মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব -১০+১১

#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১০

রাত্রির মধ্যভাগে পৌঁছেছে। পূর্ণিমার চাঁদ একটু বেশিই প্রজ্বলিত। স্নিগ্ধ আলো প্রকট। গালে হাত রেখে এদিক ওদিক ছোট ছোট দৃষ্টিতে চেয়ে আছি। ধ্রুব স্যার পাশে অসহায় হয়ে বসে আছেন। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম। পা ব্যথা করছে। চোখজোড়া গ্ৰথণ হয়ে আসছে আপনাপনি। আমি হাতের সহায়তায় বড়ো বড়ো করে টেনে ধরলাম চোখের পাতা। অগ্ৰসর হলাম সামনের দিকে। ধ্রুব স্যারও এলেন পিছু পিছু। শাড়ির অবস্থা নাজেহাল। কুঁচিগুলো খুলে ঝুলে পড়েছে নিচে। পায়ে বেঁধে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে নিলেই বলিষ্ঠ পুরুষালি হাতের সাহায্যে বেষ্টিত করে নিলেন। বিরবির করে বললেন,
“ফোন নিয়ে আসাই ভুল হয়েছে। না কল আসত, না রিসিভ করতে যেতাম। না এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতাম। ইচ্ছে ত করছে।”

“আইসক্রিম খাবো।”

“কী?”

আঙুল দিয়ে ইশারা করে বললাম, “ঐযে আইসক্রিমওয়ালা। আইসক্রিম খাবো।”

“এখন নয়, পরে।”

বায়না ধরেছি। হাত ছাড়িয়ে বসে পড়লাম নিচে। আদুরে গলায় বললাম এখনই। আদুরে আবদার। ধ্রুব স্যার কোনো উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে, আইসক্রিম কিনে দিলেন। এদিকে শাড়ির কুঁচিগুলো খুলে যাচ্ছে ক্রমশ। আমাকে নিয়ে দ্রুত পাশের নাগরদোলায় উঠলেন। আমি আইসক্রিম খেতে লাগলাম। নাগরদোলা চলন্ত হলেই খামচে ধরলাম ধ্রুব স্যারের হাত। উপরে গিয়ে স্থির হল। তিনি তৎক্ষণাৎ আমার হাত ছেড়ে ঝুঁকলেন। ধীরে ধীরে কুঁচিগুলো গুছিয়ে গুঁজে দিলেন। কেঁপে উঠলাম আমি। ধ্রুব স্যারকে দৃঢ় বাঁধনে আঁকড়ে ধরে রইলাম। এদিকে নাগরদোলা চলন্ত হল পুনরায়। মাথা ঘুড়তে লাগল। এমনিতেই ওটা খাওয়ার পর থেকেই হেসে যাচ্ছি, সাথে মাথা ঝিম ধরে আছে। এখন একটু বেড়েই গেল। আমি মাথা চেপে ধরলাম। তিঁতকুটে ঢেকুর উঠল। শরীরটা গুলিয়ে উঠল। আমি গলা চেপে ধরলাম। পরক্ষণেই বমি করে দিলাম ধ্রুব স্যারের কালো পাঞ্জাবিতে। তিনি কিছু বললেন না, যেন এটা হওয়ারই ছিল। বরং তার পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছিয়ে দিলেন। সবকিছু ক্রমশ ঝাঁপসা হতে লাগল। দেহটা জমে গেল শীতলতায়। নেত্রযুগল গ্ৰথণ করতেই শরীরটা হালকা হয়ে গেল। সমস্ত ভর ছেড়ে দিলাম ধ্রুব স্যারের উপর। মস্তিষ্ক অচল হয়ে গেল। ঢুবে গেল আঁধারে। জ্ঞান হারালাম সেখানে। আর কিছু মনে নেই।

