মেঘবৃত্ত পর্ব ৪০+৪১+৪২+৪৩+৪৪+৪৫+শেষ

#মেঘবৃত্ত
#পর্ব_৪০
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

রাত নেমেছে শহর জুড়ে। বৃত্ত রুমে দাঁড়িয়ে মোবাইলে কার সাথে কথা বলছিলো যেনো। মেঘা গোসল করছে বাথরুমে। মেঘার এই একটা অভ্যাস! বাইরে থেকে আসার পর তার গোসল করা আবশ্যক। নাহলে নাকি তার শরীর খচখচ করে। একটু পর বাথরুমের দরজা খোলার শব্দ হলো। বৃত্ত ফোন কানে রেখেই পিছন ফিরলো। চোখের সামনে জলে ভেজা, স্নিগ্ধ এক মেঘকে আবিষ্কার করতে পেরেই তার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। মেঘার মাথায় সাধারণ এক গামছা পেঁচানো, দু একটা ছোট চুল কপালে পড়ে আছে, পরনে পাতলা শাড়ি; যার বেশিরভাগ অংশই ভিজে আছে। ব্লাউজ এর হাতাটাও একটুখানি ভেজা। মেঘার এই নতুন আবেদনময়ী রূপ দেখে বৃত্তের মন তোলপাড় হয়ে গেলো। এই প্রথম বৃত্তের মনে মেঘার জন্যে বন্ধুত্বের বাইরে এক স্পেশাল কিছু অনুভব হচ্ছে।

মেঘা বৃত্তের দিকে একপল চেয়ে বললো,
— ঘুমাস নি এখনো? এত কিসের ফোনে কথা বলিস? রাত কটা বাজে খেয়াল আছে?

কথাটা বলতে বলতে মেঘা চুলের থেকে গামছা খুলে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো। পিঠের থেকে সব চুল কাঁধের একপাশে এনে গামছা দিয়ে চুল ঝাড়তে লাগলো। বৃত্তের এবার গলা শুকিয়ে এলো। মেঘার ব্লাউজের পিঠটা ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। বৃত্তের মনে এবার কাঁপন ধরলো। এ কি করছে মেঘ? তাকে কেনো এমন করে উলোট পালোট করে দিচ্ছে মেঘ? এবার বৃত্ত কি করে নিজেকে সামলাবে? বৃত্তের একবার মনে হলো, মেঘাকে বলবে; শাড়িটা পাল্টে নিতে। কিন্তু, তার কন্ঠনালী আজ যেনো হরতাল ডেকেছে। কথা অব্দি বলতে পারছে না সে। চোখটাও মেঘার দিকে তীরের ন্যায় আটকে আছে। উফ, কি অসহ্য এক অনুভূতি! বৃত্ত আর একমুহুর্ত রুমে থাকলো না। ফোন কেটে দিয়ে হনহনিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। আর একটু সময় এ ঘরে থাকলে, একটা দুটো অঘটন ঘটে যাবে। হয়তো সেই অঘটন মেঘার খুব একটা ভালো লাগবে না, বৈ খারাপ লাগবে। বৃত্ত নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো। সে এটা ভেবেই আশ্চর্য্য হচ্ছে, আজ তার হলোটা কি? মেঘাকে নিয়ে তার এমন অনুভূতি কেনো হচ্ছে? কই, আগে তো কখনো এমন হয়নি। উফ, বৃত্তের মাথা ধরে যাচ্ছে। বৃত্ত মনেমনে কয়েকবার ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ জপ করলো। এতে যদি কিছুটা রক্ষা হয়?

মেঘা হাতে পায়ে লোশন দিয়ে চুলটা আঁচড়ে নিলো। হাতের ভেজা গামছাটা বারান্দায় মেলে দিতে যেয়ে বৃত্তকে দেখলো। বৃত্ত গ্রিল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে এক জ্বলন্ত সিগারেট। মেঘা অবাক হলো খানিক। বৃত্ত কি কোনো কারণে চিন্তিত আছে? মেঘা গামছাটা দড়িতে মেলে দিয়ে বৃত্তের কাছে এসে দাঁড়ালো। নিজের পাশে মেঘার অস্তিত্ব পেয়ে বৃত্তের ভেতরকার ছটফটানি যেনো দ্বিগুণ হারে বেড়ে গেলো। সে মুখ ফিরিয়ে নিল। ঘনঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
— জলদি ঘুমিয়ে পড়, মেঘ। রাত অনেক হয়েছে।

মেঘার বিস্ময় এবার শীর্ষে পৌঁছালো। মেঘবৃত্ত যেদিন থেকে এক হয়েছে, সেদিন থেকে মেঘা বৃত্তের বুকে মাথা গুঁজে ঘুমায়। বৃত্তের যতই ব্যস্ততা থাকুক, বৃত্ত সবসময় ঘুমানোর সময় মেঘাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে। তবে, আজ কি হলো? বৃত্ত কি মেঘার উপর রেগে আছে কোনো কারণে? মেঘার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। চোখে জল জমলো একটুখানি। মেঘা বৃত্তের কাঁধে হাত রাখলো। ধরা গলায় বললো,
— আমি কি কিছু করেছি, বৃত্ত? তোকে কি কোনো কারণে আমি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি? তুই আমার সাথে এমন করে কথা বলছিস কেনো? এই, বৃত্ত?

মেঘার কণ্ঠে স্পষ্ট কিছু কান্না! বৃত্তের এবার খুব অসহায় বোধ হলো। কি করবে, ভেবে পেল না সে। হাতের সিগারেট বারান্দা দিয়ে ফেলে মেঘার দিকে ফিরল সে। কোনরকম ভনিতা ছাড়া কাটছাঁট কণ্ঠে বললো,
— দেখ, মেঘ! আজ তোকে নিয়ে আমার মনে এক্সট্রা কিছু ফিল হচ্ছে। আমি এই ফিলিংস গুলোকে প্রশ্রয় দিতে চাইছি না। এই মুহূর্তে আমার পাশে থাকা মানে, তোরই বিপদ। আমি চাইনি, আমার দ্বারা আবার কোনো ভুল হোক। তুই কষ্ট পেলে, আমি ভেতরে ভেতরে ছারখার হয়ে যাবো রে মেঘ। তাই, তোর এখন ঘুমানো উচিৎ। তুই ঘুমিয়ে পড়লেই আমি ঘরে আসবো। চিন্তা নেই, তোকে জড়িয়ে ধরেই ঘুমাবো আমি। এখন, যা তুই। জাস্ট গো!

মেঘা রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে বৃত্তের দিকে চেয়ে রইলো। বৃত্তের কথার অর্থ বুঝতে বেশ বেগ পেতে হলো তার। বৃত্তের অযথা অপরাধবোধ তার নিজের ভেতরে স্বস্থির বীজ বোপন করলো। মেঘাকে এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, বৃত্ত ভ্রু কুঁচকালো। বৃত্ত আরো দু একটা কথা বলবে, তার আগেই মেঘা বৃত্তের বাহু দুহাতে আকড়ে ধরলো। বৃত্ত হতবম্ব হয়ে গেলো। মেঘা বৃত্তের চোখে চোখ রাখলো। তুলোর চেয়েও নরম কণ্ঠে সুধালো,
— তুই আমার বর, বৃত্ত। স্ত্রীর কাছে আসা, কোনো গোনাহের কাজ না। বরং, তা পবিত্র। তোর আমার সম্পর্কের মত আমাদের কাছে আসা’টাও পবিত্র। এতে কিসের এত জড়তা?

বৃত্ত মেঘার কথা শুনে মুচকি হেসে ফেললো। সে মেঘার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো,
— আমি তোকে ছুঁলে, তোর খারাপ লাগবে না?

মেঘা লজ্জা পেয়ে গেল। তবুও সকল লজ্জার বাঁধন ছিন্নভিন্ন করে মিহি কণ্ঠে বললো,
— তোর ছোঁয়ায়, আমার সব সুখ বৃত্ত। এই সুখে আমি মরে যেতেও রাজি।
বৃত্ত একটুখানি হাসলো। এতক্ষণ লজ্জা না লাগলেও, এবার মেঘার লজ্জায় মরে যেতে লাগলো। ইশ, এতসব কথা সে কি করে বলে ফেললো। মেঘা লজ্জায় বৃত্তের কাঁধে মুখ লুকালো। বৃত্ত মেঘার এমন কাজে হেসে ফেললো। মেঘাকে আরো একটু লজ্জা দিতে বললো,
— এখন লজ্জা পাচ্ছিস কেন? এখন তো তোর সব লজ্জা ভাঙার সময়।
ইশ, মেঘার তো একদম অদৃশ্য হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। আবার নিজের সবটুকু তুলে দিতে ইচ্ছে করছে, নিজের ‘প্রিয়’র হাতে। মেঘা বৃত্তের কাঁধে চাপর দিলো। মৃদু কন্ঠে বলল,
— তুই অনেক অসভ্য হয়ে গেছিস, বৃত্ত। মাইর খাবি আমার হাতে।
#মেঘবৃত্ত
#পর্ব_৪১
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

জড়তার সুতো কেটে গেলো। পবিত্রতা ঘিরে ধরলো পৃথিবীর এই মেঘবৃত্তকে। আকাশ ঢেকে গেলো মেঘের স্তরে। মেঘ নিংড়ে নামলো অজস্র বৃত্ত। সম্পূর্ণ ধরণী যেনো একজোট হয়েছে, পৃথিবীর এক মেঘবৃত্তকে এক করার জন্যে। বৃত্ত মেঘাকে কোলে তুলে নিল। মেঘা নখের ধারালো আঘাতে খামচে ধরলো, বৃত্তের টিশার্টের কলার। বৃত্ত চেয়ে রইলো মেঘার মুখের পানে। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো ঘরের দিকে।

