মেঘবৃত্ত পর্ব ২৮

#মেঘবৃত্ত
#পর্ব_২৮
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

আজ মেঘবৃত্তের সর্বশেষ পরীক্ষা ছিলো। পরীক্ষা শেষ করে দুজনেই বেরিয়ে গেছে কেন্দ্র থেকে। উচুঁ নিচু রাস্তা বেয়ে বৃত্তদের বাইক এগিয়ে যাচ্ছে। আশপাশ থেকে ঠান্ডা, হিম হাওয়া ছুঁয়ে দিচ্ছে মেঘবৃত্তকে। মেঘার ঘন চুলগুলো বাতাসের ঝাঁপটায় যেনো হাওয়ায় উড়ে যেতে চাইছে। মেঘা বারবার ক্লিপ দিয়ে আটকে দিচ্ছে চুল। কিন্তু, মিনিট যেতেই তার সিল্কি চুলগুলো নতুন উদ্যমে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মেঘা একসময় বিরক্ত হলো। নিজের চুল নিজেই এলোমেলো করে মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো। বৃত্ত মেঘার এহেন বাচ্চামো কাণ্ড দেখে হেসে ফেললো। বললো,
— কি? দম শেষ?

মেঘা ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে বললো,
— খবরদার, মজা নিবি না!
বৃত্ত আবারও হাসলো। আয়নায় বৃত্তের হাস্যরত মুখশ্রী লক্ষ্য করতেই মেঘার রাগ একদম শূন্যে মিলিয়ে গেল। দুচোখে খেলে গেলো অসংখ্য মুগ্ধতার আঁচড়! মোহময় হয়ে চেয়ে রইলো সেই প্রাণ কাঁপানো হাসিটার দিকে। মনে মনে প্রশ্ন করলো,
‘ বৃত্ত, তুই এত সুন্দর করে হাসিস কেনো রে? এই যে, তোর এই হাসিটা দেখলে আমার অতি সুখে মরে যেতে ইচ্ছে করে, তার বেলায়? ‘
তবে, আফসোস! মেঘার মনের কথা মনেই রয়ে গেলো। মুখ ফুটে বৃত্তের সামনে নিজের অনুভূতিগুলো বলা আর হলো না।

বৃত্ত মেঘার প্রেগন্যান্সি বিষয়টা মাথায় রেখে যথাসম্ভব বাইকের স্পিড মিডিয়ামে চালালো। বৃত্ত আনমনা হয়ে মেঘার সাথে কথা বলছে। কথার মূল বিষয়বস্তু হলো, তাদের পরীক্ষা। মেঘা পরীক্ষার প্রশ্নগুলো বৃত্তের সাথে মিলিয়ে দেখছে। কিন্তু, ঘটনাটা ঘটলো একদম আকস্মিক! অনেকটা আকস্মিক ধেয়ে আসা সেই বিধ্বস্থ ঝড়ের মত! ঝড়ের হওয়ার আগে যেমন প্রকৃতি শান্ত, স্থবির থাকে, ঝড় হওয়ার পর সেই একই প্রকৃত ঝড়ের তান্ডবে একদম লন্ডভন্ড হয়ে যায়। মেঘবৃত্তের জীবনে আজকের এই ঘটনাটা ঠিক ঝড়ের মত করেই তাদের সুখী জীবনকে এক নিমিষেই লন্ডভন্ড করে ফেললো। শেষমেষ ,বাকি রইলো কিছু অপ্রাপ্তির দীর্ঘশ্বাস!

