#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২১
“আপু আমাদের বাঁচা। কলা আমাদের লড়াচ্ছে থুক্কু কলাওয়ালা, না না বাগানের মালিক আমাদের লড়াচ্ছে।”
উত্তরের দিকে থেকে অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর ভেসে এলো হাওয়ায়। পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। যেন দ্রুত বেগে ছুটে আসছে আমার নিকট। আমি শব্দ অনুসরণ করে সেদিকে দৃষ্টি দিতেই ভরকে গেলাম। বিয়ের বাড়ির ছোট ছোট বাচ্চা মেয়ে থেকে শুরু করে আঁখিও আছে। দুপুরের খাওয়ার সময় দেখা যায়নি তাদের। তাদের খুঁজতে এদিকে আসা। নতুবা এদিকে আসার প্রশ্নই ছিলনা। আমি সামনের দিকে অগ্ৰসর হলাম। তাদের কাছে পিঠে আসতেই বাবুই নিজেকে আড়াল করে নিল আমার পেছনে। তড়িগড়ি করে বললাম, “পাগলা কুকুরে কামড়েছে তোদের? এভাবে দৌড়াচ্ছিস কেন? নিজেদের বয়স দেখেছিস? ধীঙ্গি হচ্ছিস দিনকে দিন। কিন্তু বুদ্ধি হলনা।”
হাঁটুতে ভর দিয়ে হাঁসফাঁস অবস্থা আঁখির। তবুও নিজের সাথে যুদ্ধ করে একপ্রকার বলল, “আর বলিস্ না, শা’লায় দেখে ফেলছে। মোটা একটা লাঠি নিয়ে তাড়া করেছে। বুড়া হইছে আবার বলে চোখে দেখতে পারেনা আগের মত। কই আমগো তো ঠিকই দেখল। বিম্রতি। ”
“ঐ ছেমড়ি, তোর কাছে আমার বইন বিয়া দিছে নি? তুই কথায় কথায় আমারে শা’লা কস। একেই তো চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ছিস। এখন আবার শা’লা কস।”
পেছনে পঞ্চাশ উর্ধ্বে একজন বয়স্ক লোক। হাতে তার মোটা লাঠি। হাঁটতে গিয়ে বেকায়দায় পড়ছে। নিজের শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে লাঠির সাহায্য নিচ্ছে। চোখের ভ্রু সাদা হয়েছে বয়স বাড়ার কারণে। চামড়া কুঁচকে গেছে অনেকটা। চুল পেকেছে। লোকটাকে চিনি চিনি ঠেকছে। তিনি তো মুজিবুর। ছোটবেলায় কত তার বানানে চু’রি করেছি। আগের মতই লাঠি নিয়ে তারা করছেন। সরল কণ্ঠে বললাম, “দাদু কী হয়েছে, এভাবে আসছ কেন? একটু কলাই তো খেতে চেয়েছিল।”
“ওগো জ্বালায় কোনো ফল শান্তিতে রাখতে পারে?”
