মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব -১২+১৩

#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:১২

ধ্রুব স্যার ও রাহাত স্যার সন্নিকটে বসে আছে। আমি স্থির দৃষ্টিতে দু’জনকে অবলোকন করছি। পা জোড়া নিশ্চল। স্তব্ধীকৃত হলো নেত্র পলক। দৃষ্টিবিভ্রম নয়। এক’পা ফেলার ন্যায় প্রাণশক্তিটুকু উদ্বৃত্ত নেই। পা জোড়া দৃষ্টি অগোচরে আবৃত কোনো বন্ধনে। পরবর্তী পা ফেলার কথা বিস্মৃত হয়েছে। স্পর্ধা দেখিয়ে অগ্ৰসর হলাম। নতজানু হয়ে সালাম দিলাম। আমাকে দেখে একঝলক চমকালেন ধ্রুব স্যার। তবে ভাবাবেগ বিহীন রাহাত স্যার। ক্লাসে থাকলেও তেমন কথা হলনি আমাদের, অপরিচিতার ন্যায়। বলতে গেলে আমিই শুধু চিনি। ফোন নম্বরটা দেখিয়ে বললাম,
“এটা কি আপনার?”

তিনি সায় দিলেন। ইঙ্গিত করলেন বসতে। আমি বসলাম দূরত্ব বজায় রেখে। যতটা নয় অস্বাচ্ছন্দ্য, তারচেয়ে বেশি বিচলিত। ধ্রুব স্যারের উপস্থিতিতে কারণে। রাহাত স্যার অনুমান করলেন। একগ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বললেন,

“ও আমার বন্ধু ধ্রুব। আমাদের এক আত্মা এক প্রাণ। আমি বিয়ে করব অথচ আমার বন্ধু থাকবে না, এটা হতে পারে না।
আপনি নির্দ্বিধায় বলতে পারেন। পানিটুকু খেয়ে নিন আগে।”

‘আপনি’ শব্দটা বড্ড বেশিই অপ্রস্তুত বোধ বাড়িয়ে দিল। আমি পানি ভর্তি গ্লাসটা হাতে নিয়ে সৌজন্য হাসি হাসলাম। এক চুমুক দিলাম। অতঃপর পাশে রেখে বললাম, “আমি আপনার চেয়ে ছোট, তুমি করেই..

সমাপ্তি টেনে দিলাম বাক্যে। রাহাত স্যার বুঝতে পারলেন। সংক্ষেপে বলেন, “ঠিক আছে‌।”
আমার কৌতুহলী দৃষ্টিতে নিবদ্ধ হল ধ্রুব স্যারের মুখপানে। তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। চোখের মাঝে হাজারও না বলা কথা। নিমিষেই আমাকে অগ্নিদগ্ধ করে দিতে সক্ষম। আমি দ্রুত দৃষ্টি ফেরালাম। পরক্ষণেই ধ্রুব স্যার বললেন,

“রাহাত, ছেড়ে দে মেয়েটাকে। একজন ছাত্রীকে বিয়ে করাটা ভালো লাগছেনা আমার।”

রাহাত স্যার চমকে উঠলেন। উত্তেজিত হয়ে বলে, “মানে?”

“মানে, কয়েকদিন হয়েছে আমরা দেশে ফিরেছি। প্রফেসর হয়ে একজন ছাত্রীকে বিয়ে করলে কটাক্ষের শিকারে পড়তে হবে। বাংলাদেশ উন্নত দেশ নয়, সব বাজে ভাবেই দেখবে।
ভার্সিটি পড়াশোনার জন্য নয়, প্রেমের জন্য। এইসব রটাবে সবাই।”

পলকহীন, স্থির হয়ে বললেন, “তুমি আমাদের ভার্সিটির স্টুডেন্ট?”

