মেঘদিঘির পাড়ে – ২৬
মালিহা খান
নীহারিকা কাটিয়ে পূর্বাকাশে নতুন সূর্যের আলতারঙা সুপ্রভা ছড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করেছে মাত্র। বিভার ঘুম হাল্কা হলো। চোখ মেলে সেকেন্ডকয়েক কিছুই বোধগম্য হলোনা। অন্ধকার ঘরে প্রত্যুষের মায়াআলো ঢুকে পড়ছে।
বিভার টনক নড়লো। মাথার নিচে নরম বালিশের অস্তিত্ব টের পেতেই ধরফড়িয়ে উঠে বসলো সে। ইউসুফ কোথায়? তার কাছেই না ঘুমিয়েছিলো? সরিয়ে দিয়েছে?
সব কেমন ঝাপসাটে লাগছে। ঠান্ডায় গলা বসে গেছে। দু’হাতে মাথা চেপে ধরে কপাল কুঁচকালো বিভা। একটুপরেই বুঝতে পারলো এটা তার ঘর। পরণে কালরাতের কালো জামাটা। গায়ে লেপ টেনে দেয়া ছিলো। মন ধাতস্থ হলো কিছুটা। ইউসুফ শুইয়ে দিয়ে গিয়েছে হয়তো। মিনিটদশেক সেভাবেই বসে রইলো সে। তারপর একটু একটু করে নেমে দাড়ালো। পড়ার টেবিলের এককোণে বিষাদরঙা কাঁচের চুড়িগুলো রেখে দেয়া। আচ্ছা? বিষাদের রং কি কালো? বিভা আচমকা ডুঁকরে উঠে। খন্ডিত বিখন্ডিত মনে চুড়িগুলো হাতে তুলে নিলো।
সেদিনের পর দুরন্ত ছটফটে বিভা অস্বাভাবিক রকমের চুপচাপ হয়ে গেলো। দিনরাত চব্বিশঘন্টা তাকে আর সারাবাড়ি অকাজ করে বেড়াতে দেখা গেলোনা। অবিশ্রান্ত উড়তে থাকা ছোট্ট প্রজাপতির রঙিন ডানাদুটোয় হঠাৎ অসুখ করলো যেনো। ক্রমশ বেরঙে হতে শুরু করলো তারা। একসময় ফিকে, পানসে হয়ে উড়া বন্ধ করে দিলো।
দিন গড়ালো বিভার চোখের মলিনতা গাঢ় থেকে গাঢ়বর্ণ ধারণ করলো।
৪৯.
বাড়িতে মরিচবাতি ঝোলানো হচ্ছে। কর্মরত লোকের হাঁকডাকে সুপ্রভাতের নিস্তব্ধতা হাওয়ায় উবে গেছে। উঠোন থেকে ইউসুফের চড়া গলা ভেসে আসছে তখন থেকে। সে সটান দাড়িয়ে দাড়িয়ে দিকনির্দেশনা দিচ্ছে।
ঘুম থেকে উঠে গায়ে হাল্কা বেগুনী রঙের শাল জড়িয়ে উঠোনে এসে দাড়ালো ইভা। শালটা ভীষণ সুন্দর। হাল্কা বেগুনি মসৃণ জমিনে গাঢ় বেগুনী সুতোর কাজ।
একটু এগোতেই পেলব রুর্যকিরণ ঘন আঁখিপল্লব স্পর্শ করলো, চোখ বুজে এলো ইভার। চোখের পাতা পিটপিট করতে করতে ইউসুফের পাশে গিয়ে দাড়ালো। ইউসুফ একনজর ফিরে তাকালো। ইভার গায়ের মোটা শাল লক্ষ্য করে হেসে ফেললো।
-“এই রোদের মধ্যেও তোর ঠান্ডা লাগছে রে ইভা!”
ইভা প্রায়বন্ধ চোখদুটো মেলার চেষ্টা করে ইউসুফের দিকে চাইলো। সফল হলোনা।
ইউসুফ অবস্থান বদলিয়ে তাকে আড়াল করে দাড়ায়। এবার সক্ষম হয় ইভা। চোখের উপর ছায়া পড়ে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ দাড়িয়ে থেকে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো সে। ফিসফিস করে ডাকলো,
-“ইউসুফ ভাই?”