“এখনও যদি বলো, শান্তিতে রাখতে পারোনা, তাহলে আগে কী রাখতে পারতে? তোমার বাগান ফাঁকা করে ফেলতাম।”
তিনি বৃদ্ধ চোখে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। একটু বয়স বেড়ে গেলেও আহামরি কিছু বাড়েনি। চেনা অসম্ভব কিছু নয়। তবে তাকে চেনা বরং দুস্কর। তিনি লাঠিতে ভর দিয়ে এগিয়ে এলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সন্দিহান স্বরে বললেন,
“তুই শ্রেয়া মা না-কি? মুখটা তো ওর মতোই ঠেকছে।”
“এতক্ষণে চেনা হলো বুঝি?” অভিমানী সুরে।
প্রসারিত হলো ওষ্ঠদ্বয় তার। হাসলেন মৃদু। তৃপ্তিদায়ক হাসি। তার বাগানের ফল ফাঁকা করে দেওয়ার পরেও হাসছেন, ভারী আশ্চর্য। ভীত হলেন না। আবদারের সুরে বললাম, “আবার মামাতো বোন বাবুই। কখনো গ্ৰামে আসেনি। আঁখির মুখে বিচি কলার ভর্তা শুনে খেতে ইচ্ছে করছে ওর। তুমি কি তোমার বানান থেকে দুটো কলার দিবে।”
“তোরে বাঁধা দেওয়ায় সাধ্য আছে আমার? আগে কত দিয়েছিলাম, লাভ হয়নি। তুই কি শুনবি আমার বারণ? এখন চোখে ঠাওর করতে পারিনা। তুই নিয়ে যা।”
বৃদ্ধা দাদুর কথায় সবাই আনন্দে গদগদ হল। সারিবদ্ধভাবে তার বাগানের দিকে আগ্ৰসর হল। তিনিও হাঁটা ধরলেন। এগোলাম আমি।
সবুজের সমারোহ প্রকৃতি বহুদিন পর যেন স্বাগত জানাচ্ছে। হিম হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে লোমকূপ। উড়িয়ে হাওয়াতে ভাসিয়ে দিচ্ছে ওড়না। চুলগুলো এলোমেলো। নীলাভ আকাশ মেঘের ভেলা সাজালো। খণ্ড খণ্ড মেঘ। গর্জন করছে মেঘেরা। বৃষ্টি আসার পূর্ব লক্ষণ। ঠুক ঠুক শব্দ হচ্ছে লাঠিতে। যেন ঘোড়ার হাঁটা। মাঠে কাজ করছে গ্ৰামবাসীরা। অবশেষে পৌঁছে গেলাম দাদুর বাড়িতে। পথে দাদুর সাথে কথা হলো প্রচুর। তার বাড়ির সামনেই বাগান। টিন আর বাশ দিয়ে ঘেরা। এই বাগানের টাকা দিয়ে বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধাকে বছর চলতে হয়। ছেলে বিদেশে থাকে। তিনি তালা তুলে ভেতরে ঢুকতে অনুমতি দিলেন। আমি ভেতরে ঢুকলাম। কলা বাগান মানে শুধু কল নয়, বিভিন্ন ধরনের গাছ। এত গাছের নামটাও জানা নেই। তার ভেতরে কলা গাছ বেশি।
মেহগুনি গাছের হেলান দেওয়া কলাগাছ। লগি নেই। গাছে উঠে কলা পাড়তে হবে। আগে গাছে উঠার ক্ষমতা ছিল, এখন নেই বললেই চলে। তবুও গাছে আমাকেই উঠতে হল ওদের জোরাজুরিতে। আমি গাছে উঠলাম ওড়না কোমরে বেঁধে। কলা পেড়ে বসে রইলাম গাছে। নামতে ইচ্ছে করছে না। বহুদিন পর উঠা। কিন্তু মহাশয় হাজির সেখানে। আমার এখানে আসার কথাটা তিনি জানলেন কীভাবে জানা নেই। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের মত ধমকে উঠলেন এসে। রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন,
“সমস্যা কী তোমার? গাছে উঠেছ কেন?”
আমি তৎক্ষণাৎ নিচে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। ধ্রুব এবং রাহাত স্যার একসাথে দাঁড়িয়ে আছেন। ধ্রুব স্যারের হাতে একটা প্যাকেট। বিকেলে ঘুম দিয়ে উঠে দেখতে পাইনি তাকে। রমিলা আন্টি বলেছেন ধ্রুব বাড়িতে নেই। রাহাত স্যারকে নিয়ে কোথাও একটা গেছে। তবে এখানে কী করছেন? আমাকে ফলো করে ঠিক চলে এসেছে।
তার প্রশ্নের প্রত্যুত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লাম, “আপনি এখানে কী করছেন?”
