মেঘের আড়ালে চাঁদ শেষ পর্ব

#মেঘের আড়ালে চাঁদ❤
#writer: মহসিনা মুক্তি
#পর্বঃ ছেচল্লিশ

তফিজ আহমেদ বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন নিজের নতুন জুতা আনতে। জামাই মানুষ এভাবে খালি পায়ে বের হবে নাকি তাই। লজ্জা লাগলো তার এ ঘটনায়। তাওহী ভেতরে গিয়ে মায়ের আঁচল ধরে কান্না করতে লাগলো। তার বাইরে ঘুরা হলো না। আর রাফসান আহাম্মকের মতো কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ভাবলো দাঁড়িয়ে থেকে কি করবে এরথেকে বাগানে গিয়ে তুলতুলকে দেখে আসুক। এজন্য খালি পায়েই বের হলো।

তুলতুল বাগানে এসে ফুলগাছ গুলোয় হাত বুলিয়ে দেখছিল। এ গাছ ছেড়ে ও গাছের ফুল দেখছে। তার আবার লাফিয়ে লাফিয়ে চলার অভ্যাস আছে। লাফিয়ে চলতে গিয়ে ভুলবশত সামনের পায়ের জুতা পেছনের পা দিয়ে চেপে ধরায় একটা উষ্ঠা খেয়ে উপুড় হয়ে পড়ে গেছে। রাফসানের জুতা পড়ার শখ তার মিটে গেছে। উঠে জামাকাপড় ঝাড়া দিয়ে মাটি পরিষ্কার করে। হাতের তালু ছিলে গেছে। হাতের দিকে তাকিয়ে তার কান্না করতে মন চাচ্ছে। রাফসান হাঁটতে হাঁটতে বাগানে এলো। এসে দেখে তুলতুল নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। কি হয়েছে দেখার জন্য এগোতেই তার তুলতুলের পায়ের দিকে নজর যায়। সে বিস্মিত হয়ে পায়ের দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। চোর নয় তার বউ জুতা নিয়েছে। নাম হয়েছে চোরের। অবশ্য সে চুন্নি বলতে পারে। তার মনটা তো আগেই চুরি করেছে এখন জুতাটাও দখল করেছে। রাফসান তুলতুলের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো

-” ওই তুমি জুতা নিয়ে এসেছো আর ওদিকে সবাই খুঁজে শেষ হচ্ছে। নিজের জুতা থাকতে আমার জুতা পায় দিয়ে কি করো? দাও, জুতা দাও! আমি খালি পায়ে আছি।” তুলতুল রাফসানের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বলে

-” দেব না।”

-” ভেবে বলছো তো? দেবে না তো? আমি নিতে গেলে কিন্তু খবর আছে।” তুলতুলে মাথা ডানে বামে নাড়ালো। মানে সে দিবে না। রাফসান শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে তুলতুলকে ধরতে যায়। তুলতুল তা দেখে দৌড় দেয়। রাফসানও দ্রুত এগোয় তার পিছু। তুলতুল কিছুদূর দৌড় দিয়ে জুতার সাথে জুতা লেগে উষ্ঠা খেয়ে আবার হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। সে এবার উঠে না আর। ওভাবেই পড়ে থাকে। লজ্জায় কান্না আসছে তার। কেন দৌড়াতে গেলো। তুলতুললের পড়ে যাওয়া দেখে রাফসান দ্রুত এগিয়ে এসে তুলতুলকে ধরে উঠায়। তারপর দেখতে লাগে কোথাও ব্যাথা পেল নাকি। মাটি লেগে আছে হাতে সেটা পরিষ্কার করে দেয়।

-” এভাবে কেউ দৌড় দেয় নাকি পাগল! জুতাতে বেঁধে পড়ে গেছো। শুধু শুধু ব্যাথা পেলে।” তুলতুল ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। ব্যাথার থেকে বেশি সে লজ্জা পেয়েছে। রাফসানের সামনে সে উপুড় হয়ে পড়ে গেছে। কি লজ্জার কথা! আর রাফসান তুলতুলের কান্না করা দেখা ভ্যাবাচ্যাকা খায়। পরমূহুর্তে ভাবে হয়তো বেশি ব্যাথা পেয়েছে।

