মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব -০৮+৯

#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৮

ধ্রুব স্যারের ফ্রি টাকা নষ্ট করতে স্টুডেন্টরা উঠে পড়ে লেগেছে। ঘণ্টাখানেক পূর্বে স্যার জানিয়েছেন, আজ তার ক্লাসে ত্রিশ মার্কসের পরীক্ষা হবে। যে যে দশের উপরে অর্জন করবে, তাকে ফ্রিতে টুরে নেওয়া হবে দুইমাস পর। তাই মনযোগ সহকারে পড়ছে সকলে।
ক্লাসে প্রবেশ করে আমিও বই বের করে পড়তে বসলাম। টুরে যাওয়ার শখ নেই, তবে রেজাল্ট খারাপ হোক এটা কখনোই চাইনা। তাছাড়া স্যার যেগুলো মার্ক করে দিয়েছেন, সেগুলো আরও আগেই পড়া শেষ আমার। রিভিশন কম্পিলিট করলেই সমাপ্ত।
পড়ার মাঝপথে ধ্রুব স্যারের কণ্ঠস্বর শ্রবণ হল। তিনি জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বলছেন, “এই চিঠিটা কার?”

মস্তিস্কে ‘চিঠির’ কথা উপস্থিত হতেই দৃষ্টি সরালাম বইয়ের পাতা থেকে। চটজলদি বইয়ের পাতা খুঁজতে লাগলাম। কাল রাতে চিঠিটা এই বইয়ের মাঝেই রেখেছিলাম, কিন্তু নেই। প্রথম বেঞ্চিতে বসার ফলে হাওয়াতে উঠে সামনেই গেছে। অবিলম্বে উঠে দাঁড়িয়ে মিনমিনে স্বরে বললাম, ” আমার চিঠি।”

“তুমি চিঠিও লেখ? বিদেশি স্বামীর জন্য, বুঝি?”

‘বিদেশি স্বামী’ শব্দটায় একটু থমকালাম। অহেতুক বেশিই চমকালাম। তিনি জানলেন কীভাবে। মানছি, আমার দেওয়া প্রতুক্তি সন্দেহজনক ছিল। তাই বলে এতটা। শিক্ষককে প্রশ্ন করা সাজে না। তাই নতজানু হয়ে কাতর কণ্ঠে বললাম,

“স্যার, প্লীজ চিঠিটা দিন। ওটা আমার ব্যক্তিগত সংক্রান্ত। আমি চাইনা, আমার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কেউ অবগত থাকুক। প্লীজ দিন।”

স্যারের চোয়াল দৃঢ় হয়ে এল। দাঁতে দাঁত চেপে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। চিঠিটা চেপে ধরলেন মুঠোয়। অসংখ্য ভাজ পড়ল। একদম বেহাল অবস্থা হয়েছে। আমাকে পুনরায় চিঠি লিখতে হবে। আমি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে হাত মেলে দিলাম। ধ্রুব স্যার চিঠি তো দিলেনই না বরং চিঠিটা মুচড়ে জিন্সের পকেটে রেখে দিলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, “যদি ব্যক্তিগত হত, থাকলে এই চিঠিটা পাবলিকলি আনতে না। যখন এনেছ, তখন ফিরত পাচ্ছ না।”