“তোমাকে দেখতে এসেছি ইডিয়েট।”
“আমাকে কেন দেখতে আসবেন? আমার কি বিয়ে?”
তেজ নিয়ে বললেন, “বিয়ে করার খুব শখ দেখছি তোমার। বাড়িতে যাই তারপরে বিয়ে করাবো, এবার নেমে আসো। তোমার জন্য এটা এনেছি।”
হাতটা ঈষৎ উঁচুতে তুলেন প্যাকেট দেখালেন। ভেতরের জিনিসগুলো দেখা গেল না।
“না, আমি এখন যাবো না। আপনি বরং যান। আমার সাথে সেদিন বা’জে ব্যবহার করে গিফ্ট নিয়ে এসেছেন। যাবো না, বলছি তো!” উল্টোমুখী জবাব।
“চড়ুই নেমে এসো।” শান্ত কণ্ঠে বললেন রাহাত স্যার।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। ভীত হলেও প্রকাশ করলাম না বাইরে। ভয় পেলেই ঝোঁকে বসবেন। আমার ভাবাবেগ না পেয়ে টেনে টেনে বললেন, “বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে, একটা দামড়া মেয়ে গাছে উঠেছে। দৃশ্যটা কেমন লাগছে ভাবতে পারছ?
আমি কি জানতাম না-কি তুমি এখানে? বাইরে থেকে দেখে এসেছি।”
“আপনি আমাকে দামড়া বলছেন? আপনি কী হ্যাঁ? চারপাশে তো টিন..
আর বলতে পারলাম না। দৃষ্টি গেল বাইরের দিকে। সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তাহলে আমাকেও বাইরে থেকে উদ্ভূতভাবে দেখা যাচ্ছে। সৌজন্য হাসি দিলাম। নামার প্রয়াস করলাম। নামতে পারছি না। ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছেন বিপরীত দিকে। অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে উল্টোপথে হাঁটা ধরলেন। আকাশ গর্জে উঠল। অবিলম্বে বৃষ্টি শুরু হল। গাছের উপর বৃষ্টি পড়তেই পিচ্ছিল হতে লাগল। হাওয়ার ঝোঁকে বেঁকে যাচ্ছে গাছ। অতিরিক্ত হাওয়া বইতে ভারসাম্য হারিয়ে ফেললাম। ভয়ে ভয়ে গাছের ডাল ধরে রাখলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা হলোনা। গাছের ডাল ভেঙে ধাড়াম শব্দে নিচে পড়লাম। মৃদু আর্তনাদ করলাম। পা একটু বেঁকে গেল। চিকচিক করে উঠল চোখজোড়া। বৃষ্টির পানিতে জবুথবু। আলাদা করা দুস্কর। ধ্রুব ছুটে এলো। ধরল হাত। পরক্ষণে ছেড়ে দিল। বুকে হাত গুজে বলেন, “শান্তি হয়েছে? হয়েছে শান্তি। আমার সামনে না পড়লে তোমার হয়না।”
অশ্রুমিশ্রিত কণ্ঠে বললাম, “আমি কি ইচ্ছে করে পড়েছি। ডাল ভেঙে গেছে কী করব?”