জ্ঞান ফিরতে নিজের বেডের উপর অনুভব করলাম।‌ এসি অন করা। ব্লাঙ্কেট দিয়ে শরীর মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। হাই তুলে ব্লাঙ্কেট সরিয়ে উঠে বসলাম। অচেনা রুমে নিজেকে আবিষ্কার করলাম। তবে অসুবিধে হল না, ধ্রুব স্যারের বাড়ির একটি কক্ষ। দেয়াল ঘড়ির দিকে অবলোকন করে বোধগম্য হল এখন এগারোটা সাত বাজে। আমি তো সাধারণ এতসময় ঘুমাই না। আজকে কেন এত সময় ঘুমিয়েছি। পরক্ষণেই কালকে রাত্রে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো স্মৃতির পাতায় প্রকট হল। আমাকে কীভাবে এখানে এনেছে তিনি। ডেসিং টেবিলের বড়ো আয়নায় নজর আঁটকে গেল। পড়নে ঢিলেঢালা সবুজ রঙের কামিজ। এমা! আমার শাড়ি কোথায়? ধ্রুব স্যার কিছু করেনি তো! তিনিই বা কোথায় গেছেন। মাথাটা এখনও ঝিমঝিম করছে। কী খেয়েছিলাম।

আমি ওয়াশরুমের উদ্দেশ্য পা বাড়ালাম। বাড়ি ফিরতে হবে, নিশ্চয়ই মামুনি চিন্তা করছেন। অবশ্য কালকে রাতে একবার ফোন করে বলেছিলাম, বাড়িতে ফিরব না।

কাবার্ড খুলে কালকে পড়ে আসা সালোয়ার কামিজ বের করলাম। চোখ বন্দী হল পাশেই একটা পেপারের দিকে। আমি হাতে নিলাম। এটা তো আমার পরীক্ষার পেপার। যেগুলো মিসিং ছিল, তাহলে এখানে কী করছে। পেপারগুলো মেলতেই দেখলাম ধ্রুব স্যারের সাইন করা। শেষের ফাঁকা পাতায় লেখা,

“যেমন তোমার হাতের লেখা তেমনি বর্ণনা। মাত্র তিন মার্ক দেওয়া সম্ভব নয়। চল্লিশ দিলেও কম। কিন্তু ত্রিশে পরীক্ষা। তাই নিজের কাছে রেখে দিলাম।”

কিংকতব্যবিমূঢ় হলাম। বেশি মার্ক পাওয়ার উপযুক্ত বলে পেপাই মিসিং করে দিলেন তিনি। ব্যাগে জামা কাপড় নেওয়ার সাথে পেপারগুলোও নিয়ে নিলাম। বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে এলাম। গার্ডরা কিছুতেই আসতে দিবে না। ধ্রুব স্যার বারবার বলে গেছেন, আমাকে যাতে যেতে না দেয়। তিনি ভার্সিটিতে গেছেন।

____
মাঝখানে অতিবাহিত হয়েছে দু’দিন। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল পুরোপুরি। ভার্সিটিতে যাইনি। ফোন করলে রিসিভ করিনি। দুদিনে নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছি। পূর্বের ন্যায় দিনগুলো অতিবাহিত করব। ধ্রুব তো আমায় চায়না। তাহলে কেন ধ্রুব স্যারের থেকে ধ্রুবের খবর নিবো। এতে কষ্ট বাড়বে বৈ কমবে না। পড়াশোনায় মনোযোগ স্থাপন করেছি।

আজ ভার্সিটিতে এসেছি। আমার সাথে এসেছে বাবুই। এইচএসসি পরীক্ষার পর সেও এই ভার্সিটিতে ভর্তি হতে চায়। দেখতে এসেছে। একপ্রকার জোর করেই এনেছি। নাহলে দু’দিন ভার্সিটিতে না আসার কারণ, সেদিন কোথায় ছিলাম, ফোন কেন রিসিভ করিনি, হ্যাত ত্যান। তৌফিক বাবুইয়ের সাথে মজার ছল করে বলল,

“মামুনি কোন ক্লাসে পড় তুমি?”

নিরব তৌফিকের কাঁধে মৃদু শব্দে চপল মে’রে বলল, “শা’লা, ওর বোন তোর বন্ধু হলে ও কেমনে তোর মামনি হয়?”