“হম। আমি চড়ুই। তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। সেদিন ধ্রুব স্যারের সাথে লাইব্রেরী আপনাকে দেখেছিলাম।”

রাহাত স্যার গভীরতর ভাবনায় লিপ্ত হলেন। স্মৃতির পাতায় প্রকট হতেই বললেন, “মনে পড়েছে, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।”

নিরবতা বিরাজ করছে, সকাল হওয়াতে আশেপাশে তেমন কেউ নেই। আমার মুখোমুখি রাহাত স্যার এবং পাশে ধ্রুব স্যার বসে আছেন। ইতোমধ্যে ওয়েটার এসে অর্ডার নিয়েছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ওয়েটার তিনটে সফ্ট ডিঙ্ক নিয়ে হাজির। কাঁচের বোতল তাই খুলতে ব্যর্থ আমি। একপলক চেয়ে ধ্রুব স্যার খুলে দিলেন বোতলের ছিপি। আমি চুমুক দিয়ে রেখে দিলাম। এখন যাওয়া উচিত এখান থেকে। বললাম, “বিয়েটা হবে কি-না সেটা ফোন করে জানিয়ে দিয়েন। আমাকে একটু ব্যাংকে যেতে হবে। টাকা তুলে চশমার দোকানে‌ যেতে হবে।”

রাহাত স্যার সোজাসাপ্টা উত্তর দিলেন, “এখানে বিয়ে না হওয়ার কারণ দেখছি না, আমি অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করলে সেও আমার স্টুডেন্ট হবে। আমাদের ভার্সিটির না হোক, অন্য ভার্সিটির হবে। তাছাড়া পরিচয় বলে একটা কথা আছে। আমার অনেক ইচ্ছে আছে,
ক্লাসে আমি পড়া বুঝাব, তুমি আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে। ভার্সিটি শেষে পায়ে হেঁটে আমি তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিব। মাঝরাতে ফোন করে বলল, নিচে এসো। তোমার খোঁপায় ফুলের মালা গুঁজে দিব। লাইব্রেরীতে বসে ভবিষ্যৎ বাচ্চাদের নাম ঠিক করব। আরও কত কী!”

আমার চোখজোড়া বেরিয়ে আসার উপক্রম হল। বিয়েতে রাজি হওয়ার পূর্বেই তিনি সবকিছুর পরিকল্পনা করে রেখেছেন। তিনি সত্যিই জানতেন না, আমি তার ছাত্রী। ব্যাপরটা বড্ড সন্দেহপ্রবণ।
_____
বিকেলের হালকা রোদ বালির উপর পড়তেই চিকচিক করে উঠছে। রবীন্দ্রনাথের কবিতার একটি বিশেষ লাইন মনে পড়ছে,
‘চিকচিক করে বালু, কোথাও নেই কাঁদা”
গ্ৰামাঞ্চল হলে কাঁদার দেখা পাওয়া যেত। ব্যালকেনিতে দাঁড়িয়ে ব্রাশ করছি আমি।মাত্রই তন্দ্রায় ব্যাঘাত ঘটেছে। বাইরে থেকে ফিরে ঘুমিয়েছিলাম। ড্রয়িং রুম থেকে হাসি শব্দ শ্রবণ হচ্ছে। সচরাচর এমন হাসির শব্দ শোনা যায়না। মামা বাড়িতে এসেছেন। তবে শুধু মামা মামুনি নয়। অন্য কেউ আছে। হাসির কারণ জানতে আমাকে সেখানে উপস্থিত হতে হবে। আমি মুখ ধুয়ে সেদিকে অগ্ৰসর হলাম।

“কেমন করলাম প্লানটা। আমার ছেলে তো হিংস্র বাঘে পরিণত হয়েছে। বাড়ির কোনো জিনিস আস্তো নেই। ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে।”

“একদম পারফেক্ট। বন্ধুর সাথে বউকে দেখে এমন রিয়েকশন। যখন বন্ধু সেজে পরিচয় দিয়েছিলে তখন? একটা কার্ড বানিয়েছি, ধ্রুবকে দিবেন। তাহলে খেলা জমবে।”

তৎক্ষণাৎ উপস্থিত হলাম সেখানে। অস্ফুট শব্দ শ্রবণপথে গেল। আমাকে দেখে উভয়ই থেমে গেল। পরিবেশ শান্ত হল। কৌতূহলী স্বরে বললাম, “আমাকে দেখে থেমে গেলেন কেন? কীসের প্লানের কথা বলছেন।”

“ভালো আছিস মা?” রমিলা পরিবেশ শান্ত করার জন্য বলেন।

“জি আলহামদুলিল্লাহ। আপনি ভালো আছেন আন্টি?”