বৃত্তদের বাইক তখন হাইরোডে চলছিলো। কিন্তু, একদম আচমকা ফুটপাত ছেড়ে পাঁচ বছরের এক বাচ্চা মা বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে হাইরোডের একদম মাঝখানে চলে এলো। বৃত্তদের বাইক থেকে বাচ্চাটার দূরত্ব মাত্র পাঁচ ফুটের। আচমকা চলন্ত বাইকের সামনে এক বাচ্চাকে দেখে বৃত্ত হতবম্ব হয়ে গেলো। সাতপাঁচ না ভেবে খুব জোরে ব্রেক কষলো সে। বাইকটা হঠাৎ ব্রেকে বেসামাল হয়ে বাচ্চাটাকে পাশ কাটিয়ে দূরের ফুটপাথে একদম ছিটকে পড়লো। সঙ্গেসঙ্গে বাইক থেকে এক ছিটকে রাস্তায় উপুড় হয়ে পড়ে গেলো মেঘা। বৃত্ত নিজেও বাইক থেকে সামান্য দূরের ফুটপাথে ছিটকে পড়লো। ঘটনাটা এতটা তাড়াতাড়ি ঘটলো সে সম্পুর্ণ হাইরোড একদম স্থব্ধ হয়ে গেলো। সেই পাঁচ বছরের বাচ্চাটা একপাশে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে রাস্তায় পড়ে থাকা দুজন মানব-মানবীর দিকে। এখানে কি ঘটেছে সে তার কিছুই বুঝতে পারছে না। মায়ের আঁচল শক্ত করে চেপে ধরে কান্নামাখা মুখে থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে।
হঠাৎ মেঘার আর্তচিৎকার পরিস্থিতিটা করে তুললো প্রচণ্ড বিদঘুটে! বৃত্ত মাথায় হাত রেখে তাকালো পাশে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা মেঘার দিকে। মেঘা পায়জামায় তাজা লাল রক্ত। বৃত্ত একপলকের জন্যে হতবম্ব হয়ে গেলো। ভুলে গেলো তার নিজের মাথা থেকেও ঝড়ছে সেই একই লাল রঙা রক্ত! বৃত্ত হুড়মুড়িয়ে উঠে মেঘার পাশে এসে বসলো। বৃত্ত মেঘার মাথাটা নিজের কোলে রেখে উদ্ভান্তের মত বলতে লাগলো,
— মেঘ? এই মেঘ? ঠিক আছিস তুই? কোথায় ব্যথা পেয়েছিস আমায় বল! আর এ-এত রক্ত কোথা থেকে এলো? কোথায় ব্যথা পেয়েছিস তুই, হ্যাঁ? এই মেঘ?

মেঘা দুহাতে নিজের পেটে হাত খামচে ধরলো। পেটে ভয়ানক রকমের ব্যথা হচ্ছে ওর। মনে হচ্ছে, তার পেটে কেউ অজস্রবার ছুড়ি চালাচ্ছে। মেঘা বৃত্তের দিকে চেয়ে চোখদুটো খিঁচে বললো,
— বৃত্ত? আমার বাচ্চা! আমার বাচ্চাটাকে বাঁচা প্লিজ। তোর পায়ে পড়ছি আমি, আমার বাচ্চাটাকে, আমার প্রাণটাকে বাঁচা! প্লি..

মেঘা আর বলতে পারলো না। আগের থেকে দ্বিগুণ জোরে খামচে ধরলো নিজের পেটখানা। বৃত্ত থম ধরে কিছুক্ষণ মেঘার দিকে চেয়ে রইলো। মেঘার এরূপ করুন কান্না দেখে তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো। কি করবে, কোথায় যাবে, কিছুরই হিসাব কষতে পারলো না। যখন পুনরায় মেঘার অস্ফুট সুরের গোঙানি কানে আসলো, বৃত্ত সঙ্গেসঙ্গে তৎপর হয়ে উঠলো। নিজের মাথাটা মেঘার গায়ের ওরনা দিয়ে শক্ত করে বেঁধে ফেললো। এতে রক্ত পড়া খানিক বন্ধ হলো তার। বৃত্ত একনিমিষে উঠে দাঁড়ালো। মেঘার শরীরটাকে পাজকোলা করে কোলে তুলে নিয়ে সিএনজিতে তুললো। নিজেও তাড়াহুড়ো করে মেঘার পাশটায় বসলো। মেঘার নরম তুলতুলে হাতটা নিজের বলিষ্ট পুরুষালি হাতের মুঠোয় পুড়ে নিয়ে অনবরত সেই হাতকে মালিশ করতে করতে আওড়ালো,
— তুই একটু শান্ত হ। বাচ্চাটার কিচ্ছু হবে না দেখিস! কিচ্ছু হবে না। শান্ত হ একটু, রিলাক্স।