“মামা, ঢং করিস না। তুই আমার মামা, চড়ুই আমার মামনি হয়। মামনির বোন তো মামনিই হবে। তাছাড়া আমি ওরে প্রেক্টিস করাচ্ছি, কিছুদিন পর রাস্তায় বখাটেরা ধরলে যাতে নার্ভাস না-হয়!”

তৌফিক উল্টো পাল্টা যুক্তি উপস্থাপন করল। মুহুর্তেই হাসির রোল পড়ল। বাবুই চরম বিরক্ত হল। মুখ শক্ত করে বলল,
“শুনো, আমি তোমার চেয়ে বেশি ছোট না। বুঝছ? পাঁচ বছরও হবে না। আমাকে একদম মামুনি বললে না।”

“তাহলে কি বাবু বলল?”

“আমি বাবুও না। তুমি চুপ করো। তোমার নাম তৌফিক। কিন্তু তুমি মোটেও তেমন নয়। সারাক্ষণ বকবক করো।”

বলেই বাবুই উঠে গেল। ক্যাম্পাসের দিকে গেল হাঁটা চলা করতে। ফোন আছে বিদেয় হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বাবুই চোখের আড়ালে যেতেই নিরব রাগান্বিত কণ্ঠে বলে, “তুই জীবনেও মানুষ হবি না, শা’লা। জীবনেও না। চিনিস না, জানিস না। মেয়েটার পেছনে লেগে গেলি।”

“তো! কী করব, বসে থাকব? প্রিয়া হবু জামাই পেয়ে আমগো ভুলে গেছে। তুই মারিয়ারে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ধান্দায় আছিস। চড়ুইয়ের অবস্থা ভালো নয়, ধ্রুব স্যারের সাথে তার বেশ ভাব। আমি আর আঁখি খরচার খাতায়। তাই যারে পাই, লাইন মা’রার চেষ্টা করি। তোর বোনকে দিস, তাইলে আর লাইন মা’রব না। শোন তোর গার্লফ্রেন্ড আছে, আমারে শা’লা ডাকবি না, দুলাভাই ডাকবি। নতুবা কেমন জানি লাগে। ট্রিট হিসেবে আগামী বছর, তোরে মামা ডাক শুনামু। রাজি?”

দাঁতে দাঁত চেপে নিরব বলে, “দাঁড়া তোরে বিয়া করাইতেছি।”

তৌফিক সময় অতিবাহিত না করে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ছুটল। তার পিছুপিছু ছুটল নিরব। বিস্ময়ে তাকিয়ে থেকে একত্রে হেসে উঠলাম আমি।
বেল বেজে উঠল। ক্লাসের উদ্দেশ্য পা বাড়ালাম আমি, আঁখি আর প্রিয়া। ‘গুড মর্নিং’ বলে ধ্রুব স্যার প্রবেশ করলেন। তিনি শব্দ করে হাঁটা পছন্দ করেননা। তাই তার উপস্থিতি সহজে অনুমান করা সম্ভব নয়। সর্বপ্রথমে তার দৃষ্টি আমার নিকট নিবদ্ধ হল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার। এই দৃষ্টির মানে কি? কী এমন করেছি, বুঝতে পারলাম না। অতঃপর বাবুইয়ের দিকে তাকিয়ে সোজাসাপ্টা বললেন, “তুমি কে? তোমাকে তো আগে দেখিনি। বয়সও কম। কোন ক্লাস?”

নতকণ্ঠে বলি, “আমার বোন।”

“আমার জানামতে তোমার কোনো বোন নেই।” [সন্দিহান স্বরে]

“মামাত বোন।”

‘হম’ বলে বসতে বললেন তিনি। টেবিলের উপর বসে বললেন,

“আমি সাতদিনের ছুটি নিয়েছে। মার্চের দুই তিন তারিখ থেকে কার্যকর হবে। ফিরতে ফিরতে তোমাদের পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে। তাই তোমরা মন দিয়ে পড়বে। পরীক্ষা শেষেই কিন্তু টুরে যাবো। রেজাল্ট ভালো না হলে যেতে ইচ্ছে করবে না। মনে থাকবে?”

