#মৃত_কাঠগোলাপ- ৫
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
ছিপছিপে অন্ধকার একটি কক্ষ! আপাদমস্তক কালো রঙে আচ্ছাদিত। এ কক্ষে নেই কোনো জানালা, নেই কোনো আসবাবপত্র! আছে শুধু একটিমাত্র কালো রঙের দরজা। কেমন যেন গা ছমছমে পরিবেশ। রাকিব সম্পূর্ন একা এই ভ*য়*ঙ্কর কক্ষে বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। মুখ থেকে লালা গড়িয়ে পড়ে মাটিতে মিশে যাচ্ছে। তেলতেলে লালায় রাকিবের দেহ গড়াগড়ি খাচ্ছে। গা-টা মারাত্মক দূর্গন্ধে গুলিয়ে আসছে। রাকিব শেষ সম্বল হিসেবে আরো একবার চিৎকার করে উঠল,
‘ আমাকে ছেড়ে দিন। কে আছেন, আমাকে যেতে দিন এখান থেকে। আমার ভয় লাগছে। কেউ কি আছেন? ‘
রাকিবের চিৎকার কক্ষের চারপাশে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। অথচ, কেউ তার চিৎকার শুনতে পেল না। তার বলা শব্দগুচ্ছকে যেন কক্ষের দেয়ালগুলো রা*ক্ষসের ন্যায় শুষে নিল। রাকিব মাথা হেলিয়ে দিল মাটিতে। ইটের তৈরি বন্ধুর মাটি। উচুনিচু মাটির আঁকাবাঁকা আঁচড়ে রাকিবের মুখ খানিকটা কেটে গেল। রাকিব হাল ছেড়ে মিশে রইল মাটিতে।
‘ হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ, হ্যাপি হ্যাপি বার্থ ডে টু ডিয়ার ব্লাডি ম্যান। হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ। ‘
কক্ষের চারপাশ থেকে কেমন যেন একটা আওয়াজ ভেসে এল। পুরুষ কন্ঠ, অথচ কী ভয়ঙ্কর কণ্ঠের তেজ। রাকিব ছটফটিয়ে উঠলো। উঠে বসার চেষ্টা করতেই আবার মুখ থুবড়ে পড়ে গেল মাটিতে। কান খাঁড়া করে বললো,
‘ কে, কে ওখানে? ‘
‘ আ-মি, তোর মৃ*ত্যু। ‘
সেই আগের কণ্ঠ! রাকিব ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। গা-টা যেন কাঁটা দিয়ে উঠল। কণ্ঠনালি রোধ হয়ে এল বোধহয়।
রাকিব সচেতন চোখে চারপাশ পরখ করে দেখে বলল,
‘ যেই হও, সামনে আসো বলছি। নাহলে আমি তোকে খুন করে ফেলব। সামনে আয় মাদার** ‘
রাকিবের কথায় কেউ যেন হেসে উঠল। কি বি*দ*ঘুটে সেই হাসি। রাকিবের কান যেন গলে যাচ্ছে।
‘ কেমন আছো, রাকিব! ‘
রাকিব চট করে পাশে তাকাল। সঙ্গেসঙ্গে ভয়ে এক ছিটকে সরে গেল সে। তার পাশে মোমবাতি জ্বালিয়ে একজন পুরুষ হাঁটু গেরে বসে আছে। মোমবাতির এক ছটাক আলো এসে হানা দিচ্ছে পুরুষটির মুখে। পুরুষটি দাঁত খিলিয়ে হাসছে। রাকিব ভয়ে পেছাতে পেছাতে বললো,
‘ তুমি কি? কে তুমি? ‘
পুরুষটি ভয়ংকর হেসে বলল,
‘ আমি ধ্রুব, তোর মৃ*ত্যু! ‘
রাকিব ভয়ে দেয়ালের সাথে সেটিয়ে গেল। আর পেছানোর জায়গা নেই। রাকিব ভ*য়ার্ত চোখে ধ্রুবের দিকে চেয়ে ক্রমশ ঢোক গিলতে লাগল। ধ্রুব ফুঁ দিয়ে মোমবাতির আগুন নিভিয়ে দিল। সাথেসাথেই কক্ষের চারদিক ভ*য়ানক অন্ধকারে ঢেকে গেল।
‘ আয়েশীর পিছু কেন নিয়েছিলি? ‘
অন্ধকারে ধ্রুবর মুখ দেখা যাচ্ছে না। এমনকি রাকিব নিজেই নিজের অঙ্গ প্রতঙ্গ দেখতে পারছে না।
হঠাৎ এক ছটাক আলো রাকিবের চোখে এসে পড়ল। রাকিব চোখ খিঁচে নিল। সঙ্গেসঙ্গে নিজের পায়ে ইলকেট্রিক শ*কের মত কিছু একটা অনুভব হলো। রাকিব গগণবিদারি আ*র্তনাদ করে উঠল,
‘ আল্লাহ গো….’