মেঘাকে বিছানায় শুইয়ে দিতেই, মেঘা লজ্জায় ওপাশ ফিরে গেলো। বৃত্ত মুচকি হাসলো। মেঘার কাঁধ থেকে শাড়ির আঁচল সরিয়ে মুখ ডুবালো, মেঘার ঘাড়ে। মেঘা শিউরে উঠলো। লোমে লোমে কাঁপন ধরলো তার। শরীর শিরশির করে উঠলো। বৃত্ত মেঘার ঘাড়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চুমু খেয়ে ফিসফিসিয়ে ডাক দিল,
— মেঘ?
মেঘা তখন দু চোখ বুজে। বৃত্তের কথা কানে যেতেই সে সম্বিত ফিরে পেলো। তবে, চোখ খুললো না। বুজে রাখা চোখেই জবাব দিলো,
— হু?
বৃত্ত মিহি কণ্ঠে বললো,
— তুই কি আমার মেঘ হবি? পূর্ণ করবি আমাদের? হবি কি সম্পূর্ণ ভাবে আমার? তোর অনুমতি ছাড়া তোকে ছুঁবো না আমি, প্রমিজ।

মেঘা কাঁপলো খানিক। বৃত্ত মেঘার দিকে চেয়ে আছে, বুকভরা আশা নিয়ে। মেঘা ঘুরে গেলো। বৃত্তের কলার ধরলো শক্ত করে। বৃত্ত তখনো স্বাভাবিক। মেঘা বৃত্তের মাথাটা তার দিকে নিচু করলো। আলতো করে বৃত্তের গালে নিজের ওষ্ঠ ছুঁইয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
— পেয়ে গেছিস অনুমতি?

ঠোঁট টিপে হেসে উঠলো বৃত্ত। অতঃপর, বাতি নিভে গেলো। পর্দা সরে গেলো। মেঘবৃত্তকে জড়িয়ে ধরলো, এক মুঠো পূর্ণতার রশ্মি! ইশ, আজ চাঁদও এই পূর্ণতায় মুখ লুকালো মেঘেদের আড়ালে। আজ বৃত্ত আর মেঘ মিলেমিশে সত্যিকার অর্থে ‘মেঘবৃত্ত’-এ পরিণত হলো।
_____________________________
কটা দিন পরের কথা। কাজ শেষ হওয়ায়, বৃত্ত আজ একটু জলদিই বাসায় ফিরেছে। মেঘা তখন শাশুড়ির সাথে বসে গল্প করছিল। আজকাল, বৃত্তের মা মেঘার প্রতি খানিক নরম হয়ে এসেছেন। মেঘার প্রতি জন্মানো তার অযথা ক্ষোভ এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। বিষয়টা মেঘাকে বেশ স্বস্থি দিচ্ছে। দরজায় কলিং বেল বাজতেই মেঘা একপ্রকার ছুঁটে গেলো দরজা খুলতে। বৃত্ত এসেছে, জানে মেঘা। বৃত্ত আসার আগে ফোন করে জানিয়েছে। মেঘা দরজা খুলতেই বৃত্তের ক্লান্ত দেহ নজরে পড়লো তার। বৃত্তের কপালে ঘাম, শার্টটাও ঘামে ভিজে শরীরের সাথে একদম মিশে গেছে। বৃত্তের এরূপ পরিশ্রম দেখে মেঘার মনে কষ্ট উদয় হলো। মেঘা বৃত্তের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিল। ব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
— সোফায় বস। আমি লেবু পানি আনছি।

বৃত্ত ক্লান্ত হেসে ভেতরে এসে বসলো। মেঘা ড্রইং রুমের ফ্যানটা বাড়িয়ে দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো। খানিক পর হাতে ঠান্ডা পানির শরবত বৃত্তের সামনে ধরলো। বৃত্ত শরবত খেতে খেতে প্রশ্ন করলো,
— মা রাতের খাবার খেয়েছে?
— হুম।
— আর তুই?
মেঘা উত্তর দিলো না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো বৃত্তের পাশে। বৃত্ত বুঝে গেলো, প্রতিদিনকার মত মেঘা আজও খায় নি। বৃত্তের অপেক্ষায় এতক্ষণ বসে ছিলো। বৃত্ত শার্টের টাই ঢিলে করে বললো,
— অযথা অপেক্ষা না করে, খেয়ে নিলেই পারতি। কি লাভ হয় এভাবে প্রতিদিন আমার জন্যে অপেক্ষা করে বসে থাকতে। সেদিন দেখলি না, মাথা ব্যথা উঠে যাচ্ছেতাই অবস্থা হয়ে গেছিলো। তাও, শুধরাস না তুই।

বৃত্ত নিজের মতোই বকতে লাগলো মেঘাকে। মেঘা চুপটি করে বসে রইলো। একসময় বৃত্ত থামলো। হতাশ চোখে মেঘার দিকে তাকালো সে। সে জানে, এই যে মেঘাকে এত এত বকা দিল সে! এসব মেঘার কোনো কাজেই আসবে না। মেঘা একই ভুল আবার করবে। তারপর, মাথা ব্যথায় চিৎকার করে কান্না করবে। এ আর নতুন কি? বৃত্তকে থামতে দেখে মেঘা মুখ খুললো। মিনমিনিয়ে বললো,
— বকিস কেনো? আমার তোর জন্যে অপেক্ষা করতে ভালো লাগে। তাই করি। আরে, কিছু হবে না আমার। চিন্তা করিস না তো। এখন যা, ফ্রেস হয়ে আয়। ভাত বাড়ছি আমি।

বৃত্ত হতাশ নিঃশ্বাস ফেললো। মেঘার দিকে তীক্ষ্ম এক চাওনি
নিক্ষেপ করে মায়ের সাথে দেখা করতে চলে গেলো।
__________________________
কদিন ধরেই মেঘার শরীর ভালো যাচ্ছে না। হুটহাট বমি, মাথা ঘোরানো এসব যেনো মেঘার পিছই ছাড়ছে না। শরীরটাও সারাক্ষণ যেনো ম্যাজম্যাজ করতে থাকে। মেঘার যা সন্দেহ হচ্ছে, তা যদি সঠিক হয়? ইশ, মেঘা তো খুশির চোটে পাগলই হয়ে যাবে।

রাতে ঘুমানোর সময়, মেঘা বৃত্তের বুকে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। বৃত্ত ধীরে হাতে মেঘার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। আজকাল বৃত্তের চিন্তার শেষ নেই। কদিন হলো, মেঘার মাথা ব্যথা বেশ বেড়েছে। সারাদিন ব্যথা করলেই, মেঘা তা কাউকে বলে না। কিন্তু, রাত হলে আর সহ্য হয়না এই মাথা ব্যথা। শুধু মাথা দুহাতে খামচে ধরে, কাঁদতে থাকে। বৃত্ত অনেকবার মাথার টেস্ট করিয়েছে। কিন্তু, লাভ হয়নি। কেউ রোগ ধরতে পারছে না। এ নিয়ে বৃত্তের রাতের ঘুম প্রায় হারাম হয়ে গেছে।

— বৃত্ত?
মেঘার ডাকে বৃত্তের ধ্যান ভঙ্গ হলো। সে বেখেয়ালিতে জবাব দিলো,
— হু?
মেঘা বৃত্তের বুকের আরো গভীরে মাথা গুজলো। বৃত্তও সুন্দর করে আগলে নিল তাকে। মেঘা মিনমিনিয়ে বললো,
— বৃত্ত, আই থিঙ্ক আই অ্যাম প্রেগন্যান্ট।

বৃত্তের হাত থেমে গেলো। চুলে বিলি কাটা বন্ধ হয়ে গেলো। এ কি বললো মেঘা? তার কান ধপধপ করছে। সে কি ঠিক শুনলো?
#মেঘবৃত্ত
#পর্ব_৪২
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
অনুগ্রহপূর্বক, নিচের নোট পড়বেন।

মেঘা বৃত্তের বুকের আরো গভীরে মাথা গুজলো। বৃত্তও সুন্দর করে আগলে নিল তাকে। মেঘা মিনমিনিয়ে বললো,
— বৃত্ত, আই থিঙ্ক আই অ্যাম প্রেগন্যান্ট।

বৃত্তের হাত থেমে গেলো। চুলে বিলি কাটা বন্ধ হয়ে গেলো। এ কি বললো মেঘা? তার কান ধপধপ করছে। সে কি ঠিক শুনলো? বৃত্তের শ্বাস ভারী হয়ে এলো। মেঘার লুকিয়ে রাখা মুখশ্রীটা নিজের দিকে উচুঁ করে চেয়ে রইল ক্ষণিক। মেঘা লজ্জায় দু চোখ বুজে ফেললো মুহূর্তেই। বৃত্ত নরম কণ্ঠে সুধালো,
— সত্যি বলছিস তুই? আমরা আবার মা বাবা হবো?

