্ণতা পেতে যাচ্ছিল, তখন উপরওয়ালা কি নিষ্ঠুর খেলাটাই না খেললেন। আল্লাহ তাকে সেই অপেক্ষার ফল দিলেন না? আয়েশী আবার ডুকরে কেঁদে উঠল। কামরুল হাসান মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। মেয়ের চুলে হাত বুলিয়ে বললেন,
‘ কাঁদে না, মা। এত কাঁদলে তুমি অসুস্থ হয়ে যাবে। শান্ত হও, মা। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন। আল্লাহর ফয়সালার উপর ভরসা রাখো, মা। সব ঠিক হয়ে যাবে। ‘
আয়েশী বাবার শার্ট হাতের মুঠোয় মুচড়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলল,
‘ যে ভালো আমার কাছ থেকে আমার সবচে প্রিয় জিনিসকে কেড়ে নেয়, সে ভালো আমার দরকার নেই, বাবা। আমি আর পারছি না বাবা। মৃদুল কেন আমায় ফাঁকি দিল বাবা। সে বলেছিল, সে আসবে। কিন্তু দেখ, সে কথা রাখল না। সে আমায় একটুও ভালোবাসে নি বাবা। একটুও না। ‘
এক ছোট বাচ্চার ন্যায় হাউমাউ করে আয়েশী কাদঁছে। ভালোবাসা পাওয়ার জন্যে কাতর হয়ে ভিক্ষা চাইছে উপরাওয়ালার কাছে। মৃদুল আর নেই, আয়েশীর যেন তা বিশ্বাস-ই হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, এক্ষুনি মৃদুল আসবে। আয়েশীর কানের কাছে দুষ্টুমিভরা কণ্ঠে ফিসফিস করে বলবে, ‘ এত কাঁদছিস কেন পাগলী! ভালোবাসি তো! ‘
এই তো, মৃদুল আয়েশীকে ভালোবাসি বলেছে। ইশ, আয়েশীর ভালোবাসা পাওয়ার তৃষ্ণা আরো বাড়িয়ে দিয়ে গেল এই নিষ্ঠুর প্রেমিক। তার হৃদয়কে একটানে ছিঁড়ে যেন ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলল। ইশ, এ হৃদয়ের জ্বালা আর সয় না। আয়েশী মৃদুলকে কক্ষণো ক্ষমা করবে না। সে আয়েশীকে ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কি সুন্দর তাকে ছেড়ে চলে গেল। মৃদুলের কথা মনে পড়ায় আয়েশী আবার শব্দ করে কেঁদে উঠল। পাগলের মত মাথার চুল খামচে ছিঁড়ে ফেলল কয়েক গোছা চুল। নিজেই নিজের হাত পায়ে আঁচড় কাটছে। নখের ধারালো আঘাত লেগে হাত অনেকখানি কেটে রক্ত বেরিয়ে গেল। কামরুল হাসান মেয়েকে শান্ত করবার চেষ্টা করছেন। কিন্তু আয়েশীকে হাতের মুঠোয় আটকে রাখা দুঃসাধ্য ঠেকছে।
কক্ষে উপস্থিত সবার আয়েশীর কান্না দেখে মুখ চেপে কাদছেন। হাসিখুশি মেয়েটার এ কি হাল হয়ে গেল!