“তা আছি। এককাপ চা খাওয়াবি মা। তোর মামনির তৈরি চায়ে স্বাদ পাচ্ছি না।”

‘হম’ বলে এগোলাম রান্নাঘরে। ধ্রুবের মা রমিলা হঠাৎ আমাদের বাড়িতে কেন এসেছেন। ডেক্সিতে পানি বসিয়ে আড়ি পাতলাম। এদের কথোপকথনের আওয়াজ ধীর গতিতে চলছে। এতটা কাছে থেকেও শোনার যোগ্য নয়।
তিন কাপ চা নিয়ে ট্রে সমেত টেবিলের উপর রাখলাম। কাপ হাতে তুলে দিয়ে বসলাম। পুনরায় একই প্রশ্ন করলাম,
“মামা, বললে না কীসের প্লান করছ?”

ফট করে জবাব দিলেন, “কীসের আর তোর বিয়ের। বিয়ের কার্ড ছাপানো শেষ। দেখ। দেখ পছন্দ হয় কি-না।”

উত্তর যেন গোছানই ছিল। এগিয়ে দিলেন কার্ডটা। নিলাম না। সৌজন্য হাসি দিয়ে নিজ কামরার দিকে পা বাড়ালাম। দুমড়েমুচড়ে উঠছে অন্তঃকরণ। সহ্য ক্ষমতা শূন্য। পেছন থেকে মামা ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিতে বললেন। কমরায় তখন বাবুই ছিল, তাই যেতে হয়নি। খামটা ওর কাছে দিলাম, পৌঁছে দেওয়ার নিমিত্তে।

দরজা হেলান দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলাম। না চাইতেও আবৃত হয়েছি এই বন্ধনে। এত অবহেলার পরেও ইতি টানতে ব্যর্থ।
_________

অমাবস্যা তিথি। চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। মৃদু হাওয়া বইছে। ঈষৎ শব্দ হচ্ছে পাতার সংঘর্ষে। ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে অদূরে। হিম মেঝে। ছাদে অবস্থানরত আমি। রেলিংয়ের ওপর বসে আছি। তৎক্ষণাৎ আবির্ভাব ঘটল বাবুইয়ের। ফোন নিয়ে ছুটে এসেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
“আপুই, তোমার ফোন বাজছে। তোমাকে চাইছে।”

“বন্ধ করে রেখে দে, ইচ্ছে নেই।”

‘জরুরী’ বলে হাতে ধরিয়ে দিল। আমি কর্ণকুহরে ধরতেই পরিচিত কণ্ঠস্বর ঠেকল।

“কতবার ফোন করেছি, কোথায় ছিলে? নিচে আছি। পাঁচ মিনিট সময় দিলাম, নিচে এসো।”

“স্যার, আপনি এতরাতে এখানে? স্যরি, আমি যেতে পারব না।”

“আসতে বলেছি, সো এখনি। আসবে পাঁচ মিনিটের এক সেকেন্ডও এদিক ওদিক যাতে না-হয়। তাহলে তোমার বাড়ির ভেতরে পৌঁছে যাবো। এতরাতে একটা ছেলে বাড়িতে তোমার জন্য এসেছে, ব্যাপারটা কি ভালো দেখাবে?” একরোখা জবাব।

বিনাবাক্যের নির্গত করলাম, “হম।”