বৃত্তের এহেন নরম কণ্ঠ শুনে মেঘার খুব আদর আদর পেলো। লজ্জাবতী গাছের ন্যায় মিইয়ে গেলো ও। দু হাতে ঝাঁপটে ধরলো বৃত্তের বলিষ্ট দেহখানা। চোখ থেকে দু ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিয়ে ধরা কণ্ঠে বলল,
— হুম। আমরা দুজন আবার বাবা মা হবো। আবারো আমাদের কোল আলো করে এক ছোট্ট বাচ্চা আসবে। আমরা এবার সত্যি সত্যিই পূর্ণ হবো রে বৃত্ত।

বৃত্তের চোখ টলমল করে উঠলো। আগের বাচ্চাটা নিয়ে বৃত্তের শুধু দায়িত্তনোধ ছিলো ঠিকই, কিন্তু বাচ্চাটা মারা যাওয়ায় বৃত্তের এক মুহূর্তের জন্যে মনে হচ্ছিল, তার বুকটা ফাঁকা ফাঁকা হয়ে গেছে। বুকের মধ্যে কেউ ছুরি ঢুকিয়ে বুকটাকে একদম এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে। এত ব্যথার মধ্যেও সে নির্বাক ছিলো। বৃত্ত ভেঙে পড়লে, মেঘাকে সামলাবে কে? বৃত্ত জানতে অপারগ, তার এই কষ্টের কারণ। শুধু এটুকু জানতো, বাচ্চাটার জন্য মেঘার মত কষ্ট না পেলেও তার কষ্টের ঝুঁলিটাও কম ছিল না বটে।

বৃত্ত চোখ মুছলো। মেঘাকে দুহাতে আগলে নিয়ে মেঘার চুলে ঠোঁট বসালো। মিহি সুরে বললো,
— আলহামদুলিল্লাহ!

মেঘা নিজেও ফিসফিসিয়ে বললো, ‘ আলহামদুলি্লাহ ‘.
অতঃপর, কেটে গেলো কতক মুহূর্ত। হঠাৎ মেঘা ডাক দিল,
— বৃত্ত?
বৃত্তের মাথায় তখন ঘুরছে নানা চিন্তা। তার সব চিন্তাটা যেনো এই আগত বাচ্চাকেই ঘিরে। মেঘার ডাকে তার হুশ এলো। জবাব দিলো সে,
— হু, বল।
— এই বাচ্চাটাও কি তোর জন্যে শুধু দায়িত্ত্ব হয়েই থেকে যাবে রে? প্লিজ, আমার বাচ্চাকে এবার অন্তত বাবার অধিকার থেকে বঞ্চিত করিস না। পায়ে পড়ি তোর। প্লিজ!

মেঘা কেঁদে উঠলো শব্দ করে। মেঘার কান্না দেখে অপরাধবোধ বৃত্তকে আস্টেপিস্টে ঘিরে ফেললো। বৃত্ত শশব্যস্ত হয়ে উঠলো। মেঘার মুখটা নিজের দিকে তুলে সারামুখে অজস্র চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে তুললো। মেঘা চোখ বন্ধ করে শুধু উপলব্ধি করলো বৃত্তের এই ভালোবাসার স্পর্শ। বৃত্ত মেঘার কপালে নিজের কপাল ঠেকালো। ধরা কণ্ঠে বলল,
— আমি সরি রে মেঘ। আর আমাকে মনে করিয়ে দিস না, আমি কত বড় অপরাধ করেছি। বৃত্ত সরি বলছে তার মেঘকে। একবার, দুবার, হাজারবার। সে তার বাচ্চাকে আর কখনো অবহেলা করবে না। কখনো না। বৃত্ত তার বাচ্চা আর বাচ্চার মাকে মাথায় তুলে রাখতে জানে। কি, জানে না?

মেঘা মাথা নাড়লো, উপর নিচে। বৃত্ত হাসলো। মেঘার কপালে চুমু খেয়ে মেঘার মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলো। মেঘা একদম গুটিয়ে গেলো বৃত্তের বুকের মধ্যিখানে। বৃত্ত টিটকারী মেরে বললো,
— তুই অনেক ছিঁচকাদুনে রে মেঘ। এখন তো আমার নিজের কথা ভেবেই টেনশন হচ্ছে। বাচ্চাটা হয়ে গেলে আমি কাকে সামলাবো। বাচ্চাকে না তার বাচ্চা মাকে?

মেঘা হেসে ফেললো। বৃত্তের কাঁধে চাপর মেরে বললো,
— চুপ, আর একটা কথা বললে মাইর খাবি আমার থেকে।
— তুই তোর হাসবেন্ডকে মারবি? হাসবেন্ডকে মারলে গুনাহ হয় জানিস না?
— না, জানিনা। আর জানার দরকারও নেই আমার। এত জেনে কি হবে?
— আমাদের আরো ডজন খানেক বাচ্চা হবে, আরকি!
মেঘা এবার লজ্জায় গুটিয়ে গেল। বৃত্তের বুকে আদুরে দুয়েক কিল ঘুষি দিয়ে গাল ফুলিয়ে বললো,
— চুপ, একদম চুপ। খালি অসভ্য কথাবার্তা।
বৃত্ত হেসে হেসে মেঘাকে নিজের বুকের সাথে একদম মিশিয়ে ফেললো। ইশ, ভালোবাসা কি ভীষন সুন্দর!
________________________
আজ মেঘার প্রেগন্যান্সি রিপোর্ট দিবে। বৃত্ত মেঘার প্রেগন্যান্সি টেস্ট এর সাথে তার মাথার আরো একটা টেস্ট করিয়েছে। আজ এসব গুলোর রিপোর্ট দিবে। বৃত্ত অফিসের কাজ শেষ করে হাসপাতালে এসেছে রিপোর্ট নেওয়ার জন্যে।
একটু পর বৃত্তের সিরিয়াল এলে, বৃত্ত চেম্বারে প্রবেশ করলো। ডাক্তার একদম মধ্য বয়স্ক। বৃত্ত তাকে সালাম দিয়ে চেয়ারে বসলো। ডাক্তার চোখের চশমা নাকের ডগায় তুলে বেশ কিছুক্ষণ নজর বুলালেন রিপোর্ট দুটিতে। বৃত্ত একসময় জিজ্ঞেস করলো,
— অ্যানি প্রবলেম, ডক্টর?

ডাক্তার এবার মুখ তুলে তাকালেন বৃত্তের দিকে। রিপোর্ট দুটো টেবিলের একপাশে রেখে দুহাত ভাঁজ করে টেবিলে রাখলেন। বললেন,
— কংগ্রাচুলেশন, ইউ আর গোইং টু বি অ্যা ফাদার।
বৃত্ত হেসে ফেললো। মাথা চুলকে লজ্জামিশ্রিত কণ্ঠে বললো,
— থ্যাংকস!
— বাট, মিস্টার বৃত্ত। আই অ্যাম সরি টু সে দ্যাট, আপনার স্ত্রীর একটা ম্যাজর রোগ হয়েছে। সেই প্রবলেম তার লাইফকে অব্দি রিস্কে ফেলে দিতে পারে।
#মেঘবৃত্ত
#পর্ব_৪৩
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

— কংগ্রাচুলেশন, ইউ আর গোইং টু বি অ্যা ফাদার।
বৃত্ত হেসে ফেললো। মাথা চুলকে লজ্জামিশ্রিত কণ্ঠে বললো,
— থ্যাংকস!
— বাট, মিস্টার বৃত্ত। আই অ্যাম সরি টু সে দ্যাট, আপনার স্ত্রীর একটা ম্যাজর রোগ হয়েছে। সেই প্রবলেম তার লাইফকে অব্দি রিস্কে ফেলে দিতে পারে।

ডাক্তারের এহেন কথা শুনে বৃত্তের মাথা মুহূর্তেই যেনো ঘুরে গেলো। হাত দিয়ে শক্ত করে চেয়ারটা খামচে ধরে সে বললো,
— ক-কি রোগ হয়েছে আমার মেঘের?

মধ্যবয়সি ডাক্তার বৃত্তের এমন ভেঙে পড়া দেখে নিজেও একটুখানি অবাক হলেন। স্বামীকে তার স্ত্রীর এই মরণঘাতী রোগ সম্পর্কে জানানো, বেশ জটিল ব্যাপার বটে। ডাক্তার একটু নড়েচড়ে বসলেন। অতঃপর বেশ শান্ত সুরে বললেন,
— শি হ্যাজ এ ম্যাজর ব্রেইন টিউমার!

‘ব্রেইন টিউমার’ মত বিশ্রী শব্দটা বৃত্তকে বুকে ছুরি চালালো অজস্রবার। হুট করেই বৃত্তের মনে হলো, ‘ ব্রেইন টিউমার’ শব্দটা কোনো হালকা শব্দ নয়, বরং আসমান সমতুল্য ভারী এক শব্দ। যার ভার বৃত্তের দ্বারা বহন করা সম্ভব না। সে মরে যাবে! মেঘবিহীন বৃত্ত ঝড়ে যাবে, নিঃশেষে হয়ে যাবে, ক্ষয় হয়ে যাবে। বৃত্ত ধরা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— এই রোগ কি নিরাময়যোগ্য না? মেঘ ভালো হয়ে যাবে, এই আশা আপনি কি আমাকে দিতে পারবেন না? বলেন?

ডাক্তার লোকটা বুঝতে পারলো বৃত্তের কষ্ট। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মেঘার মাথার সিটিস্ক্যান বৃত্তের দিকে তুলে সেটাতে একটা অংশ ইঙ্গিত করে দেখালেন! বললেন,
— মিস.মেঘার মাথার ঠিক সেন্ট্রালে এই টিউমারটা রয়েছে। টিউমার অপারেশন করা যাবে, তবে তাতে মেঘার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুব কম। এই ধরেন, ৫%! তবে, এই অপারেশন বাচ্চা পেটে থাকাকালীন করা যাবে না। এতে বাচ্চাটা মারা যাবে নিশ্চিত! মেঘার অ্যাবোরেশন করিয়ে অপারেশন করতে হবে। তবে ওই যে বললাম, টিউমারটা একদম সেন্ট্রাল হওয়ায় মেঘার অপারেশন সাক্সেসফুল হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

এটুকু বলে থামলেন ডাক্তার। বৃত্ত হতবম্ব। এসব কথা শুনে তার কথা হারিয়ে গেছে। চোখ দুটোতে মনে হচ্ছে, কেউ আগুন ঢুকিয়ে দিয়েছে। মরিচের ন্যায় জ্বলছে তার চোখ। যেকোনো মুর্হুতে বৃত্তের সব বাঁধা উপেক্ষা করে তার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়বে। বৃত্ত খুব কষ্টে মুখ খুললো,
— বাঁচার কি কোনো চান্স নেই, ডক্তর?