ধ্রুব হাত বাড়িয়ে দিলেন। উপায়হীন হয়ে খামচে ধরলাম হাত। তাকে ধরে উঠার প্রয়াস করতে পায়ের ব্যথা বেড়ে গেল। পায়ের টাকনু ভেঙে গেছে এমন অবস্থা। আমি পা ধরে বললাম, “আপনি আমাকে অভিশাপ দিয়েছেন ধ্রুব, তাই আমার পা ভেঙে গেছে। আমি আর হাঁটতে পারব না। আপনার ভালো হবেনা।”
ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইলেন। আমি একটু নতজানু হলাম। এই প্রথম ‘ধ্রুব’ শব্দ বলেছি। ধ্রুব দ্রুত কোলে তুলে নিল আমায়। ঘোর কা’টল। কেঁপে উঠল সর্বাঙ্গ। বিস্মিত হয়ে জড়িয়ে ধরলাম গলা। তড়িগড়ি করে বললাম, “কী করছেন টা কী? আপনি নিজেই ভাঙাচোরা মানুষ। এখন আবার মা’স্তানি করে আমাকে কোলে তুলেছেন। নামান বলছি।”
“হ্যাঁ মা’স্তান।”
“সে তো দেখতেই পাচ্ছি, ভাঙাচোরা মাস্তান।”
“আমাকে ভেঙাতে এসো না, তুমিও কিন্তু ভাঙাচোরা।”
উচ্চে পড়ল তেজ। নাক ফুললো মুহূর্তে। ছাড়াতে ছাড়াতে বললাম,
“দেখতে পারছেন কত মানুষ। সবাই দেখছে, নামান দ্রুত। প্লীজ নামান।”
ধ্রুব নামালেন না। এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে। বৃষ্টির ধাঁচ কমার বদলে বেড়ে চলেছে। ধ্রুবের মুখের উপরে বৃষ্টি ফোঁটা পড়ছে। বেয়ে বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে মুখের উপর। চুলগুলো লেপ্টে আছে কপালের কোণায়। ব্যান্ডেজ খোলার কারণে কপালের পাশের কাঁটা দাগটা ভেসে আসে। কালচে হয়ে আছে জায়গাটা। একটু সাদাও হয়েছে চামড়াটা। চোখজোড়া বৃষ্টিতে ভেজা। গম্ভীর মুখশ্রী।
#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২২
ধ্রুবের কোলে দেখে সবাই একটু সন্তুষ্ট হলেও পরক্ষণেই আঁতকে উঠল। আমি তখনও নির্দ্বিধায় ধ্রুবের গলা জড়িয়ে রেখেছি। আমাকে ভেজা অবস্থায় সোফার উপর বসিয়ে গম্ভীর গলায় আঁখিকে বললেন, “যা দ্রুত যা। আপাতত বরফ নিয়ে আয়। আসার সময় রসুনের কোয়ায় ডুবিয়ে সরিষার তেল গরম দিয়ে আসিস।”
আঁখি নিরবে সায় দিয়ে চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। আমি পায়ের দিকে চেয়ে রইলাম। নড়াতে পারছিনা। ইতোমধ্যে কালচে হয়ে গেছে। কালকে অর্কের বিয়ে। ভেঙে গেলে অর্কের বিয়ের বরযাত্রী হিসেবে যেতে পারবনা। নিজের কথায় নিজেই থতমত খেলাম। আমিই একমাত্র মেয়ে যে, বিয়েতে যাওয়ার জন্য পা ভালো করতে চাইছি। আচ্ছা যদি বিয়েটা না হত, তাহলে কি চাইলাম পা ভাঙাই থাক?
আমার ভাবনার ইতি টেনে রমিলা আন্টি থমথমে গলায় বললেন, “কী হয়েছে ওর? এভাবে নিয়ে এলি হঠাৎ?”
“গাছ থেকে পড়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছে।” সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়েই তিনি প্রসন্ন হলেন। কিন্তু প্রসন্ন হতে ব্যর্থ হলাম আমি। পড়ে ব্যথা পেয়েছি, আমি কী ইচ্ছে করে পড়েছি? হাওয়াতে ডাল ভেঙেছে, আমার দোষ কোথায়? আশ্চর্য!”
“তুই গাছে কেন উঠতে গেলি? বড়সড় কিছু হয়ে গেলে, তখন? আর ধ্রুব তুই। তুই ওকে কোথায় পেলি?”
“কোথায় আবার? বাঁদরের মত গাছে ঝুলছিল। নামতে বলেছি নামেনি,
এরজন্যই বলে বড়দের কথা শুনতে হয়, না শুনলে পস্তাতে হয়।”
“আপনি..
