#মেঘের আড়ালে চাঁদ ❤
#writer: মহসিনা মুক্তি
#পর্বঃ আট
সকাল থেকে বাতাস বইছে খুব। দিনটি মেঘলা মেঘলা।আকাশে ধূসর মেঘের ছড়াছড়ি। হঠাৎ কিছু সময়ের জন্য সূর্য্যি মামাকে দেখা গেলেও তা আবার কিছুক্ষনের মধ্যেই মেঘের ভেতর ডুবে যাচ্ছে। তুলতুল নিজ মনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিছু ভাবছে। ভালো লাগছে তার এভাবে থাকতে। কিন্তু সে তার ভালো লাগাকে গুরুত্ব না দিয়ে রুমের ভেতর চলে গেলো। অনেকদিন হলো কোথাও বের হয় না ঐ ঘটানার পর। বের হয়না বললে ভুল হবে কেউ বাইরে যেতে দেয় না তাকে। বিরক্ত হয়ে গিয়েছে সে। রুমে গিয়ে ভাবে একটা উপন্যাসের বই পড়বে। বইয়ের ভেতর মন চলে গেলে আর একঘেয়েমি লাগবে না। তুলতুল বইয়ের তাকের কাছে গিয়ে একটা বই সিলেক্ট করে নিতে যায় তখন তার হাতে লেগে কিছু একটা পড়ে যায়। তাকিয়ে দেখে একটা নীল সাদার মিশ্রণ রঙের ডায়েরি। তুলতুল অদ্ভুত ভাবে ডায়েরির দিকে তাকিয়ে থেকে ওটা হাতে নিয়ে খাটের ওপর হেলান দিয়ে বসে।
তুলতুল ডায়েরির উপরে লেখার দিকে তাকায়। কাভারের উপরে বড় করে কালো কালি দিয়ে লেখা -” ভালবাসা” তুলতুল লেখাটির ওপর হাত বুলালো। ডায়েরির খুলে প্রথম পাতায় সুন্দর হাতের লেখায় বড় বড় করে লেখা -” বিনা অনুমতিতে কারো জিনিস ধরা উচিত না। আমি আমার ডায়েরি পড়ার অনুমতি কাউকে দেইনি। তাই না বলে এটা পড়বেন না।” তুলতুল মুচকি হাসলো লেখাটা দেখে। ইউনিক সিকিউরিটি সিস্টেম হা হা হা। কিন্তু আজ সে এই লেখাটা দেখে প্রতি বারের মতো ডায়েরিটা রেখে দেবে না। আজ সে ডায়েরি টা পড়বেই। কি আছে এতে লেখা। প্রতিবারই কৌতুহল বসত ডায়েরিটা হাতে নেয় কিন্তু এই লেখাগুলো দেখে আর পড়ে না। এটা সে কয়েকবছর ধরেই করে আসছে। কারণ কারো ব্যক্তিগত ডায়েরি অনুমতি ছাড়া পড়া উচিত না সে যতো কাছের ব্যক্তিই হোক না কেন। কিন্তু মানুষের নিষিদ্ধ জিনিসের ওপর আকর্ষণ বেশি থাকে। সে ডায়েরির আরেকটা পাতা উল্টালো
“তোমাকে দেখে ছিলাম কোনো এক স্নিগ্ধ সন্ধ্যায়। চারপাশে মৃদু বাতাসের আলোড়ন। তোমার ঐ শান্ত চাহনি দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিলাম। মনের ভেতর ঝড় তুলেছিল সেই চোখের চাহনি। যার জন্য আমার রাতের ঘুম উবে গেল। চোখ বুঝলেই দেখতাম তোমাকে। মানুষের মন সদা পরিবর্তনশীল। ভেবেছিলাম হয়তো ভুলে যাব। কিন্তু না, ভুলিনি। ভেবেছিলাম হয়তো সেটা চোখের মোহ, দৃষ্টির আকর্ষণ। কিন্তু না এমন কিছুই না। তুমি আমার মনের ভেতর গেঁথে গিয়েছিলে। আমার ভাবনাগুলোও তুমিময় হয়ে থাকতো। বার বার গিয়েছি যেখানে তোমাকে দেখছিলাম। কিন্তু সেখানে তোমাকে আর পাইনি। পেয়েছিলাম কলেজের সেই কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বন্ধুদের সাথে বসে থাকা অবস্থায়। প্রায়ই তোমাকে দেখতাম আমি সেখানে। দূর থেকে তাকিয়ে থাকতাম তোমার ঐ স্নিগ্ধ সুন্দর মুখের দিকে। আচ্ছা কখনো কি আমাকে দেখো না তুমি? একটু কি খেয়াল করো না দুটো চোখ তোমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কেউ তোমার আশেপাশে অকারণে ঘুরঘুর করে,তোমাকে একটু দেখার জন্য, তোমার সম্পর্কে জানার জন্য। কিন্তু নাহ দেখো না আমায়। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রতিদিনের মতোই দূর থেকে তাকিয়ে থাকি এই আশায় হয়ত আমায় দেখবে তুমি, আমার অব্যাক্ত কথা গুলো চোখের দৃষ্টি দেখে বুঝবে।”
তুলতুল আর পাতা উল্টালো না ডায়েরির। তার অস্বস্তি লাগছে অন্যের লুকানো অনুভূতি পড়তে। পড়ে পড়া যাবে এই ভেবে ডায়েরি টা রেখে দিল।
.