কথাটা বললে বৃত্তের যে দমবন্ধ হয়ে আসছে, ডাক্তার সেটা হলপ করে বলতে পারেন। ডাক্তার লোকটা বললেন,
— আছে! বাচ্চাটা অ্যাবোরেশন করে তারপর একটা ম্যাজর অপারেশন করতে পারলে মেঘার বাঁচার সম্ভাবনা ৫%! আর যদি এই অপারেশনটা একমাসের মধ্যে না করান, তবে আপনার স্ত্রী বড়জোর ছ মাসের মত বেঁচে থাকবেন। যেহেতু আপনার স্ত্রীর গর্বের বাচ্চার বয়স মাত্র দুই মাস। এই আট মাসে বাচ্চাটা আদৌ জন্ম নিতে পারবে কিনা, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। এবার আপনি ঠিক করুন কি করবেন? তবে আপনার বাচ্চার অ্যাবরেশনের সিদ্ধান্ত একা আপনার হলে হবে না, বরং আপনার স্ত্রীর এতে সম্মতি থাকতে হবে। বুঝতে পেরেছেন আমি কি বলেছি?

বৃত্ত আর সহ্য করতে পারলো না। টেবিলে হাত ভাঁজ করে মাথাটা নত করে ফেললো সে। বহু কষ্ট আটকে রাখা এক ফোঁটা জল বিসর্জন গেলো তার চোখ বেয়ে। ডাক্তার বৃত্তের এহেন অবস্থা দেখে নিজেও কষ্ট পেলেন। বললেন,
— মিস্টার বৃত্ত, নিজেকে সামলান। সামনের পরিস্থিতিটা আরো বিদঘুটে হয়ে অপেক্ষা করছে আপনার জন্যে। সামলান নিজেকে।

বৃত্ত মাথা উঁচু করে চেয়ে রইলো মেঘার মাথার সিটিস্ক্যানের দিকে। খুব কান্না পাচ্ছে তার। এ কি দুটানায় পড়লো সে? আল্লাহ তাকে এ কি পরিস্থিতির মধ্যে আটকে দিয়েছেন?

ডাক্তারের চেম্বার থেকে বিদায় নিয়ে বৃত্ত রাস্তার মোড় ঘেঁষে হাঁটতে লাগলো। বেশ রাত হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে ঘড়িতে সময় দেখতে ইচ্ছে হলো না বৃত্তের। মনেমনে আন্দাজ করলো সে, ঘড়িতে বোধহয় এগারোটা বাজে। বৃত্ত বারবার শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছছে। তার ভেতরের গুমরে গুমরে কান্নার অভিযোগ শোনাচ্ছে নিজ রবের কাছে। হঠাৎ বৃত্তের ফোন বেজে উঠলো। বৃত্ত গলা খাঁকারি দিয়ে চোখ পরিষ্কার করলো। ফোন হাতে নিয়ে মেঘার নাম্বার দেখে তার বুকটা আবার ভারী হয়ে উঠলো। সে ফোন রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে মেঘার উচ্ছল কণ্ঠস্বর কানে এলো তার,
— রিপোর্ট পেয়েছিস, বৃত্ত? কি এসেছে রিপোর্টে? বল না? এই বৃত্ত? হ্যালো, হ্যালো, বৃত্ত?

বৃত্ত চোখ ভারী, ভেজা। সে যথাসম্ভব নিজেকে সামলে বললো,
— হুম, পেয়েছি রিপোর্ট।
— ওহ, কি এলো? বল না? আমি সত্যি সত্যি প্রেগন্যান্ট তো? আরে, বল না জলদি।
বৃত্ত একটু হাসার ভান করে বললো,
— জ্বি, মিসেস উডবি মাম্মাম! আমাদের বাচ্চা আসবে, কনফার্ম।
— সত্যিই?
মেঘা কথাটা শুনে সজোরে চিৎকার দিয়ে উঠলো। চিৎকারের শব্দে বৃত্তের কানের পোকা যেনো আজ বের হয়েই যাবে। বৃত্ত হাসার চেষ্টা করলো। বললো,
— হুম, সত্যি।
— আল্লাহ, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। সত্যিই আমি মা হবো?
— মেঘ?
— হুম, বল।
— আমার ফিরতে আজ লেইট হবে। তুই খেয়ে নিস। খবরদার না খেয়ে থাকবি তো আজ আমার বুক পেতে দিবো না তোকে। তুই একপাশে ঘুমাবি আর আমি একপাশে। কাছে আসলেই বেদম মাইর খাবি।

মেঘা মুখ ফুলালো। ঠোঁট উল্টে বললো,
— ঠিক আছে। খাবো আমি। তুই কিন্তু বেশি লেইট করবি না। আমি অপেক্ষা করবো তোর জন্যে।
— ঠিক আছে মেরি বউ। এখন যা, খেয়ে নে কিছু। রাখছি।
— হুম, বাই।

বৃত্ত ফোন কেটে দিলো। রাত বেড়ে গেছে। রাস্তার গলিতে মানুষের চলাচল থেমে গেছে। সম্পূর্ণ রাস্তা এখন স্থবির, শান্ত! বৃত্ত রাস্তার ফুটপাতে বসে গেল। মেঘার প্রেগন্যান্সি রিপোর্ট হাতে নিয়ে কতক্ষণ চেয়ে রইলো সেই রিপোর্টটার দিকে। একসময় বৃত্ত আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। রিপোর্টটার মধ্যে মাথা রেখে পুরুষালি নিয়মের সম্পূর্ণ বাইরে গিয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠলো সে। বৃত্তের কান্নার শব্দ নীরব রাস্তাটাকেও কাঁদিয়ে ফেললো। আজ চাঁদ কাঁদলো, আকাশ কাঁদলো, মেঘ কাঁদলো, মেঘের বৃত্ত কাঁদলো। কান্নায় কান্নায় ভারী হলো পৃথিবীর বায়ু। এত কষ্ট কেনো হচ্ছে বৃত্তের?
#মেঘবৃত্ত
#পর্ব_৪৪
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

নতুন অতিথি আসার খুশিতে বৃত্তদের ঘরে যেনো উৎসব লেগে গেছে। মেঘার বাবা মাও আজ এ বাড়ি এসেছেন। পাড়ার চেনা পরিচিত মহিলারা মেঘার মাথায় হাত বুলিয়ে কতশত দোয়া পড়লেন। সর্বোপরি, এক এলাহী কাণ্ড! এসবের মধ্যে বৃত্ত একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। বুকে হাত ভাঁজ করে স্থির দৃষ্টিতে পরখ করছিল সবার খুশি, আনন্দ। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে তার। কি করবে, কোথায় যাবে কিছুই মাথায় ঢুকছে না। মেঘার চিন্তায় চিন্তায় তার মাথাটা মনে হচ্ছে, পেঁচিয়ে যাচ্ছে। কিন্ত, এই মেঘাকে দেখো না? আজ তার মুখ থেকে হাসি সরছেই না। কথা বলছে আর ক্ষণে ক্ষণে হাসছে শুধু। সবার থেকে ক্রমাগত দোয়া নিচ্ছে বাচ্চার জন্যে। এবার যেনো বাচ্চাটার আর কোনো ক্ষতি না হয়! এবার বাচ্চাটার কিছু হলে মেঘাকে বাঁচানো যাবে না একদম। দূর থেকে মেঘার খুশি দেখে বৃত্ত প্রচন্ড কষ্ট হলো। কান্না পাচ্ছে খুব তার। সে বারবার আঙ্গুলের ডগা দিয়ে চোখ মুছে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে। আজ মেঘা বাচ্চাটা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় বৃত্তের দিকে তাকানোর সময় নেই তার। মেঘা ওর মত অনাগত বাচ্চাকে নিয়ে সুন্দর সময় কাটাচ্ছে। বৃত্তের এমন অসহায়ত্ব আর কারো নজরে না পড়লেই বৃত্তের মায়ের নজরে ঠিকই পড়েছে। তিনি দূর থেকে ভ্রু কুঁচকে বৃত্তের দিকে চেয়ে আছেন। বৃত্তের ভেজা চোখ তার মনকে চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে। বৃত্তের মা এগিয়ে আসতে যাবেন, তার আগেই তাকে একজন মহিলা টেনে নিয়ে গেলেন কথা বলার জন্যে। বৃত্তের সাথে কথা বলা আর হলো না তার। তবে মনেমনে তিনি প্রচন্ড উশখুশ করতে লাগলেন। এই মুহূর্তে বৃত্তের সাথে কথা বলাটা খুব দরকার!
_______________________
মধ্য রাত, মেঘা বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। এই একটু আগে অব্দি মেঘা মাথা ব্যথায় চিৎকার করে কেঁদেছে। বৃত্ত আর কোনো উপায় না পেয়ে মেঘাকে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। বৃত্ত মেঘার ঘুমন্ত মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। মুগ্ধ হলো সে, প্রিয় মানুষের নিষ্পাপ মুখখানা দেখে!
পৃথিবীর সবচেয়ে সবচেয়ে মুগ্ধকর মুহূর্ত হলো, যখন প্রিয় মানুষটা নিজের পাশে ঘুমিয়ে থাকে। তার একেকটা নিঃশ্বাস জানান দেয়, মানুষটার প্রতি এক বুক ভালোবাসা! তার বুজে থাকা চোখ জানান দেয় প্রিয় মানুষটাকে ঘিরে থাকা তার নিদারুণ ভরসা। ঘুমন্ত অবস্থায় এই পৃথিবীর সকল প্রিয় মানুষকেই সুন্দর লাগে।