বাক্য শেষ করার পূর্বেই ধ্রুব শান্ত কণ্ঠে বললেন, “চুপ। ডোন্ট টক।”
রমিলা আন্টি অগোচরে হাসলেন। ধ্রুবকে তাড়া দিয়ে বললেন, “পা টা ভেঙে গেল না তো! তাড়াতাড়ি তেল দিয়ে মালিশ করে দেখতে হবে। নতুবা ডাক্তার ডাকতে হবে।”
আমি বিস্মিত হয়ে বসে রইলাম। ইতোমধ্যে আঁখি বরফ এবং তেলের বাটি নিয়ে হাজির। ওড়নায় বরফের টুকরোগুলো ঢেলে পেঁচিয়ে নিলেন। হাতের করতল মেলে দিলেন। কোমল কণ্ঠে বলেন, “পা রাখো।”
“আপনি সরুন, আমি..
“জাস্ট পা টা রাখতে বলেছি।”
ধীরে ধীরে পা হাতের উপর রাখতেই খপ করে ধরে ফেললেন। নিজের রুমাল বের করে মুছিয়ে দিলেন পায়ের মাটি কাঁদা। বরফের কাপড়টা পায়ের উপর রেখে মালিশ করে দিতে পাগলেন। অতঃপর তেল দিয়ে সেক দিলেন। আমি নতজানু হয়ে বসে রইলাম স্থির হয়ে। স্পর্শের ফলে ব্যথাটা প্রখর হয়ে উঠছে। সামলানো দায়। ওড়নার কোণা চেপে খিঁচে চোখ বন্ধ করে রইলাম। লজ্জা কী লজ্জা।
___
মহতাব বাড়ি। বাইরে বড় করে খোদাই করে লেখা ‘মহতাব’ শব্দটি। বাড়িটা নতুন হলেও মহতাব বেশ পুরোনো। যৌথ পরিবারের বসবাসের জন্য তিনতলা এই বাড়িটি। ধ্রুব এবং রমিলা আন্টি না থাকলেও তাদের জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট ঘর। সবাই গ্ৰামেই বসবাস করে বিধেয় বাইরে থেকে নতুন কেউ আসেনি।
পূর্ণিমার চাঁদ নেই। বাঁকা চাঁদের ফালি। অতি শীঘ্রই আকাশে পূর্ণ চাঁদের দেখা মিলবে।
বাড়ির ছাদটা বেশ বড়। চারপাশে ফুলের গাছ লাগানো। ফাগুনের সময় বিধেয় ফুলের সুবাস ভেসে আসছে। এই গ্ৰামে এমন বাড়ি দেখা যায়না বললেই চলে, এখান থেকে বড় রাস্তা অবধি দেখা যায়। মৃদু হাওয়া বইছে। চুলে কাঁটার লাগানো। অবাধ্য ছোট চুলো একটু উড়ছে। তবে কপালেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। আড্ডা দেওয়ার জন্য এটাই উপযুক্ত জায়গা। রঙ বেরঙের আলো দিয়ে সাজানো। কালকে বরযাত্রী যাবে, পরবর্তী সময় পাবো কি-না জানা নেই। তাই আজকেই আসর জমানো হয়েছে। বড় ছোট সকলে।
পায়ের ব্যথা একটু কমেছে। মচকে গেছে। একটু একটু ভর দিতে পারলেও পুরোপুরি ভর দেওয়া যায়না। দুই তিনবার তেল গরম লাগালে ঠিক হয়ে যাবে।
আমি রেলিং ধরে ধরে ছাদে এসে পৌঁছালাম। দেয়ালের কারণে অন্যপ্রান্তটা আঁধারের চাদরে ঢাকা। ছাদে কাউকে না দেখে অন্ধকারের দিকে পা উঁচু করে একপায়ে ভর দিয়ে সেখানে গেলাম। তৎক্ষণাৎ ভাউ করে উঠল কেউ। ‘আম্মু গো’ বলে চিৎকার দিয়ে পেছনের দিকে ছুটলাম আমি। পায়ে ব্যথায় এগোতে পারছি না। পরক্ষণে পুনরায় কানের কাছে মুখ এনে ভাউ করল কেউ। আমি একটু ভীত হলাম। কিন্তু কণ্ঠটা চেনা। শুধু চেনাই বড্ড বেশি চেনা। ফট করে পেছনে ফিরতেই ধ্রুবের মুখশ্রী নজরে এলো।
ধ্রুব বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে প্রকাশ করলাম না। ‘হো হো’ করে হেসে উঠলেন তিনি। মনে হচ্ছে, এটা যাত্রা হচ্ছে আর আমি তার একটা চরিত্র। ভেংচি কাটলাম। তিনি হাসি থামাতে ব্যর্থ হয়ে বললেন,
“মুখে তো সবসময় ফটড় ফটড়। জ্ঞান দেওয়া। এবার তুমি কেন ভয় পেলে। তুমি ভয় পাও চড়ুই, হাউ ফানি। এটাও সম্ভব।”
“মোটেও না। আমি মোটেও ভয় পাই না, বুঝতে পেরেছেন আপনি?”