-” থাক কান্না করে না তুলুমনি। ব্যাথা করছে অনেক?” রাফসান তুলতুলকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কিন্তু তুলতুল কিছু বললো না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল রাফসানের বুকের সাথে মাথা ঠেকিয়ে।

ওপরের বেলকনি থেকে দিয়া আর তিয়াস তাকিয়ে দেখছিল দুজনকে। দিয়া তিয়াসের দিকে তাকিয়ে বললো

-” এখনো রাগ করে থাকবেন?” তিয়াস দিয়ার দিকে তাকালো। দিয়া এগিয়ে এসে তিয়াসের গালে হাত দিয়ে বলে

-” এখনো সন্দেহ আছে রাফসান তুলতুলকে ভালোবাসে কিনা তা নিয়ে? দেখছেন তো সে সবসময় কিভাবে তুলতুলকে আগলে রাখে। এই এখনকার কথাই বলি, তুলতুল কিন্তু ব্যাথায় কান্না করে নি, লজ্জায় কান্না করেছে সেটা আমি জানি। কিন্তু রাফসান সেসব বাদ দিয়ে সে দেখছে তুলতুল ব্যাথা পেয়েছে কিনা! যদি ভালো না বাসতো এমন করতো? ভালো না বাসলে তুলতুল পড়ে গেছে এটা নিয়ে মজা করতো, তাকে আরো লজ্জা দিত। কিন্তু এমন কিছুই করেনি উল্টো আগলে রেখেছে। আপনিই তো বলেন মাঝে মাঝে কে যেন বলেছিল প্রিয়তমার আঘাতে, কষ্টে তোমার যদি কষ্ট না লাগে বুকের ভেতর ক্ষতবিক্ষত না হয় তাহলে সেটা কিসের ভালোবাসা! তো আপনার কথা মতো রাফসান কিন্তু ঠিক আছে। সে ভালোবাসে আমাদের তুলুকে। আর আগলেও রাখবে।” এরপর একটু আকুতি ভরা কন্ঠে বলে দিয়া

-” মেনে নিন না ওদের। স্বাভাবিক ভাবে ওদের সাথে মিশুন। কেন এমন করছেন? সবসময়ই তো আর অতীত ফিরে আসে না। আর রাফসানও আরো সচেতন হয়ে তুলুকে আগলে রাখে। তুলুর সাথে আপনি কথা বলেন না, এতে ও কষ্ট পায়, কান্না করে। আপনি নিজেও কষ্ট পাচ্ছেন। এবার অন্তত আর এমন করবেন না। আগের বার কেউ জানতো না এবার তো সবাই জানে, তো তুলতুলকে আপনিও প্রটেক্ট করতে পারবেন। প্লিজ যা হয়েছে তা মেনে নিন। তুলু তো খুশি আছে। ওর খুশির জন্যই না হয় সবকিছু মেনে নিন।” দিয়ার কথায় তিয়াস আর কিছু বললো না। চোখ ফিরিয়ে নিচে দাঁড়িয়ে থাকে দুজনের দিকে তাকায়। আর দিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ভাবে তিয়াস হয়তো তার কথা মানবে না।
রাফসান যাওয়ার আগে তুলতুলের হাতে অ্যান্টিসেপটিক দিয়ে পরিষ্কার করে দেয়। কোন কিছু ধরতে মানা করে। হাত ছিলে গিয়েছে জায়গায় জায়গায়। তার কাজ আছে দেখে বেশিক্ষন থাকতে পারলো না আবির ফোন দিয়েছিল, যেতে হবে তাকে। যাওয়ার আগে তাওহীর মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে বুঝায়। তাকে ঘুরতে নিয়ে যেতে পারেনি দেখে সরি বলে। কথা দেয় পরবর্তীতে নিয়ে যাবে। রাফসানের ব্যবহার দেখে আজ তফিজ আহমেদ আর আফসা বেগম সন্তুষ্ট হয়েছেন। কিছুটা চিন্তামুক্ত হয়েছে তারা।

.