ইউসুফ তাকাল। ইভার ডাকার ভঙ্গি দেখে মনে হলো সে খুব দুর্জ্ঞেয় গোপন কিছু বলবে। চোখের ভাষা ছুড়ির মতো ধারালো ঠেকছে। ইউসুফ কপালে ভাঁজ ফেলে একটু ঝুঁকে গেলো। ইভার মতোই ফিসফিসিয়ে বললো,”বল, জরুরি কিছু?”
ইভার ঢোক গিলে গলা ভেজায়। আশেপাশে দেখে নেয়। চোখভর্তি প্রখর সংশয়ের মিছিল বসিয়ে পূর্বের ন্যায় ফিসফিস করেই জিজ্ঞেস করে,
-“আপনি আপার সাথে কি করেছেন বলেনতো, আপা আজকাল এতো চুপচাপ থাকে কেনো?”
ইউসুফের কর্ণকুহর কাঁপলো। ভ্রুকুন্চন মিলিয়ে গেলো চট করে। চোখমুখে অদ্ভুত শিথিলতা। দৃষ্টি সরাতে সরাতে আলগোছে সে উওর দিলো,”আমি কি করবো?”
উওর দিয়ে একবার বাড়ির ভেতরে তাকালো ইউসুফ। বিভা খাবার টেবিলে বসে আছে। সামনে প্লেট রাখা তবে সে খাচ্ছেনা। নাড়াচাড়া করছে। ইউসুফ চোখ সরিয়ে নেয়।
ইভা ভ্রু কুঁচকালো। ইউসুফের উওরটা কিয়ৎপরিমানও পছন্দ হয়নি তার। মনমরা হয়ে বললো,
-“আপনিই কিছু করছেন ইউসুফ ভাই। এইতো আপা যেদিন মেলা থেকে আসলো। তারপর থেকেই তো আর কথা বলেনা। প্রশ্ন করলে হু হা জবাব দেয় শুধু।”ইভার চোখ মন খারাপে উপচে ওঠে।
তার কথার মাঝেই বাড়ির পিছন দিক থেকে দৌড়ে এলো বাহাদুর। ইউসুফ চটজলদি হাত বাড়িয়ে দিতেই ধুপ করে কোলে উঠে পড়লো। বিস্তর হেসে বাড়ির দিকে চেয়ে কৌতুহলী কন্ঠে বললো,
-“বাড়িতে রশি লাগাচ্ছে কেনো?”
ইউসুফ হাসলো। ইভাকে দেখে নিয়ে উওর দিলো,”বুবুর বিয়ে যে। এগুলোতে রাতভর আলো জ্বলবে।”
ইভার লাল মুখ চমকে আরো লাল হয়। সে দ্রুত প্রস্থান করতে চায়। আবার ধুম করে চলে গেলে ইউসুফ কি ভাববে ভেবে চুপ করে দাড়িয়ে থাকে। বাহাদুরের প্রশ্নের অন্ত নেই। ইউসুফ উওর দিতে দিতে কাহিল। একটুপর নামিয়ে দেয়। বাহাদুর আবার দৌড় লাগায়।
ইভা দ্রুত বলে,
-“আপনি উওর দেননি ইউসুফ ভাই।”
ইউসুফ স্মিত হাসলো। ইভার প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বললো,”সায়ন আসবে আজকে। একটু বের হোস ঘর থেকে। ও তো আমাদের দেখতে আসেনা, তোকে দেখতেই আসে।”
ইভা এতক্ষণ চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। সায়নের প্রসঙ্গ আসতেই তার মাথা নুঁয়ে পড়লো। ইউসুফ হাসলো। মৃদুস্বরে বললো,
-“রোদে গা পোড়াচ্ছিস কেনো? ভেতরে যা। দেখে তো মনে হচ্ছে গাল নাক কেটে রক্ত বের করে দিয়েছে কেউ।”
৫০.