“তা তো দেখতেই পেলাম।”
প্রবল রাগ লাগল। আমি ভেংচি দিয়ে সরে এলাম। ততক্ষণে সবাই হাজির হয়েছে। গোল করা বসেছেন। আমি আঁখির পাশে বসলাম। ‘স্পিন দা বোতল’ শুরু হল গেমটি। প্রথম বোতল ঘোরাতেই থামল গিয়ে দাদিমার দিকে। দাদিমা হেসে বললেন,
” যাহ্! প্রথমেই আমার। আমি আর কী নিবো? বুড়ো বয়সে এইসব মানায়?”
“না দাদিমা, এটা বললে কিন্তু শুনব না। তোমাকে নিতেই হবে?”
দাদিমা বললেন, “আমি আর কী নিবো।”
আমি ফট করে বললাম, “তুমি তোমার প্রিয় গানটা গাও না, কতদিন শুনি না।”
সবাই আমার দিকে বিস্মিত চোখে চেয়ে রইলেন। এই গানটা তার একান্ত প্রিয়। প্রিয় থেকেও প্রিয়। আমি শুনছি অনেকবার, দাদু বেঁচে থাকতে গাইতেন। সবাইকে চমকে দিয়ে তিনি গাইলেন,
“পুরোনো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়।
ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা সে কি ভোলা যায়?
আয় আর একটিবার আয় সখা, প্রাণের মাঝে আয়।
মোরা সুখের দুখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়।
মোরা ভোরের বেলা ফুল তুলেছি, দুলেছি দোলায়–
হায় মাঝে হল ছাড়াছাড়ি, গেলেম কে কোথায়–
আবার দেখা যদি হল, সখা, প্রাণের মাঝে আয়।”
থামতেই দাদিমার গাল গড়ালো অশ্রুতে। তিনি আঁচলের আড়ালে চোখ মুছে নিলেন। হাসলেন তৃপ্তিকর হাসি। বোতল পুনরায় ঘুরানো হল। থামল গিয়ে ছোট চাচার দিকে। তিনি প্রথমে বললেন, “ট্রুথ।”
অর্ক সংক্ষেপে বলল, “তোমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের জিনিস কোনটা?”
আগে পিছু না ভেবে সোজা বললেন, “কে আবার তোর চাচি। বিয়ের পর থেকে জ্বালিয়ে আসছে।
আসলে বাদুরের গলায় মুক্তার মালা হলে যা হয় আরকি!”
তখনই ছোট চাচি নিচ থেকে কাজ সেরে উপরে উঠে আসছিল। কোমড়ে হাত দিয়ে বললেন, “কী আমি বাদুর?”