অদূরে স্ক্রিনের ঈষৎ আলো দেখে অনুমানসাপেক্ষ এটা ধ্রুব স্যার। সেদিন বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তাই ঠিকানা জানা অবাস্তব কিছু নয়, অবাস্তব তার আগমন। ছাত্রীর সাথে দেখা করতে এসেছেন।
ফোনটা পুনরায় বাবুইয়ের হাতে দিয়ে বললাম, “যা গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। গ্ৰামের ভাষায়, এই রাতটা ভালো নয়। বাইরে থাকা নিরাপদ নয়। যা!”
গ্ৰামে বসবাস কালীন সময়ে সন্ধ্যা ছয়টার পূর্বেই কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুম। আর এখন! এখন বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। ঘুমের ছিটেফোঁটাও নেই।

ছাদের দরজা বন্ধ করে নিচের দিকে এগোলাম। ধ্রুব স্যার মেইন দরজার থেকে কিছুটা দূরে অপেক্ষা করছেন।

“আসসালামু আলাইকুম।”

দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে, “ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”

“জরুরী কোনো দরকার ছিল স্যার। এতরাতে ডেকে পাঠালেন।”

আবদারের সুরে, “আমার জন্য আজকের দিনটা বড্ড যন্ত্রণাদায়ক চড়ুই। সকল থেকে এখন পর্যন্ত, সবকিছু অমাবস্যায় ঘিরে রেখেছে।
একটু হাঁটবে আমার সাথে?

তার বামহাতে একগুচ্ছ গাঁদা ফুল। রাহাত স্যারের কথা অনুযায়ী তিনি আমার খোঁপায় ফুল গুঁজে দিতে চেয়েছিলেন। এখন কি ধ্রুব স্যার আমার খোঁপায় গাঁদা ফুল গুঁজে দিবেন?

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৩

“এতরাতে ছাত্রীর সাথে দেখা করতে আসাটা কি শোভা পায়, স্যার? আপনার মত বিচক্ষণ মানুষের দ্বারা এতবড় ভুল?”

ধ্রুব স্যার নিশ্চল। প্রতুক্তি দেওয়ার ন্যায় ভাবাবেগ নেই। অনুদ্ধত দৃষ্টি নিবদ্ধ দূর মেঘহীন অমাবস্যা অন্তরিক্ষে। তার নিশ্চলতায় অসন্তোষ প্রকাশ করলাম। অগ্ৰসর হওয়ার প্রয়াস করলাম পেরিয়ে আসা পথে। ব্যর্থ হলাম অকস্মাৎ স্পর্শে। জমে গেল দেহ। হিম স্তুপে রুপান্তরিত হল। বা’হাত বলিষ্ঠ সুপুরুষের আয়ত্তে। আমি দ্রুত দৃষ্টি মেলালাম। হাত ছাড়লেন, সরলেন না। বরং এগিয়ে এলেন। অগোছালো চুলগুলোকে খোঁপায় পরিনত করল। চুলের মাঝে গুঁজে দিল কালচে গাঁদা ফুলের গুচ্ছ। লহমায় অমাবস্যা তিথি রুপ নিল পূর্ণিমার। ঈষৎ গলায় বলেন, “চলো।”
পুনরায় আঙুলের ভাঁজে আঙুল গুঁজে পা বাড়ালেন। স্পর্শের মাঝেও ঘোরতর দূরত্ব। সূচালো বাঁধল হাতে। অবিলম্বে বোধগম্য হল। বিচলিত হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম,

“কী হয়েছে আপনার? ব্যান্ডেজ করা কেন? কথা বলছেন না কেন?”