ধ্রুব ইলকেট্রিক তার সরিয়ে নিল। ঘর পুনরায় অন্ধকারে ঢেকে গেল। রাকিব গা কাঁপিয়ে কান্না করছে। পায়ের ত্বক গলে গেছে বোধহয়। ধ্রুব চেঁচিয়ে বললো,
‘ বল, শালা। আয়েশীর পিছু কেন নিয়েছিলি? ‘
রাকিব কাঁপতে লাগল। পাগলের মত মাথা নাড়িয়ে বললো,
‘ আমি আর পিছু নিমু না ওর। ছাইড়া দেন আমারে। দোহাই লাগে আপনার। ছাইড়া দেন আমারে। ‘
ধ্রুবর হাসল। রাকিব স্পষ্ট শুনতে পেল সেই হাসি। সেই একই ভ*য়ংকর, গা ছমছমে হাস। রাকিব ভয়ে দেয়ালের সাথে মিশে যেতে চাইল। ধ্রুব বললো,
‘ এই ধ্রুব না কখনো কাউকে সরি বলেছে, আর না কখনো কাউকে সরি বলার সুযোগ দিয়েছে। আচ্ছা যা তোকে একটা সুযোগ দিলাম। একদিনের জন্য দয়ার সাগর হয়ে গেলাম নাহয়। এখন পারফেক্টলি সরি বলে দেখা। ‘
‘ কি, কি করতে হবে আমায়? ‘
ধ্রুব আচমকা গলা টি*পে ধরল রাকিবের। রাকিব শ্বাস নিতে পারছে না। খুকখুক করে কেশে উঠল সে। ধ্রুব রাকিবের গলায় নিজের ধা*রালো নখ বসিয়ে দিল। দু ফোঁটা র*ক্ত ধ্রুবের নখের ডগায় লেগে গেল। রাকিব চিৎকার করে যাচ্ছে। ধ্রুব রাকিবের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ তোর তাজা তাজা র*ক্ত উপহার চাই আমার। দিবি? ‘
রাকিবের গলা বেয়ে র*ক্ত গড়াচ্ছে। ধ্রুব এবার রাকিবকে ছেড়ে দিল। রাকিব গলায় হাত চেপে ধরে পাগলের মত চিৎকার করতে লাগল। রাকিবের চিৎকার কানে আসতেই ধ্রুব মনেমনে ভীষন সুখ অনুভব করল। সে মুচকি হেসে রাকিবকে বলল,
‘ আরো চেঁচা। এমন করে চেঁচা, যেন তোর পা*পী আত্মা অব্দি মৃত্যু ভয়ে থরথর করে কাঁপে। চেঁচা, বেশি করে চেঁচা। ‘
অতঃপর ধ্রুব একজনকে ডেকে আনে। রাকিবের দেহ টেনে গার্ডেনে নিয়ে আসতে বলে ধ্রুব সেই কক্ষ থেকে চলে যায়।
বিশাল বড় একটি বাগান। বাগানের একপাশে একটা বিশালাকার খাঁচা। খাঁচার মধ্যে দুটি বিদেশী বাঘ। বাঘদের দেখে মনে হচ্ছে কত দিনের ক্ষুধার্ত তারা। ধ্রুব খাঁচার দরজা খুলে দেয়। বাঘগুলো দৌঁড়ে এসে ধ্রুবের গলায় আদুরে ভঙ্গিতে মুখ ঘষে। ধ্রুব ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘ তোদের জন্যে খাবার এনেছি। খাবি? ‘
বাঘগুলো খাবারের কথা শুনে হিং*স্র হয়ে উঠে। মুখ দিয়ে ভয়ংকর গর্জন করে উঠে। ধ্রুব হাসে। রাকিবকে ধরে একটানে ফেলে দেয় ক্ষুধার্ত বাঘদের খাঁচার ভেতর। অতঃপর খাচা বন্ধ করে দেয়। বহুদিন জ্যান্ত মানুষের মাংস না খেতে পেরে বাঘেরা বেশ উগ্র হয়েই ছিল। চোখের সামনে জলজ্যান্ত মানুষের মাংসের দলা দেখতে পেয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে রাকিবের উপর। এরপর শুধু রাকিবের একটি চিৎকার শোনা যায়। তারপর-ই সব কেমন যেন নিস্তব্দ হয়ে গেল। পাঁচ মিনিটের মাথায় রাকিবের শুধু র*ক্তে মাখা হাড্ডি পড়ে রইল খাচার ভেতর। বহুদিন পর মানুষের মাংস খেতে পেয়ে, বাঘেরা সুখী সুখী ঢেঁকুর তুলতে লাগল। রাকিবকে প্রচন্ড তৃপ্তি নিয়েই খুবলে খুবলে খেয়েছে তারা। ধ্রুব এতক্ষণ বুকের উপর হাত ভাঁজ করে তার প্রিয় পোষা বাঘদের খাওয়া দেখছিল। খাওয়া শেষ হলে, ধ্রুব খাঁচাটা পরিষ্কার করার কথা বলে নিজের কক্ষে চলে যায়। ওসমান এখনো হতবম্ব চোখে চেয়ে রইলো খাঁচার মধ্যে পড়ে থাকা রাকিবের র*ক্তা*ক্ত হাড্ডির পানে!