আয়েশীর বাবা কোনোরকম আয়েশীকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে ডাক্তারকে ইশারা করলেন। বয়স্ক ডাক্তার এগিয়ে আসলেন।
আয়েশীর হাতে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে আয়েশীকে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। আয়েশী দুবার হিঁচকি দিয়ে, বালিশে মাথা রাখল।
‘ কামরুল সাহেব, আপনি একটু আমার সাথে আসেন। ‘
ডাক্তারের কথা শুনে কামরুল হাসান মেয়ের দিকে ভেজা দৃষ্টিতে চেয়ে ডাক্তারের পিছু পিছু কক্ষের বাইরে এলেন।
‘ দেখুন, কামরুল সাহেব, আয়েশী এখন ম্যাজর এক ট্রমাতে আছে। যত দিন যাবে, এই ট্রমা ক্রমশ খারাপ রূপ ধারণ করবে। এমনকি রোগী যেকোনো মুহূর্তে সুইসাইড করতে পারে। যতদিন না পর্যন্ত আয়েশী মৃদুলকে ভুলতে পারছে, ততদিন আয়েশীর মানুষিক স্বাস্থ্য সুস্থ হবে না। ‘
কামরুল হাসান চিন্তিত হয়ে বললেন,
‘ মৃদুলকে কি কখন আয়েশী ভুলতে পারবে? ‘
‘ পারবে। কাঁটা দিয়ে কাঁটা যেমন করে তুলতে হয়, তেমন করে ভালোবাসা দিয়ে ভালোবাসার যন্ত্রণা ভুলাতে হয়। রোগীর পাশে সর্বক্ষণ একজন মানুষ থাকা দরকার। এমন একজন যে রোগীকে যথাসম্ভব সময় দেবে। তার মানুষিক স্বাস্থ্য সুস্থ করে তুলতে সাহায্য করবে। আপনি কি বুঝতে পেরেছেন আমার কথা? ‘
কামরুল হাসান অবাক কন্ঠে বিড়বিড় করলেন,
‘ এমন একজন মানুষ কোথায় পাবো? ‘
‘ আপনি আছেন, আপনার স্ত্রী আছেন। আপনারা সবাই মিলে তাকে সাপোর্ট দেবেন। তবে হ্যা, এই মুহূর্তে আপনার মেয়ের একমাত্র ঔষুধ হলো এক সমুদ্দুর ভালোবাসা। তার এমন একজন প্রেমিক দরকার, যে মৃদুলের ভালোবাসা আয়েশীর মন থেকে মুছে নতুন করে আয়েশীকে ভালোবাসতে শেখাবে। ‘
‘ আয়েশীকে মৃদুল চেয়ে বেশি আর কে ভালোবাসতে পারে?’
‘ আছে একজন। চোখ কান খোলা রাখুন। যদি পেয়ে যান এমন কাউকে, তবে বিলম্ব না করে অতি শীঘ্রই আয়েশী বিয়ে দিয়ে দিন। সংসারের বেড়াজালে আটকে গেলে অতি শীঘ্রই মৃদুলকে ভুলে যাবে আয়েশী। ‘
ডাক্তার তার মত চিকিৎসা দিয়ে চলে গেলেন। কামরুল হাসান চিন্তায় পড়ে গেলেন। ডাক্তারের কথা একেবারে ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না। যুক্তি আছে তার কথায়। কিন্তু কথা হচ্ছে, কে আছে, যে আয়েশীকে ভালো রাখতে পারবে?
‘ আঙ্কেল? ‘
ধ্রুবর কথায় সম্বিত ফিরে এল কামরুল হাসানের। তিনি পেছনে ফিরে তাকালেন। ধ্রুব বলল,
‘ ডাক্তার কি বললেন? ‘
কামরুল হাসান দ্বিধায় পড়ে গেলেন। ধ্রুবকে কি কথাগুলো বলা ঠিক হবে? যত হোক, নিজের মানুষ তো আর না। পরে যদি তার হাসির খোরাক হয়ে যান? কামরুল হাসান চুপ করে রইলেন। ধ্রুব বুঝতে পারল, কথাগুলো বলতে কামরুল হাসানের আত্মসম্মানে আঘাত হানছে। তার মুখ থেকে এত সহজে কথা বের হবে না। তাই সে অন্য চাল চাললো।
‘ আঙ্কেল, আপনি আমাকে নিজের ছেলে হিসেবে সব কথা বলতে পারেন। আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করব আপনার সমস্যার সমাধান করার। বলুন, আঙ্কেল? কি বললেন ডাক্তার? ‘