অবিলম্বে চ্যাঁচামেচির সূচনা হল। ধ্রুব স্যারের ভার্সিটিতে আগমনের পর থেকে স্টুডেন্ডদের অনুপস্থিত হার কমে গেছে। পড়াশোনাও করে, কখন কোন প্রশ্ন ধরে, না পারলে প্রেস্টিজ পাংচার। তাই! সবার মাঝখান থেকে মাহি দাঁড়িয়ে বলল,
“প্লীজ স্যার, আপনি যাবেন না।”

ধ্রুব স্যার টেবিলের উপর করতলের সাহায্যে আঘাত করে বললেন, “সাইলেন্ট, আমি যাচ্ছিনা। গ্ৰামে যাচ্ছি কিছুদিনের জন্য। কত বছর পর দেশে ফিরেছে, দাদা দাদি আছে। দেখা করব।
এবার আসা যাক মেন পয়েন্টে, যে কারণে তোমাদের বলা। অনেকেই এখনো আইডি কার্ড সংগ্রহ করনি। আমি প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে রেখে যাবো। তোমরা সংগ্রহ কর।”

আইডি কার্ড মস্তিষ্কে হানা দিতেই দ্রুত আঁখিকে বললাম, “কীসের আইডি কার্ড?”

“ধ্রুব স্যারের কাছে আমাদের আইডি কার্ডের দায়িত্ব ছিল না, এটা!”

স্যার ক্লাসে মনোনিবেশ করলেন। সবাই উৎসাহ নিয়ে ক্লাসে মনোযোগী। মনোযোগী কি আর তার পড়ার জন্য? তাকে দেখতেই ব্যস্ত।
ক্লাস শেষে প্রস্থান করার সময়ে আমার আইডি কার্ডটা হাতে ধরিয়ে দিলেন। মিসেস চড়ুই দেখে চমকে উঠলাম। ফট করে স্যারের মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে কৌতূহলী স্বরে বললাম,
“মিসেস চড়ুই কেন?”

“ভুল থাকলে কেবিনে এসে ঠিক করে নিও। অন্য টিচারের ক্লাস এখন।”
#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১১

“সাধারণ একটা নাম নিয়ে এতটা সমস্যা কেন হবে? বিবাহিত মেয়েরা অবিবাহিত ট্যাগ কেন ইউস্ করবে চড়ুই? আমার জানা মতে তুমি বিবাহিত, তাই অবশ্যই মিসেস চড়ুই হবে।”

চোয়াল দৃঢ় করে নিচের দিকে চেয়ে রইলাম। আমি সত্যিই প্রচুর বিরক্ত, ধ্রুবকে নিয়ে। যার সাথে থাকছি না, তার জন্য কেন মিসেস ব্যবহার করব। টেনে টেনে বললাম,
“দেখুন, আমার ধ্রুব নামের কাউকে নিয়ে ভাবতে চাইনা। যে আমার অতীত তাকে নিয়ে তো নয়ই। আপনি আমার টিচার, টিচারের মতো ব্যবহার করলে সন্তুষ্টি হব।”

ধ্রুব স্যার প্রতুক্তি করলেন না। স্থির তার দৃষ্টি পানির গ্লাসে নিবদ্ধ, সরে না। পাথরেতর ন্যায় স্তব্ধ হয়ে গেল। অতিবাহিত হল প্রহর। ইতস্তত বোধ করলাম। ধ্রুব স্যারের স্তব্ধতা সহ্য হল না। তিনি গ্লাস তুলে নিলেন। একঢোক পান পান করে পূর্বের স্থানে রেখে দিলেন।‌ পরিস্থিতি অন্তরে আওড়ালাম। করুন হলাম, ক্লান্ত লাগল। অস্থিরতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকল। তার অন্তঃকরণে কী চলছে হলনা বোধগম্য। তবে সোজাসাপ্টা বললেন,

“এবার তুমি আসতে পারো। আমার ক্লাস আছে। কাল সকালে জমা দিয়ে যেও, ঠিক করে দিব। আপাতত আমার সময় নেই।”

