মেঘের ওপর আকাশ উড়ে পর্ব -০৯

#মেঘের_ওপর_আকাশ_উড়ে
#Part_09
#Writer_NOVA

দেখতে দেখতে দুই মাস কেটে গেল। এক বিকেলে বারান্দায় বসে সবেমাত্র খবরের কাগজটা খুলে বসেছেন মৃদুলের বাবা জয়নাল বিল্লাহ। চা হাতে তার স্ত্রীর প্রবেশ। ঢুকেই বিরক্তির সুরে বললো,

— নেও তোমার চা।

— তুমি কেন,বউমা কোথায়?

— তার কি আর এসবে মন আছে? সংসারের সব তো এখুনি আমায় সামলাতে হয়।

— তোমার সংসার কে সামলাবে তাহলে?

— ভেবেছিলাম বউ আসলে একটু সুখ করতে পারবো। সবকিছু তার হাতে তুলে দিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বাকি জীবন পার করবো৷ আমার কি আর সেই কপাল আছে।

জয়নাল বিল্লাহ খবরের কাগজ থেকে চোখ না সরিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলেন,

— কি হয়েছে হঠাৎ এমন কথা কেন?

— কেন বলছি জানো না?

— না বললে জানবো কি করে?

— সবই আমার কপাল।

— আহ্ মৃদুলের মা বলবে তো কি হয়েছে?

জয়নাল বিল্লাহর চোখ মুখে কিছুটা বিরক্তির ছাপ দেখা গেলো। তাতে সুমি বেগম কিছুটা বিব্রত হয়ে গেলো। স্বামী চটে গেলে সে যে কথা বলতে এসেছে তা বলতে পারবে না। তাই ভনিতা না করে দ্রুত বললো,

— মৃদুলের জন্য কি তোমাকে সাবাকেই পছন্দ করতে হলো? পৃথিবীতে কি মেয়ের আকাল পরেছে?

— কেন সাবা কি করেছে?

— কিছুই করেনি। সে মোটেও সংসারী মেয়ে নয়। আমি মৃদুলের জন্য একটা লক্ষ্মী মেয়ে আনতে চেয়েছিলাম। যে পুরো সংসারটাকে আর আমার ছেলেটাকে সামলে রাখবে।এমন উড়নচণ্ডী মেয়ে চাইনি। যার সংসার নিয়ে কোন চিন্তা নেই। আমার ছেলেকে নিয়ে কোন খেয়াল নেই।

স্ত্রীর কথায় কপাল কুঁচকে এলো জয়নাল বিল্লাহর। আজ কোন সুমিকে আবিষ্কার করছে সে? সাবাকে নিয়ে তো কখনো এসব কথা বলেনি সে। বরংচ সাবাকে মিথিলার মতো ভালোবাসতো। তাহলে কি সুমি বেগমও বাংলার শাশুড়ীর মতো ব্যবহার শুরু করেছে? তাই তো মনে হচ্ছে জয়নাল সাহেবের।সে কিন্তু তার সহধর্মিণীর ব্যবহারে বেশ অবাকও হলো। মুখে অবাকের রেখা বজিয়ে রেখে বললো,

— কি হয়েছে তোমার? তুমি আজ এমন কথা কেন বলছো? সাবাকে তো তুমি নিজের মেয়ের চোখে দেখো। তাই তো খুশিমনে ওকে ঘরর বউ করে আনলাম। আজ তোমার কথার সুর বদলে গেলো কেন? তুমি তো কখনও এমন ব্যবহার করো না। তোমার শরীর ঠিক আছে তো?

— হ্যাঁ, সবকিছু ঠিক আছে। তুমি ভুল বলোনি। আমি সাবাকে পছন্দ করি। কিন্তু ওকে বউমা হিসেবে নয়। মেয়ে হিসেবে ও ভালো কিন্তু বউ হিসেবে নয়। আমি মৃদুলের সাথে সাবার বিয়েটা মেনে নিতে পারিনি। এমন উড়নচণ্ডী মেয়ে বউ হিসেবে একটুও পারফেক্ট নয়। আমি ওকে মেনে নিতে পারছি না। ভেবেছিলাম বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমি নিরাশ। ওদের দুজনের সম্পর্ক ঠিক নেই। আগের মতোই আছে। আমি বউ এনে রান্নাঘর থেকে একটু অবসর পাই না। রাজ্যের যতকাজ আমারি করতে হয়।

এসব কথা শুনে পর্দার আড়ালে থাকা সাবার হাতটা ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলো। মনে হচ্ছে এই বুঝি চায়ের কাপটা পরে গিয়ে ঠাস করে শব্দ হবে। শ্বশুরকে চা দিতে এসেছিলো সে। শাশুড়ীর কথা শুনে ভেতরে যাওয়ার সাহস হলো না। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরতে লাগলো। সে তো গতমাস থেকে ভালো বউ হওয়ার চেষ্টা করছিলো। তবু কেন এতো সমস্যা? ওড়না দিয়ে চোখ মুছে দ্রুত সেখান থেকে সরে গেলো। মাথাটা চক্কর দিচ্ছে। এখানে বেশি সময় থাকলে মাথা ঘুরে পরে যাবে।

— মৃদুলের মা!