বৃত্ত মাথা ঝুঁকে মেঘার কপালে নিজের ঠোঁট ছোঁয়ালো। মেঘা ঘুমের মধ্যেই বৃত্তের হাত ছুঁয়ে একটু নড়েচড়ে আবার শুয়ে পড়লো। বৃত্ত সরে এলো। শীত প্রায় কমে এসেছে। ঈষৎ গরম পড়েছে দেশে। বৃত্ত মেঘার গা কাঁথা দিয়ে ঢেকে দিলো। অতঃপর, সে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।

বৃত্তদের ঘরের ড্রইং রুমে এক বড় বারান্দা আছে। বৃত্ত সে বারান্দায় গিয়ে গ্রিল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গেলো। নিজের ঘরে সিগারেট খেলে মেঘার ঘুমে সমস্যা হতে পারে। মাথা ব্যথাটাও আবার চাড়া দিতে পারে। সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিয়ে তাতে আগুন ধরালো। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বৃত্ত ভাবলো খুব। এই বাচ্চাটা তার চাই, তেমন করে মেঘাকেও তার চাই। কোন মুখে সে মেঘাকে বলবে, বাচ্চা অ্যাবোরেশনের কথা! মেঘা তো ওকে মেরেই ফেলবে। একবার বাচ্চা হারিয়ে মেঘার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। মেঘার কষ্টের সাক্ষী স্বয়ং সে নিজেই। আরো একবার বাচ্চা স্বেচ্ছায় নষ্ট করার কথা বললে, মেঘা হয়তো সারাজীবনের জন্যে বৃত্তের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিবে। তখন, বৃত্ত বাঁচবে কাকে নিয়ে? উফ, বৃত্তের মাথা ধরে যাচ্ছে। সিগারেটের ধোঁয়ায় বৃত্তের চোখ জ্বলছে। তবুও সে একটার পর একটা সিগারেট শেষ করছে।

— এসব কি, বৃত্ত? তুই এই মাঝরাতে সিগারেট খেয়ে ঘর ধোঁয়া করছিস কেনো? তোর বাবা দেখলে কুরুক্ষেত্র ঘটে যাবে।

মায়ের কন্ঠ শুনে বৃত্ত তটস্থ হয়ে উঠলো। চটজলদি হাতের সিগারেটটার আগুন নিভিয়ে বারান্দা দিয়ে ফেলে দিলো। দু চোখ মুছে মায়ের দিকে ফিরল সে। নত কণ্ঠে বললো,
— আসলে, ঘুম আসছিলো না। তাই ভাবলাম….
— মেঘা কোথায়?
— ঘুমাচ্ছে।
— তাহলে, তুই এখানে কি করছিস?
— ঘরে সিগারেট খেলে মেঘার ঘুমাতে প্রবলেম হবে, তাই ভেবেছিলাম এখানে এসে…

কথা অসম্পূর্ণ রেখে বৃত্ত থামলো। বৃত্তের মা এবার দমলেন একটু। হঠাৎ বিকেলের কথা মনে পড়ায় তিনি কালবিলম্ব না করে বললেন,
— তুই কি কোনো কারণে কষ্টে আছিস বৃত্ত? আজ বিকালেও দেখলাম তুই কেমন উদাস। কি হয়েছে মাকে বল। মেঘা কিছু করেছে?

বৃত্ত মায়ের কথা শুনে মুখটা ভার করে ফেললো। কথা এড়িয়ে যাবার চেষ্টায় বললো,
— না, কিছু হয়নি মা। তুমি খামোকা চিন্তা করছ!
— তাই? মাকে মিথ্যা বলছিস? এত সাহস কোথা থেকে এলো তোর, হ্যাঁ?
বৃত্ত অনেক চেষ্টা করলো কথা লুকানোর। কিন্তু মায়ের এমন ভরসার হাত নিজের কাঁধে পেতেই এবার আর নিজেকে আটকাতে পারলো না। মাকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। চোখ থেকে দু ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিয়ে বললো,
— মা, আমার সব শেষ মা। সব শেষ। তোমার বৃত্ত মরে যাচ্ছে, মা। তুমি কিছু একটা করে আমাকে বাঁচাও প্লিজ। আমি মেঘ ছাড়া শেষ হয়ে যাবো মা। প্লিজ মা, আমার মেঘকে বাঁচাও!

বৃত্তের মা বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে গেলেন। বৃত্তের নীরব কান্নার জলের অস্তিত্ব নিজের কাঁধে পেতেই তিনি সম্ভিত ফিরে পেলেন। বৃত্তের পিঠে একহাত রেখে বললেন,
— বৃত্ত, কি হয়েছে মেঘার? বল মাকে।
বৃত্ত থামলো খানিক। ধরা গলায় খুব কষ্টে মুখ খুললো সে। বললো,
— ওর ব্রে-ব্রেইন টিউমার।
বৃত্তের মায়ের হাত থেমে গেলো। অসার হয়ে গেলো সম্পূর্ণ শরীর। নিজের অজান্তেই তার হাত নিচে পড়ে গেল। অবাক কণ্ঠে বললেন তিনি,
— ব্রেইন টিউমার?
— হ্যাঁ! কাল ডাক্তার বলেছে হয় বাচ্চাকে বাঁচাতে নয় মেঘকে। টিউমারের পজিশন এত ক্রিটিকাল যে মেঘের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুব কম। মা, ডাক্তার কি করে এমন কথা বলতে পারলো? আমি আর মেঘ মাত্রই তো এক হলাম। এত জলদি দুজন আবার আলাদা হয়ে যাবো কি করে মা? মা প্লিজ, আমার মেঘকে বাঁচাও। আমি মরে যাবো মা। সত্যিই মরে যাবো। আমার কোনো বাচ্চা চাইনা, আমার শুধু মেঘকে চাই, মা। শুধু মেঘকে চাই। আল্লাহ আমাকে এত বড় শাস্তি কি করে দিতে পারলেন, মা?

বৃত্তের মা ছেলের এমন ভেঙে পড়া দেখে কি বলবেন খুঁজে পেলেন না। ছেলের এহেন কষ্টে তার চোখেও জল জমে গেলো। বৃত্ত যথেষ্ট শক্ত এক ছেলে। ছোটবেলা থেকে তার কান্নার অভ্যাস খুব কম। বড় হওয়ার পর থেকে যতই কঠিন পরিস্থিতি হোক না কেনো, বৃত্তের চোখ ভেজে না। সে জানে পরিস্থিতি কি করে সামলাতে হয়। কিন্তু, আজ এক অন্য বৃত্তকে আবিষ্কার করলেন বৃত্তের মা। এই বৃত্ত কাঁদছে, নিজের ভালোবাসার জন্য। হু হা করে কাঁদছে সে। বৃত্তের মা ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দিতে লাগলেন। কিন্তু আজ তিনি নিজেও ভেঙে পড়েছেন। মেঘার এহেন অবস্থা তিনি মোটেও মেনে নিতে পারছেন না। কি থেকে কি হয়ে গেল? তার সাজানো গোছানো সংসারটা এভাবে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে দেখে তার মনটা হাহাকার করে উঠলো।
#মেঘবৃত্ত
#পর্ব_৪৫
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

অতঃপর কেটে গেলো কতক দুঃসহ দিন। এ কদিনে বৃত্ত বহু চেষ্টা করেছে মেঘাকে বাচ্চা অ্যাবোরেশনের কথা বলতে। কিন্তু, মেঘার বাচ্চা নিয়ে পাগলামি দেখে বৃত্তের সাহস হয়ে উঠেনি। শেষ পর্যন্ত বৃত্ত নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত নিলো, বাচ্চাটা জন্ম নেওয়ার পরই মেঘার অপারেশন হবে। বৃত্ত পারবে না, মেঘার মনটা আবার টুকরো টুকরো করে ভেঙে ফেলতে।
বৃত্তের অফিস থেকে কক্সবাজারের একটা ট্যুরের আয়োজন করেছে। ট্যুরটা মূলত অফিসের কাজ ডেভেলপ করার জন্যেই আয়োজিত হয়েছে। কিন্তু, বৃত্ত মেঘাকে এমন অবস্থায় রেখে ট্যুরে যেতে নারাজ। মেঘা অনেকবার বুঝিয়েছে বৃত্তকে। বারবার বলেছে, ‘ সে আর বাচ্চা দুজনেই ঠিক আছে! তাদের নিয়ে এত চিন্তা করতে হবে না। বৃত্তের ট্যুরে যাওয়াটা দরকার। খামোকা মানা করে লাভ কি ‘