বিস্মিত হলাম আমি। তোয়াক্কা করলেন দৃষ্টিকে। অগ্ৰসর হলেন ক্লাসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। মাঝপথে থেমে গেলেন প্রিন্সিপাল স্যারের আগমনে। সালাম দিয়ে স্যারকে ভেতরে আসতে বললেন। আমি সৌজন্য হাসির রেখা ফুটিয়ে সালাম দিলাম। স্যার খুশিতে গদগদ হলেন। আমাকে দেখে একটু বেশিই আনন্দিত হলেন। হাস্যোজ্জ্বল সুকণ্ঠে বলেন,

“বাহ্, মেঘ না চাইতেই জল। চড়ুইকেও দরকার ছিল। একসাথে পেয়ে গেলাম।”

ধ্রুব স্যার সন্দিহান হয়ে ফোড়ন দিয়ে বলেন, “কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি, স্যার?

“তেমন কিছু নয়। কাল না, পরশু আমার বাড়িতে তোমাদের দাওয়াত। মেলা মুখ ভার করেছে, তোমরা না গেলে হাসবে না।”

আমি দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়ে সম্মতি দিলাম। ধ্রুব স্যারের ‘ঠিক আছে’ দু শব্দের বাক্য কর্ণপথে যেতেই পথ ধরলাম।
.
হিম পানি মুখশ্রী স্পর্শ করতেই তাপমাত্রা হ্রাস পেল। মুহুর্মুহু পানির ঝাপটা দিতেই ক্লান্তির অবকাশ নিল। ওড়নার নিম্ন প্রান্ত দ্বারা অবশিষ্ট পানিটুকু মুছে চশমা চোখে পড়লাম। কাঁধে ঝুলে থাকা ব্যাগটা স্পর্শ‌ করার পূর্বেই ধাক্কা খেলাম। একটু হেলে চশমাটা খুলে পড়ল নিচে। ঠেকলাম দেয়ালের সাথে। এমনিতেই ঝাপসা এবং ফাটা গ্লাস, আজ আবার পড়ল। চশমা না তুলে মানুষটিকে দেওয়া প্রয়াস করে পিছু ফিরল। একজন তরুণীর পেছন সাইড প্রকট হল। কিছুটা ঝাপসা। তবে অতিশয় পরিচিত ঠেকল। আমি বসে চশমা খোঁজার প্রয়াস করলাম। হাতের সংস্পর্শে আসতেই মৃদু শব্দ শ্রবণ হল। আমি মাথা তুলতেই মাহিকে নজরে এল। মাহি তো আমাদের ক্লাসের স্টুডেন্ট। ধ্রুব স্যারের পেছনে চুইংগামের আঠার ন্যায় পড়ে আছে। যার ফলশ্রুতিতে যখন তখন ধ্রুব স্যারের ঝাঁঝালো কথা শুনতে হচ্ছে। আমার পেছনে পড়ার কারণ বুঝতে ব্যর্থ হলাম। চশমাটা পা দ্বারা পিষে ফেলেছে ততক্ষণে। চিবিয়ে চিবিয়ে বল,
“ধ্রুব স্যারের সাথে তোর এত কী? স্যার তোকে বারবার কেবিনে কেন ডাকে? স্যারের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চল।”

মুখ চিপে হাসলাম শব্দহীন। অগোছালো চুলগুলো পেছনে হেলিয়ে দিয়ে চশমা হাতের মুঠোয় বন্দী করে নিলাম। এতক্ষণে বোধগম্য হল তার অ’শ্লীল আচরণের মানে। ফিচেল হেসে দিয়ে বললাম, “এখন যদি কথাগুলো স্যারকে গিয়ে বলি, তাহলে।”

“স্যার কথা বিশ্বাস করবে, প্রুভ ছাড়া?” একরোখা জবাব দিল মাহি।

“ভাঙা চশমা তো আছে, এটা প্রুভ। নিজের চশমা তো নিজে ভাঙব না। আমি বরং যাই।”