#মৃত_কাঠগোলাপ- ৬
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
ধ্রুবর হাতে একটি আধখাওয়া সিগারেট। ধ্রুব সিগারেটের ডগা মুখে পুড়ে নিয়ে সুখী সুখী ধোঁয়া ছাড়ছে। তার সামনে সোফা সংলগ্ন টেবিলের উপর পড়ে আছে মৃদুল ও আয়েশীর বিয়ের কার্ড। একটু আগে মৃদুল নিজে এসে দিয়ে গেছে। ধ্রুবকে বারবার করে বলে গেছে বিয়েতে আসার জন্যে। ধ্রুব না এলে নাকি মৃদুল বিয়ের পিঁড়িতেই বসবে না। ধ্রুবর জন্যেই তো সে আয়েশীকে বিয়ে করতে পারছে। তাই মৃদুল ধ্রুবকে কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুললো না। মধ্যবিত্ত লোকেদের এই এক সমস্যা। তারা নিজেদের আত্মসম্মানবোধের রাজা মনে করে। যে তাকে এক টাকা দিয়ে বিপদে সাহায্য করে, মধ্যবিত্তরা তার জন্যে প্রাণ দিতেও কুণ্ঠিত হয়না। বড্ড বোকা তারা। পৃথিবীতে এমন ভালো মানুষের দাম কোথায়? তাই তো তারা সবার কাছে লাঞ্ছিত হয়ে থেকে যায়। মাথা তুলে দাঁড়াবার বোধটুকু অব্দি পায়না।
ধ্রুব সিগারেট মুখে পুড়ে আড়চোখে মৃদুলের বিয়ের কার্ডের দিকে চেয়ে থাকলো। কিছু একটা চিন্তা করছে মনে হলো। ওসমান ধ্রুবর পাশে দাড়িয়ে রইলো! আয়েশী বিয়ে করছে অথচ ধ্রুব এখনো নির্বিকার হয়ে বসে রয়েছে। বলা হয়, ঝড় আসার আগে পরিবেশ নাকি বরফের ন্যায় শীতল হয়ে যায়। তারপর..এক ধ্বংসাত্মক ঝড়ে লন্ডভন্ড করে দেয় সেই পরিবেশ। ধ্রুব, সে তো এক আপাদমস্তক ঝড়ের নাম। যার এক থাবা-ই যথেষ্ট চারপাশ ধ্বংস করে দিতে। তাহলে কি ধ্রুবর এক নিশ্চুপতা কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস। ওসমান ভয়ে কেঁপে উঠল। ধ্রুব পায়ের উপর পা তুলে বসল। হাতের সিগারেট অ্যাশ ট্রে তে ফেলে পিষে ফেলল। নতুন আরেকটি সিগারেট ধরিয়ে ওসমানের উদ্দেশ্যে বললো,
‘ কি ব্যাপার, ওসমান? তোমার পা কাঁপছে কেন? ভয় পাচ্ছো নাকি? ভয় পেও না। তুমি হলে আমার পাপ সম্রাজ্যের ডান হাত। যতক্ষন না তুমি আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছ, তোমায় আমি মারবো না। এতটাও অকৃতজ্ঞ না আমি। হা হা হা। ‘
ধ্রুব গা দুলিয়ে হাসল। হাসিমাখা মুখে কি যে সুন্দর লাগলো তাকে!