দুপুরের রোদ আদিপত্য বাড়িয়েছে। ধূসর গাড়িটা গতি কমিয়ে সদরদরজা পেরিয়ে ঢুকে পড়লো। স্টেয়ারিং থেকে হাত নামাতে নামাতেই পিপাসিত নয়নে বিশাল বারান্দায় পানে তাকালো সায়ন। মরিচবাতির তাঁর ছাড়া সেখানে আর কাকপক্ষীটিও নজরে এলো না। সায়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ নামালো। লিথিশা মিটিমিটি হেসে বললেন,”তুই দেখি বড্ড অধৈর্য রে! বেচারী বউ মানুষ, লাজ লজ্জা ফেলে তোর জন্য বারান্দায় দাড়িয়ে থাকবে নাকি রে!”
সায়ন আড়চোখে তাকালো। অত:পর হেসে ফেললো।
সারাবাড়ির মানুষ ব্যস্ত হয়ে পড়লেও ইভার দেখা মিলালোনা। মাঝখানে একঝলক সালাম দিয়েই সে উপরে চলে গেছে।
সবার সাথে কথায় কথায় সায়ন খেয়াল করে দেখতেও পারেনি মেয়েটাকে। কি যন্ত্রনা!
কাবিনের ডালা-টালা বাদবাকি সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে লিথিশা। ঘর ভরে গেছে।
__________
জামরঙা কামিজ গায়ে গোসল থেকে বেরিয়ে এলো ইভা। পিঠের ফিতেটাও বাঁধা হয়নি। তোয়ালে দিয়ে চুল ঝেড়ে, হাত উঠিয়ে পিঠের ফিতে বাঁধতে বাঁধতে হঠাৎই চোখ পড়লো পড়ার টেবিলের উপর। ড্রয়ারটা খোলা। সে তো খুলে রেখে যায়নি। তবে?
ড্রয়ার বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো ইভা। বাহাদুর খুলে রেখেছে হয়তো।
কামিজের সাথে মিলানো কারুকাজ করা একইরঙের ওড়নাটা বিছানার উপর রাখা ছিলো। পিঠের ফিতে বেঁধে, কোনরকমে ভেজা চুল গুছিয়ে বেখেয়ালিভাবে বিছানার ওড়না টান দিতেই মৃদু শব্দ তুলে কলমটা ছিঁটকে পড়লো মেঝেতে। ইভা চমকে উঠলো।কি হলো? একটা সাদা কাগজ খসে পড়েছে পায়ের কাছে।
ভ্রু কুঁচকালো ইভা। উবু হয়ে তুলে নিলো হাতে। তারই পড়ার খাতার একটা এবড়োথেবড়ো ছেঁড়া পৃষ্ঠা। ইভা দ্রুত বিছানায় তাকাল। সবুজ মলাটের খাতাটা ভীষণ অযত্নে পাশেই ফেলে রাখা।
ইভা স্তব্দ, বিমূঢ় হয়ে পড়লো।
ভীষণ তাড়াহুঁড়ো হাতের লেখায় সেখানে দু’টো লাইন লেখা হয়েছে,
-“আমার হাত পায়ের পশম কি বেশি বড় হয়ে গেছে ইভা বিনতে নেওয়াজ? বাঘ ভাল্লুক মনে হয় দেখে?”
