মেঘবৃত্ত পর্ব ১৩

#মেঘবৃত্ত
#পর্ব_১৩
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

হাসপাতাল থেকে বাসায় আসার পর থেকেই মেঘার মায়ের মুখখানা থমথমে। এখন পর্যন্ত মুখে ‘রা’ অব্দি কাটেন নি। সেই কখন থেকে নিজের ঘরে ঘাপটি মেরে বসে আছেন। মেঘা কয়েকবার সাহস জুটিয়ে মায়ের কাছে গেলেও, দরজা অব্দি এসে থেমে গেছে। মায়ের কাঠিন্যভরা মুখশ্রী দেখে ঘরে প্রবেশের সাহস ক্রমশ নিঃশেষে হয়ে গেছে।
মেঘা আবারও নিজের ঘরে এলো। ফোন হাতে নিয়ে কললিস্ট জরিপ করলো। নাহ! এখনো বৃত্তের কোনো কল নেই। মেঘার রাগ এবার হুরহুর করে বেড়ে গেলো। কীবোর্ডে শশব্দে আওয়াজ তুলে লিখলো, ‘ আজকের পর তুই আর জীবনেও আমায় কল দিবি না। তোকে বিলিভ করাটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। ‘
মেঘা মেসেজটা পাঠিয়ে ফোন বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দিলো। মেঘার ছুঁড়ে ফেলা ফোনটা বিছানার একদম কোণায় গিয়ে ঠেকলো। মেঘা দুহাতে চুল খামচে ধরে ধাম করে বিছানায় বসে পড়লো। এতক্ষনের জমে থাকা রাগ এবার কান্নায় পরিণত হলো। মেঘার চোখের কোণা বেয়ে গড়ালো দু ফোঁটা জল। বুকের ভিতরটা যেনো কেউ খামচে ধরে রেখেছে। চিন্তায়,চিন্তায় শ্বাস অব্দি নিতে পারছে না। মনে হচ্ছে, অত্যাধিক ভয়ে যেকোনো সময় মেঘা অজ্ঞান হয়ে যাবে।

রাত পেরিয়ে ধবধবে নতুন এক সকাল এলো। জানালার কাছটায় থাকা আম গাছে দু জোড়া শালিক বসে আছে। নীরবে, নিভৃতে! একটা শালিক মাঝেমধ্যে ওপর শালিকের কপালে ঠোঁট দিয়ে টোকা দিচ্ছে। ওপর শালিক সেই টোকায় নেচে নেচে উঠেছে। খিলখিলিয়ে হাসছে যেনো। মেঘা গ্রিল ধরে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আনমনা চোখে জোড়া শালিকের কারসাজি দেখছে। পুরুষ শালিকের স্পর্শ পেয়ে মহিলা শালিকের এমন দুরুন্তপনা দেখে মেঘার ফিক করে হেসে ফেললো। প্রকৃতিতেও প্রেম হয় বুঝি? মেঘা তো মানুষ
তাহলে, মেঘার জীবনে প্রেম নেই কেনো? নাকি, প্রেম বলতে কিছুর অস্তিত্বই নেই? সবই মিথ্যা, অহেতুক? কি জানি। হতেও পারে। মেঘা চোখ ঘুরিয়ে বিছানার দিকে তাকালো। বিছানার উপর অযত্নে ফেলে রাখা তার ফোনটা ক্রমশ কেঁপে কেঁপে উঠছে। নিশ্চয়ই, বৃত্ত ফোন করেছে। কিন্তু মেঘা পণ করেছে, সে ফোন ধরবে না। ফোনের ওপাশে বৃত্ত জ্বলবে, উশকুস করবে, এলোমেলো হবে। বারবার পাগলের মত ফোন করবে। তবুও মেঘা ফোন ধরবে না। কাল যখন মেঘা এতবার করে বৃত্তকে কল করেছিল, তখন ধরেছিল? নাহ! তখন বৃত্ত নিজের বেখেয়ালির পরিচয় দিয়েছে।তাই, মেঘা এমনটা করছে। বৃত্তের করা অপরাধের শাস্তি এটা।

