মেঘফুল ফুটলো মনে পর্ব -১৯

#মেঘফুল_ফুটলো_মনে
#পর্বঃ- ১৯
#লেখনীতেঃ আবরার আহমেদ শুভ্র

সকলে বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে আছে তানজিমের দিকে। তার চেয়েও অবাক হলেন নাবিল আরমান। কারনটা হয়তো নিজেই তিনি জানেন। আরও একবার বিষ্ময়ের সাথে তানজিমের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়লেন নাবিল আরমান,

–মা এসব কি বলছিস তুই? আর মৃন্ময়ই বা কেন তোকে মারতে চাইবে? এতে ওর লাভ কি হতো?

পাল্টা প্রশ্নের উত্তর দিলো বেশ কিছুটা সময় নিরব থাকার পর।

–বাবা ওনার লাভ কি সেটা অবশ্য আমি জানি না, কিন্তু ওনার চোখে একরাশ গভীর ক্ষোভ দেখেছিলাম আমার প্রতি। এটা বুঝতে পারছি না ওনার এতো ক্ষোভ কেন আনার প্রতি!

আরেক দফা অবাক হলো সবাই। সবাইকে ছাপিয়ে শায়লা বেগম এবার মেয়ের কাছে বসে মাথাটা কোলে নিলেন। অতঃপর চুলে বিলি কাটতে কাটতে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,

–আচ্ছা বুঝার দরকার নেই মা। এখন বল তোর সাথে সেদিন কি হয়েছিলো? কে কে ছিলো সেদিন?

একবার সারাহ-র মায়ের দিকে তাকালো তানজিম। পরক্ষণে সারাহ-র দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢুক গিললো সে। মিহি কন্ঠে বলে উঠলো,

— সেদিন মৃণ্ময় ভাইয়ার সাথে তুহিন আংকেল ছিলো। তিনি কি যেন ডিলের ব্যাপারে কথা বলছিলেন তার সাথে। আর যে মাত্র আমি তাদের কথা শোনতে পেয়েছিলাম তার কয়েক মূহুর্ত পর কেউ একজন আমার মাথায় আঘাত করে। এর পর আর কিছু মনে ছিলো না আমার।

এতোক্ষণ শান্ত থাকলেও আর নিজেকে আটকাতে পারেননি সারাহ-র মা সুলতানা। রুক্ষ স্বরে বলে উঠলেন তিনি,

–সে কি মরতে পারে না। জানো*য়ার একটা! এতো বড় ধোঁকা দিলো সে আমাদের। বিশ্বাস করো ভাইজান এখন প্রতিটা মূহুর্তে মনে মনে তার মৃত্যু কামনা করছি। কেন সে মরে না?

মায়ের কথা শোনে নিজের মধ্যে জ্বলতে থাকা রাগটাকে আর দমাতে পারলো না সারাহ’ও। চিৎকার করে বলে উঠলো,

–কাকে মরতে বলছো মা? একটা পাষণ্ড মানুষটাকে? তার মৃত্যু কি এমনে এমনেই হবে? তাকে কি এতো সহজে মরতে দেয়া যায়? না, তাকে ঠিক তেমন ভাবেই মারা হোক ঠিক যেমন ভাবে মেজোমামা আর মেজোমামিকে মারা হয়েছিল। তবেই না তাদের আত্মা শান্তি পাবে। হোক সে নিজের বাবা। বাবা বলতে লজ্জিত হচ্ছি আমি। এমন একটি পাষাণ হৃদয়ের মানুষ কখনোই আমার বাবা হতে পারে না।

নিস্তব্ধতার মাঝে সারাহ-র কান্নার শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে আসছে বারংবার। কতটা কষ্ট পেলে মানুষ এমন কথা বলতে পারে, সেটা হয়তো সারাহ-কে না দেখলে বুঝা দায়।
_____________

তানজিমের রুমের সোফায় বসে আছে ফুয়াদ। আর তানজিম তার সামনে খাটে স্যুপের বাটি হাতে নিয়ে বসে আছে। একচামচ প্রথমে মুখের সামনে নেয় পরক্ষণেই নাকমুখ কুঁচকে বাটিতে রেখে দেয় চামচটা। কেমন যেন লাগছে তার এই স্যুপটি। কিন্তু কোনোমতেই খেতে চাইছে না সে এটা। সোফায় বসে শান্ত হয়ে বসে তানজিমের কর্মকাণ্ড লক্ষ করছে সে। তার এমন ছেলেমানুষীগুলো দেখে ভীষণ রাগ লাগছে ফুয়াদের। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,

–এমন ছেলেমানুষী করছিস কেন তানজু? তুই কি এখনো ছোট রয়ে গেছিস? এখন কি খাবি নাকি অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে আমার?