অবশেষে , বৃত্ত রাজি হয়েছে। তবে সে একা যাবে না। মেঘাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। বৃত্তের কথা শুনে মেঘার খুশি দেখে কে? মেঘা একদিনের ভেতরেই সমস্ত লাগেজ রেডি করে ফেললো। ট্যুরের সবাই অফিসের টাকায় বাস দিয়ে গেলেও বৃত্ত মেঘার কথা ভেবে প্লেইনের টিকেট বুক করেছে। মেঘাকে নিয়ে সে কোনো রিস্ক নিতে চায়না।
এ ছ মাস মেঘবৃত্তের জীবনের স্বপ্নের সময় হবে। এই ছ মাসে মেঘবৃত্ত এক হবে, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত তাদের ঝুলিতে পুড়বে। সারা জনমের একসাথে থাকার তৃষ্ণা এ ছয়মাসে তারা পূরণ করবে। ভালবাসার এক নতুন অধ্যায় গড়বে এই ছোট্ট মাসগুলোতে।
______________________________
মেঘবৃত্ত মাত্রই রিসোর্টে এলো। ইতিমধ্যে মেঘার দুবার বমি হয়েছে। মাথা ব্যথায় চোখে পানি চলে এসেছে তার। মেঘাকে এত কষ্ট পেতে দেখে বৃত্তের নিজের চোখেও পানি চলে এলো। বৃত্ত মেঘার হাত ধরে বললো,
— খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে, মেঘ?
মেঘা একহাতে মাথা খামচে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। ঠোঁট কামড়ে ধরে বললো,
— বৃত্ত, আমার মাথা! আমার মাথাটা ফেঁটে যাচ্ছে বৃত্ত। মাথার ভেতর মনে হচ্ছে কেউ ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছে। ইয়া আল্লাহ, এত কষ্ট কেন হচ্ছে আমার?

মেঘা ক্রমশ আর্তনাদ করতে লাগলো। বৃত্ত নিজের চোখের জল মুছে মেঘার মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলো। মাথায় ঘনঘন হাত বুলিয়ে ধরা গলায় বললো,
— আল্লাহকে ডাক মেঘ। সব ঠিক হয়ে যাবে। কিচ্ছু হবে না তোর। তোর কিছু হয়ে গেলে আমার কি হবে রে মেঘ? আমি মরে যাবো রে। খুন হয়ে যাবো আমি। আল্লাহকে ডাক মেঘ।

মেঘা বৃত্তের কথার অর্থ ধরতে পারলো না। বৃত্তের পিঠের শার্ট খামচে ধরে ঘাপটি মেরে মিশে রইলো বৃত্তের বুকের সাথে।
______________________
মেঘা মাত্রই গোসল করে বের হলো। ঔষধ খাওয়ার পর মাথা ব্যথাটা খানিক কমেছে। নাক মুখ লাল টকটকে হয়ে গেছে মেঘার। কান্না করতে করতে শ্বাসকষ্ট উঠে গেছে তার। এখন গোসল করায় একটুখানি শান্তি লাগছে।

বৃত্ত বিছানায় বসে আছে। মুখখানা ভার, থমথমে। হাঁটু ক্রমাগত নাড়িয়ে নত মুখে কি একটা চিন্তা করেই যাচ্ছে সে।
মেঘা হাতে পায়ে ক্রিম দিতে দিতে বৃত্তের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলো,
— ওই, কি হলো তোর? এমন করে বসে আছিস কেনো?

মেঘার কণ্ঠ শুনে বৃত্তের মুখ স্বাভাবিক হলো। মাথা উঁচু করে মেঘার দিকে তাকালো সে। মেঘার শরীর ভেজা, চুল থেকে টপটপ পানি পড়ছে। শাড়ীর আঁচল মাটি ছুঁইছুঁই। কি সুন্দর দৃশ্যখানা। বৃত্ত বড়ই মুগ্ধ হলো। ভুলে গেলো যতসব সব চিন্তা, ভয়। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো মেঘার দিকে।

ঘাড়ে তপ্ত নিঃশ্বাসসের অস্তিত্ব পেতেই মেঘার শরীর শিরশির করে উঠলো। কোমরে বৃত্তের হাতের ছোঁয়া পেতেই তার শ্বাস আটকে যেতে লাগলো। এ কি করছে বৃত্ত? বৃত্তের এমন আগুন ছোঁয়ায় মেঘার যেনো মরণ নিশ্চিত! বৃত্ত মেঘার শরীর নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
— নিড অ্যা কিস রাইট নাও, মিসেস বৃত্ত!

ইশ, কিসব অশ্লীল কথা। মেঘা বরাবরের মত লজ্জা এর অস্বস্তিতে লাল হয়ে গেলো। মেঘা দেয়ালের সাথে একদম মিশে আছে। বৃত্ত মেঘার দুপাশে দুহাত দেয়ালে ঠেসে রেখে ঝুঁকে আছে মেয়েটার দিকে। ঘরের একপাশের বিশাল জানালা থেকে ভেসে আসছে, সমুদ্রের গর্জন-তর্জন। মৃদু মন্দ দখিনা বাতাস দুজনের গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে। উড়ছে মেঘার চুল, মেঘার শাড়ির আঁচল। বৃত্ত নেশাময় চোখ রাখলো মেঘার পানে। আলতো হাতে মেঘার বেবি হেয়ার কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে ওষ্ঠ ছোঁয়ালো মেঘার দু ভ্রুয়ের ঠিক মধ্যখানটায়। মেঘা কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে চোখ খিঁচলো। খামচে ধরলো বৃত্তের কাঁধের টিশার্ট। বৃত্ত সরে এলো মেঘার থেকে। চোখ রাখলো মেঘার দু আফিমসম নেশালো চোখে। সঙ্গেসঙ্গে ডুবে গেলো সে, হারিয়ে গেলো, মত্ত হলো ওই কাজল কালো চোখ জোড়ায়। বৃত্ত ফিসফিসিয়ে বললো,
— তুই এত সুন্দর কেন রে মেঘ? কি মাখিস বল তো, আমাকে তোর নেশায় বুদ করে রাখতে?

মেঘার মনটা ভরে গেলো। চোখ ভিজে এলো, গলা শুকিয়ে গেলো। মনে হলো, এক জীবনে আর কি চাই তার। বৃত্ত নামক প্রেমিক পুরুষটা তাকে ভালোবাসে। নিজ পুরুষের চোখে মেঘা সবচেয়ে সুন্দরতম নারী। এর চেয়ে শ্রেষ্ট অনুভূতি আর কিইবা হতে পারে। মেঘার ভয় হলো। যদি বৃত্তকে সে হারিয়ে ফেলে? তখন কি হবে মেঘার? এত এত ভালোবাসা হারিয়ে ফেললে মেঘা তো মরেই যাবে।
মেঘাকে চিন্তায় দেখে বৃত্ত হালকা ভ্রু কুচকালো। মেঘার থুতনি আঙ্গুলের ডগায় ধরে উচুঁ করলো। মেঘা চিন্তা ভেঙে বৃত্তের দিকে তাকালে বৃত্ত বললো,
— কি ভাবিস এত?
মেঘা ঢোক গিললো। কম্পিত কণ্ঠে বললো,
— আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
বৃত্ত মুচকি হাসলো। বললো,
— হুম, বল।
— আমি মরে গেলে তুই কি করবি বৃত্ত? আমার ভাগের ভালোবাসা তুই অন্য কাউকে দিয়ে দিবি?
মেঘার কথা শুনে হুট করেই বৃত্তের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। দাঁতে দাঁত চেপে অদ্ভুত এক শব্দ তুললো সে। জোরে জোরে কতক নিঃশ্বাস ফেলে হঠাৎ করেই খামচে ধরলো মেঘার নরম দুগাল। মেঘা বোকা বনে গেলো। হুট করে বৃত্তের এমন রাগ দেখে ভয়ে তার আত্মা শুকিয়ে গেলো। বৃত্ত দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে বললো,
— আবার মরার কথা বলে দেখ না? মাটিতে পুঁতে ফেলবো একদম। মরার শখ জাগছে না তোর? এক কাজ করি, বিষ এনে তোকে প্রথমে খাইয়ে আমিও খেয়ে নেই। তারপর, দুজনেই একদম পগার পা। ভালো আইডিয়া না? এখন চুপ কেন? উত্তর দে?

মেঘা গাল দুটো মনে হচ্ছে বৃত্তের আঙ্গুল দেবে যাচ্ছে। মেঘা ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো। বৃত্ত সঙ্গেসঙ্গে মেঘাকে ছেড়ে দিলো। মেঘা ছাড়া পেয়ে গালে হাত রেখে আহত চোখে বৃত্তের দিকে চেয়ে রইলো। বৃত্ত সরে দাঁড়ালো। দুবার ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে খামচে ধরলো নিজের মাথার চুল। এতেও যখন তার রাগ ঠান্ডা হলো না, সে বেরিয়ে গেলো রুম ছেড়ে। যাওয়ার আগে মেঘার দিকে আঙুল উচিয়ে বলে গেলো,
— থাক তুই, তোর এসব লেইম মরার চিন্তা নিয়ে। আমি চলে যাচ্ছি। খবরদার, আমাকে ফোন দিবি না, খুঁজবিও না।