বলেই সামনের দিকে অগ্ৰসর হলেন। আমি বিস্ময় দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। এটা কেমন কথা, আশ্চর্য। টেবিলের উপরে বই রেখে হোয়াইট বোর্ডে প্রশ্ন লিখতে লাগলেন। আমি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নিচের দিকে চেয়ে রইলাম। চিঠিটা কারো কাছে রাখা যাবেনা, ধ্রুব স্যারের কাছে তো নয়ই। আমি চুপ করে পরীক্ষায় মনোযোগ স্থাপন করলাম। ক্লাস শেষে স্যারের কেবিনে গিয়ে স্যরি বলে নিয়ে আসব।
.
পরীক্ষা ভালোই হয়েছে। সবগুলো প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক দিয়েছি। কিন্তু পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো হয়নি। সেটা আমায় মাথায় ঢুকছে না। মাঝখানের কয়েকটা পেজ মিসিং। ধ্রুব স্যার বলছেন আমি না-কি এইভাবেই জমা দিয়েছি। অথচ প্রিয়া, আঁখি, নিরব ও তারিফ আমারটা দেখে দেখে লিখে সাতাশ পেল। আমি সেখানে ত্রিপল জিরো। ত্রিপল জিরোকে আঁটকে দিয়েছে বড় একটা জিরো দিয়ে। যেন মাঝখানে তিনটা মিষ্টি আর উপরেরটা মিষ্টির প্যাকেট। ক্লাসে বাকি স্টুডেন্টরা বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। হয়ত তাদের মস্তিষ্ক এটাই ধারণ করতে পারছে না, ক্লাস টপার কীভাবে ফেল করল। আমার বিচলিত অবস্থা দেখে ফোড়ন টেনে প্রিয়া বলল,

“আমার মাথায় এটাই ঢুকছে না, তোর বাকি পেজগুলো কোথায় গেল।”

বিদ্রুপ করে প্রতুক্তি দিল তারিফ, “হাউ ফানি। এখনও তোর মাথায় ঢুকছে না। পুলিশ জামাই বুঝি তোকে কালকে কিছু বুঝায়নি।”

“দেখ তারিফ। তৌফিকের সম্পর্কে একদম এভাবে বলবি না।” [একরোখা জবাব দিল প্রিয়া]

এমনিতেই পরীক্ষার খাতা নিয়ে চিন্তায় মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম সাথে যোগ হয়েছে এদের বকবকানি। ধমকে বললাম,
“চুপ কর বাপ আমার। প্লীজ চুপ। বিরক্ত লাগছে আমার।”

আমতা আমতা করে আঁখি বলল, “আমরা স্যারকে বলি আমরাই তোরটা দেখে লিখে সাতাশ পেয়েছি। তোর তাহলে ত্রিশে ত্রিশ পাওয়ার কথা।”

ঝাঁঝালো স্বরে বলি, “যা বল, বারণ করেছে কে? এখন শাস্তি একা আমি পাবো। বললে আমরা সবাই। চুপচাপ বসে থাক।”

বলেই ফুঁপিয়ে উঠলাম। ক্লাস নাইনের পর থেকে পরীক্ষায় ফেল তো দূর থাক, দশ মার্ক কম পাই নি, সেখানে ত্রিপল জিরো। আমার এরুপ অবস্থা থেকে বিচলিত হয়ে পড়ল বন্ধুমহল। আমাকে শান্ত করতে নিরব গম্ভীর গলায় বলল,

“দেখ চড়ুই, এটা ক্লাস পরীক্ষা। আমরা কেউ তোকে ছাড়া টুবে যাবো না। প্রমিজ।
এই শা’লায় ইচ্ছে করে এমন করছে। প্রিয়ার হবু জামাই ধলা উল্লুকটাকে দিয়ে তোর পরীক্ষার পেপার খুজাবো। প্রয়োজনে আবার পরীক্ষার ব্যবস্থা করব, তবুও থাম।”

মুহুর্তেই হেসে উঠলাম আমি। আমার সাথে তাল মিলিয়ে ওরা হেসে উঠল। হাসির শব্দ একটু বেশিই প্রকট। ধ্রুব স্যারের কর্ণধার অব্দি পৌঁছে গেল। স্যার সন্দিহান দৃষ্টিতে অবলোকন করলেন। পরীক্ষায় জিরো দেওয়ার পরেও এত আনন্দ আসে কোথা থেকে। তবে তেমন কিছু বললেন না। সোজাসাপ্টা বললেন,