পেরিয়ে গেছে সাতদিন। উন্নতি হয়েছে কিছু সম্পর্কের, মজবুত হয়েছে ভেতরকার বোঝাপড়ার সম্পর্ক। সবকিছুই স্বাভাবিক ভাবে চলছে। প্রতিদিন তুলতুলের সাথে কথা বলা, দু একদিন বেলকনি দিয়ে তার সাথে দেখা করা। ভালো লাগা, মন্দ লাগা সবকিছু দুজন দুজনকে শেয়ার করা সবমিলিয়ে ভালোই রয়েছে তারা। রাফসান ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে সবকিছু ভাবছিল। অফিসে বসেও তুলতুলের মুখ তার চোখের সামনে ভাসছে। বড্ড ডিস্টার্ব করছে মেয়েটা, কাজের সময়ও শান্তি দেয় না। এতটা তার প্রতি আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। বলে তো দিয়েছে তার শশুর কে যে তুলতুলের অনার্স শেষ হলে উঠিয়ে নেবে। কিন্তু আদৌও কি সে এই কথা রাখতে পারবে? সময়ে অসময়ে মনে হয় তুলতুলকে সামনে বসিয়ে তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকুক। কিন্তু তা তো সম্ভব না। রাফসান নিজের ভাবনা দেখে মুচকি হাসলো। নিজেই নিজের মাথার চুল আউলিয়ে আবার ঠিক করে কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করলো।

এমন সময় এলা নক না করে ভেতরে এলো। তাকে দেখাচ্ছে বিধস্ত। সে এসে সরাসরি কোন ভণিতা না করে রাফসান কে বললো অস্থির হয়ে

-” বেবি আমি ড্যাডিকে খুঁজে পাচ্ছি না। কাল বাড়ি থেকে বের হয়েছেন আর ফিরে আসেনি। তুমি দেখো না ড্যাডি কোথায় আছে। আমি লোক লাগিয়েছি তবুও ড্যাডির কোন খোঁজ পাচ্ছি না।” বলে এলা কান্না করতে লাগলো। রাফসান মুচকি হাসলো। এলার ড্যাড তিনদিন আগে দেশে ফিরেছে। এলার সাথে বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছে। রাফসান এলাকে বললো

-” তুমি আরো আগে আমাকে বলবে তো। আমি আঙ্কেলের খোঁজ দিতে পারতাম। তোমাকে এতো টেনশন করতে হতো না বেবি। আমি মনে হয় আঙ্কেলের খোঁজ জানি।” এলা অস্থির হয়ে বললো

-” আমাকে নিয়ে চলো। আমি ড্যাডকে দেখবো।” এলার কথায় রাফসান মুচকি হাসলো। তারপর এলাকে নিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠলো। এলা রাফসানকে এ প্রশ্নটা করলো না যে রাফসান কিভাবে জানে তার ড্যাডের খোঁজ। অস্থিরতার কারনে সব ভুলে গিয়েছে। রাফসান একটা গোডাউনের সামনে গাড়ি থামায়। এলাকে গাড়ি থেকে নামতে বলে। এলা গাড়ি থেকে নেমে জিজ্ঞেস করে

-” এখানে এলে কেন? ড্যাড কোথায়?”

-” ভেতরে চলো” বলে রাফসান গোডাউনের ভেতর ঢুকলো।এলাও রাফসানের পিছনে গেলো। ভেতরে ঢুকে কেমন একটা গন্ধ পেলো নাকে এলা। মানুষের রক্তের গন্ধ। সে রাফসানকে বলে

-” কোথায় নিয়ে আসলে? আর এতো বিশ্রী গন্ধ কেন?” রাফসান উত্তর দিল না। সে ভেতরে ঢুকে গোডাউনের দরজা লক করে দিয়েছে। এলা তা দেখে ভ্রু কুঁচকে বললো

-” গেট লক করছো কেন? ড্যাড কোথায়?” রাফসান একটা হাসি দিয়ে বললো

-” এখানেই ”

-” কোথায় আমি তো দেখতে পারছি না!”