প্রান্ত আর তুলতুল রাস্তার পাশ ঘেঁষে হাঁটছে। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। চারদিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলছে। তুলতুল হাঁটছে বললে ভুল হবে সে লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে। রাস্তার পাশে কিছু নাম না জানা ফুল ফুটে রয়েছে। তুলতুল কিছু সময় হাত দিয়ে সেগুলো ছিড়ছে, আবার কিছু সময় তাকিয়ে দেখছে। এতে প্রান্ত সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। সে এটা দেখে তাড়াতাড়ি গিয়ে প্রান্তর হাত ধরে ঝুলে পড়ে। প্রান্তও এতে কিছু বলছে না। সে অনেকদিন পর বাইরে বের হতে পেরেছে তাও কেউ একা ছাড়েনি প্রান্তও সাথে এসেছে। হঠাৎ প্রান্ত প্রশ্ন করলো
-” আচ্ছা দিয়ার কি হয়েছে রে?”
-” কেন ওর আবার কি হবে?” তুলতুল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
-” না মানে এই যে তুই সবসময়ই ওদের বাড়ি যাস কিন্তু সেই হিসেবে ও খুবই কম আসে তোদের ওখানে।”
-” ও” বলে তুলতুল খিকখিক করে হাসতো লাগলো।
-” আরে তুই হাসছিস কেন? হাসির কি বললাম?”
-” আরে আমার একটা কথা মনে পড়ে গেল। আমি আর দিয়া একদিন কথা বলছিলাম তো ওই সময় দিয়া আমাকে বলেছিল যে সে তিয়াস ভাইয়া কে ভালোবাসে। ভাইয়াকে ছাড়া সে বাঁচবে না। বিয়ে ভাইয়াকেই করবে। ভাইয়া তার থেকে অনেক বেশি বড় তারপর তাকেই বিয়ে করবে। এ কথা তিয়াস ভাইয়া শুনে ফেলে। আর ওকে থাপ্পড় মেরেছিল সাথে ধমক ও দিয়েছিল। এরপর থেকে দিয়া ভাইয়াকে ভয় পায়। আর আমাদের বাড়ি কম আসে। হা হা হা”
-” ও বুঝেছি” প্রান্ত বিজ্ঞ ভাবে মাথা নাড়লো। সেই সময় প্রান্তর ফোনে কল আসলো। স্ক্রিনে বিরক্ত লেখা তুলতুল এটা দেখে হাসলো। ও বললো-
-” ভাইয়া তুমি যাও আমি চলে যাব এখান থেকে বাড়ি। বেশি দূর তো না। তুমি গার্লফ্রেন্ড এর সাথে দেখা করে এসো।” দাঁত কেলিয়ে বললো তুলতুল।
-” না তোকে একা ছাড়া যাবে না দেখা যাবে বাড়ি না গিয়ে উল্টো পথ ধরেছিস। আর কিসের গার্লফ্রেন্ড? বড় ভাইয়ের সাথে ফাজলামো করিস।”
-” আরে না ফাজলামি না। তুমি যাও দেখো আমি বাড়ি চলে যাব। আর আমার কাছে ফোন আছে। ব্যাগে মরিচের গুঁড়ো, ফল কাটা ছুড়ি আছে। চিন্তা করো না যাও।” প্রান্ত কিছু বলবে তার আগেই তুলতুল ঠেলতে লাগলো- যাও যাও আমি বাচ্চা না।
-” আচ্ছা যাচ্ছি তুই সাবধানে যাবি ঠিকাছে? ” তুলতুল মাথা নাড়লো।
.