ইভা থমকালো। হাসি পেলো খুব।
কাঁপাহাতে কাগজ উল্টাতেই হাসি মিলিয়ে গেলো তার। হাত-পা ক্রমশ অনায়ত্ত, অবশ হয়ে এলো। বিকট লজ্জায় কানের লতি রক্তবর্ণ ধারণ করলো।
কালো কালির সদ্যলেখা অক্ষরগুলোতে নিষ্পলক চেয়ে রইলো সে।
“অনেক হয়েছে অপেক্ষাময়ী। আর পারছিনা বিশ্বাস করো! ব্যস্ত শহরের ইটপাথরে আমার শ্বাসরুদ্ধ হয় রুপবতী।
এবার এসো, নতুবা নিশ্চিত মৃত্যু ঘটবে।”
~চলবে~মেঘদিঘির পাড়ে – ২৭
মালিহা খান
সামান্য মুক্লপৃষ্ঠায় লিখে রাখা শব্দ অন্ত:স্হল অবধি দামামা তুলে দিলো। উপেক্ষা করা সম্ভবপর হলোনা। দূর্বলহাতে কাগজটা ভাঁজ করে টেবিলের বইয়ের তাঁকের মাঝে ঢুকিয়ে রাখলো ইভা। অত:পর লাজ ছাঁপিয়ে কপালের সীমান্ত পর্যন্ত ওড়না টেনে চুপচাপ নিচে নেমে গেলো।
সিঁড়ির মাঝামাঝি আসতেই ইউসুফ সমাদরে ডাক দিলো তাকে,”ইভা? এদিক আয়।”
ইভার অস্বস্তি উপশম হলো। শ্বেতসরোজতূল্য পবিত্র মুখখানি নত করে এগিয়ে গেলো সে। কোথায় বসবে বোঝার আগেই ইউসুফ হাত টেনে নিজের পাশে বসিয়ে দিলো। ভাইয়ের কর্মকান্ডের কারণটা গুনেগুনে সেকেন্ডখানেক পরেই ধরতে পারলো ইভা। সে যেখানে বসেছে তার ঠিক মুখোমুখি সোফাটায় বসে অধৈর্য, অস্থির লোকটা বসা। না তাকিয়েও বোঝা গেলো সমস্ত অভিনিবেশ তার উপরই ঘোরাফেরা করছে। আপাদমস্তক, সর্বাঙ্গে। ইভার গলা শুকিয়ে এলো। পারিবারিক আলাপে মন বসলো না। বারেবারে ঢোক গিলে অন্যদিকে চেয়ে রইলো সে। মনে মনে সহস্রাধিকবার ইউসুফকে শাসাতে ভুললোনা একমূহুর্তের জন্য।
খাবার টেবিলেজুড়ে তেজি রোদের ছ’টা আসছে। দুপুরে গ্রীষ্ম অথচ সন্ধ্যা নামতেই মোটাকাপড় ছাড়া বেরোনো যায়না। ইউসুফ, সরফরাজের মাঝের চেয়ারটায় বসেছে ইভা। কোলে বাহাদুর। বিভাও এসেছে টেবিলে, সরফরাজের অপরপাশে যেয়ে বসেছে। তার ম্রিয়মান মুখমন্ডলে একটা ছদ্ববেশী ক্ষীণ হাসি শোভা পাচ্ছে।
সায়নের পরণে কালো হাফহাতা টি-শার্ট। উপরে একটা ফুলহাতা সাদাশার্ট ছিলো গরম লাগায় সেটা খুলে রেখেছে।
হাফহাতা টি-শার্ট গায়ের সাথে সেঁটে আছে। বা-হাতের কঁনুইয়ের কাছে কাঁচঢোঁকা ক্ষতটা ভরে গেলেও গাঢ় দাগের চিন্হ রয়ে গেছে। ফর্সা হাতে মাসকয়েক পুরনো ক্ষতটা এখনো স্পষ্ট। সরফরাজ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
-“তোমার হাত কেটেছিলো কিকরে সায়ন? এভাবে!”তার কন্ঠে বিহ্বলতা ঝরে পড়ছে।
উপস্থিত সবার চোখ যেয়ে আটকালো সায়নের হাতে। ইভা থতমত খেয়ে চোখ তুলল। সেই দূর্ধর্ষ প্রণয়প্রতুষ্যের স্বৃতিচারণ হতেই নিমীলিত হয়ে গেলো সে। সায়ন ক্ষতটায় চোখ বুলালো একবার। সেই আঘাত, তার আঘাতে ইভার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া জল, ভাইয়ের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ঘন্টাদেড়েক ঘরে আটকে রাখা আধপাগল ভীতু মেয়েটার কান্ড সবটাই মনে পড়লো। ভীতু মেয়েটা এখনো ভয় পাচ্ছে। ছম্ছমে ভয়ার্ত চোখে তার দিকে চেয়ে আছে। সায়ন একনজর চোখে চোখ রাখলো। মনোহারিনী মুখটা কি ভীতু দেখাচ্ছে। সে তাকাতে আরো চুপসে গেলো।
সায়ন চোখ সরিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
-“বাইক আ্যক্সিডেন্ট ভাইয়া। ভয়াবহ দূর্ঘটনা। ভোরবেলা হয়েছিলো। এইতো ক’দিন আগেই। শখের বসে মাঝেমধ্য চালাইতো।”
সরফরাজ আফসোস করলো। ইভা ততক্ষণে মুখনত করেছে। কি অবলীলায় বানিয়ে বলে দিলো লোকটা। হাহ্!