–খাবো না আমি। এসব আমার একদমই পছন্দ না সেটা নিশ্চয় আম্মু জানে। তবুও কেন পাঠালো আপনাকে দিয়ে? খেতে ইচ্ছে করছে না আমার।

এবার শান্ত স্বরে বলল সে,
–তানজিম অবাধ্যতা করিস না কথার। ভালো মেয়ের মতোন খেয়ে নে স্যুপটা। নাহলে এমন পানিশমেন্ট দিবো তখন খেতে চাইলেও আর পাবি না।

ফুয়াদের কথায় ঢুক গিলে বলে উঠলো সে,

–বিশ্বাস করেন ফতুয়া ভাই আমার খে্, বলে থেমে গেলো সে। কি বলতে গিয়ে মুখ ফসকে কি বলে ফেলছে সেটা মনে হতেই আবারও শুকনো ঢুক গিললো সে।

ফুয়াদ এবার রাগী স্বরে বলে উঠলো,
–ওয়াট ইজ দ্যা ফতুয়া ভাইয়া? এসব কি তানজু? তাহলে এতোদিন তোরা আমার অগোচরে আমার নামকে এভাবে বেইজ্জতি করতি? তোদের থেকে এগুলো আশা করি নি। ভার্সিটিতে তাহলে এগুলো শিখায় তোমাদের জান?

–আসলে আমি বল্

তানজিমকে থামিয়ে দিয়ে ফুয়াদ আবারও বলে উঠলো,

–ওকে, সেটার পানিশমেন্ট এমন সময় পাবি যেটা তুই কখনও আশা করিস না। এখন তাহলে ভালো মেয়ের মতোন খেয়ে নাও পেট ভরে কেমন?

মাথা নেড়ে “হা সূচক” মাথা নাড়ালো তানজিম। তার এমন ভয়ার্ত মুখশ্রী দেখে তারই অগোচরে হালকা হাসে ফেললো ফুয়াদ। প্রচন্ড মায়াবী লাগছে তাকে আজ। হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে ফুয়াদ তানজিমের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

–শাস্তির কথাটা মাথায় রেখো বউ কেমন! খুউব শীঘ্রই সেইটার ব্যবস্থা করছি। এখন খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।

বলে আর একমুহূর্তও থামলো না, সোজা রুমের বাইরে চলে গেলো সে। এদিকে তানজিম বসে বসে ফুয়াদের বলে যাওয়া শেষোক্ত কথাটি ভাবছে। কি বললো সে এইটা! বউ! ভয়ের মাঝেও ফিক করে হেসো দিলো সে। আর আনমনে বলে উঠলো,

–তাহলে সেই কেশবতীটা কি আমি? ইজ দ্যাট পসিবল এট অল? কিন্তু ওনি আমায় হঠাৎ বউ বলে সম্মোধন কেনই বা করলেন?

অতঃপর খেয়ে ফ্রেশ হয়ে শোয়ে পড়লো সে। কেমন যেন একরকম শান্তির হাওয়া বইছে তার মন মাজারে।
_________

আজ সকালবেলায় হঠাৎ অথৈয়ের পেইন উঠে যাওয়ায় ওকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে ফুয়াদ। যতই সে তানিমকে ঘৃণা করুক না কেন, অথৈকে তো আর ঘৃণা করতে পারবে না সে। অথৈ তার বোন হয়। আপন বোন না হোক সে তো অথৈকে আপন বোনের মতোনই ভালোবাসে। তানিম অফিসে ছিলো তাই তাকে খবর দেয়নি কেউ। অবশ্য তার আজ জরুরি মিটিং এর কথা ছিলো তাই খুব ভোরবেলাই অফিসে চলে যায় সে। খবর পেলে হয়তো এতোক্ষণে সে ছুটে আসতো হতদন্ত হয়ে! কিন্তু সেটা একদমই চাইনি ফুয়াদ, তাই বাড়ীর সকলকে বারং করে দিয়েছে যেন তানিমকে কিছু না জানানো হোক।