ঘন্টা পার হলো। মেঘা এখন জানালা ছেড়ে বিছানায় এলো। ফোন হাতে নিয়ে কললিস্ট দেখলো। বৃত্তের পনেরোটা কল এসেছে। মেঘা ফোন হাতে নিতেই আরো একটা কল এলো। মেঘা এবার ফোন ধরলো। ফোন কানের সাথে ধরতেই বৃত্ত ওপাশ থেকে রাগান্বিত কণ্ঠে বললো,
— বাহ! এতক্ষণে ফোন ধরার সময় হলো আপনার? কই মরছিলি? হ্যাঁ? আর কাল মেসেজে ওটা কি বললি? টেস্ট করেছিস মানে? কিসের টেস্ট? কোথাকার টেস্ট?
মেঘা হতাশ হলো। কাল টেস্ট করার মেসেজ ব্যতীত আরো এক মেসেজ পাঠিয়েছিল মেঘা। মেঘার অভিমান মিশ্রিত মেসেজ। তবে, বৃত্তের কোনো মাথা-ব্যথা নেই মেঘার সেই রাগ-অভিমান নিয়ে। সে এখনো তার দায়িত্ত্ববোধ নিয়ে পড়ে আছে। মেঘা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ছোট্ট করে বললো,
— কালকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন মা। ডাক্তার আমার লক্ষণ দেখে প্রেগন্যান্সি টেস্ট দিয়েছিলো।মা শুনে প্রথমে থ হয়ে গেছিলেন। পরে ডাক্তারের কথায় সব টেস্ট করিয়েছেন। আজকে বিকেলে রিপোর্ট দিবে বলেছে।