ধ্রুব ভীষন সুন্দর মুখের এক তরুণ। ঈষৎ হলদেটে মুখখানি, সরু দু নয়ন, তামাটে বলিষ্ট দেহ! সবমিলিয়ে এক অতীব সুদর্শন পুরুষ। তার হাসিখানা যেন সমুদ্রের ন্যায় শীতল অথচ গভীর। সে হাসলে, তার থুতনিতে ছোট্ট একটা গর্ত পড়ে। ভীষন সুন্দর লাগে তখন! ওসমান মাঝেমধ্যে ভাবে, ধ্রুব যদি মেয়ে হত তবে তার পেছনে ছেলের অভাব হতো না।
কিন্তু যেমন সুন্দর তার বাহ্যিক দেহ, ঠিক তেমন-ই কুৎসিত তার মনের ভেতর। যে একবার ধ্রুবর ফাঁদে পা দেয়, সে-ই ফেঁসে যায়।
ধ্রুব হাত বাড়িয়ে বিয়ের কার্ড নিল। কার্ডটি খুলে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে চোখ বুলালো লাল-হলুদ কারুকাজ করা বিয়ের কার্ডটিতে। ধ্রুব কার্ডে চোখ রেখে বলল,
‘ তোমার ভাবিকে কখনো দেখেছ, ওসমান? ‘
ওসমান বুঝল, ধ্রুব আয়েশীর কথা বলছে। ওসমান মাথা নাড়ালো। বললো,
‘ দেখেছি, স্যার। ‘
ধ্রুবর নজর কঠিন হয়ে এল। কার্ড থেকে চোখ সরিয়ে ওসমানের দিকে চেয়ে বলল,
‘ একবার দেখেছ, তাই মাফ করে দিলাম। পরবর্তীতে তার দিকে চোখ তুলে তাকাবে না, ওসমান। নাহলে তোমার সেই দুঃসাহসী চোখ আমি ছুরি দিয়ে উপড়ে দেবো। ‘
ভয় পেয়ে ওসমান তাৎক্ষণিক নিজের চোখে হাত দিল। এই বয়সে আর অন্ধ হওয়ার শখ নেই তার। ওসমান মাথা নত করল। বলল,
‘ দুঃখিত, আর হবে না স্যার। ‘
‘ গুড। ‘
ধ্রুব কার্ড আবার টেবিলে রেখে দিল। ওসমানের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল,
‘ বিয়েটা যেন কবে, ওসমান? ‘
‘ স্যার, এ মাসের দুই তারিখ। ‘
ধ্রুব কেমন করে যেন হাসল। ওসমানের মনে হলো, এ হাসি কোনো সাধারণ কোনো হাসি নয়। ধ্রুব আরো একটা সিগারেট ধরালো। দু আঙুলের মাথায় একসাথে দুই সিগারেট মুখে পুড়ে নাক মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লো। সিগারেটের ধোঁয়ায় সম্পূর্ণ কক্ষ ধূসর রঙে ছেয়ে গেল। ধ্রুব বলল,
‘ তৈরি হও, ওসমান। এ মাসের দুই তারিখ আমার ঘরে এক টুকটুকে বউ আসবে। আমার রক্তজবা আসবে। তৈরি হও। অভিশপ্ত বাড়ি পুনরায় ফুল দিয়ে সাজিয়ে তুলো। সকল পাপ মোচন করো। সে আসছে। আমার রক্তজবা আসছে। হা হা হা! ‘
ধ্রুব পাগলের মত হাসছে। তার হাসির শব্দে ওসমানের গায়ের লোম সোজা হয়ে যাচ্ছে। কি বিদঘুটে হাসি! ওসমান হতবম্ব চোখে চেয়ে রইলো ধ্রুবর দিকে।
__________________________
আজ আয়েশীর হলুদ সন্ধ্যা! সকাল থেকেই ঘরের মেয়েরা ব্যস্ত কাজ কর্মে। পুরুষেরা ব্যস্ত বাজার করতে। বাড়ীর সবচেয়ে আদুরে মেয়ের হলুদ বলে কথা! আয়েশীর বাবা কামরুল হাসান মেয়ের বিয়েতে এতটুকু ত্রুটি রাখতে চান না। মহা ধুমধামে মেয়ের বিয়ে হবে! মেয়ে আলতা রাঙা পায়ে পা রাখবে তার শ্বশুরবাড়িতে। গা ভর্তি গয়না থাকবে, পরনে ভারী জামদানি শাড়ি থাকবে, হাত পা রাঙানো থাকবে মেহেদীর লাল রঙে। মেয়ে তাদের রাজরানী হয়ে বাড়ি ছাড়বে। কামরুল হাসান একবার এদিক যাচ্ছেন, আরেকবার ওদিক যাচ্ছেন। কাজের শেষ নেই তার। কাজের চাপে কখন যে প্রেশার কমে গেল বুঝতেই পারলেন না তিনি। ফুলের ঢালা নিয়ে মেয়ের কক্ষের