মাহি ছুটে এল। বাঁধা দেওয়ায় প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। সেদিন অর্থাৎ বসন্ত উৎসবের কিছুদিন পূর্বে উপর থেকে ময়লা পানিগুলো যে ও ফেলেছে, তা বুঝতে অসুবিধে হলনা‌। অহেতুক আমি ধ্রুব স্যারকে এইসবের জন্য দায়ি করেছিলাম। আমি ক্লাসের উদ্দেশ্যে অগ্ৰসর হলাম। মামাকে জানিয়ে একটা চশমা আনতে হবে। ধ্রুব স্যার ক্লাসে। কিন্তু এখন তো রাহাত স্যারের ক্লাস। আজ রাহাত স্যার আসেনি, তাই ধ্রুব স্যার ক্লাস নিতে এসেছেন। তার মুখশ্রীতে গম্ভীর ভাব বিরাজমান। একদম প্রথমদিনের ন্যায়। এতটা গম্ভীর তাকে সরাচার দেখা যায়না।

“আসব স্যার?”

দৃষ্টি বিঘ্ন হল, মনোযোগী বিচ্ছিন্ন হল। ধ্রুব স্যার হাতের সিলভার রঙের হাতঘড়ির দিকে একপলক চেয়ে বললেন,
“পঞ্চান্ন সেকেন্ড লেট। যারা সময়ের সম্পর্কে সচেতন নয়, তাদের আমার ক্লাসে চাইনা। ডিস্টার্ব না করে যাও।”

কিয়ৎক্ষণের নিমিত্তে থমকালাম আমি। কয়েক মুহুর্তের ব্যবধানে তার ব্যবহার পরিবর্তন ঠেকল। পঞ্চান্ন সেকেন্ডে কী-বা যায় আসে? আমি তো পাঁচ মিনিটও লেট করেছি, তার বেলায়। আমার ধ্যানের ছেদ ঘটল। ঝংকার তুলে মুঠোফোনটা বাজছে। বাবুই কল করেছে। কেটে দিলাম। পাশে এলাম। বাবুইয়ের কথা ভুলতে বসেছিলাম। বাড়িতে ফিরতে হবে। ওর সামনে ফাইনাল পরীক্ষা, পড়াশোনা বলে একটা ব্যাপার আছে না। এমনিতেই ফাঁকিবাজির শেষ নেই।
_________
ঘড়ির দুরন্ত কাঁটা ছুটে চলেছে ক্রমাগত। রাত এগারোটা ছুঁই ছুঁই। অতিশয় তন্দ্রায় দেহটা নুইয়ে পড়েছে। আয়রন করছি সালোয়ার কামিজে। ধ্রুব স্যারের বাড়ির থেকে যেটা পড়ে এসেছিলাম। কালকেই ফিরত দিব ভেবেছি। বিছানায় টানটান হয়ে শুয়েছে বাবুই। উবুত হয়ে শুয়ে ইংরেজি ‘প্যারাগ্রাফ’ মুখস্থ করছে। আজ বায়না ধরেছে আমার কাছে থাকবে। ওড়নাটা আয়রন করে ভাঁজে রাখতেই বিদ্যুৎ বিভ্রাট হল। আঁধারে আবৃত হল কক্ষ। চিৎকার করে উঠল বাবুই। হুট হাট জিনিসগুলোতে ভয় পেয়ে যায় বাবুই। আমি দ্রুত ফোন খুঁজতে ব্যস্ত হলাম। অবশেষে হাতের নাগালে পেলাম। টর্চ জ্বেলে দিলাম। মৃদু আলোয় অন্ধকার দূর হল। জামা কাপড়গুলো ব্যাগে রাখলাম। ইতোমধ্যে বই খাতা গোছানো শেষ বাবুইয়ের। দিনদিন ফাঁকিবাজি হচ্ছে। রাগান্বিত স্বরে বললাম,
“বই গোছালি কেন? তোর প্যারাগ্ৰাফ মুখস্থ হয়েছে?”

“না!” দাঁত কেলিয়ে!

“তাড়াতাড়ি প্যারাগ্ৰাফ মুখস্থ করে পড়া দিয়ে তবে উঠবি।”

“দেখ আপুই, আমার বিদ্যাসাগর হওয়ার ইচ্ছে নেই। এত পড়লে এরিস্টটলের মত মাথায় সিলিং ফ্যান ভেঙে পড়বে।”

“অ্যাহ্! এরিস্টটলের মাথায় ফ্যান ভেঙে পড়েছিল?”