-” ঐ দেখো” বলে রাফসান হাত দিয়ে একটা জায়গা,দেখালো। এলা তাকিয়ে দেখে একটা চেয়ার রয়েছে, তারওপর দড়ি পড়ে আছে। চেয়ারের নিচে হালকা শুকিয়ে যাওয়া রক্ত অনেকটা জায়গা জুড়ে মাখামাখি হয়ে আছে। এলা তা দেখে রাফসানের দিকে তাকিয়ে বললো

-” কি বলছো তুমি? এনি হাউ তুমি কি আমার সাথে মজা করছো?” রাফসান মুচকি হেসে সেই জায়গা টায় গিয়ে বলে

-” একদম না আমি কি তোমার সাথে মজা করতে পারি?” বলে এলার দিকে তাকালো। এলার চেহারায় ইতিমধ্যে ভয় দেখা যাচ্ছে। রাফসান গম্ভীর হয়ে বললো

-” এই যে রক্ত দেখছো না? এগুলো তোমার ড্যাডের রক্ত। আর এই চেয়ার দেখছো এটাতে তোমার ড্যাডকে বসিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল।” এলা চিৎকার করে বললো

-” কি বলছো তুমি এসব? ড্যাড এখানে আসবে কিভাবে? আর ড্যাডের রক্ত কিভাবে হতে পারে? আমি বিশ্বাস করি না।”

-” তুমি বিশ্বাস করো আর না করো এটাই সত্যি। আমি নিজের চোখে দেখছি। কিন্তু তাকে বাঁচাতে পারিনি। তোমার ড্যাডকে প্রথমে এই চেয়ারে বেঁধে রেখে প্রচুর পেটানো হয়। তার হাতের নখগুলো উপড়ে ফেলা হয়। তারপর তার দুইচোখে গুলি করা হয়। তখনই সে আধমরা হয়ে গিয়েছে। তারপর আবার তার জিভ কেটে দেওয়া হয় শেষমেষ বুকে গুলি করা হয়। তারজন্যই এই রক্তের স্রোত বয়ে গেছে চেয়ারের নিচে। খুব অত্যাচার করেছে তোমার ড্যাডের ওপর। আমি বাঁচাতে পারিনি। অবশ্য চাইও নি।” এলা চিৎকার করে বলে

-” কি বলতে চাও তুমি? আমার ড্যাডকে বাঁচাতে চাওনি কেন? আর কে মেরেছে আমার ড্যাডকে? কার কথায় এ কাজ করেছে?” রাফসান শয়তানি হেসে বলে

-” কেন আমি আছি না? আমাকে দেখছো না বেবি?” এলা রাগে থরথর করে কাঁপছে। রাফসান করেছে এ কথা শুনে এলা আর কিছু না ভেবে নিজের কাছে লুকিয়ে রাখা রিভলবার বের করে রাফসানকে শুট করতে যায়। কিন্তু তার আগেই রাফসান তার হাতে শুট করে। এতে এলার হাত থেকে রিভলবার পার যায়। সে আরেকহাত দিয়ে সেই হাত চেপে ধরে রক্ত পড়ছে তার হাত দিয়ে। রাফসান গিয়ে পড়ে থাকা রিভলবার নিয়ে তা থেকে বুলেট বের করে ফেলে দেয় দূরে।

-” রাফসান এতো কাঁচা কাজ করে না। মাথায় রাখা উচিৎ!” এলা দাঁতে দাঁত চেপে বলে

-” কেন এমন করলে? কি করেছে আমার ড্যাড? আর কি করেছি আমি? তোমাকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম!” রাফসান যেনো এবার হিংস্র হয়ে উঠলো। চোখে মুখে ক্রোধ ফুটে উঠেছে। সে গিয়ে এলার গলা চেপে ধরে বলে

