#মেঘফুল_ফুটলো_মনে
#লেখনিতে- আবরার আহমেদ শুভ্র
~পর্ব- ০৩
.
– শুনলাম তোর প্রেমিক পুরুষের নাকি বিয়ে হয়েছে তাও আবার তোর ফুফাতো বোনের সাথে? কিরে তানজিম কথাটা কি সত্য?
কলেজে আসা মাত্রই যে এমন কথা শোনবে সে আগে থেকেই জানতো এ ব্যাপারে। তাই সে তার মতো করে প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। কোনোভাবেই নিজেকে অস্বস্তিতে ফেলতে চাইছে না সে। স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলো,
– প্রেমিক পুরুষ মানে ঠিক বুঝতে পারেনি। কে বলা কার বিয়ে হয়েছে তাতেই সে আমার প্রেমিক পুরুষ হয়ে গেলো? আজব!
– তুই বুঝতে পারলি না? আরে আমাদের সিনিয়র ছিলো না তানিম মাহমুদ! ওনি তো তোর বয়ফ্রেন্ডও ছিলো। সেইরকমই শুনছিলাম। তাই তোকে জিজ্ঞেস করলাম।
গলা ধরে এলো তানজিমের। কি উত্তর দেবে এখন সে। তবুও স্বাভাবিকতা অবলম্বন করে উত্তর দিলো,
– কে বলল তোদের এসব ফাও কথা? সে সম্পর্কে আমার কাজিন। আমার বড় আব্বুর ছেলে, দ্যাট মিনস্ সে আমার বড় ভাই হয়। এর চেয়ে বেশি কিছুই ছিলো না আমাদের সম্পর্কে। নেক্সট টাইম আর এইসব ব্যাপারে আমাকে জড়িত করবি না। ….. বলে গটগট পা ফেলে ক্লাসের দিকে চলে গেলো সে।
সবাই তার যাওয়ার দিকে হা করে তাকিয়েই রইল৷ তাদের যেন কেমন অবিশ্বাস্য লাগলো ব্যাপারটা। যে মেয়ে কখনও একটুখানি রাগ পর্যন্ত করে নি, উচু গলায় কথা শোনায় নি, উল্টো সবসময়ই মজা করতো, ক্লাসটাকে দুষ্টুমিতে মাতিয়ে রাখতো আর সেই মেয়ে কিনা আজ তাদের সাথে রাগান্বিত হয়ে কথা বলে গেলো।
– রিহা, আমার না ব্যাপারটা বেশ সন্দেহ লাগলো। ওর আর তানিম ভাই এর রিলেশন থাকতেও পারে। হয়তো এমনও হতে পারে তাদের মধ্যে তানিম ভাই তার সাথে মিসবিহেবও করতে পারে! নয়তো, মেইবি এ টাচ অফ হেটার্ড এন্ড বিটার্নেস এবাউট দেম!
– আমারও তাই মনে হয়। না হলে ওর এক্সপ্রেশনে, ওর চোখে তানিম ভাইয়ের প্রতি এতোটা ঘৃণার আভাস পাওয়া যেতো না। ও তো তানিম ভাইকে বেশ সম্মানও করতো। তাহলে?
– ব্যাপারটা বেশ ক্রিটিকাল। চল নিহাদের সাথে দেখা করতে হবে। কয়েকটা নোটস নিতে হবে।
– আচ্ছা চল। … বলে দুই বান্ধবী চলে গেলো তাদের অন্য ফ্রেন্ডসদের কাছে। পাশ থেকে কেউ একজন সবটা শোনে মুচকি হাসি দিলো।
_____
ক্লাসে মনখারাপ করে বসে আছে তানজিম। তার মনটা কেমন যেন বিষিয়ে আছে আজ! কয়েকটা দিন একলা থাকতে পারলে ভালো হতো৷ আজ ভার্সিটিতে আসতে চাই নি। কিন্তু বাড়ীতে থাকলে যেকোনো মুহুর্তে সে তানিমের মুখোমুখি হতে হবে। সে চাই না কোনো বিশ্বাসঘাতকের মুখোমুখি না হতে। যদি মুখোমুখি হয়ে যায় তাহলে বেহায়া মনটা বারংবার তার বিরুদ্ধে যাবে। ইচ্ছে করবে ছুটে গিয়ে তাকে উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে নিতে। কিন্তু সে কখনও সেটা চাইই না। হঠাৎ ধ্যান ফিরলো সারাহ্’র কথায়। চমকে উঠলো তানজু,
– এই মেয়ে ভাবছিস কি এতো? মনে হয় তোরে আমি কয়েক হাজারের মতো ডেকে চলছি আর তুই ডুবে আছিস তোর ভাবনায়!