ছেলে হয়েছে অথৈ-তানিমের ঘর আলোকিত করে। টানা দু’ঘন্টা ওটির পর অথৈয়ের ডেলিভারির শেষ হয়েছে। প্রথমদিকে বাচ্চাকে বাঁচানোর সম্ভাবনা একেবারে শূন্যের কোঠায় ছিলো! কিন্তু মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে সকল সমস্যা কাটিয়ে ওটি কমপ্লিট করলেন ডাক্তাররা। কেবিনে শিফট করা হয়েছে অথৈকে। এতোক্ষণে হাসপাতালে এসে উপস্থিত হয়েছে তানিম। চোখে তার রাগ স্পষ্ট! নিজের মাকে অনেকক্ষণ ধরে ঝাড়ি দিলো সে। কারণ, অথৈকে আজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে অথচ তাকে কেন খবর দেয়া হয়নি। কিন্তু পরক্ষণেই ছেলের মুখখানা দেখে সব রাগ নিমিষেই হারিয়ে গেছে তার। তানজিমও খুশি, একদিকে সে খালা অন্যদিকে সে ফুফি হয়েছে। কেবিনের ভিতর থেকে খবর এলো অথৈ তানিমকে ডাকছে ভেতরে ইমিডিয়েট! অবাক হলো উপস্থিত সকলে। তানিম দ্রুত কেবিনে চলে গেলো।

–কেমন লাগছে এখন অথৈ? ছেলেকে দেখেছো? একদমই তোমার মতোন হয়েছে দেখতে।

রুমে ঢুকতেই কথাগুলো এক নিশ্বাসে বললো তানিম অথৈয়ের উদ্দেশ্যে। কিন্যা তার তরফ থেকে কোনো প্রতিত্তোর না পেয়ে হতাশ হলো তানিম। সেদিনের পর থেকে খুব একটা প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতো না অথৈ তানিমের সাথে। যেদিন অথৈ জেনেছিলো তানিম তানজিমের মনে ভীষণ আঘাত দিয়েছিলো। ধোঁকা দিয়েছিলো তানজিমকে। সেই কথাটা জানার পর আর কোনো প্রয়োজন ব্যাতিত কোনো কথাই হতো না তাদের। ব্যাপারটা তানিম আদৌও জানে না। কেন তাকে এমন ইগনোর করে চলে অথৈ? কখনও বুঝতেই দেয় নি সে বিষয়টি। কিন্তু আজ হঠাৎ এমন একটি আবেগঘন মূহুর্তে এমন ব্যবহার আশা করেনি তানিম। সে আবারও বলে উঠলো,

–আজও কি তুমি আমার সাথে প্রয়োজনাতীত আর কোনো কথায় বলবা না? কি দোষ করেছি আমি? একটু কি বলবে আমায়? যার কারণে এতোগুলা দিন এমন করে কষ্ট দিচ্ছো আমায়? অন্তত আজকে এই মূহুর্তের জন্যে হলেও একটু কথা বলো আমার সাথে?

এবার মুখ খুললো অথৈ। খুব ধীরে সুস্থে যে কথাটি বললো তাতে নিমিষেই শেষ আলোটাই নিভে গেলো তানিমের। অপর পাশ ফিরে অথৈ চক্ষুজল মুছে তানিমের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

–আমার ডিভোর্স চাই! আমি আমার ছেলেকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো। আর আপনাকে কখনোই ডিস্টার্ব করবো না। আপনি আপনার ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে ভালো থাকুন। কাল সকালেই উকিল আসবে, সো আজ এখনের পর থেকে আপনি কোনো মতেই আমার কাছে আসার চেষ্টা করবেন না।

#চলবে~

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here