মেঘবৃত্ত পর্ব ১৭

#মেঘবৃত্ত
#পর্ব_১৭
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

অতঃপর, এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। মেঘা লাল বেনারসি সামলে মায়ের সাথে পা মিলিয়ে বসার ঘরে এলো। মেঘার মা মেঘাকে বৃত্তের ঠিক বা পাশটায় বসালেন। মেঘা আড়ষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নত করে বসে রইলো। খুব লজ্জা লাগছে তার। গালে ফুটে উঠেছে এক চিমটি লাল আবির। শ্যামলা মুখশ্রীতে লজ্জার আঁকাবাঁকা আঁচড়। বুকের ভিতরে হৃদপিন্ডটা অদ্ভুত ভাবে চঞ্চল ব্যাঙের মতন লাফাচ্ছে। মনে হচ্ছে, হৃদয়টা বুক ছিঁড়ে যেকোনো মুহূর্তে বেরিয়ে আসবে। খুবই হঠাৎ করে, মেঘার নির্লজ্জ মনটা সহসা জানতে চাইলো, তার পাশে বসে থাকা বৃত্তকে বর হিসেবে কেমন লাগছে? ঠিক তখন, পাশ থেকে বৃত্তের হাসির শব্দ মেঘার কানকে স্বার্থক করে দিলো। মেঘা আড়চোখে সেদিকে একবার তাকালো। বৃত্ত হাসছে। সেই প্রাণখোলা হাসিতে বৃত্তের আঁকাবাঁকা দাঁতগুলো বড্ড মোহময় লাগছে। আজকেও বৃত্তের কোলে এক বাচ্চা। কতই বা বয়স বাচ্চাটার? মাত্র দু কি আড়াই বছর? তবুও দেখো কত সহজে বৃত্তের সাথে মিশে গেছে। অন্যের বাচ্চার প্রতি বৃত্তের আদর দেখে মেঘার বড়ই আফাসোস হলো। বৃত্তের নিজের বাচ্চা দুদিন পরেই তাদের ঘর আলো করে আসবে। কিন্তু, সেই বাচ্চার বেলায়ই বৃত্তের যত অবহেলা, যত খামখেয়ালিপনা। বাচ্চাটা তো বৃত্তের কাছে সামান্যই এক দায়িত্ববোধ! শুধু বাচ্চাটার মা মেঘা বলেই কি বৃত্ত এই দায়িত্বগুলো দেখাচ্ছে? বাচ্চাটার মা অন্য কেউ হলে,তখন? তখনও কি বৃত্ত এমনই থাকতো? এরূপ অসংখ্য প্রশ্ন মেঘার মুখের কাছে দলা বাঁধায়। তবে সেসব মুখ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার পূর্বে মেঘা কঠোরভাবে গলাধঃকরণ করে ফেলে। লাভ কি এসব প্রশ্ন করে? যার উত্তরের ঘটটায় শুধুই বিষাক্ত কিছু শূন্যতা!
অবশেষে এলো সেই সময়, সেই ক্ষণ, সেই হৃদ-কাঁপানো অনুভুতি। কাজি মোলায়েম সুরে বললেন,
— বলো মা, কবুল।
মেঘার এবার কান্না পাচ্ছে। এতটা বছরের প্রতিটা স্মৃতি তার মস্তিষ্ককে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে, এ বাড়ির প্রতিটা জায়গা মেঘাকে চিৎকার করে বলছে, ‘ আমরা তোর ছোটোবেলা, আমরা তোর স্মৃতি, আমরা তোর অভিমান। আমাদের ছেড়ে চলে যাবি? এতটা পাষাণ কেনো রে তুই?’ মেঘার ঠোঁট চিপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো। তবে, বরাবরের মত ব্যর্থতার গ্লানি টেনে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। মেয়ের কান্না দেখে মেঘার বাবা-মায়ের চোখ দুটো ঝাপসা হলো। চোখে কোন বেয়ে গড়ালো অশ্রু। মেঘার মা মেয়ের কাঁধে হাত রেখে ছলছল চোখে আশ্বাস দিলেন। মেঘা কণ্ঠ ভিজলো, ভিজলো চিবুক, থুতনি। সে কি কান্না মেয়ের!
বৃত্ত মেঘার কান্না দেখে দু মিনিট থ হয়ে বসে ছিলো। যখন মেঘার কান্না থামার নাম নিচ্ছে না, তখন বৃত্ত সজাগ হলো। মেঘার কাঁধে হাত রাখলো। মেঘা করুন চোখে তাকালো বৃত্তের দিকে। বৃত্ত চোখের ইশারায় আশ্বাস দিলো। কিন্তু আফসোস। আজও ওই দু চোখে শুধুই দায়িত্ববোধ। বৃত্তের চোখে নিজের জন্যে দায়িত্ত্ববোধ দেখলে মেঘার মরে যেতে ইচ্ছে হয়। মেঘা দু আঙ্গুল দিয়ে চোখের জল পরিষ্কার করলো। অতঃপর, কম্পমান কণ্ঠে বললো,
— কবুল, কবুল, কবুল।