কামরুল হাসান ভাবলেন। শুরু থেকে ধ্রুব এ বাড়ির একজন ছেলে হয়ে বিয়ের পুরো দায়িত্ত্ব একা হাতে সামলেছে। তাকে বলতে দোষের কি আছে? যদি সে একটুখানি সাহায্য করতে পারে? সারাজনম ঋণী হয়ে থাকবেন ধ্রুবর কাছে। কামরুল হাসান একটু জড়তা নিয়ে ডাক্তারের বলা কথাগুলো ধ্রুবকে জানালেন। ধ্রুব ভেতর ভেতর হাসল। যেমন চাল চেলেছে, তেমনই ফল আসছে। পথ তবে পরিষ্কার! ধ্রুব একটু গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে বলল,
‘ আঙ্কেল, আপনি চাইলে আমি বিয়ে করব আয়েশীকে। ‘
#মৃত_কাঠগোলাপ – ১২
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
খোলা জানলা টপকে এক মিষ্টি আলো ছুঁয়ে দিচ্ছে আয়েশীর ঘুমন্ত মুখশ্রী। এক ছটাক আলো আয়েশীর চোখের পাতা স্পর্শ করলে, আয়েশী চোখ খিঁচে নেয়। আলো থেকে রক্ষা পেতে ওপাশ ফিরে শোয়। সুন্দর একখানা স্বপ্ন দেখছে আয়েশী। আয়েশী মৃদুলের কাঁধে মাথা রেখে সমুদ্র দেখছে। সমুদ্রের পানির রং ফকফকা সাদা। পানিতে সে কি স্রোত! স্রোতের পানির ঝাপটা ছুঁইয়ে দিচ্ছে আয়েশী-মৃদুলের গা। আয়েশীর পরনে থাকা লাল পাড়ের সাদা শাড়ি ভিজে লেপ্টে আছে গায়ের সাথে। আয়েশীর শীতে চোখ বুজে আসে। মৃদুলের গায়ের সাথে মিশে উষ্ণতা নিতে চায়! মৃদুল আয়েশীর কানের কাছে মুখ এনে মোহাচ্ছন্ন কণ্ঠে সুধায়,
‘ সমুদ্রের জলে যেমন কলঙ্ক নেই, তেমনই আমার কাছে কলঙ্কবিহীন, রক্তজবা। আকাশে যেমন কোনো কালিমা নেই, তেমনই তোমার মনের মধ্যে এক রত্তিও কালো দাগ নেই। আকাশের নীলের ন্যায় বিশুদ্ধ তুমি! কিন্তু পৃথিবীর সকল পাপমুক্ত জিনিস কারো না কারো কুনজর পড়ে! তেমনি তোমার জীবনে আমি হলাম সেই একমাত্র কুনজর। যার কুনজর থেকে আজ অব্দি কেউ বাঁচতে পারেনি। সবাই ভুগেছে, ছটফট করেছে, মুক্তি চেয়েছে। কিন্তু আমি কাউকে মুক্তি দেয়নি। নিজের কাছে বন্দী করে রাখাই আমার ধর্ম! তাই তুমিও বন্দী হবে রক্তজবা। তবে আমার ভালোবাসা তোমার সকল অভিযোগকে সমূলে ধ্বংস করবে। ভালোবাসি, প্রাণের চেয়েও বেশি আমার রক্তজবা! ‘
‘রক্তজবা’ শব্দটা আয়েশী জীবনে প্রথম শুনল। ঘুমের মধ্যেই আয়েশীর ভ্রুরু কুঁচকে এল। চোখের সামনে মৃদুল সমুদ্রের গভীরে হারিয়ে গেল। আয়েশী পাড়ে বসে আছে। চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল কি?
স্বপ্নে হঠাৎ করে সমুদ্রের শান্ত জল, গর্জন করে উঠল। সমুদ্রের জল দৈত্যের ন্যায় আঁচড়ে পড়ল আয়েশীর গায়ের উপর। আয়েশী ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। সমুদ্রের জলে ভেসে যেতে যেতে আয়েশী দেখল,সমুদ্রের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক অতীব সুন্দর পুরুষকে! পুরুষটি আয়েশীর দিকে চেয়ে রহস্যময় হাসছে। তার গায়ের স্পর্শে সমুদ্রের জল শান্ত শিশুর ন্যায় হয়ে গেছে। সমুদ্রে যেন আলিঙ্গন করছে সে পুরুষটিকে! আয়েশী অবাক চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল পুরুষটির দিকে! কে এ পুরুষ? কে সে?