চাচা অর্কের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ছাদের দরজাটা কেন লাগাসনি? দেখলি তো চলে এল, আমার রিনা খান। [চাচিকে উদ্দেশ্য করে] তুমি কেন বাদুর হবে?”
চাচি খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন, “তারমানে আমি মুক্তার মালা। এতদিনে একটা ঠিক কথা বলেছ। আমি সহ্য করে আসছি এই বুড়োকে।
সবজায়গাতেই তার কবিরাজি ফলাতে যায়, আর মা’র খেয়ে আসে। জীবিত মানুষকে মৃত্যু বানিয়ে দেয়।”
“তুমি একদম আমার কাজ নিয়ে খোটা দিবেনা।”
“খোটা দিবো না কি আদর করমু, আর কোনোদিন কবিরাজি করতে দেখলে এই মুক্তার মালা আর তোমার গলায় থাকবে না।”
‘তাড়াতাড়ি নিচে যেতে’ বলে চাচি রাগ দেখিয়ে চলে গেলেন। চাচা চাচির পেছনে যেতে যেতে ধ্রুবকে বললেন,
“তুই যাওয়ার আগে আমার থেকে পানি পড়া নিয়ে যাস, দুইবেলা খাওলেই শ্রেয়া তার চৌদ্দ গুষ্টির নাম ভুলে তোর নাম জপ করবে।”
ধ্রুব চোখ টিপে বললেন, “তাহলে তো নিতেই হবে।”
মুখ ঘুরিয়ে শুনিয়ে শুনিয়ে বললাম, “হ্যাঁ, আমিও পানি পড়া খেতে চাই। চৌদ্দ গুষ্টির নাম ভুলে সারাদিন ধ্রুব ধ্রুব করতে চাই। ধ্রুব চাচা, ধ্রুব ভাই, ধ্রুব মামা, ধ্রুব বাবা, ধ্রুব..
তড়িগড়ি করে ধ্রুব বলল, “দরকার নাই পানি পড়া। তুমি শুধু ধ্রুব ধ্রুব করো, তাতেই চলবে।”
পুনরায় শুরু হল খেলা। একে একে সবার কাছে বোতল থামলেও আমার আর ধ্রুবের দিকে থামল না। তাই আমাদের ডেয়ার দিল। একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। আমি আপত্তি করলেও কুল পেলাম না। যে রাজি হবেনা, সে হারবে। আমি বাধ্য হয়ে ধ্রুবের চোখের দিকে তাকালাম। অদ্ভুত তার চোখজোড়া। ক্ষণে ক্ষণে দৃষ্টি আমাকে ডাকছে। ধ্রুব অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তারদিকে তাকিয়ে থাকা যেন দায়। হুট করে চোখ টিপলেন ধ্রুব। তৎক্ষণাৎ পলক পড়ল চোখের। একবার নয়, বেশ কয়েকবার। চ্যাঁচিয়ে উঠল সকলে। তাজ্জব বনে গেলাম আমি। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললাম,
“মানে কী? আপনি আমাকে চোখ টিপ দিয়েছেন। তারপরে আমার পলক পড়েছে। আপনি আগে পলক ফেলেছেন।”
“একচোখে ফেলেছি, দুই চোখে নয়। তুমি দুইচোখের ফেলেছ, তাই আমি জিতেছি।”
উঠে দাঁড়ালেন ধ্রুব। বামহাতে চুলগুলো ঠিক করলেন। আমার চোখ থেকে চশমা খুলে নিলেন দ্রুত। নাক ধরে টান দিলেন। চোখে পড়ে নিলেন। স্থির পাজোড়া সামনের দিকে অগ্ৰসর করলেন। গান ধরলেন,
“চড়ুই ধান খাইল-রে, খেদানোর মানুষ নাই। খাবার বেলায় আছে মানুষ, কামের বেলায় নাই। চড়ুই ধান খাইল-লে।”
আমি গমনপথের দিয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। এখানে তো কাউয়া ছিল, চড়ুই আসলো কোথা থেকে।
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]