বৃত্তকে একই নিয়মে কবুল বলতে বলা হলো। বৃত্ত ধীরে সুস্থে কবুল বললো। অতঃপর, তিন অক্ষরের সেই শব্দ দ্বারা দুজন বেঁধে গেলো এক সুন্দর, পবিত্র সম্পর্কে। হয়ে গেলো, একে অপরের সারা জীবনের সঙ্গী! বিয়ে সম্পন্ন হলো মেঘবৃত্তের।
______________________
বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতে বেশ রাত হলো। ঘড়ির কাঁটা এগারোটা পেরিয়ে বারোটায় পা রেখেছে। মেঘা ও বৃত্ত গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ি চালু হয়েছে দশ মিনিট হলো। মেঘার ফোঁপানো এখনো থামে নি। ইতিমধ্যে টিস্যুর বাক্স অর্ধেক ফাঁকা হয়ে গেছে। একসময় বৃত্ত অতিষ্ট হলো। এত কান্নার কি আছে সেটাই বৃত্তের বোধগম্য হচ্ছে না। এমন তো নয় যে মেঘা অপরিচিত কারো বাড়ি যাচ্ছে। বৃত্ত, যাকে ছোটবেলা থেকে চিনে, যার সাথে একসাথে বড় হয়েছে তার বাড়ি যেতে এত কিসের শঙ্কা? পুনরায় মেঘার কান্নার শব্দ কানে আসলো। বৃত্ত এবার হুট করে মেঘার হাত থেকে টিস্যু ছিনিয়ে নিয়ে জানালা দিয়ে ফেলে দিলো। বৃত্তের এমন আকস্মিক আচরনে মেঘার কান্না থেমে গেছে। বরং, চোখে ভর করেছে চমক। এমন করলো কেনো বৃত্ত? বৃত্ত মেঘার দিকে চেয়ে রাগ দেখিয়ে বললো,
— তোরে আমি সাধে ছিঁচকাদুনে বলি না, মেঘ। তোর এসব কাজের জন্যেই বলি। সেই কখন থেকে কেঁদে কুটে কানের পোকা বের করে দিচ্ছিস। এত কিসের কান্না? তোকে মেরে ফেলবো আমি? নাকি তোর কিডনি বিক্রি করে আই ফোন কিনবো? অবশ্য তোর বেহুদা কিডনি দিয়ে একটা ভালো আই ফোনও হবে না। তার চেয়ে বরং তোকে মেরে ফেলি। কি বলিস?
কথাটা বলে বৃত্ত চোখ সরু করে বেশ রাগ নিয়ে তাকালো মেঘার দিকে। মেঘা দুবার ফুঁপিয়ে উঠলো। নাক টেনে বললো,
— হাত লাগিয়ে দেখ একবার। হাত দুটো ভেঙে গুঁড়ো করে ফেলবো একদম।
বৃত্ত এবার হেসে উঠলো। মেঘার শাড়ীর আঁচল ঠিকঠাকভাবে মাথায় তুলে দিয়ে বললো,
— এই না হলে আমার মেঘ। তোর এই ঝাসি কি রানী রুপই আমার বেশ লাগে। বাকি কিছু ভার মে যাক।
মেঘা ফিক করে হেসে ফেললো। সঙ্গেসঙ্গে দেখা গেলো তার গজ দন্ত। বৃত্ত মেঘার হাসির দিকে একবার স্থির চোখে তাকিয়ে মুহূর্তের মধ্যে চোখ সরালো। মেঘার কান্না এখন সম্পূর্ন থেমে গেছে। আপাতত সিটে মাথা হেলিয়ে বসে আছে সে।
বৃত্ত কতশত কথা বলছে। কখনো হাসছে, কখনো অবাক হচ্ছে, কখনো রাগ দেখাচ্ছে। বৃত্ত নামক প্রেমিকের যে কত রূপ! সেই রূপের বহর এ জন্মে যেনো শেষ হওয়ার নয়।
হঠাৎ, বৃত্তের কথা থেমে গেলো। পাশ থেকে মেঘার কোনোরূপ আওয়াজ না পেয়ে মেঘার দিকে তাকালো। মেঘা সিটে মাথা হেলিয়ে মাতালের মত ঘুমাচ্ছে। মেঘার এমন বাচ্চাদের মত ঘুমানো দেখে বৃত্ত ফিচেল হাসলো। আস্তে করে মেঘার মাথাটা নিজের কাঁধে রাখলো। মেঘার ঘুমন্ত দেহ একটু আরাম পেতেই গুটিসুটি মেরে বৃত্তের কাঁধে নাক ঘষলো। এতে বৃত্তের কেমন যেনো সুড়সুড়ি লাগলো। তবে, মেঘার অসুবিধে হবে তাই বৃত্ত একবিন্দুও নড়লো না। ঠায় বসে রইলো নিজ জায়গায়। ঘুমের ঘোরে মেঘা বৃত্তের এক হাত আকড়ে ধরে বৃত্তের কাঁধে আবারও নাক ঘষলো। বৃত্তের সম্পূর্ণ শরীর যেনো ঝটকা খেলো এতে। এর আগেও মেঘার সাথে একান্ত সময় কাটিয়েছে সে। তবে, সেটা নেশার ঘোরে। তখন মনে না ছিল কোনো অনুভূতি, না ছিলো নিজের সক্রিয় মস্তিষ্ক। যা ছিলো পুরোটাই শারীরিক চাহিদা। কিন্তু, আজ? আজ মেঘার সামান্য স্পর্শ বৃত্তের মনকে মাতিয়ে তুলছে। এই অনুভূতি সম্পূর্ণ নতুন, সদ্য ফোঁটা ফুলের ন্যায় পবিত্র। বৃত্ত মেঘার এহেন কান্ড দেখে হাসলো খুব। ক্লান্ত থাকায় মেঘার মাথায় নিজের মাথাটা হেলান দিয়ে চোখ বুজলো সে। বড্ড ঘুম পাচ্ছে তার।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here