বৃত্ত চলে গেলো। মেঘা সেখানে হাঁটু গেরে বসে গেল। কি থেকে কি হয়ে গেল, সে বুঝতেই পারলো না। এমন নয় যে, মরার কথা মেঘা এর আগে কখনো বলে নি। বলেছে সে। তবে, আজকের মত বৃত্ত এতটা রাগ দেখায় নি। আজ কি হলো তার? তবে, মেঘা জানে। বৃত্ত আসবে। রাত গভীর হলেই বৃত্ত তার কাছেই ফিরে আসবে। প্রতিদিনের মত মেঘাকে বুকে জড়িয়ে ঘুমাবে। এটাই যে মেঘবৃত্তের রোজকার নিয়ম!
________________________
ঘুমের মধ্যেই মেঘা উপলব্ধি করল, বৃত্ত তার পাশে নেই। মেঘার চোখ খুলে গেল। রুমের চারপাশ পরখ করলো। বারান্দা থেকে সিগারেটের গন্ধ নাকে আসতেই মেঘার ভ্রু কুঁচকে গেলো। ছিঃ, বৃত্ত আবার সিগারেট খাচ্ছে? একে তো আজ একটা বেদম গালি দিতেই হবে। সিগারেট খাবে আর হার্ট নষ্ট করবে। বৃত্তের কিছু হয়ে গেলে, মেঘার কি হবে? মেঘা বেশ রাগ নিয়ে বিছানা ছাড়লো।

হোটেলের বারান্দায় ডিভানে বসে আছে বৃত্ত। হাতে সিগারেট। যে বৃত্ত এককালে মেঘার জন্যে সিগারেট ছেড়ে দিয়েছিল, আজ সেই বৃত্ত ইতিমধ্যে এক প্যাকেট সিগারেট শেষ করে ফেলেছে। আজ বৃত্তের খুব কষ্ট হচ্ছে। তুফানের ন্যায় কান্নার গলার মাঝখানটায় ধুম্রজাল তৈরি করছে। সেই ধোঁয়ায় বৃত্তের নিঃশ্বাস আটকে আসছে। বৃত্তের চোখে জল জমতেই হাত দিয়ে সে জলটুকু মুছে ফেললো সে। তবে, বাহ্যিক কান্না লুকাতে পারলে কি হবে? বুকের ভিতরে এক সর্বগ্রাসী কান্না ভিতরে হৃদয়টাকে একদম এফোঁড়ওফোঁড় করে দিচ্ছে।

— বৃত্ত?
পিছন থেকে মেঘার ডাক শুনে বৃত্ত স্থির হয়ে গেলো। সিগারেটের শেষ অংশটুকু একটানে শেষ করে বাইরে ফেলে দিলো। চোখ মুছে বললো,
— ঘুম শেষ তোর?
মেঘা জবাব দিলো না। বরং, ধীরে ধীরে বৃত্তের পাশে এসে দাঁড়ালো। বৃত্তের মুখ ভেজা, চোখের কোণায় এখনো জল জমে আছে। মেঘার বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না, বৃত্ত কান্না করেছে। মেঘা বললো,
— কান্না করেছিলি কেনো?
বৃত্ত অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। তাড়াহুড়ো করে নিজের চোখের জল মুছে বললো,
— কোথায় কান্না করেছি? আচ্ছা। বাদ দে সেসব। মাথা ব্যথা কমেছে?
মেঘা বৃত্তের বাম হাত জড়িয়ে তার কাঁধে মাথা রাখলো। মৃদু হেসে বললো,
— হুম। আগের চেয়ে বেটার। তুই ঘুমাস নি?
— নাহ। ঘুম আসে নি।
— কেনো আসে নি?
— জানিনা।
— কি জানিস তাহলে? শুধু সিগারেট ফুঁকতে?
বৃত্ত মৃদু হাসলো। মেঘার কোমরে চিমটি কেটে বললো,
— উহু! আরো একটা জিনিস পারি। তোকে কুটকুট করে খেয়ে ফেলতে। সেটা আমি ভালোই পারি। আই থিঙ্ক ইউ নো দ্যাট। হুম?
মেঘা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। বৃত্তের পিঠে কতক ঘুষি দিয়ে বললো,
— তুই আজকাল খুব খারাপ হয়ে গেছিস। সারাক্ষণ মুখে শুধু অশ্লীল কথা। মুখ সেলাই করে দিবো একদম।
— দে তাহলে। আমি চুপ করে গেল তোর সহ্য হবে? সেদিনের কথা মনে নেই। একদিন কথা বলে নি দেখে কেঁদে কেটে তো সমুদ্র বানিয়ে দিয়েছিলি। বাপরে। তোর কান্না দেখে আমি তো পুরাই ভয় পেয়ে গেছিলাম। ভাবলাম, কে না কে মরে গেছে।

বৃত্তের কথা শুনে মেঘা হু হা করে হেসে দিলো। আর বৃত্ত নির্নিমেষ চেয়ে রইলো সেই প্রাণ খোলা হাসির দিকে। আবারো চোখ ভরে এলো তার। এত কেনো কষ্ট হচ্ছে ওর? সহ্য করতে পারছে না আর। দম বন্ধ হয়ে আসছে। কি ক্ষতি হতো, মেঘবৃত্তের সুন্দর এক সংসার হলে? কি এমন ক্ষতি হতো মেঘবৃত্তে সারাটাজনম হাতের উপর হাত রেখে কাটিয়ে দিলে? ব্রেইন টিউমারের রিপোর্টটা কি কি একবারের জন্যেও মিথ্যে প্রমাণিত হতে পারে না?
#মেঘবৃত্ত
#অন্তিম_পর্ব
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

পথটা বেশ দীর্ঘ ছিলো। কাঁটাময়, বন্ধুর পথটা পাড়ি দেওয়া ততটা সহজ ছিলো না। দিনে দিনে মেঘার শরীরের অবনতি যেনো বৃত্তের চোখে আঙুল উঁচিয়ে বলছে, ‘ তোর মেঘ হারিয়ে যাচ্ছে বৃত্ত। চোখের সামনে তোর সাজানো গোছানো জীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তুই কিছুই করতে পারলি না। ছিঃ, ধিক্কার তোকে বৃত্ত! ‘
মেঘার কদিন ধরেই রক্তবমি হচ্ছে, মাথাটাও ফুলে গেছে কালশিটে হয়ে গেছে। মেঘার ঘন চুল পড়ে একদম পাতলা হয়ে গেছে। মেঘা নিজের রোগ সম্পর্কে না জানায় এসব লক্ষণ তার খুব অদ্ভুত লাগছে। তবুও নিজের বাচ্চার জন্যে বিনা অভিযোগে সব সহ্য করছে ও।
ছ মাস কেটে গেছে। মেঘার শরীরের অবস্থা দিনদিন আরো শোচনীয় হচ্ছে। একসময় বৃত্ত সিদ্ধান্ত নিলো, না, অনেক হয়েছে। মেঘার অপারেশনটা এবার করাটা জরুরি। বাচ্চাটার ক্ষতি হলে হোক। মেঘা সুস্থ থাকলে বাচ্চা আরো নেওয়া যাবে। এই বাচ্চার জন্যে মেঘার এত কষ্ট চোখে দেখা যাচ্ছে না। বৃত্তের মাঝেমধ্যে মন চায়, চিৎকার করে কাঁদতে। কিন্তু দিনশেষে ও একজন পুরুষ। পুরুষ মানুষের কাঁদা পাপ। ঘোর পাপ। তাই, বৃত্ত কাঁদতে পারে না। বরং ভেতরে ভেতরে গুমরে মরছে সে। এ যেনো এক মরন কষ্ট!
_________________________
— মাত্র সাতমাস! বেবি এখনো প্রিপায়ার্ড না, মিস্টার বৃত্ত। আপনি কি সিউর সিজার করতে চান?

ডাক্তারের কথা শুনে মেঘা স্থব্ধ হয়ে গেলো। ডাক্তারের কথা না ছোট্ট মস্তিষ্কে প্রবেশ করতে পারলো না। সে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকালো বৃত্তের দিকে। বৃত্ত তখন নির্বিকার। মেঘা কণ্ঠে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— বৃত্ত, ডাক্তার এসব কি বলছে? এখন সিজার করবে মানে? এখনো তো সময় হয়নি। কিসের সিজার এখন?

বৃত্ত মেঘার কথার উত্তর দিলো না। বরং শান্ত চোখে ডাক্তারের দিকে চেয়ে বললো,
— আমি সিউর। আপনি অপারেশন থিয়েটার রেডি করুন, ডক্টর!

ডাক্তার লোকটা মেঘার দিকে একপল তাকালেন। মেঘার চোখে জল এসে গেছে। সে পাগলের মত বৃত্তের সাথে বারবার কথা বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু, বৃত্ত একবারও মেঘার দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না। ডাক্তার এবার গম্ভীর সুরে বললেন,
— ঠিক আছে। আমি সব রেডি করছি। আপনি আপাতত আপনার স্ত্রীকে সামলান, মিস্টার বৃত্ত।

ডাক্তার চলে গেলেন কেবিন ছেড়ে। মেঘা এবার বৃত্তের কলার আঙ্গুলের ডগায় মুচড়ে ধরলো। বৃত্ত মেঘার দিকে তাকাচ্ছে না অব্দি। সে অন্যদিকে চেয়ে মেঘার হাত থেকে নিজের কলার ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো,
— কলার ছাড়, মেঘ।
মেঘা কেঁদে উঠলো। চোখের জলে মাখামাখি হলো তার শ্যামা মুখশ্রী। মেঘা বৃত্তের মুখ দুহাতে ধরে বৃত্তের দৃষ্টি আকর্ষন করার চেষ্টা করলো। বললো,
— এই বৃত্ত, এই? কি হয়েছে তোর, হ্যাঁ? এমন করছিস কেনো তুই? বাচ্চাটা মাত্র সাত মাসের। এখন একে পৃথিবীতে আনলে ও মরে যাবো তো। আমার বৃত্ত এতটা পাষাণ হতে পারে না। এই বৃত্ত? তাকা না আমার দিকে। বল আমাকে। কি সমস্যা তোর? এই বৃত্ত? তাকা না একবার।

বৃত্তের এবার নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। তার চোখও অশ্রুতে টলটল করছে। সে মেঘার দিকে তাকালো। মেঘা ফ্যালফ্যাল চোখে বৃত্তের দিকে চেয়ে আছে। বৃত্ত এক ঢোক গিললো। অতঃপর খুব কষ্ট নিয়ে বললো,
— তুই বাঁচলে বাচ্চা আরো নেওয়া যাবে, মেঘ। কিন্তু তোর কিছু গিয়ে গেলে, আমি শেষ হয়ে যাবো রে। প্লিজ পাগলামি করিস না, মেঘ। বুঝার চেষ্টা কর।

বৃত্তের এত কঠিন কথা মেঘার বোধগম্য হলো না। সে ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো,
— ক-কি হয়েছে আমার?