-” কি করেছিস তোর ড্যাড আর তুই তাই না? জানিস না বোধহয় কি করেছিস? বলতে হবে আমাকে? তাহলে শোন! তুই আর তোর ড্যাড খুনি। আমার মা বাবার আর তিয়াসার খুনি তোরা। আমার জানোয়ার চাচার সাথে যুক্ত হয়ে আমার মা বাবাকে মেরেছে তোর ড্যাড। আর তুই আর তোর ড্যাড মিলে তিয়াসাকে মেরেছিস। সাথে আরো কিছু পশু ছিল। এতকিছুর পরেও কিভাবে ভাবতে পারিস রাফসান তোকে বিয়ে করবে? ফাঁদ ছিল বুঝেছিস? তোর বাপকে দেশে আনার ফাঁদ! ভয়তে তো লুকিয়ে ছিল অন্য দেশে ঘাপটি মেরে। সন্দেহ ছিল আমার তোর ড্যাডের ওপর কিন্তু তোর কথা শুনে তা আমার পুরাপুরি দূর হয়ে গিয়েছে। তাই তোর ড্যাড দেশে আসার পর তাকে উঠিয়ে এনে শাস্তি দিয়েছি। কেমন লাগছে এখন? তুই শুধু তোর ড্যাডকে হারিয়েছিস আর আমি? সবকিছু হারিয়েছি! বুঝতে পারছিস একটুও এখন আমার কষ্ট? মনে হয় পারছিস না। তোর চোখে একফোঁটা পানিও নেই। শুধু ক্রোধ আছে আর কিছু না। তোর কারো প্রতি ভালোবাসাই নেই। বল এবার কেন এসব করেছিলি? কেন তিয়াসাকে মারতে আমার শত্রুর সাথে হাত মিলিয়ে লোক পাঠিয়েছিলি? বল!” রাফসান হুংকার দিয়ে বলে উঠে। সে এলার গলা ছেড়ে দেয়। এলা নিচে বসে কাশতে থাকে। তার চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। আরেকটু হলে সে মরেই যেতো। রাফসান জোরে তার গলা চেপে ধরেছিল। এলা একটু স্বাভাবিক হয়ে রাফসানকে উল্টা প্রশ্ন করে

-” তুমি জানলে কিভাবে?” রাফসান ক্রুর ভাবে হাসে এতে। সেদিন রাফসান তার রুমে যাওয়ার আগে এলার কন্ঠ শুনে থেমে যায়। অস্পষ্ট কিছু শুনে কৌতুহলবশত দাঁড়িয়ে যায়। সে শুনতে পায় এলা কাউকে বলছে

-” ড্যাড তুমি আমাকে শান্ত হতে বলছো? কিকরে শান্ত হবো? ঐ মেয়েটা রাফসানকে দখল করে নিচ্ছে। আমি এবারো রাফসানকে পাবো না। আগে ওর বোন বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে আর এখন ও। ওর বোনকে তো আমি সরিয়ে দিয়েছি এবার ওকেও সরিয়ে দেবো। রাফসান শুধু আমার হবে ড্যাড। তুমি শুনতে পারছো আমি কি বলছি? শুধু আমার হবে। এরজন্য যা করার করো কিন্তু আমার রাফসানকে চাই।” এলা জেদ ধরে বলে। তারপর ওপাশ থেকে কিছু বললে এলা বলে

-” ড্যাড আমি তোমার আসা পযন্ত ওয়েট করতে পারবো না। তুমি কবে আসবে বলতো? রাফসানের মা আর বাবাকে মেরে যে ভয়ে চলে গেছো আর আসো নি! কবে আসবে? আমি রাফসানকে আর কারো হতে দেবো না। তুমি আসার আগেই ঐ মেয়েটা রাফসানকে আমার থেকে ছিনিয়ে নেবে। ঠিকাছে তুমি যেহেতু বলছো আমি আরো ভালো করে চেষ্টা করবো যাতে রাফসান আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়।” এতটুকু পযন্ত শুনেই রাফাসানের রাগ উঠে যায়। সে সেদিন অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে ছিল। আর সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছিল। তাই এতদিন ধরে এলার সাথে নাটক করতে হয়েছে। রাফসান একটু সরে দাঁড়িয়ে এলাকে বলে

-” আমি কিভাবে জানলাম সেটা তোর না জানলেও চলবে। যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দে ফাস্ট।” এলা আর কোন উপায় না পেয়ে বলে