“নজরে পড়ল বুঝি। আমি তো ভেবেছিলাম, দেখলেও এড়িয়ে যাবে।”

“ফাজলামো বন্ধ করুন তো! কী হয়েছে বলুন।”

“তা পরে বলছি, এখন এসো।”
বলে এগোলেন। তোয়াক্কা করলেন না। কিছুটা পথ পেরিয়ে আসতেই‌ তার গাড়ি নজরে এল। আলো বন্ধ ফলস্বরুপ গাড়িটা দৃষ্টিনন্দনে আসতে বেশ বেগ পেতে হল। আমি ভনিতা না করতেই সামনের সিটে বসলাম। সিটব্যাল্ট বাঁধতে গেলেই বারণ করলেন। ড্রাইভিং সিটে বসে দরজা ভিড়িয়ে বললেন,

“যতদিন বাঁচব, প্রাণ খুলে বাঁচব। অহেতুক কোনো বন্ধনে বন্দিত থেকে নয়।
আর চিন্তা নেই, তুমি পাশে থাকলে এতটা জোরে ড্রাইভ করব না। লাগুক, ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর।”

বলেই শুরু করলেন। অন্তরিক্ষের দিকে ধ্যান রাখলাম।

‘আলো নেই, আঁধার নেই, নেই চাঁদ কিংবা বাঁকা চাঁদের ফালি। তবুও আমার আকাশে পূর্ণিমা। মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা। যার কারণ, আমারই অজানা। এইমাত্র এই মানুষটির সান্নিধ্যের জন্যই তীব্রতর অপেক্ষায় রইতে পারি।’
_______
বেসরকারি হসপিটালে করিডোরে বসে আছি। শুভ্র রঙের বাতির আলো হ্রাস পেয়েছে। মানুষের আনাগোনা নেই বললেই চলে। নার্স, স্টার্ফ কিংবা ওয়ার্ড বয় যাচ্ছে। আমি নিভু নিভু দৃষ্টি মস্তিষ্কে গেঁথে নিচ্ছি। নিদ্রায় চোখজোড়া আপনাআপনি গ্ৰথণ হয়ে আসছে। এদিকে পেটের ক্ষুধায় অস্তির। ধ্রুব স্যার আমার নাজেহাল অবস্থা দেখে সন্দিহান গলায় বলেন,

“ঘুম পেয়েছে?”

“না, নাচ পেয়েছ। নাচব এখানে? আশ্চর্য!”

আমার কথার ফোড়ন দিয়ে বলেন, ” সত্যি নাচবে, গান বাজাব? কিন্তু তোমার নাচ দেখলে পেসেন্টরা হসপিটাল ছেড়ে পালাবে। কী ঝামেলা।”

প্রখর চাইনি নিক্ষেপ করে বললাম, “দেখছেন যে, হাই তুলছি তবুও বোকার মত জিজ্ঞেস করছেন।”

অতিবাহিত হল কিছু মুহুর্ত। একজন স্টার্ফের আগমন হল। ধ্রুব স্যারকে ভেতরে যাওয়ার জন্য বলেই তার গন্তব্যে ছুটলেন। ধ্রুব স্যার উঠে এগোলেন। পিছু না ফিরে অবিচল হয়ে বললেন, “ভেতরে এসো।”

“ভেতরে গিয়ে আমি কি করব?” একরোখা জবাব।

“তুমি না গেলে চিকিৎসা করবে কার?”

“মানে?”
“গেলেই দেখতে পারবে।”

ভেতরে প্রবেশ করতেই তাজ্জব বনে গেলাম। ধ্রুব স্যার একটা লিস্ট দেখিয়ে বললেন টেস্ট করিয়ে আনতে আমায়। বোধগম্য হলনা, কী এমন হয়েছে আমার। শতবার বারণ করার সত্বেও অনিবার্য করেন টেস্ট করতে। স্টার্ফরা জোরপূর্বক তাদের সঙ্গে নিয়ে যায়। দীর্ঘ দুই ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পরে রেহাই মিলেছে। বাড়ির মূল দরজার থেকে কিছুটা দূরত্বে গাড়ি থামালেন। এমন অবধি বেশ কয়েকবার কথা বলার প্রয়াস করেছেন। আমি নিশ্চুপ, বুলিহীন। কিয়ৎক্ষণ আমার মুখপানে চেয়ে থেকে বললেন, “তোমার বাড়িতে পৌঁছে গেছি। যাবে না?”