৫১.
বিভার অস্বাভাবিক মৌনতা বেশ ভাবাচ্ছে তন্দ্রাকে। চিন্তা হচ্ছে খুব। মেয়েটার ঘরে গেলেই দেখে হয় ঘুমিয়ে আছে নয়তো শুয়ে শুয়ে চোখ মেলে রেখেছে। সে গেলে আগে কতো কথা বলতো, বাচ্চাটাকে নিয়ে তার কতো ভাবনা। সপ্তাহখানেক ধরে ঘর থেকে বেরই হয়না তেমন। সে নিজ থেকে গেলে,”ভালো আছো ভাবি? শরীর ভালো?” জিজ্ঞেস করেই চুপ হয়ে যায়। তাছাড়া আরো কিছু সে লক্ষ্য করেছে। ভাবনাটা সেখানেই প্রখররূপ ধারণ করছে।
সরফরাজ পান্জাবি খুলে রেখে বাথরুমে গেছে। বাইরে সন্ধ্যা গড়িয়েছে। অন্ধকার তমসাচ্ছন্ন সন্ধ্যা। কিন্তু বাইরে অন্ধকার নেই। বাড়িতে মরিচবাতির সোনালী আলো জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে।
তন্দ্রা আচ্ছন্ন হয়ে ভাবতে ভাবতে পান্জাবি ভাঁজ করছে।
মুখ ধুয়ে বেড়িয়ে এলো সরফরাজ। তন্দ্রা তোয়ালে এগিয়ে দিয়ে বিছানায় বসলো। মুখ ধুঁতে গিয়ে গলা, কাঁধ ভিজিয়ে ফেলেছে সরফরাজ। গমরঙা ত্বকের পানির ছিঁটেফোটা মুছে নিচ্ছিলো সে। তন্দ্রা হঠাৎই বললো,”ইভার বিয়ে তো দিয়ে দিচ্ছেন, বিভা ইউসুফের কথা ভেবেছেন?”
সরফরাজ একবার তাকালো। তন্দ্রা উওরের অপেক্ষায় তার দিকেই চেয়ে আছে। মুখ ফিরিয়ে গা মুছতে মুছতে উওর দিলো,
-“ওদের বিয়ে ওদের সময়মতো হবে। তাছাড়া ইভার বিয়ে তো তাড়াতাড়ি হচ্ছে। ওকে আমি কখনোই এই ছোট বয়সে বিয়ে দিতাম না। নেহাতৎই সায়ন অন্যরকম বলে। আর বিভা…বিভার বিয়ে আরো পরে দিবো। বাড়ি খালি হয়ে যাবে আমার। বাকি ইউসুফ, ও তো ছেলে মানুষ। ওকে তো আর ধরেবেঁধে বিয়ে দিবেনা চাচা-চাচী। যখন ওর মন চাবে তখন করবে।” বলে তোয়ালে রেখে তন্দ্রা মাথায় বারদুয়েক চাপড় মারলো সরফরাজ। নরম হেসে বললো,”বুঝেছো?”
তন্দ্রা আমতাআমতা করলো। ইতস্ততভাবে বললো,
-“আমি আলাদা আলাদা বলিনি। আপনি বড় মানুষ। আপনি কি কিছুই লক্ষ্য করেননি?”