মুখটা মলিন করে ফেললো তানজিম। যার মানে বুঝতে দেরি হলো না সারাহ্’র। তাই তানজিমকে রাগাতে সে ফন্দি আটলো,
– দোস্ত, রহিম কাকু আছে না। সে না…
– আরেকটা কথা বললে আমি কিন্তু ধ্রুব ভাইয়াকে বলবো যে তুই ওনার অগোচরে ইটিসপিটিস করছ। জানোস তো সে আমাকে কতটা বিশ্বাস করে৷
সারাহ্ মুখটা ইনোসেন্ট করে,
– তুই বন্ধু না শত্রু রে? এতো বড় মিথ্যে তুই আমার নামে বলতে পারবি?
– তুই যাই ভাবোস আই হেভ নো প্রবলেম । আজকে যদি ট্রিট না দিস তাহলে সব কিছুই ধ্রুব ভাইয়ার কানে।… বাচ্চাদের মতোন তাকিয়ে রইলো সারাহ্’র দিকে।
বেচারি বাংলা পাঁচের মতোন তাকিয়ে রইল তানজিমের দিকে। আর তানজিম তো ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ললিপপ খেতে লাগল। সারাহ্ বিড়বিড় করে বলে উঠল,
– লালবিচ্ছু দেখবি তুই তোর জামাই আস্ত একটা বদমাইশ আর খাটাশ হবে। সারাক্ষণ তোরে ঝাড়ির উপর রাখবে। দেখে নিস, এই বদদোয়া দিলাম তোরে।
একদিকে তানজিমের মনের খারাপ লাগা খানিকটা দূর করতে পেরে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো সারাহ্।
_____
চারিদিকে সন্ধ্যাকে ঘিরে কুয়াশারা সন্ধ্যাে খেলায় মেতে উঠেছে, হালকা নীলাভ শূন্যে করে হাতে গোণা ক’টি তারা, তাদের চরিত্র প্রকাশে ব্যস্ত আজ। পূর্ব পশ্চিম দিগন্ত হতে পাঁচ পাখি ডানা মেলেছেন গন্তব্যের দিকে, পূর্বকোণে হালকা উজ্জ্বলতা টুকি দিচ্ছে নীলিমা। পাখিরা তাদের কন্ঠস্বর ছড়িয়ে দিচ্ছে মুক্ত বাতাসে, বাতাস যেন মনোসংযোগে কর্ণপাত করছে পাখিদের গান। ধীরে ধীরে কুয়াশার চাদরে মুড়ি দিল সন্ধ্যা! চারিদিক বিরাচ করল নীরবতায় ভরা স্নিগ্ধ মৃদু বাতাস। পাখিরা পাঁচফোড়ন পরিচয় দিয়ে গেল ঘন কুয়াশার মাঝে। ছাদের কার্নিশ ধরে দাঁড়িয়ে আছে সারাহ্। গত কয়েকদিন ধরে ধ্রুব তাকে কেমন এড়িয়ে চলছে। বারংবার কল দেয়ার পরেও ধরে না সে। এ নিয়ে বেশ অভিমান জমে আছে ওর মনে। আজ তার জন্মদিন অথচ ধ্রুবের কোনো খবরই নেই৷ গাল বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল তার। হঠাৎ চমকে উঠলো সে,
– হ্যাপি বার্থডে টু ইউ। হ্যাপি বার্থডে টু মাই লাভ!
– আপনারা?