-” রাগ হতো আমার তোমার প্রতি। তোমাকে আমার ভালো লাগতো। কখনো ভালোবাসিনি তোমায়। জাস্ট ভালোলাগা ছিল। সেই হিসাবেই তোমার সাথে মিশতে চাইতাম। কিন্তু তুমি সবসময় আমাকে ইগনোর করতে। রাগ হতো আমার, যেখানে সব ছেলেরা আমার জন্য পাগল ছিল সেখানে তুমি আমাকে পাত্তা দিতে না। এর ভেতরই জানতে পারি তুমি আমার দূর সম্পর্কের কাজিন হও। আমার জেদ ওঠে কেন তুমি আমায় পাত্তা দাও না। আবার তিয়াসার সাথে সম্পর্ক হয়ে যায় তোমার। তখন আমার ইগোতে লাগে আমাকে পাত্তা না দিয়ে ঐ মেয়ের সাথে সম্পর্ক করায়। জেদ করি যে তোমাকে আমার চাই এট এনি কস্ট। তাই ড্যাড আর তোমার শত্রুর সাথে প্লান করে তিয়াসাকে সরিয়ে দেই। এবার ওর বোনকেও দেবো।” একথায় রাফসান এলাকে প্রচন্ড জোরে থাপ্পড় মারে। এলার ঠোঁট কেটে রক্ত বের হয়। রাফসানের রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে তার তুলতুলকে মারার কথা বলছে! একবার ভালোবাসা হারিয়ে সে এখনো বেঁচে আছে এবার যদি হারিয়ে ফেলে তো সে আর বাঁচবে না। বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন এখন ওই মেয়েটা। আর তাকেই সরিয়ে দিতে চাইছে।

-” সে সুযোগ আর আমি তোকে দেবো না। আপাতত তুই এখানেই থাক। তোর ব্যবস্থা আমি পরে করছি।” একথায় এলা রাফসানকে ধাক্কা মেরে গোডাউনের দরজা খুলে চলে যেতে চায় কিন্তু পারে না। রাফসান টেনে ধরে তাকে ভেতরের দিকে ধাক্কা মারে। এতে এলা পড়ে যায়।

-” এখানেই থাকবি তুই। তোর শাস্তি এখনো বাকি।” বলে রাফসান পেছনে ফিরে ফোন বের করে টিপতে টিপতে বের হতে লাগে, আর তখনই পরপর গুলির শব্দে থেমে যায়। রাফসান পেছনে ফিরে দেখে এলা রক্তাক্ত ভাবে পড়ে রয়েছে। তার হাতে রিভলবার। রাফসান সামনে তাকায়, দেখে আবির রিভলবার তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। রাফসান পেছনে ফিরে যাওয়ার সময় এলা তার নিজের কাছে রাখা এক্সট্রা রিভলবার বের করে তাকে শুট করতে যায়। কিন্তু আবির এসে তা দেখে ফেলায় এলা শুট করার আগেই সে শুট করে। অনবরত গুলি ছুড়ে সে। রাফসান এগিয়ে গিয়ে এলার নাকের সামনে হাত দিয়ে দেখে নিঃশ্বাস নিচ্ছে কিনা! কিন্তু না নিচ্ছে না। রাফসান দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সে এলাকে শাস্তি দিতে চেয়েছে ঠিকই কিন্তু মারতে চায় নি। কিন্তু কর্মফল বলে একটা কথা আছে সেটা এলাকে ছাড়ে নি। সে গোডাউন থেকে বের হয়ে যায়।

.

তুলতুল কলেজে এসেছে। আজ বিদায় অনুষ্ঠান হবে কলেজে। পরীক্ষা এসে পড়েছে। আজকের পর আর ক্লাস হবে না। কলেজ জীবনের ক্লাস এখানেই শেষ। দিয়াও এসেছে। তারা দুজনে শাড়ি পড়েছে। তুলতুল পড়েছে লাল শাড়ি ওপরে সোনালি রঙের কাজ,আর দিয়া পড়েছে বেগুনির ওপর সোনালি রঙের কাজ করা শাড়ি। দুজনকেই সুন্দর লাগছে। আজকে আর আনিস স্যার তাদেরকে কাজ করায়নি। কারন রাফসানও এখানে উপস্থিত আছে। যথারীতি অনুষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হয়। প্রবেশপত্র,রুটিন সব শিক্ষার্থীদের দেয়াহয়। তারপর প্রিন্সিপাল কিছু বক্তব্য দেন। তারপর প্রধান অথিতি আর কলেজের ট্রাস্টি রাফসান চৌধুরীকে কিছু বলার অনুরোধ করেন। রাফসান মাইক হাতে নিয়ে তুলতুলের দিকে তাকায় একবার, তারপর মুচকি হেসে ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন। বক্তব্য শেষ হলে রাফসান কিছুক্ষণ থেকে সেখান থেকে চলে যায়। তুলতুলের কেন জানি খুশি খুশি লাগছে। তারপরে আজকে অনেকদিন পর তিয়াস ভাইয়া তার সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে। এতে সে অনেক খুশি। তুলতুলের ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠেছে। দিয়া তা দেখে দিয়া খোঁচা দিয়ে বলে