সরফরাজ ভ্রু কুঁচকালো। কয়েকসেকেন্ড বিমূর্ত চেয়ে থেকে হো হো করে হেসে ফেললো। হাসতে হাসতেই বললো,”কিসব বলছো তনু? তুমিওনা! কি যে বলো।”
তন্দ্রা অসহায়ের মতো চেয়ে রইলো। চোখদুটোতে রাজ্যসম চিন্তা।
~চলবে~মেঘদিঘির পাড়ে – ২৭
মালিহা খান
(বর্ধিতাংশ)
৫৩.
অলিন্দ ফাঁকা। আলোয় ভেসেছে। বাতি এখনো নিভানো হয়নি। বহুদূর থেকেও বনিয়াদী বাড়ির আড়ম্বরে ঘেরা আলকসজ্জা চোখে বিঁধতে বাধ্য।
ইউসুফ বুকে দু’হাত ভাঁজ করে বারান্দায় দাড়িয়ে আছে। দ্বিগ্বিদিক ছেড়ে তারাহীন নীলিমায় আবদ্ধ হয়ে আছে তার পুরুষ চোখ। হরিদ্রাভ আলোর মোলায়েম দীপ্তছায়া তার উজ্জ্বলবর্ণ মুখে শোভা পাচ্ছে।
দীর্ঘদেহী মানুষটার লম্বা প্রতিবিম্ব পড়েছে পিছে। ঘড়ির কাঁটা নিষুপ্তিচ্ছন্ন হবার কাঁটায় ঘুর্ণায়মান কিন্তু অক্ষিপাতায় ব্যাকুলতা থাকলে স্বাধ্যি কার?
বিভা তেমন একটা ঘর ছেড়ে বেরোয়না। বাইরে ঘোরাফেরা অতিমাত্রায় কমে গিয়েছে। আকাশ দেখা হয়না। মন খারাপও হয়না। কান্নাও পায়না। শূন্য শূন্য লাগে কেবল।
জানলার পাল্লা খুলে দিলো বিভা। জানলার শিক থেকে একহাত দূরেই মরিচবাতি জ্বলছে। বোনটার বিয়ে। শেষ দু’বছর আগে সরফরাজ ভাইয়ের বিয়েতে এভাবে সাজানো হয়েছিলো। তখন কি আগ্রহ ছিলো তার।
ভাইয়ের সাথে দাড়িয়ে দাড়িয়ে ফুললাগানো, বাড়িসাজানো দেখতো। বিভা হাত বাড়িয়ে একটু ছুঁয়ে দিলো।
বাইরে থেকে বাড়িটা দেখা হয়নি। দেখার জন্য দরজা খুলে বের হলো।
দরজার ছিঁটকিনি খোলার খুটখাট শব্দটা ইউসুফের কানে এলো সহজেই। বিভার ঘরটা ইভার ঘরের পাশেই। এই বারান্দার দিকে তিনটা ঘর। কোঁণার টা সরফরাজের, মাঝের টা ইভার, তারপরেরটা বিভার।
শরীর না ঘুরিয়ে কেবল ঘাড়টা ঘোরালো ইউসুফ। কয়েকমূহুর্ত নিরবতা..অত:পর…বিদীর্ণ হিয়া ঝলসে গেলো।।
ইউসুফের শিরদাড়া বেয়ে প্রবলগতিতে বিদ্যুৎ খেলে গেলো যেনো। চোখ নামিয়ে ধীরগতিতে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে শুকনো ঢোঁক গিললো সে। পা পর্যন্ত গোল সুতির জামা, কোমড় ছাঁপানো লম্বা চুলের গাঢ় শ্যামবর্ণের মেয়েটা। নারীসৌন্দর্য্য এক আশ্চর্য জিনিস। সামান্য বর্ণনায় তা সীমাবদ্ধ করা বিস্ময়কর।
শ্যামবর্ন নিয়ে কতো তুচ্ছাতিতুচ্ছ। তবে এই শ্যামরঙে সে কিকরে এতো মশগুল হলো? হাজার শুভ্রেও যা কাটানো অসম্ভবতূল্য।
বিভা ইউসুফের সামনে আসেনা। হঠাৎ সাক্ষাত হয়ে যাওয়ায় কেমন অপ্রস্তুত হলো। তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে দু’পা পিছিয়ে দরজা আটকে দিতে চাইলো। হলোনা। হাত থেমে গেলো সামান্য প্রশ্নে,
-“এদিক এসো, ঘরে কি করো সারাদিন?”