“না আপেল পড়েছিল। আপেল গাছের নিচে পড়ছিল। আসলে তিনি আপেল চু’রি করতে গিয়েছিলেন। সন্দেহ থেকে বাঁচতে বই মেলে বসেছিলেন।”

“কী বলছিস তুই? নিউটনের মাথায় আপেল পড়েছিল, এরিস্টটলের মাথায় না।”

আমাকে থামিয়ে দিয়ে কর্কট কণ্ঠে বলে, “নিউটনের চৌদ্দ গুষ্টির ভাগ্য, মাথায় তাল পড়েনি। তাহলে বুঝত, কত ধানে কত চাল। আচ্ছা এরা কি ভাত খায়?
এ বেডার জন্য আমারে সূত্র মুখস্থ করতে হয়েছে।
আপেল পড়ল, অমনি বুঝে গেল মহাকর্ষ শক্তি। বলি আপেলটা যদি উপরের দিকে যায় থাকলে খাবে কে? ওর বাপ। আপেলটা নষ্ট হয়ে যাবে না। তাই মাটিতে পড়ে।”

“অ্যাহ!”

“অ্যাহ নয় হ্যাঁ। নতুন সূত্র। বিজ্ঞানী বাবুই।”

বাবুইয়ের যুক্তি শুনে আমার স্তব্ধ ওষ্ঠদ্বয় কিঞ্চিৎ বিচ্ছিন্ন হল। কিয়ৎক্ষণের নিমিত্তে স্তব্ধ হয়ে রইলাম। ওর যুক্তি শুনলে মৃত নিউটন লাঠি ভর করে বাংলাদেশে চলে আসত। এসে বলত, “ঐ আমারে চিনছোস।” তখন পৃথিবীর জনগণ ভুত ভুত করে আকস্মিক মৃত্যুবরণ করত। বাবুইকে সত্যিই জাদুঘরে রাখা উচিত। অন্তত কিছু পয়সা তো উপার্জন হতো।

তৎক্ষণাৎ হাসির শব্দ শ্রাবণ হল। মামা হলদে মোমবাতি সমেত হাজির। বাবুইয়ের যুক্তি উপস্থাপন দেখে নিশ্চয়ই সে হাসছে। মোমবাতি টেবিলের উপর রেখে একশো টাকার নোট এগিয়ে দিল বাবুইয়ের দিকে। বললেন,
“তোর যুক্তি শুনে মন ভালো হয়ে গেল‌। তাই এটা তোর।”

এক লাফে ছুটে এসে টাকা নিল বাবুই। মাঝরাতে বায়না ধরল, আইসক্রিম খাবে। এতরাতে দোকান অবশ্যই খোলা থাকবে না। তাই কালকে রাতে নিয়ে যাবো। বাবুই কক্ষ ত্যাগ করতেই মামা ডাক দিলেন। একটা খাম এগিয়ে দিয়ে বললেন,

“তোর জন্য একটা ছেলে দেখেছি মা। না করিস না। পড়াশোনার অজুহাত দিস না। বিয়েটা তোর পরীক্ষার পরেই হবে।
এখানে ছেলের ছবি আছে। ধ্রুবের জন্য আর অপেক্ষা নাই বা করলি।”

অজানা দহনে প্রজ্বলিত হল বুক। দুমড়েমুচড়ে উঠল ভেতরটা। মামা একবুক আশা নিয়ে এসেছেন। তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার দুর্সাহস নেই। ছবিটা না নিয়েই বললাম,
“দেখার দরকার নেই মামা। তোমার ইচ্ছেই আমার ইচ্ছে।”

“অভিমান করে বলছিস না তো!”

“না, মামা।”

“ঠিক আছে, আগামীকাল দশটা নাগাদ তোর সাথে দেখা করতে চায়। তোর ফোন নাম্বার দিয়েছি রাহাতকে। সরাসরি দেখা করে জানাস আমাকে।”

‘রাহাত’ নামটা বেশ পরিচিত ঠেকল। মিনমিনে গলায় আওড়ালাম, “রা-হা-ত।”

“হম।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]
[চলবে..ইন শা আল্লাহ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here