বৃত্ত চুপ হয়ে যায়। কথা বলতে পারছে না সে। গলায় যেনো কেউ আস্ত এক পাথর বসিয়ে দিয়েছে। মেঘা এবার চিৎকার করে বললো,
— বল? কি হয়েছে আমার?
বৃত্ত নিজেকে সামলালো। এক ঢোক গিলে টলমলে চোখ নিয়ে বললো,
— ব্র-ব্রেইন ট-টিউমার।
বৃত্তের মুখে এত কঠিন বাস্তব শুনে মেঘা মুহূর্তেই নিথর হয়ে গেলো। বৃত্তের গালে থাকা দুহাত আপনা আপনি নিচে পড়ে গেলো তার। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে মেঘা দুমিনিট চেয়ে রইলো বৃত্তের দিকে। বৃত্ত নিজেও কাঁদছে আজ। সে পারেনি তার কান্না আর আটকাতে। হুট করে মেঘার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। মেঘা নিজেকে সামলাতে না পেরে পড়ে যায় বৃত্তের বুকের উপর। বৃত্ত মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে যায়। মেঘার মুখখানা নিজের দিকে উঁচু করে ওর গালে আস্তে করে থাপ্পর মেরে ডাকে,
— মেঘ, এই মেঘ? মেঘ? কি হলো তোর? মেঘ?

মেঘার জ্ঞান আসে না। বৃত্ত পাগলের মত হয়ে যায়। একবার ডাক্তারকে ডাকে আরেকবার নার্সকে ডাকে। নিজেকে এই মুহূর্ত বড্ড উন্মাদ মনে হচ্ছে তার। এই বৃত্তকে দেখে কেউ চিনতেই পারবে না, এই সেই বৃত্ত। যার সুন্দর চেহারা সম্পূর্ণ ভার্সিটিতে আলোচিত ছিলো। এই বৃত্ত সেই বৃত্ত না, যে সারাক্ষন নিজের ত্বকের যত্ন নিত। এই বৃত্ত তো কোনো অন্য! যে প্রেমে পাগল হয়ে গেছে। প্রিয় মানুষকে হারানোর ভয়ে উন্মাদ হয়ে এদিক ওদিক ঘুরছে। বৃত্তের এহেন দশা দেখে আজ সবার চোখে পানি চলে এসেছে। মেঘার বাবা মায়ের গর্বে বুক ফুলে, তাদের মেয়ে জীবনে একজন সুন্দর মনের স্বামী পেয়েছে।

মেঘাকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়েছে। বৃত্ত একপাশে বসে আছে। চোখ বেয়ে শুধু জল গড়াচ্ছে তার। বৃত্তের মা এসে বৃত্তের পাশে বসলেন। তিনি বৃত্তের কাঁধে হাত রাখতেই বৃত্ত মাকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। মায়ের কাঁধে মুখ রেখে হু হু করে কেঁদে উঠলো ও।
— মা, আমার মেঘ? আমার মেঘ ফিরে আসবে তো? আল্লাহ কি কোনো মিরাকেল করতে পারেন না? আল্লাহ চাইলে ত সব করতে পারেন। মা, আমি মরে যাবো মা। আমার কোনো বাচ্চা চাইনা, মা! বাচ্চাটার যা কিছু হয়ে যাক, মেঘ যেনো ফিরে আসে মা। মেঘ ছাড়া আমি কি করে থাকবো মা। কি করে?

বৃত্তের মা আর নিজেকে আটকাতে পারলেন না। নিজেও ডুকরে কেঁদে উঠলেন। মেঘার বাবা মা একপাশে দাঁড়িয়ে শুধু চোখের জল ফেলছেন। এত এত মানুষের কান্না দেখে আল্লাহর কি সত্যিই দয়া হবে না? হয়তো!
_________________________
— আব্বু, জানো আজ আমাদের ক্লাসে একটা নতুন ছেলে এসেছে। টিচার ওকে আমার পাশে বসিয়েছে। তুমি জানো আব্বু, ছেলেটা না খুব পাজি। সারাক্ষণ আমার চুলের বেনুনি ধরে টান দেয়। আবার আমাকে বলে, আমি নাকি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড হবো। আমি তো একদম মানা করে দিয়েছি। বলেছি, আমি কাউকে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড বানাবো না। আমি সারাজীবন একা একা থাকবো। কাউকে আমি বন্ধু বানাবো না। একা একা থাকতে অনেক মজা, তাইনা আব্বু?

বৃত্ত আর বৃষ্টি নৌকায় বসে মাছ ধরছিল। হঠাৎ নিজের মেয়ের মুখে এ কথা শুনে বৃত্ত একপ্রকার অবাকই হয়েছিল। মেঘবৃত্তের মেয়ে, বৃষ্টি একদম নিজের বাবার মত হয়েছে। যাকে এককথায় অগোছালো, বেপরোয়া বলা যায়। মেয়ের এমন আচরণে বৃত্ত বেজায় খুশিও বটে। বৃত্ত মেয়ের মাথায় হাত বুলালো। আদর করে বললো,
— একটা কথা জানো আম্মু, আমাদের লাইফে একজন বেস্টফ্রেন্ডের খুব দরকার। যে মানুষটাকে আমরা চোখ বন্ধ করে ভরসা করতে পারি। তার কাছে আমাদের সুখ দুঃখের ঝুলি উপড়ে দিতে পারি। আর তাকে অনেক অনেক ভালোবাসতে পারি। সারাটা জীবন একা একা থাকা যায়না আম্মু। আমাদের জীবনে একটা পর্যায়ে এসে একজন কাছের মানুষের খুব প্রয়োজন হয়। সে কাছের মানুষটা যদি হয় আমাদের বেস্ট ফ্রেন্ড, তখন আমাদের জীবনটা স্বপ্নের মত সুন্দর মনে হয়।

বাবার কথা বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনলো বৃষ্টি। কিন্তু, পরক্ষনেই অবুঝ মেয়ের মত মাথা নাড়িয়ে বললো,
— না, না। আমি একাই থাকবো। একদম অ্যালোন অ্যালোন। কাউকে আমি বন্ধু বানাবো না। কাউকে না।

বৃত্ত মেয়ের কথা শুনে হেসে ফেললো। মেয়ের নরম গালে ছোট্ট করে চুমু খেয়ে বললো,
— ঠিক আছে, ঠিক আছে। তুমি যা বলবে তাই হবে। এখন চলো, মাছগুলো মায়ের কাছে নিয়ে যাই। মা মজা করে রান্না করবে। ঠিক আছে?

বৃষ্টি লাফিয়ে উঠলো যেনো। দুহাত এক করে ক্রমাগত তালি দিয়ে মাথা নাড়লো মেয়েটা। বৃত্ত মেয়েকে কোলে তুলে নিলো। একহাতে মাছের ঝুড়িটা নিয়ে নৌকায় থাকা উনুনের কাছে এলো।

উনুনের সামনে একটা মেয়ে বসে আছে। শরীরে জড়ানো লাল টকটকে এক শাড়ি। শাড়ীর আঁচল মাটিতে অবহেলায় লেপ্টে আছে। তার ঘন রেশমি চুলগুলো দখিনা হাওয়ায় উড়ছে। দুহাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি ঝনঝনিয়ে শব্দ তুলছে। সে এক দারুণ রূপবতী মেয়ে! বৃত্ত মৃদু হেসে এগিয়ে গেলো মেয়েটার দিকে।

— মেঘ?
রূপবতী মেয়েটা তাকালো বৃত্তের দিকে। বৃত্ত মাছের ঝুড়ি এগিয়ে দিল মেয়েটার দিকে। বললো,
— মাছগুলো ঝটপট ভেজে ফেল তো। বাপ বেটি মিলে আজ কব্জি ডুবিয়ে খাবো।
মেঘা হেসে ফেললো। কিন্তু, পরক্ষণেই মুখ ফুলিয়ে বললো,
— এখন? বৃষ্টি আসবে যে?

বৃত্ত মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকালো। আকাশে মেঘ জমেছে। আর একটু পরেই মেঘ নিংড়ে বৃত্তাকার বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টি, বৃষ্টি নামবে শুনে খুশি হয়ে হাতে তালি দিতে লাগলো। বললো,
— ইয়াহু, বৃষ্টি আসবে। আব্বু, আমি বৃষ্টিতে ভিজবো?
বৃত্ত হেসে বৃষ্টির গাল টিপে দিলো। অতঃপর, মেঘার দিকে চেয়ে মোহাচ্ছন্ন কণ্ঠে বলল,
— আজ নাহয় একটুখানি বৃষ্টি হোক। আজ মেঘবৃত্ত আর বৃষ্টি নিয়ে আমাদের এক গল্প হোক। রচিত হোক একটা সুন্দর প্রেমের গল্প!

#সমাপ্ত

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here