বিভা তাকাল। ঠোঁট কামড়ে ধরলো। দেখা হওয়াটা উচিত হয়নি। একদম উচিত হয়নি। তবু ইউসুফ ডেকেছে বলে আর পিছালোনা সে। এদিক ওদিক দেখে বেরিয়ে এলো। পায়ে জুতো নেই, পাতায় ঠান্ডা লাগছে।
ইউসুফের থেকে কয়েকবার দুরত্ব বজায় রেখে দাড়ালো সে। বিভার মলিনমুখে তাকানো দায়। শ্যামবর্ণের মেয়েদের ঠোঁট সাধারণত গোলাপী হয়না। বিভার ঠোঁট কালো। শীতে রুক্ষ হয়ে আছে।
ইউসুফ অন্যদিকে চোখ ফিরায়। রুক্ষ কালো ঠোঁটেও কি সর্বগ্রাসা মদ্যপনেশা!
বিভা রেলিংয়ে হাত রেখে নিচের দিকে ঝুঁকে বললো,
-“বেশ সুন্দর সাজিয়েছেন তো।”তার প্রাণহীন কন্ঠে সামান্য হাসি ধরা দিয়েছে তখন।
ইউসুফ মুখ ফিরিয়ে বিভার দিকে তাকায়। তার কষ্ট হয়। আস্তে করে বলে,
-“তুমি এমন চুপচাপ থেকোনা।”
-“কেনো?”
ওপাশ থেকে উওর এলোনা। দারোয়ান চাচা ঝিঁমাচ্ছে। এখান থেকে দেখা যায়। গাছের পাতাও নড়ছেনা।
অনেকক্ষণ পর ইউসুফ বললো,
-“ভালোবাসিতো। তুমি সবসময় শুনতে চাইতে না? এইযে বলছি। ভালোবাসি। কিন্তু পাওয়ার সাহস নেই। এই অধম কে তুমি ক্ষমা করো বিভা। ভালোবাসা পেতে গিয়ে তোমার জীবনটা নরক বানাতে চাই না। আমার জন্য হলেও এমন চুপ করে থেকোনা বিভা।”
বিভার ঠোঁট কাঁপলো। ধীরপায়ে এগিয়ে আস্তে করে ইউসুফের কাছে মিশে গেলো সে। দু’হাতে বাচ্চাদের মতো পিঠ জড়িয়ে ধরে, বুকে মাথা রেখে নিষ্প্রভ কন্ঠে বললো,
-“বিশ্বাস করেন, আপনাকে আমি বেশি ভালোবাসি। আমার মতো করে আপনি কখনো ভালোবাসতে পারবেন না। কোনোদিন পারবেননা। কক্ষণো না।”
৫৪.
ইভা দু’দিকে দু’হাত মেলে বসে আছে। খোলা দরজা দিয়ে ঝলমলে আলো ঢুকে পড়ছে ঘরে। বাইরে উজ্জ্বল বিকেল। জলপাইরঙের কামিজের হাতাটা বাহু পর্যন্ত তোলা। চুলে শক্ত খোঁপা। দু’টো মেয়ে তার দু’পাশে বসে মেহেদি লাগাচ্ছে। মেয়েদুটো গ্রামেরই। কথাবার্তা হয়না যদিও তবে সে চেনে। তন্দ্রা ঘরে ঢোকে। ইভা মেহেদীর দিকে তাকিয়ে ছিলো। তন্দ্রা আসায় তাড়াতাড়ি মুখ তুলে বলে,”ভাবী? আপা কোথায়?”