চুলে বলিষ্ট পুরুষালি হাতের স্পর্শে আয়েশীর ঘুম ভেঙে যায়। আয়েশী চোখ খুলে তাকায়। কেউ নেই পাশে। তাহলে কে তার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল? আয়েশী শোয়া থেকে উঠে বসল। গায়ে বিয়ের শাড়িটি আর নেই। বোধহয় মা পাল্টে দিয়েছেন। মস্তিষ্ক সজাগ হলে, আয়েশীর পুনরায় মনে পড়তে লাগল মৃদুলকে। আবার কান্না আসছে। আয়েশীর চোখ থেকে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। বিড়বিড় করে বলল
‘ কোথায় তুই মৃদুল? আমার খুব মনে পড়ছে তোকে। আয় না ফিরে। আমার কথা কি তোর একটুও মনে পড়ে না? এত পাষাণ কেন রে তুই? ‘
‘ আয়েশী, ঘুম থেকে উঠে গেছিস মা? ‘
মনোয়ারা চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করলেন। আয়েশী চোখ তুলে তাকাল মায়ের দিকে। আয়েশীর মা চায়ের ট্রে টি টেবিলের উপর রাখলেন। আয়েশীর দিকে এক কাপ চা এগিয়ে দিয়ে বললেন,
‘ চা খা। শরীর ভালো লাগবে। ‘
আয়েশী চায়ের কাপ হাত দিয়ে ফিরিয়ে দিল। বলল,
‘ খাবো না। ভালো লাগছে না আমার। ‘
‘ আমি ভেবেছিলাম আজ মা-মেয়ে একসাথে চা খাবো। অথচ, তুই তো তোর কথা বলে দিলি। আমার কথা আর কে ভাববে? আমি কে তোর? ‘
মায়ের অভিমানী অভিযোগ শুনে অন্যসময় হলে আয়েশী হাসত। অথচ আর তার ঠোঁটকোলে বেদনার ছাপ। আয়েশী না চাইতেও চায়ের কাপ হাতে নিল। চায়ে চুমুক দিতেই গা-টা শিরশির করে উঠল। গরম মসলা চা খেয়ে গা বেশ চাঙ্গা লাগছে। শরীরের অবসন্ন ভাব নিমিষেই যেন নিঃশেষে হয়ে গেল। কেন সবসময় মা জেনে যায়, কখন আয়েশীর কি দরকার!
আয়েশীর মা, মেয়েকে এটা সেটা বলে ব্যস্ত রাখতে চাইছেন। ডাক্তার বলেছেন, আয়েশীকে যত ব্যস্ত রাখা যাবে, আয়েশী তত দ্রুত মানসিক অবসাদ কাটিয়ে উঠতে পারবে।
মনোয়ারা চলে গেলে, আয়েশী হাফ ছাড়ে। মায়ের চোখে নিজেকে ভালো দেখাতে গিয়ে, এতক্ষণ হাফিয়ে উঠছিল।
মা বলে গেছেন, বাবা খাবার টেবিলে যেতে বলেছেন। আয়েশী প্রথমে মানা করতে চাইলে, বাবার কথা ভেবে আর মানা করতে পারেনি। তাই অবিন্যস্ত চুল হাত দিয়ে খোঁপা করে বাথরুমের কাজ সেরে খাবার ঘরের দিকে যায়।
‘ বসো,মা। ‘
আয়েশীকে দেখতে পেয়ে কামরুল খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন। মেয়ে যে তার কথামত খেতে এসেছে সেই ত অনেক। আয়েশীকে এই ট্রমা কাটিয়ে উঠতে চাইলে, সবার সঙ্গে মিশতে হবে। একা থাকা কখনোই যাবে না। বাবার কথায় আয়েশী চুপচাপ চেয়ারে বসে পড়ল।
খাবার খাওয়া শুরু করতে চাইলে, কামরুল বাঁধা দেন। বললেন
‘ আরো একজন আসবে। তার জন্যে অপেক্ষা করো। ‘