দিকে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ মাথাটা কেমন যেন ঘুরে উঠল। সঙ্গেসঙ্গে তিনি হাত দিয়ে চেপে ধরলেন পাশে থাকা পিলারটি। এত এত কাজের চাপে আজকে প্রেশারের ঔষুধ খাওয়া হয়নি। কামরুল হাসান সময় দিলেন নিজেকে। মাথাটা ঠিক হতেই পিলার ছেড়ে সামনে এগুতে চাইলেন। কিন্তু আবার চক্কর দিয়ে উঠলো মাথা। কামরুল হাসানের হাত থেকে ঢালা পড়ে গেল। মাথা ঘুরিয়ে মাটিতে পড়ে যেতে গেলে, হঠাৎ কোথা হতে আয়েশীর মা মনোয়ারা বেগম হন্তদন্ত হয়ে ধরে ফেললেন স্বামীকে। কামরুল হাসান স্ত্রীর গায়ে ঢলে পড়ে জ্ঞান হারালেন। মনোয়ারা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লেন। হাকঢাক করে ডেকে আনলেন কিছু মানুষকে। অতঃপর কামরুল হাসানকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো তার ঘরে।
বিছানায় শোয়ানোর কয়েক মুহূর্ত পর জ্ঞান এল কামরুলের। তিনি চোখ খুলে তাকালেন। আশপাশ পরখ করে ক্লান্ত কণ্ঠে বললেন,
‘ আমার মা-টা কোথায়, মনোয়ারা? ‘
মনোয়ারা স্বামীর পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। স্বামীর প্রশ্ন শুনে তিনি শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বললেন,
‘ আয়েশী সাজছে। ওই পার্লারের মেয়েগুলো এলো না? ওদের কাছেই আছে। ডেকে আনবো? ‘
কামরুল মানা করলেন। বললেন,
‘ না, না। থাক, সাজুক। আজ কত বিশেষ দিন আমার মা-টার। এই দিনে তার মন খারাপ করতে নেই। থাকুক! ডেকে এনো না। আমি ঠিক আছি। ‘
মনোয়ারা ঔষুধের বাক্স বের করলেন। প্রেশারের ঔষুধ বের করে স্বামীর দিয়ে এগিয়ে বললেন,
‘ তুমি আজও প্রেসারের ঔষুধ খাও নি, না? কতবার বলব, নিজের খেয়াল রাখতে শেখো। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমাদের কি হবে? কোথায় যাবো আমরা? সে নিয়ে কখনো ভেবেছো? নিজের মর্জি আর কত? ‘
মনোয়ারা কথা বলতে বলতে কেঁদে উঠলেন। কামরুল স্ত্রীর চোখ মুছে বললেন,
‘ আহা, কাঁদো কেন? আমি ঠিক আছি। দাও, ঔষধটা দাও। অনেক কাজ পড়ে আছে। ‘
মনোয়ারা পানির গ্লাসসহ ঔষধ স্বামীর হাতে দিলেন। কামরুল ঔষধ খেয়ে বিছানা থেকে উঠে যেতে চাইলে মনোয়ারা বাঁধা দেন। জোরপূর্বক স্বামীকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলেন,
‘ কোনো কাজ না এখন। শুয়ে থাকো তুমি। কাজ করে করেই শরীরের আজ এই অবস্থা। তুমি ঘুমাও, আমি সব দেখে নেবো। সাবধান, বিছানা ছেড়ে উঠবে না। বুঝেছ? ‘
স্ত্রীর কথা শুনে কামরুল চুপটি করে মিশে রইলেন বিছানায়। মনোয়ারা কক্ষের বাতি নিভিয়ে চলে গেলেন কাজে। স্ত্রী চলে যেতেই কামরুল হাসান বিছানা ছেড়ে উঠে গেলেন। এখন ঘুমালে কি চলে? বিয়ে বাড়ীতে কত কাজ। মনোয়ারা একা কতদিক সামলাবে?
মনোয়ারা রান্নার দিকটা দেখছিলেন। খানিক পর রান্নাঘর থেকে চোখ গেল ড্রয়িং রুমের দিকে। কামরুল হাসান বাইরে থেকে এসেছেন। হাতে মিষ্টির প্যাকেট। এসে হাক ডাকছেন,
‘ আয়েশীর মা, ও আয়েশীর মা! মিষ্টিগুলো কোথায় রাখব?’
মনোয়ারা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মানুষটা যে কবে বুঝতে শিখবে!
#চলবে