তন্দ্রা ভ্রু কুঁচকালো। বিভা এখানেও আসেনি? দুপুরে খাবার টেবিলে খেতেও যায়নি মেয়েটা। উপোষ রয়ে আছে। ইভাকে “ডাকছি” বলে সে বেরিয়ে গেলো।
এই বিকেলবেলায় ঘর অন্ধকার করে রেখেছে মেয়েটা। দরজার ছিঁটকিনি নামানো ছিলো। তন্দ্রা টোঁকা না দিয়েই ঢুকলো। বিছানায় কাঁথামুড়ি দিয়ে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে বিভা। ঘুমাচ্ছে নাকি?
তন্দ্রা যেয়ে কপালে হাত রাখলো। সাথেসাথেই চোখ মেলে তাকালো বিভা। হতচকিত হয়ে একটু ভয় পেলো, সে বুঝতে পারেনি ঘরে কেউ এসেছে। কিসব ভাবছিলো। তন্দ্রার মুখ দেখে শান্ত হলো।
-“জেগে জেগে শুয়ে আছিস কেনো? ওঠ, চল আমার সাথে। ইভাকে মেহেদি পড়াচ্ছে। তুই পড়বিনা? আয়।”
বিভা আমতাআমতা করে বললো,”ভাবি শরীর ভালো লাগছেনা। এখন না যাই?”
তন্দ্রা একহাতে কোমড়ের সাইড ধরে ঝুঁকে গেলো। বিভার চুলে আঙুল চালিয়ে বললো,”শরীর খারাপ? আগে বলিসনি কেনো? দুপুরেও খেলিনা। কি হয়েছে?”
তন্দ্রার কষ্ট হচ্ছে দেখে বিভা নিজেই উঠে বসে। চুলে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে বলে,
-“তুমি বসো ভাবি। আমার কিছু হয়নি। মুখটা ধুয়ে আসি তারপর যাচ্ছি।”
তন্দ্রাকে বসিয়ে বালিশের পাশ থেকে চুলের কাঁটাটা খোপায় গুঁজে নিলো বিভা। গায়ের কাঁথা সড়াবে তার আগেই হুট করে তার গালে হাত রাখলো তন্দ্রা। চোখভরে দেখে নরম গলায় বললো,
-“তোর কি হয়েছে সোনা?”
বিভা যেনো ধরা পড়া অপরাধীর মতো থমকালো। মমতামাখা কন্ঠে তার ভেতরটা চুরমার হয়ে গেলো। চোখ নামিয়ে এলোমেলো কন্ঠে বললো,”কিছু হয়নি ভাবি।”চোখে পানি চলে এসেছে।
তন্দ্রা হাত ধরলো। শক্ত করে। বললো,
-“আমাকে বল বিভা। আমি বুঝতে পারছি কিছু একটা হয়েছে। বল।”
এরপর আর পারা গেলোনা। ভীষণ আবেগী মেয়েটা আচমকা খরস্রোতা নদীর মতো জড়িয়ে ধরলো তন্দ্রা। এতদিনের চেপে রাখা কান্নার জোয়ারের মতো আছরে এলো। তন্দ্রার চোখ আতঙ্কিত হয়ে গেলো। মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সে অস্থির হয়ে বললো,
-“কি হয়েছে সোনা?”
৫৫.
হাতভরে মেহেদি দেয়া হয়ে গেছে ইভার। ডানহাতের তালুর দিকে ছোট একটা অংশ ফাঁকা রাখা। ছেলের নাম লিখবে বলে। আঙ্গুলগুলোতে একটু বাকি ছিলো। ততটুকু দিয়ে শেষ করে ইভার দিকে তাকালো সেই হাতে মেহেদী লাগানো মেয়েটা।
বাইরে সন্ধ্যা নেমেছে। খাটের পিছে মাথা ঠেকিয়ে ইভা প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিলো। মেয়েটা আস্তে করে ডাক দিলে সে সজাগ হলো। সোজা হয়ে বসে হাতের দিকে চেয়ে বললো,”শেষ?”
মেয়েটা ইশারায় ‘হ্যাঁ’ জানালো। অত:পর মুচকি হেসে নামটা জিজ্ঞেস করলো। ইভা আমতাআমতা করলো কিছুক্ষণ। শেষমেষ বুজে আসা গলায় মিনমিন করে উওর দিলো,”সায়ন। উনার নাম সায়ন।”
চলবে~
[