” সবাই টুরে যাবে তুমি যাবে না, এটা ভালো দেখায় না। আজ থেকে আগামী একমাস তুমি আমার কাছে পড়বে। টুরের আগে তোমার একটা পরীক্ষা নিবো। মার্কস ভালো পেলে তুমিও যেতে পারবে।”

বলেই এগিয়ে এলেন তিনি। একটা ভিজিটিং কার্ড এগিয়ে দিলেন। আমি সৌজন্য হাসি দিয়ে কার্ডটা হাতে নিলাম। ফেল করলে এত সুবিধা, জানলে ক্লাসের সবাই ফেল করত। স্যার তো জনেনা, পড়াশোনায় সবাই ঢেড়স। সবাই তো আমার খাতাই দেখে লিখেছে, তাই তাদেরও একটা হক আছে। আমি যখন স্যারের বাড়িতে যাবো, সবাইকে নিয়ে যাবো। হি! হি! হি!
_____
নীল অন্তরিক্ষ বড্ড বেশি বিভাসিন। চারদিকে ছড়িয়ে আছে অন্ধকার। সূর্য ঢুবে গেছে। চাঁদ উঠতে ঢেড় দেরি। ফুলে গন্ধে মোমো করছে। বসন্তে ফুল ফুটেছে নিশ্চয়ই। আমরা দাঁড়িয়ে আছি ধ্রুব স্যারের বাড়ির সামনে। রাজপ্রাসাদে চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। চারদিকে গার্ডরা আবৃত করে আছে। আমি ক্লাসের সবাইকে নিয়ে হাজির হয়েছি ধ্রুব স্যারের বাড়ির সামনে। গার্ডরা ধ্রুব স্যারের অনুমতি ব্যতিত কাউকে প্রবেশের অনুমতি দিবেন না। স্যারের কন্টাক্ট নাম্বার নেই। আমি এগিয়ে সামনে যেতেই গার্ডরা আমার দিকে গভীর চোখে চাইলেন। নিজেদের ভেতরে কিছু বলাবলি করে পথ ছেড়ে দাঁড়ালেন। আমি সবাইকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। একজন গার্ড আমাদেরকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন। ধ্রুব স্যার বিস্ময় দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন সবাইকে দেখে। আমি চাপা হাসলাম অগোচরে। ধ্রুব স্যার বললেন,

“তোমরা সবাই এখানে কী করছ? আমি তো শুধু চড়ুইকে পড়ানোর কথা বলেছিলাম।”

দাঁত কেলিয়ে বললাম, “আসলে সবাই পড়াশোনায় দূর্বল, তাই সবাইকে নিয়ে এসেছি। ভালো করেছি না।”

ধ্রুব স্যার রক্তচক্ষু করে চেয়ে রইলেন। কিছু বললেন না। সৌজন্য হাসি দিয়ে সামলে নিলেন।

“আসলে মা গ্ৰামে গেছে। আমার চাচাত ভাইয়ের জন্য মেয়ে দেখতে। সপ্তাহখানেক পর বিয়ে। বাড়ি ফাঁকা। আমি সেফদের হাতের তৈরি খাবার খেতে পারি না। নিজেই রান্না করছি।
মা ফিরলে পড়াবো। আপাতত পারছি না।”

সবাই খুশি হলেন। ক্রাশ বলে কথা। তবে চলে যেতে হবে বলে মুখটা দেখার মত ছিল। আমিও যাওয়ার প্রয়াস করতেই হোঁচট খেলাম কিছুর সাথে। ভারসাম্যহীন হয়ে ধপাস করে পড়লাম নিচে। চশমা ছিটকে গেল। খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু পাচ্ছি না। সবাই এগিয়ে আসতে চাইলে ধ্রুব স্যার মিষ্টি কণ্ঠে বললেন,
“তোমরা যাও। স্টার্ফদের দিয়ে খুঁজে দিচ্ছি চশমা। পায়েও হয়ত ব্যথা পেয়েছে, বরফ লাগিয়ে দিচ্ছি।”