-” ব্যাপার কি হুম হুম? আজকে দেখি হাসি মুখ থেকে সরছেই না। জামাই কে দেখে এতো খুশি নাকি?”

-” ধুরর! কি বলিস তুই। জানিস আজকে না ভাইয়া আমার সাথে কথা বলেছে। আগের মতই কথা বলেছে।” তুলতুলের চোখে মুখে হাসি লেগেই আছে। বোঝা যাচ্ছে আজ সে খুব খুশি। দিয়াও মুচকি হাসে তা দেখে। যাক তিয়াস তাহলে তার কথা শুনেছে। কলেজের অনুষ্ঠান শেষ হলে দিয়া আর তুলতুল বাইরে বের হয়। দেখে তিয়াস দাঁড়িয়ে আছে। তাদের দেখে এগিয়ে আসে, তারপর বলে

-” তাড়াতাড়ি গাড়ি উঠ দুইটাই। আমার কাজ আছে। তোদের নামিয়ে দিয়ে অফিসে যাবো। বাই দা ওয়ে, অনুষ্ঠান কেমন হলো কলেজে?”

-” ভালো” বলে তুলতুল দাঁড়িয়ে থাকে। তা দেখে তিয়াস ভ্রু উঁচু করে বলে

-” কিরে তুই স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? গাড়িতে উঠ।” তা শুনে গাড়ির ভেতর থেকে দিয়া বলে

-” তুলু আমাদের সাথে যাবে না। জামাইবাবু ওয়েট করছে তার জন্য।” একথায় তুলতুল ভীতু ভাবে তিয়াসের দিকে তাকায়। কিন্তু দেখে তিয়াস মুচকি হাসছে। তাহলে কি সে রাফসানকে মেনে নিয়েছে? তিয়াস তুলতুলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে

-” যেখানেই যাস সাবধানে যাবি। আর দ্রুত ফিরে আসবি কিন্তু।” তুলতুল মুচকি হেসে মাথা নাড়ে। তিয়াস গাড়িতে ওঠে গাড়ি স্টার্ট করে। গাড়ি টান দিলে তুলতুল এগিয়ে যায় মুচকি হাসি দিয়ে। আজ সে অনেক খুশি। তার ভাই রাফসানকেও মেনে নিয়েছে। কিছুদূর এগিয়েই রাফসানের গাড়ি দেখতে পায়। তুলতুল গাড়িতে উঠে বসে। রাফসান তুলতুলকে দেখে বলে

-” আজকে তুলু মনিকে অনেক খুশি লাগছে যে!”

-” হুম, তুলতুল আজ এতো খুশি” সে দুহাত ছাড়িয়ে দেখায়। তা দেখে রাফসান হেসে ওঠে। আর বলে

-” তা এতো খুশির কারণ?”

-” ভাইয়া আপনাকে মেনে নিয়েছে। আপনার কথা শুনে আজকে রাগ করেনি বরং হেসেছে।”

-” ওহ এ কথা! শালাবাবুর সাথে তো আমার কালকেই কথা হয়েছে। সব মিটমাট কালকেই হয়ে গেছে। ” রাফসানের কথা শুনে তুলতুল হা করে থেকে বললো

-” ভাইয়া কাল আপনার সাথে কথা বলেছে? তাহলে আপনি আমাকে বলেন নি কেন?”