মুখের বুলিতে বৃত্ত এসব স্বান্তনাবাণী আওড়ালেও মনে মনে সে নিজেও ভয়ে রীতিমত চুপসে আছে। মেঘার বারবার ভয়ংকর রকমের আর্তনাদ করে জানিয়ে দিচ্ছে, তার ব্যথাটা ঠিক কতটা প্রখর, কতটা হৃদয়বিদারক! মেঘার অবস্থা দেখে বৃত্তের মনে হচ্ছে, মেঘার শরীরের অন্য কোথায় মেজর কোনো ব্যথা লাগে নি। রাস্তায় একদম উপুড় হয়ে পড়ায় পেটে বড়সর আঘাত লেগেছে। আর সেই আঘাতের ফলস্বরূপ, এই বাচ্চাটার জীবন ঝুঁকিতে পড়ে গেছে। যদি বাচ্চাটার কিছু হয়ে যায়? না, না! বৃত্ত আর ভাবতে পারলো না। এ কদিনে বৃত্ত এটা বুঝে গেছে যে, এই বাচ্চাটা মেঘার জন্যে মেঘার প্রাণ! বাচ্চাটার কিছু হয়ে গেলে মেঘা শেষ হয়ে যাবে, মরে যাবে একদম। বৃত্ত সিএনজি ড্রাইভারকে তাড়া লাগালো জলদি চালানোর জন্যে। এত চিন্তার মধ্যে আচমকা এক অদ্ভুত কিছু অনুভব করলো বৃত্ত। যে বাচ্চাটা বৃত্তের কাছে শুধুই একটা দায়িত্ববোধ ছিলো, আজ সেই বাচ্চার জন্যে তার মনে চিনচিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে। কিন্তু, কিসের জন্যে এই ব্যথা? এই বাচ্চাটা শুধু মেঘার বাচ্চা নয়। বরং, বাচ্চাটা তার নিজের একটা অংশ বলেই কি তার মনের এমন আহাজারি?
______________________
— এখানে মিস্টার বৃত্ত আফজাল হোসেন কে?
মেঘার অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে আসা ডাক্তারের মুখে নিজের নাম শুনে বৃত্ত হনহনিয়ে ডাক্তারের সামনে এসে দাড়ালো। তাড়াহুড়ো কণ্ঠে বললো,
— আমি, আমি। মেঘ কেমন আছে এখন? আর বাচ্চাটা?
ডাক্তার মুখটা পাংশুটে বানিয়ে বললেন,
— অ্যাক্সিডেন্টটা মাইনোর ছিলো, বিধায় আপনার স্ত্রীর কোনো মেজর আঘাত লাগে নি। শি ইজ অলরাইট! যেহেতু তিনি মাত্র তিনমাসের গর্ভবতী ছিলেন। সাধারণত এই অবস্থায় ভ্রূণের অবস্থা বেশ নাজুক থাকে। তাই মায়ের পেটের এই সামান্য আঘাতে বাচ্চাটার বেশ ক্ষতি হয়ে গেছে। মিস্টার বৃত্ত, আই অ্যাম সরি টু সে, আপনার স্ত্রীর মিসক্যারাজ হয়ে গেছে।

ডাক্তারের মুখে এহেন ভয়ানক কথা শুনে বৃত্ত দু মিনিট থ হয়ে ছিলো। বাচ্চাটা আর নেই শুনে তার মাথা ভনভন করতে আরম্ভ করল। এবার মেঘাকে সে কি করে সামলাবে? মেঘাকে সে কি উত্তর দিবে? সে বাবা হয়ে তার কথা রাখতে পারেনি? নিজের বাচ্চাকে সে রক্ষা করতে পারেনি? উফ! বৃত্তের মাথা ধরে যাচ্ছে। বৃত্ত ব্যান্ডেজকৃত মাথা দুহাতে চেপে ধরে চেয়ারে ধাম করে বসে গেল। বৃত্তের মা-বাবা শুধু বোকার মত এসব দেখে গেলেন। আপাতত, বাচ্চার বিষয়টা তাদের মাথায় ঠিকঠাক প্রবেশ করতে পারছে না। কি থেকে কি হয়ে গেল, তাদের চিন্তার মূল ধারা আপাতত এই।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here