সবাই চলে গেল। বিকট শব্দে দরজা বন্ধ করে দিলেন ধ্রুব স্যার। আমি কেঁপে উঠলাম। ঝাপসা চোখে কিছুতেই চশমা খুঁজে পাচ্ছি না। চশমা বের করে দিলেন। আমি অতিদ্রুত চোখে পড়লাম। তবুও ঝাপসা। ফেটে গেছে গ্লাস। উঠে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে অগ্ৰসর হলাম। সবকিছু ঝাপসা। আলোতে গেলে যদি পরিষ্কার দেখতে পারি। ফলস্বরুপ, দেয়ালে বাড়ি খেলাম। মাথা টনটন করে উঠল। ধ্রুব স্যার আমাকে দ্রুত আলোর কাছে নিয়ে গেলেন। পানি ভর্তি গ্লাস এগিয়ে দিলেন। পান করে কিয়ৎক্ষণ নেত্রযুগল গ্ৰথণ করে রইতে বলেন। তার কথ্যমত চোখ বন্ধ করে রইলাম। পরক্ষণেই মাথায় শীতলতা অনুভব করলাম। ধ্রুব স্যার আইস ব্যাগ এনে মাথায় প্রেস করছে। বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পরে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে উঠল।

“কেমন লাগছে?”

“ওকে স্যার!
কিন্তু আমি এখন বাড়িতে যাবো।” [মিনমিনে স্বরে]

বিলম্বে ভয়ংকর রুপ ধারণ করলেন। চোখ মুখ শক্ত করে টেনে টেনে বললেন,
“আমি তোমাকে একা পড়তে আসতে বলেছিলাম কি?”

“আমি আসলে..

“চুপ! একদম চুপ! আমি যেটা আস্ক করছি, সেটা বলবে‌।”

“হ্যাঁ!”