-” এইযে তোমার এই হাসি দেখার জন্য বলি নি। কালকে ফোনে বললে কি আর তোমার হাসি দেখতে পেতাম? পেতাম না।” তুলতুল জবাবে আর কিছু বলে না। রাফসান গাড়ি স্টার্ট করে একহাত দিয়ে তুলতুলের একহাত ধরে রাখে, আরেকহাত দিয়ে গাড়ি চালায়। সে কিছুক্ষণ আগে তিয়াসা কবর জিয়ারত করে এসেছে। অনুষ্ঠান চলাকালীনই বের হয়ে গিয়েছিল এজন্য। পরে এসে তুলতুলের জন্য ওয়েট করে। তুলতুল বাইরে তাকায়। রাস্তাটা তুললতুলের কাছে চেনা চেনা লাগলো তবুও কোন রাস্তা তা মনে করতে পারলো না। রাস্তাটা ছায়ায় ঢাকা আর নির্জন। রাফসান অনেকক্ষন পরো গাড়ি থামায়।

তুলতুল গাড়ি থেকে নেমে দেখে রাফসান তাকে সেই নদীর পাড়ের জায়গা টায় নিয়ে এসেছে। এজন্যই এত চেনা লাগছিল রাস্তাটা। রাফসান তুলতুলের হাত ধরে পাড়ের দিকে এগোয়। বাতাসে তুলতুলের খোলা চুল আর শাড়ির আঁচল উড়ছে। রাফসান কিছুক্ষণ তুলতুলের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। তারপর পাড়ের কাছে একটা বড় গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রাফসান গাছে হেলান দিয়ে একপা উঠিয়ে গাছের সাথে লাগিয়ে তুলতুলের দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখে একরাশ মুগ্ধতা। সাথে সেই চোখে ভালোবাসাও দেখতে পারছে তুলতুল। তুলতুল এগিয়ে গিয়ে রাফসানের বুকের কাছের শার্ট মুঠ করে ধরে বলে

-” ভালোবাসি”
রাফসান কিছুক্ষণ তুলতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে
-” আবার বলো”
তুলতুল আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলে
-” ভালোবাসি আপনাকে গুন্ডামশাই” রাফসান হেসে তুলতুলকে জড়িয়ে ধরে তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে
-” আমিও ভালোবাসি আমার তুলুমনিকে। খুব ভালোবাসি।” তুলতুল হাসে, প্রশান্তির হাসি। রাফসান তুলতুলের হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। বাতাসের শো শো শব্দ শোনা যাচ্ছে। নদীর পাড় থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়ায়। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আকাশে একটা বাঁকা চাঁদ উঠেছে এখনি। কিন্তু সেটা আবছা, আলো ছাড়ায়নি এখনো। রাফসান তুলতুলকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে মাথা রাখে। তুলতুলের মুখ হাসি ফুটে উঠে। রাফসান তুলতুলের গালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। তারপর মুচকি হাসে। তার মনের আকাশের চাঁদ হাসছে। সারাজীবনই যেনো সে এই হাসি দেখতে পায়। একবার তার চাঁদ মেঘের আড়ালে লুকিয়ে গেছে কিন্তু এবার আর সে তার চাঁদকে মেঘের আড়ালে লুকাতে দেবে না। আগলে রাখবে তার ভালোবাসাকে, তার তুলুমনিকে, তার মনের আকাশের চাঁদকে। জীবনে সবক্ষেত্রেই এই মেয়েটিকে পাশে চায় সে। সুখের সময়ে, দুঃখের সময়ে, ভরসার জায়গা তার,বেঁচে থাকার অবলম্বন মেয়েটা। তাকে সে হারাতে দেবে না। রাফসান আকাশের চাঁদের দিকে তাকায়। আকাশে মেঘ আছে, কিন্তু সে তার মনের আকাশে মেঘ জমতে দেবে না। সৃষ্টিকর্তার কাছে সে চায় জীবনের শেষ সময় পযন্ত যেন ভালোবাসা, ক্ষুনশুটি, হাসি, কান্না, সুখ সবকিছুই তুলতুলের সাথে কাটাতে পারে। সেও চায় একটা হাসিখুশি স্বাভাবিক জীবন। বাতাসে তুলতুলের চুল উড়ে রাফসানের মুখের ওপর পড়ছে। তুলতুলের চুল থেকে একটা মিষ্টি সুঘ্রাণ পাচ্ছে। সে তুলতুলকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে প্রিয়তমার সাথে প্রকৃতিকেও অনুভব করতে লাগলো।

সমাপ্ত.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here