“না!” মুখ ফুলিয়ে বলি।

ভ্রু কুঁচকালেন তিনি। অগোচরে হাসলেন মৃদু। বিদ্রুপ করে বলেন, “তারমানে তুমি যাবে না, গাড়ি ঘুরাব?”

“না!”

“বেশি লেখেছে?”

“আপনাকে কেন বলব?”
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই সরে গেলেন তিনি। ফট করে নেমে দাঁড়ালাম। ঝংকার তুলে দ্বার গ্ৰথণ করে দিলাম। প্রবল বেগে ধাবিত হলাম। তিনি পথ আঁটকে দাঁড়ালেন। হাইট মাপলেন আমার। ধ্বনিশূন্য ওষ্ঠদ্বয় নাড়িয়ে কিছু উচ্চারণ করলেন। অতঃপর কিঞ্চিত শব্দে বলেন, “সামনে পরীক্ষা। তোমাকে পড়ানোর কথা ছিল। কালকে লাইব্রেরীতে দেখা হচ্ছে। গুড নাইট।”

“যাবো না।”

“বাড়িতে চলে আসব।”
বলেই চঞ্চল হল পাজোড়া। গাড়ির ভেতরে ঝুকে একটা প্যাকেট বের করলেন। অনুমতি ব্যতীত হাতে গুঁজে দিয়ে বলে, “জানি, ধ্রুবের চিন্তায় খাওয়া হয়নি। খেয়ে নিও।
চিন্তা করো না। যাতে রাহাতের সাথে তোমার বিয়েটা না-হয়, তাই এই টেস্ট গুলো করা জরুরি ছিল।”

তার উষ্ণ ওষ্ঠদ্বয় স্পর্শ করল ললাট। আমি বিস্মিত হলাম। চোখ জোড়া চড়কগাছে উঠল। আমার বিস্ময় ভঙ্গ হওয়ার পূর্বেই তিনি মিলিয়ে গেলেন রাতের আঁধারে।‌ তার স্থান দখল করে নিল দমকা হওয়া। কম্পিত করল ভিশন। তপ্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম। অমাবস্যা রাত তারকাময় রাত। চাঁদের চেয়েও ঢেরগুন বেশি রঙিন।

______
পূর্বের দিনগুলোর ন্যায় আজকের দিনটাও সূর্যের আলোয় পরিপূর্ণ। প্রকৃতি তার স্ব স্ব রীতিতে চলবে। তাকে বাঁধা দেওয়ায় সাধ্য নেই। তবে আমার রীতি একটু বদলে গেছে। তন্দ্রা থেকে মুক্তি মিলেছে একটু বিলম্বে। যার ফলশ্রুতিতে ভার্সিটিতে আসতে বিলম্ব ঘটেছে। আমি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলাম। ততক্ষণে ক্লাসের সময় ঘনিয়ে এসেছে। ধাক্কা খেলাম কারো সাথে। একটু সময়ের জন্য থমকে ‘স্যরি’ বলে পুনরায় হাঁটা ধরলাম। কিন্তু তরুণী আমার পিছু ছাড়ল না। পেছন থেকে ডেকে উঠল জোর গলায়। তরুণী আর কেউ নয়, মাহি! বই চাইল। গতকাল ধ্রুব স্যার ও রাহাত স্যারের সাথে দেখার করার জন্য অনুপস্থিত ছিলাম ক্লাসে। পড়াও জানা ছিল না। তিনি বেশি পড়া দিয়েছেন। আমি সন্তর্পণ হাসি দিয়ে বই দিলাম। অতঃপর ছুটলাম লাইব্রেরীর দিকে। দূর থেকে অস্ফুট বেল বাজার শব্দ শ্রবণ হল। আমি দ্বি মুহূর্ত অতিবাহিত না করে পৌঁছে গেলাম সেখানে। ধ্রুব স্যার বই নাড়াচাড়া করছিলেন। আমাকে দেখে এক পলক চাইলেন। সেকেন্ডের মাথায় দৃষ্টি সরালেন। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,

“ক্লাসের সময় হয়ে এসেছে। এখন এসেছ পড়তে। তোমার সময় শেষ। ছুটির পর সোজা এখানে আসবে।”

অব্যক্ত স্বরে বললাম, “কাল রাতে দেরিতে ঘুমিয়ে ছিলাম, তাই..