“ওদেরকে কেন নিয়ে এসেছ?এন্সার মি, ইডিয়েট।”
#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৯
“তোমার সাহস তো কম নয় চড়ুই। তুমি ধ্রুবকে ডিভোর্স দিতে চাও। ধ্রুবকে। তুমি চাইলেই এত সহজে মুক্তি মিলবে? অসম্ভব, এটা তোমার দুর্সাহস।”
বলেই টেবিলের উপর ফাঁকা গ্লাসটা মুঠো করে চেপে ধরলাম। বিকট শব্দে ভেঙে গেল। আমি কেঁপে উঠলাম। অতিদ্রুত দু-হাতের সহায়তায় চেপে ধরলাম কর্ণধার। আর্তনাদ করলাম। ধ্রুব স্যারের হাত থেকে রক্তধারা গড়িয়ে পড়ছে। কাঁচের টুকরো এখনও হাতে। টেনে টেনে বললাম, “র-ক্ত। র-ক্ত। প্লীজ হাত সরান।”
তৎক্ষণাৎ হাতটা পেছনে লুকিয়ে ফেললেন। বোধগম্য হল হয়ত, আমার ব্লাড ফোবিয়া রয়েছে। আমি একটু শান্ত হওয়ার প্রচেষ্টা চালালাম। পরক্ষণেই ধ্রুবের কথনগুলো মাথায় নড়েচড়ে উঠল। নিশ্চয়ই আমার লেখা চিঠি তিনি পাঠ করেছেন। নতুবা এতটা জানা সম্ভব নয়। অধর জোড়া স্বল্প ব্যবধানে নাড়িয়ে না বোঝার স্বরে শুধালাম,
“আপনি কেন আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন? কেন আমার অনুমতি ব্যতীত চিঠি পড়েছেন?”
তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া করলেন না। পেছনে দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে ভারসাম্য বজায় রেখে বললেন, “তুমি যার জন্য লিখেছ, সে পড়ছে!”
“মানে..
“মানে তুমি ধ্রুবের জন্য লিখেছ, ধ্রুবই পড়েছে। সেই ধ্রুব আমি নই, কিন্তু ধ্রুব তো। তবে আমি ধ্রুবের কাছে পৌঁছে দিতে পারি।”
“কীভাবে?” [সন্দিহান কণ্ঠস্বর আমার]
“তুমি যেই ধ্রুবের কথা লিখেছ, সে আমার বন্ধু।”
“মিথ্যা বলছেন আপনি? একেই তো আমার অনুমতি ব্যতীত চিঠি পড়েছেন আবার মিথ্যা বলছেন।”
আমাকে থামিয়ে দিয়ে তিনি বলতে শুরু করলেন, “ওয়েট! ওয়েট! তোমার কোনদিক দিয়ে মনে হয়েছে আমি মিথ্যা বলছি।
ধ্রুব জার্মানে গেছে, আমিও জার্মানে ছিলাম। তার মায়ের নাম রমিলা। আমিও তাকে মা বলে ডাকি। আমি ধ্রুবের বেস্টফ্রেন্ট। তাই ছোটবেলায় ঘটে যাওয়া সবকিছু আমাকে বলেছে।”
আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ধ্রুব স্যার ধ্রুবের মায়ের নাম কীভাবে জানলেন। সত্যি ধ্রুব তার বেস্টফ্রেন্ড না-কি তিনিই ধ্রুব, আমার সাথে মজা করছেন। তার উত্তর পেলাম না। আমি গভীর ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলাম। ধ্রুব নেই। আমি কৌতূহল হল নিয়ে সামনের দিকে অগ্ৰসর হলাম। একটা রুমের ভেতর থেকে শব্দ শ্রবণ হতেই সেদিকে গেলাম। ধ্রুব স্যার হাত ব্যান্ডেজ করছেন।
আমাকে দেখে কাবার্ড খুলতে বললেন। ইতস্তত বোধ নিয়ে কাবার্ড খুলতেই একটা প্যাকেট পেলাম। পুরো কাবার্ড ফাঁকা। তিনি আমাকে শাড়িটা পড়তে বললেন এবং আজ বাড়িতে যেতে নিষেধ করলেন। ধ্রুবকে নিয়ে কথা বললেন তিনি। আমিও নিজের ভেতরের অনুভূতি ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়ে সম্মতি দিলাম।