বৃত্ত সব শুনে হতবাক হয়ে গেলো। এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো সে। মেঘার কথা শুনে মনে হচ্ছে, বিষয়টা অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। ইশ! কালকে সন্ধ্যার পর পার্টি না করে যদি একবার মেঘার ফোনটা রিসিভ করতো, তাহলে আজকে এই ঘটনা এতটা বাজে রূপ নিত না। বৃত্ত একহাতে ফোন কানে রেখে, ওপরহাত দিয়ে ঘন চুল শক্ত করে টেনে ধরলো। উদ্ভান্তের মত বিছানায় বসে বললো,
— ওহ নো! আচ্ছা, আন্টি কিছু বলেছে তোকে?
— নাহ। এখন অব্দি কিছুই জিজ্ঞেস করেনি। কিন্তু মনে হয়, রিপোর্ট পজিটিভ পেলে রীতিমত যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিবে। মায়ের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।
বৃত্ত কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর বললো,
— রিপোর্ট আনতে কে যাবে? আন্টি?
— নাহ। আমি, তুই আর মা। তিনজন। ডাক্তার বলেছে, তোকেও নিয়ে যেতে অ্যাজ অ্যা হাসবেন্ড।
মেঘার শেষের কথাটায় এক ভয়ঙ্কর তাচ্ছিল্য মেশানো ছিলো। এ আবার কেমন হাসবেন্ড? কেমন বিয়ের বন্ধন? যেখানে এক বাচ্চা আছে, কিন্তু ভালোবাসার ছিটে-ফোঁটাও নেই। ধিক্কার এমন সম্পর্ককে!
বৃত্ত নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছুক্ষণ ভাবলো। বললো,
— আচ্ছা। ঠিক আছে। আমি ব্যাপারটা দেখছি। তুই রিলাক্স থাক।
মেঘার হাসলো। মলিন, ফ্যাকাসে হাসি। বৃত্ত বারবার এমনই করে। সব দায়িত্ত্ব নিজের কাঁধে চাপিয়ে মেঘাকে রিলাক্স থাকতে বলে। কিন্তু, নিজেই উধাও হয়ে যায়। এটা বৃত্তের প্রতিদিনকার কাজ। এ আর পুরনো কি?
মেঘা ফোন কেটে আবারও বিছানার উপর ছুঁড়ে ফেলে দিলো। চোখ দুটো খিঁচে দু হাতে চুল খামচে ধরলো। গলা ফাঁটিয়ে কাঁদতে মন চাইছে মেঘার। এই ভয়ঙ্কর চিন্তা মেঘার আর সহ্য হচ্ছে না। পাছে ঘরের বাইরে যাতে কান্নার আওয়াজ না যায়, তাই মেঘা দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
_______________________
মেঘার মা মেয়েকে নিয়ে সিএনজি থেকে নামলেন। সিএনজির ভাড়া মিটিয়ে হাসপাতালের সামনে এসে দাঁড়ালেন। ঘাড় এপাশ ওপাশ করে বৃত্তকে খুঁজতে লাগলেন। মেঘা হাত দিয়ে কামিজ খামচে ধরে মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আজ কি হবে, সেটা ভাবলেই মেঘার আত্মা যেনো বুক ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে।
একটু পরই বৃত্তের বাইক এসে থামলো মেঘাদের পাশে। বৃত্ত বাইক থেকে নেমে মেঘার মায়ের পাশে দাঁড়ালো। ছোট্ট করে সালাম দিলো। কিন্তু, মেঘার মা উত্তর দিলেন না। বরং, কঠিন চোখে বৃত্তকে আগাগোড়া লক্ষ্য করে বললেন,
— ভিতরে চলো। আমাদের দেরি হচ্ছে।
বৃত্ত মাথা নিচু করে সায় দিলো। মেঘার মা সামনে হাঁটছেন। বৃত্ত আর মেঘা পিঁছু পিঁছু আসছে। বৃত্ত মেঘার দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললো,
— জানিস? এই মুহূর্তে তোর মাকে দেখে আমার আস্ত এক হিটলারের নানি মনে হচ্ছে। কি তেজ দেখেছিস? আগে তো আন্টিকে দেখলে শান্তশিষ্ঠই মনে হতো। কিন্তু আজকে দেখ। একদম ঝাসি কি রানী লাগছে। তোর মায়ের এই গোপন ট্যালেন্ট সম্পর্কে আমাকে আগে বলিস নি কেন? ভেরি ব্যাড, ইউ নো!
কথাটা বলে বৃত্ত খুব দুঃখ পাওয়ার ভান করলো। মেঘা এতে কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া দেখালো না। বরং, ভাবলেশহীন ভাবে বৃত্তকে পাশ কাটিয়ে মায়ের সাথে হাঁটতে লাগলো।
বৃত্ত মেঘার এমন ভাব দেখে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। হাত দিয়ে কপালের চুল পিছনে ঠেলে দিয়ে মেঘার পিঁছু পিঁছু আসতে লাগলো।
_____________________
— আপনিই মিস.মেঘা জুয়েল রহমানের স্বামী?
বৃত্তকে সরু চোখে প্রশ্ন করলেন সেই মহিলা ডাক্তার। বৃত্ত একঝলক মেঘার দিকে চেয়ে অতঃপর উত্তর করলো,
— হ্যাঁ।
— কাল আপনার স্ত্রীকে কিছু টেস্ট দিয়েছিলাম। আজকে তার রিপোর্ট দিয়েছে।
বৃত্ত কিছু একটা বলতে তার আগেই মেঘার মা উৎসুক মুখে প্রশ্ন করলেন,
— ম্যাডাম, রিপোর্টে কি এসেছে?
ডাক্তার মহিলা এবার মেঘার দিকে ঝুঁকে তাকালেন। অত্যন্ত উচ্ছসিত সুরে বললেন,
— মিসেস মেঘা, কনগ্রাচুলেশন! আপনি মা হতে যাচ্ছেন। ইউ আর প্রেগন্যান্ট!
‘প্রেগন্যান্ট’ শব্দটা শুনতেই মেঘার মায়ের মাথাটা যেনো একবার চক্কর দিয়ে উঠলো। তিনি হাত দিয়ে টেবিল শক্ত করে ধরে মেঘার দিকে তাকালেন। মেঘা মাথা নত করে বসে আছে। বৃত্ত মেঘার ওমন অগোছালো চাওনি দেখে মেঘার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিল। শক্ত করে সেই মেয়েলি হাতটাকে আকড়ে ধরে চোখের ইশারায় মেঘাকে শান্ত থাকতে বললো। কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে নিজেও ভয়ে ক্ষয়। না জানি মেঘার মা এই সংবাদে কি প্রতিক্রিয়া দেখান?
মেঘার মা একটু থেমে নিজেকে সামলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলেন। কম্পিত কণ্ঠে ডাক্তারকে প্রশ্ন করলেন,
— ম্যাডাম, বাচ্চাটা কয় মাসের হবে?
— আনুমানিক দু মাসের ত হবেই।
মেঘার মায়ের যেনো এবার গলা শুকিয়ে এলো। মেঘার পেটে এক মাসের একটা বাচ্চা? মেঘা আর বৃত্তের বিয়ের মাত্র এক সপ্তাহ হয়েছে। সেখানে, দু মাসের বাচ্চা কোথা থেকে এলো? মেঘার মা যেনো চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলেন। মাথাটা যেন চক্রাকারে ঘুরছে। তিনি মেঘার হাত খামচে ধরে মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। নিজের মেয়েকে ‘চরিত্রহীনা’ উপাধি দিতে তার বুকটা যেনো ফেঁটে যাচ্ছে। সত্যিই কি তার মেয়ে একজন চরিত্রহীনা?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here