“ক্লাসে চলো।”
তার পৌঁছে যাওয়ার পূর্বেই আমি হাজির হলাম ক্লাসে। দ্রুত বন্ধুমহলের পাশে বসলাম। আঁখির ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে এক ঢোক পান করলাম। অবিলম্বে স্যার উপস্থিত হলেন। আমি সৌজন্য হাসি দিয়ে দাঁড়ালাম। স্যার বসতে বলে লেকচার দেওয়া শুরু করলেন। বই চাইলেন। ফট করে মাহি আমার বইটা এগিয়ে দিল। পড়ায় মনোযোগ দিলাম। একসময় স্যার থেমে গেলেন। বইয়ের ভেতর থেকে ভাঁজ করা পৃষ্ঠা বের করলেন। খুলে পড়লেন। বইয়ের পাতা বন্ধ করে গম্ভীর গলায় বললেন,

“এই বইটা কার?”

মাহি আমাকে দেখিয়ে দিয়ে বলে, “চড়ুইয়ের!”

তিনি এগিয়ে এসে পৃষ্ঠা সামনে ধরে বললেন, “এটা কী চড়ুই?”

“পৃষ্ঠা।”

“আমিও দেখতে পাচ্ছি পৃষ্ঠা। কী লিখেছ, সেটা জিজ্ঞেস করছি।”

আমি হাঁ করে চেয়ে রইলাম। আমি লিখেছি? কী লিখেছি? কখন লিখেছি। আড়চোখে মাহির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সে হাসছে? বোধগম্য হলনা।
স্যার হাতে ধরিয়ে দিলেন। পিছিয়ে গেলেন। পড়ে শোনাতে বললেন।
আমি সাহস সঞ্চয় করে পড়তে লাগলাম। কী বিশ্রী হাতের লেখা।‌ দাঁত ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। কার হাতের লেখা? তাকে জাদুঘরে বড় করে টানিয়ে রাখা উচিত।

“প্রিয় ধুব,
আপনি আমার..

“ওটা ‌ধুব না ধ্রুব।” মাহি উঠে বলে।

আমি সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার পড়তে লাগলাম,

“আপনি সম্পর্কে আমার স্যার হলেও, স্যারের নজরে দেখি না। প্রেম প্রেম নজরে দেখি। আপনি ভার্সিটিতে আসার পর থেকেই আপনাকে ভালো লাগে।”

মাত্র এই কয়টা শব্দ উচ্চারণ করতে কম করে হলেও ৫ মিনিটের বেশি নষ্ট হলো। তুতলে যায়। ধ্রুব স্যার আমার করুন অবস্থা দেখে পৃষ্ঠা নিয়ে মাহির হাতে ধরিয়ে দিল। তাকে পরার নির্দেশ দিলেন। মাহি দিব্যি পড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এটা ওর লেখা।
ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে লাগলাম। এই মেয়েটারই কাজ। নাহলে এমন কাজ কেউ করতে পারে না।

আমার ভাবনায় ছেদ ঘটল ধ্রুব স্যারের হুংকারে। তিনি মাহির ব্যাগ সার্চ করে খাতা বের করলেন। পরখ করলেন হাতের লেখা। সন্দিহান গলায় বললেন,

“তাজ্জব ব্যাপার তো, মিস মাহি! চড়ুইয়ের হাতের লেখা তোমার সাথে কীভাবে মিলে গেল। আবার তুমি গড়গড় পড়ছ, মনে হচ্ছে কবিতা মুখস্থ বলছ?”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]
১৫ পর্বের ভেতরেই সব পরিস্কার হয়ে যাবে, অতএব অপেক্ষা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here