_______
রঙিন আলোয় আলোকিত হয়েছে উৎসব মুখর পরিবেশ। আমি দাঁড়িয়ে আছি ধ্রুব স্যারের পাশে। বাড়ি থেকে কয়েক মুহুর্তের দূরত্ব অবস্থিত উৎসবটি। সাইকেলে এসেছি এখানে। সাথে এনেছে টিফিন ক্যারিয়ার। ধ্রুব স্যার নিজের হাতে রান্না করেছেন। আগেই দু’টো টিকেট সংগ্রহ করেছেন। তাই টিকেট কাউন্টারে লাইন দিতে হলনা। টিকেট দেখিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। তেমন একটা ভিড় নেই। আমাকে নিয়ে ফুলে সজ্জিত রাস্তার উপর দিয়ে হাঁটতে লাগলেন তিনি। আলো নেই। পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চারিদিকে ফুলের সুবাস আসছে। ধ্রুব স্যার আমাকে নিয়ে বসালেন একটা টেবিলে। চারটে মোমবাতি জ্বলছে। তিনি মোমবাতি নিভিয়ে দিলেন। আমার সাথে মিলিয়ে তিনিও কালো রঙের শেরওয়ানি পড়েছেন। পূর্ণিমার আলোয় তার ধবধবে সাদা মুখটা দেখা যাচ্ছে। একদম স্নিগ্ধ। মাতাল করা চাইনি। আমি অস্বস্তি নিয়ে শুধালাম,
“আমরা হঠাৎ এখানে কেন এসেছি?”
“এই উৎসবটা বছরে একবার হয়। আমি দেশে ফেরার পর এই প্রথম। দু’টো টিকিট বুকিং করেছিলাম। মা নেই, একা আসার মজা নেই। তাই তোমাকে নিয়ে এলাম।
বসো, আমি স্টার্ফকে ডাক দিচ্ছি। এসে খাবার সার্ভ করে দিবে।”
ফট করে বললাম, “আমি দেই!”
“তোমাকে পাকনামি করতে বলেছি? না-তো। ধ্রুব শুনলে আমাকে আস্ত রাখবে না।”
বলেই ফোনে টাইপিং করলেন। মিনিটখানেকের মধ্যেই একজন সার্ভেন্ট এলেন। টিফিন ক্যারিয়ার খুলে সার্ভ করতে লাগলেন। তিনটা বাটিতে তিন আইটেম। নুডুলস, হালিম, পায়েস। সাথে লেবুর রস। টক, ঝাল, মিষ্টি একসাথে। টেবিলের মাঝবরাবর কোল্ড ডিঙ্কের বোতল রেখেছেন, সাথে চিকেন ফ্রাই। ধ্রুব স্যারের ফোন এল। তিনি ফোন রিসিভ করতে অন্যপাশে গেলেন। আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে হালিমে লেবুর রস মিশিয়ে মুখে দিলাম। হালিম বরাবরই আমার ফেভারিট। টকের মাঝেও ঝাল লাগছে। নুডুলস মুখে দিতেই ঝালে স্বাদবদল হল। মরিচের অভাব ছিল কি-না বুঝতে পারলাম না। এত ঝাল। আমি দ্রুত মাঝখান থেকে বোতল নিয়ে একঢোক পান করলাম। গুলিয়ে উঠল দেহ। তিঁতকুটে ঢেকুর উঠল। পেটের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠল। ঝালের মাত্রা কয়েকগুন বৃদ্ধি পেল। চোখ ঝাপসা হল। আমি অতিদ্রুত আরও এক ঢোক পান করলাম। পরক্ষণেই বোতল ফাঁকা। কিন্তু বিপরীতমুখী কাজ করছে। বোতল রেখে পায়েসের বাটি তুলে নিলাম। কয়েক চামচ মুখে তুলতেই শান্তি। ঝাল কমে এল। ইতোমধ্যে চোখের কণা পূর্ণ হয়ে এসেছে। মাথা চেপে বসে রইলাম।
তৎক্ষণাৎ ধ্রুব স্যার এলেন। চাঁদের আলোয় ততটা মুখ দেখতে পেলেন না আমার। কৌতূহলী হয়ে বললেন,
“এনিথিং রং? আর ইউ ওকে?”
“ফাইন, কিন্তু একটু পানি।”
ধ্রুব স্যার বোতল থেকে পানি ঢালতে গেলেন গ্লাসে। বোতল ফাঁকা। সন্দিহান হয়ে নাকের কাছে এনে স্মেল নিলেন। গম্ভীর গলায় বললেন,
“এটা এখানে কেন? কে এনেছে? তুমি কি এটা খেয়েছ?”
দাঁত কেলিয়ে বাচ্চাসুলভ কণ্ঠে বললাম, “না। খেতে পারিনি। এইটুকু ছিল। একদম এইটুকু। তুমি আবার অর্ডার দাও না!”
“অ্যাহ! তুমি এভাবে কথা বলছ কেন? আবার আমাকে তুমি করে বলছ।”
মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বললাম, “হ্যাঁ তো! বলবই তো। যা ইচ্ছে তাই বলব। আমি তো প্রজাপতি। উড়তে পারি আকাশে। আপনি আমাকে কিচ্ছু বলতে পারবেন না, আমি তার পূর্বেই উড়ে যাবো। আমার ডানা গজিয়েছে। হি! হি! হি!”
বলেই হাত মেলে দিলাম। শাড়ির দরুন আঁচলটা ডানার চেয়ে কম লাগছে না। হি হি করে হাসছি। ধ্রুব স্যার এগিয়ে আসতে চাইলেই পিছিয়ে গেলাম আমি। লাফ দিয়ে চেয়ারে উঠলাম। হাতলের উপর উঠতেই ধপাস করে চেয়ার সমেত নিচে পড়লাম। আমি ওষ্ঠদ্বয় ঈষৎ ফাক করে পূর্বের অবস্থায় চেয়ারে রইলাম। নড়াচড়া নেই। আমার হাত ধরে উঠানোর প্রয়াস করলেন। আমি উঠলাম না। উল্টো হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে পড়লাম। তৎক্ষণাৎ উপস্থিত হল স্টার্ফরা। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“এনি প্রবলেম স্যার?”
রাগান্বিত স্বরে বললেন, “দেখতে পারছেন না কী প্রবলেম। আমি কি ডিঙ্ক অর্ডার করেছি? তাহলে ডিঙ্ক কেন এনেছেন?”
“স্যার ডিঙ্ক তো অর্ডার করা হয়েছে!”
“কে অর্ডার করেছে ভুতে? আমি কিংবা আমার ওয়াইফ তো করব না। তাহলে কে করবে?”
অবিলম্বে একজন স্টার্ফ এসে টেবিল নং ঠিক করে দিলেন। ক্ষমা চাইলেন ধ্রুব স্যারের কাছে। টেবিল নং নয় এবং টেবিল নং ছয় এলোমেলো হয়ে গেছে। ধ্রুব কিছু বললেন না, পরবর্তীতে দেখে নিবেন। আমি সবকিছু দেখতে লাগলাম। কিছুই মাথায় ঢুকছে না। গান গাইতে ইচ্ছে করছে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিলাম,
“সদরঘাটে যাইও নাআ…
কেন যাবো না, বলো না।
সদরঘাটের মাইয়ারা দেয় লুঙ্গি ধইড়া টান। এক নিমেষে যাইবে মান সম্মান। বুঝছ, এরজন্য যাবে না।”
ওষ্ঠদ্বয় মিলিয়ে গেল একে অপরের সাথে। ধ্রুব স্যার তার বলিষ্ঠ পুরুষালি হাতের সহায়তায় মুখ চেপে ধরেছেন। আমি ছলছল চোখে চেয়ে রইলাম। তিনি অসহায় কণ্ঠে বললেন, “প্লীজ চড়ুই। প্লীজ। কাকের মত কা কা করো না। সবাই পালিয়ে যাবে!”
“আপনি আমাকে কাক বলছেন?”
“না, আমি তো তোমার প্রশংসা করছি।”
“সত্যি বলছেন তো?” [ সন্দিহান গলায়]
“আমি তোমাকে মিথ্যা বলতে পারি? এবার উঠো!”
ধ্রুব স্যার উঠানোর প্রচেষ্টা করতে লাগলেন। কোমরে আঘাত পেয়েছি। আমি ঠোঁট উল্টো বাচ্চাসুলভ আচরণ করে বললাম, “ব্যথা পেয়েছি!”
“আচ্ছা কষ্ট করে উঠো। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।”
“না, আমাকে কোলে নিতে হবে। তাহলে সুস্থ হব। প্লীজ!”
ধ্রুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে স্টার্ফদের দিকে অবলোকন করে আমাকে কোলে তুলে নিল। টেবিলে বসিয়ে হাতে একটা গ্লাস তুলে দিল। আমি মুখ কুঁচকে বললাম, “খাবো না, ওটা খাবো।”
“ওটা পঁচা, গন্ধ। এটা খাও আবার কোলে নিবো।”
“না, ওটাই খাবো।” ন্যাকা কান্নার স্বরে।
ধ্রুব স্যার আমাকে শান্তনা দিয়ে বোতল নিয়ে স্টার্ফদের হাতে দিলেন। ফিসফিসিয়ে কিছু একটা বললেন। আমি কান খাড়া করে শোনার প্রয়াস করলাম। কিন্তু কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। চোখের সাথে কানেরও কি বারোটা বাজল?
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here