হঠাৎ ধ্রুবকে এই সন্ধ্যার মূহুর্তে নিজের বাসায় দেখে অবাক হয়ে গেলো সারাহ্। এমন সময় তাকে নিজের বাসায় ডিজার্ভ করেনি সে। তার রসগোল্লার মতো চোখ খানি দেখে ঠোঁটের কোনার হাসিটা আরও চওড়া হলো তানজিমের।
– কিরে ওমন রসগোল্লার মতো করে রাখছস কেন চোখগুলো? আগে কখনও দেখিস নাই ভাইয়াকে?
তানজিমের কথা শোনে লজ্জায় লজ্জাবতী গাছের মতো নুয়ে গেলো সারাহ্। মনে মনে হাজারটা গালি দিল তানজিমকে। ‘এই মেয়ের আর কোনো কাজেই নাই খালি ওনার সামনে আমাকে লজ্জায় ফেলা ছাড়া।’ বলে কটমট দৃষ্টিতে তানজিমের দিকে তাকালো সে।
তানজিমের মুখে বিশ্ব জয়ের হাসি। ইশারায় বুঝালো সকালেরটার প্রতিশোধ নিয়েছে সে। তাদের মনোযোগ আকর্ষন করার জন্য ধ্রুব একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠল,
– আসলে আমি কি আপনাদের মাঝে আসতে পারি? আই মিন আমি কি কিছু কথা বলতে পারি?
– জি ভাইয়া অবশ্যই। .. হাসিমুখে জবাব দিলো তানজিম।
– আসলে সারাহ্ আমি জানি তুমি আমার উপর অভিমান করে আছো৷ সেটাই স্বাভাবিক, কারণ গতি দুদিন ধরে আমি তোমার ম্যাসেজ বা কল কোনোটারই এন্সার দিতে পারি। আ’ম এক্সট্রিমলি সরি ফর দ্যাট। জানি স্যরি বললেও জানি না তোমার রাগ ভাঙাতে পারবো না। বলো…. ধ্রুবকে আর কিছু বলতে দিলো না সারাহ্। দ্রুত গিয়ে জড়িয়ে ধরল সে। তাদের এই আবেগঘন মূহুর্তে বাঁধা না দিয়ে তানজিম নিঃশব্দে ছাদের বাইরে চলে এলো।
ধ্রুবও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তার প্রিয়তমাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে স্বযত্নে,
– গত ২ দিন আগে আমি একটা মিটিংয়ের জন্য খুলনা গিয়েছিলাম। কাজের চাপ এতই বেশি ছিলো যে তোমার কল বা ম্যাসেজ কোনটিরই উত্তর দিতে পারলাম না।
– আমি জানি ধ্রুব আপনি ব্যস্ত ছিলেন। তাহলে আপনি এতো কৈফিয়ত দিচ্ছেন কেন আমায়?
– আমার হবু বউকে কৈফিয়ত না দিয়ে কাকে দিবে? শুনো এটা তোমার অধিকার। সো অধিকার নিয়ে অনাধিকার চর্চা না করায় শ্রেয়। বুঝলেন ম্যাডাম?
– উহু, এটা আমার দ্বারা একদমই পসিবল নয়। তবু চেষ্টা করে দেখবো।
– হুহ্, চলো কেকটা কেটে নি। আজ সেই দিন যে দিনটি না হলে তোমায় পাওয়া হতো না আমার। আজ সেই স্পেশাল দিন যেই স্পেশাল দিনে আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পেশাল একজন মানুষের জন্ম হয়েছিলো। শুভ জন্মদিন প্রিয়৷ ভালোবাসি!
চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা অশ্রু। যেটা দুঃখের নয় বরং সুখের! কিছু পাওয়ার অশ্রু সেটা।
সবটা শেষ হওয়ার পরে হঠাৎ ফোন এলো ধ্রুবের!
– এক্সকিউজ মি!… বলে ধ্রুব সাইডে বলে চলো আর সারাহ্ ও তানজিম দুষ্টমির মাঝেই রয়ে গেলো। আর একজোড়া তীক্ষ্ণ চক্ষু আড়াল থেকে চেয়ে রইল সেই দিকে। যেন হাজার বছরের তৃষ্ণা মিঠিয়ে নিচ্ছে।
~ চলবে….!
[