তুলতুল হেঁটে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। তার ভালো লাগছে একা একা হাঁটতে। আকাশে কাস্তের মতো চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় সবকিছু হালকা হালকা দেখা যাচ্ছে। তুলতুল হঠাৎ থেমে গেল। সামনে বড় গাছের নিচে কেউ আছে, কিছুটা নড়ছে। ওটা কি ভূত নাকি। তুলতুলের ভূতে ভয় আছে। ভূতের কথা শুনলে সে আর স্বাভাবিক থাকে পারে না। তারপরও স্বাভাবিক থেকে দ্রুত চলে যেতে চাইলো।
কিন্তু কানে হঠাৎ অস্ফুট শব্দ এলো। সে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখে এটা মানুষ কোনো ভূত না। সে এগিয়ে গেল ওদিকে মনে সাহস সঞ্চয় করে।তুলতুল আগাচ্ছে আর মানুষটার মুখ একটু একটু স্পষ্ট হচ্ছে। সে কাছে গিয়ে দেখলো রাফসান গাছের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। হাতে ড্রিংকস এর বোতল। পা কেটে রক্ত পড়ছে। জিন্স সহ কেটে গেছে তাই তুলতুল ক্ষত স্পষ্ট দেখতে পারছে। নাহ সে আর এখানে থাকবে না এ লোক মাতাল হয়ে আছে স্বাভাবিক থাকলেই মারতে চায় আর এখন তো হুঁশ নেই। সে দ্রুত পিছনে ফিরে চলে যেতে গেলে রাফসান তার হাত ধরে ফেলে হ্যাঁচকা টানে তার পাশে বসিয়ে দেয়।
ঘটনার আকস্মিকতায় তুলতুল হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। কি হয়েছে এটা বুঝতে পেরে তুলতুল চিৎকার দিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে কিন্তু পারে না রাফসানের সাথে। রাফসান চোখ খুলে তুলতুলের সামনে ঝুঁকে বলে-
-” বেঁচে আছ তাহলে দেখছি। আমি তো ভাবলাম মরে ভূত হয়ে গিয়েছো।”
-” কি খারাপ লোক আপনি একে তো গুলি মারলেন অকারণে, তারপর ওখানেই ফেলে রেখে গিয়েছেন,আর এখন বলছেন মরে ভূত হয়ে গিয়েছি।” তুলতুল হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বললো।
-” চেষ্টা করে লাভ নেই ছাড়াতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি ছাড়ছি। আর আমি অনেক খারাপ সেটা তো ওইদিন নিজের চোখে দেখেছো তাহলে কেন আসো আমার সামনে? সেদিন না বললে আর কখনো সামনে আসবে না তাহলে আজ এসেছ কেন? তোমাকে দেখলে বিরক্ত লাগে আমার বুঝেছো, অকারণে রাগ হয়, মাথা ভার হয়ে আসে। ইউর ফেস বদার মি সো মাচ।” রাফসানের কথা জড়িয়ে আসছে। সে বুঝতে পারছে তার নেশা হয়ে গেছে।
-” আমি ইচ্ছে করে আপনার সামনে আসি না। আমার চেহারা অতটাও খারাপ না যে কারো বিরক্তি লাগবে। আর সেদিন বলেছিলাম আমাকে ছেড়ে দিলে আপনার সামনে আসবো না। কিন্তু আপনি কি আমাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন? দেন নি। আর আজকেও জানতাম না এটা আপনি। হুহ
-” তাই নাকি আমি না হয়ে অন্য কেউ হলে ভালো হতো মনে হয়। রাত বিরাতে মেয়ে মানুষ একা বের হয়েছ কেন? ভয় নেই। এখন যদি আমি কিছু করে ফেলি তাহলে? রাফসান ধমক দিয়ে বললো।
-” কি করবেন? আর ছাড়ুন আমাকে।” তুলতুল ভয়ে ভয়ে বললো। তারপর কিছু একটা ভেবে চট করে রাফসানের দিকে তাকিয়ে বললো-
-” আপনি কি আমার কেয়ার করছেন? ব্যাপার কি বলুন তো? তুলতুল দাঁত কেলিয়ে করে বললো।
-” চুপ আজ একটু ভালোভাবে কথা বলেছি দেখে মাথায় উঠে গেছে।” রাফসান ধমকে উঠলো। তার রাগ উঠে যাচ্ছে এই মেয়েটার কথায়।
-” দে.. দেখুন..
হঠাৎ করে রাফসান হাতের বোতলটা ফেলে রিভলবার বের করে তুলতুলের মাথার লাগিয়ে ওর দিকে ঝুকে বললো-” চুপচাপ এখানে বসে থাক কথা বলবি না, আর নাহলে এটার গুলি মাথার এপাশ ভেদ করে ওপাশে চলে যাবে।”
চলবে…