আয়েশী অবাক হলো। কে আসবে নাস্তার সময়? একটু পর কলিং বেল বাজল। কামরুল বলেন,
‘ আয়েশী, যাও দরজা খুলে আসো। ‘
আয়েশীর ভালো লাগলো না বাবার কথা। মন মেজাজ ঠিক নেই। হাঁটতে একটুও ভালো লাগছে না। শুধু গা কাপিয়ে কান্না আসছে। চিৎকার করে কান্না করতে পারলে মনটা হালকা হতে পারত। অথবা আত্মহত্যা করে ফেললে রক্ষা মিলে যেত এই মরণযন্ত্রণা থেকে! জীবিত থেকেও লাশ হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে একবারে মরে যাওয়া ভীষন সুখের।
আয়েশী সদর দরজা খুলল। কিন্ত সে অবাক হলো ভীষন। ধ্রুব এখানে কি করছে? ধ্রুবর সাথে আয়েশীর মাত্র দুবার দেখা হয়েছে। তবে মৃদুলের মুখে বারবার ধ্রুবর কথা শুনেছে। মৃদুল বলেছে, ধ্রুবর মত ভালো আর শুদ্ধ মানুষ এই পৃথিবীতে নাকি দুটো হয়না!
‘ ভেতরে ঢুকতে দেবেন না? ‘
ধ্রুবর কথায় হুশ ফেরে আয়েশীর। লজ্জায় আলুথালু হয়ে যায়। দ্রুত দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়িয়ে বলে,’আসুন।’
ধ্রুব ভেতরে প্রবেশ করে। ধ্রুব ঘরে ঢুকেই খাবার টেবিলে চেয়ার টেনে বসে যায়। আয়েশী ভীষন অবাক হয়। এখন কি ধ্রুব তাদের সাথে নাস্তা খাবে? বাবা কি তবে তার কথা-ই বলেছিলেন? আয়েশী চুপচাপ টেবিলে বসে। খাবার খেতে খেতে ধ্রুব ও কামরুল নানা রকম কথা বলেছেন। তাদের কথার শোরগোল আয়েশীর কান জ্বালা করে। ধ্রুবর এখানে আসা, মৃদুলকে হারানোর স্মৃতি আরো তাজা করে দিচ্ছে। আয়েশীর আবার কান্না পাছে। ইচ্ছে করছে মাথার চুল খামচে ছিঁড়ে ফেলতে। গায়ের জামাটাও টুকটুক করে কেটে ফেলতে। মৃদুল কেন তাকে ছেড়ে চলে গেল?
আয়েশী আর সহ্য করতে পারে না। অর্ধেক খাবার ছেড়ে উঠে যায়। কামরুল হাসান ধ্রুব থেকে চোখ সরিয়ে আয়েশীর দিকে তাকান।
‘ খাবার ছেড়ে উঠে গেলে যে? ‘
আয়েশী একপল ধ্রুবর দিকে চায়। ধ্রুব মাথা নিচু করে খাচ্ছে ও সুখী সুখী আওয়াজ তুলছে। আয়েশী বাবার দিকে চেয়ে বলে,
‘ আমার পেট ভরে গেছে। আমি রুমে যাচ্ছি। একটু একা থাকতে দাও আমাকে। প্লিজ! ‘
আয়েশী গটগট করে তার কক্ষে চলে যায়। ধ্রুব সেদিকে তাকায়। কামরুল হাসান গম্ভীর চোখে ধ্রুবর দিকে তাকান। বললেন,
‘ বিষয়টা মনে হয়না খুব সহজ হবে তোমার জন্যে, ধ্রুব। ‘
ধ্রুব হাসল। আজ পর্যন্ত তার কাছে কোনো কিছুই অসম্ভব ঠেকে নি। সব কাজে সফল সে হয়েছে! সফল না হলে, কিভাবে সফলতা ছিনিয়ে আনা যায় সেটাও ধ্রুবর জানা। ধ্রুব কামরুল হাসানের দিকে চেয়ে মুচকি হাসল। বলল,
‘ আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আছি তো! সব সামলে নিব।’
#চলবে