জয়নাল বিল্লাহ স্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য মৃদুস্বরে ডাকলো। সুমি বেগম চোখ তুলে তাকিয়ে বললো,

— হুম বলো।

— কোন মানুষ পারফেক্ট নয়। তাকে করে নিতে হয়। তুমি ঠিক বলেছো সাবা একটু ছটফট স্বভাবের মেয়ে। তবে মনের দিক দিয়ে ভীষণ ভালো। ওকে তুমি এতদিনেও বুঝতে পারলে না তাতেই আমার আফসোস। সাথে মন খারাপ হয়ে গেলো। তুমি ওর সাথে শাশুড়ী সুলভ ব্যবহার না করে মায়ের মতো আচরণ করো৷ তাহলে দেখবে তোমাদের সম্পর্কটা আগের মতো ঠিক হয়ে গেছে। তোমার কথা শুনে বুঝলাম তুমি এখন ওকে ছেলের বউয়ের চোখে দেখো,মেয়ের চোখে নয়। তাই ওর এতো দোষ তুমি খুঁজে পাও। কোথায় আগে তো এসব দেখিনি৷ তাই তোমাকে বলবো ওর সাথে সম্পর্ক বাজে না করে সুন্দর করে বুঝাও। কোন ভুল হলে বকাঝকা না করে ঠান্ডা মাথায় সুন্দর করে বুঝিয়ে দাও। কাজের সময় ওকে ডাক দিবে। দুজন গল্প করতে করতে কাজ করবে। এতে দুজনের সম্পর্ক মজবুত হবে। তুমি যদি এসব না করে সব হেলাফেলা করে ছেড়ে দাও তাহলে খুব শীঘ্রই তোমাদের সম্পর্ক নষ্ট হবে। যেই পরিবারে বউ, শাশুড়ীর সম্পর্ক খারাপ সেই পরিবারে অহরহ অশান্তি লেগে থাকবে। আশা করি আমি যা বলছি তা তুমি বুঝতে পারবে।

সুমি বেগম চুপ করে স্বামীর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো। তার মাথায় কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। এমন করে তো সে কোনদিন ভাবেনি। এটা সত্য যে বিয়ের পর থেকে সাবাকে সে বউয়ের চোখেই দেখছে।

💞💞💞

দূর আকাশে মেঘগুলো তুলোর পাজার মতো উড়ে যাচ্ছে। আকাশে অর্ধচন্দ্র উঠেছে। যার দরুন চারিপাশে বেশ আলো। ছাদে দাঁড়িয়ে আনমনে সেই দিকে তাকিয়ে আছে সাবা৷ গাল বেয়ে পানি গরিয়ে পরছে। তার এখন মনপুরা মুভির যাও পাখি বলো তারে গানটা ভীষণ মনে পরছে। গুনগুন করে কয়েক লাইন গেয়ে ফেললো,

“মেঘের ওপর আকাশ উড়ে,
নদীর ওপার পাখির বাসা
মনে বন্ধু বড় আশা”

গান থামিয়ে আবার আকাশের দিকে তাকালো। ওর কাছে এখন সত্যি মনে হচ্ছে আকাশের ওপর মেঘ নয় বরং মেঘের ওপর আকাশ উড়ছে। এই দুইমাসে ওদের সম্পর্ক উন্নতি না হলেও সাবা ভীষণরকম মৃদুলের মায়ায় জড়িয়ে গেছে। ওকে ছাড়া কোন কিছু ভাবতে পারে না।ওকে ছেড়ে যাওয়ার কথা মনে এলেই বুকের ভেতরটা ধুক করে উঠে। সাবা নিজের মনে বিরবির করে বলে উঠলো,

— তোকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না মৃদুল। তুই আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিস। তোকে আমার প্রয়োজন। তবে তুই আমার শুধু প্রয়োজন না সাথে প্রিয়জনও। টম এন্ড জেরীর মতো ঝগড়া করতে করতে যে কখন তার মায়ায় জড়িয়ে গেছি তা আমি নিজেও বুঝতে পারিনি৷ বৈধ সম্পর্কে যে এতটা জোর আছে তা আমার জানা ছিলো না। পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ বলে কি তোর জন্য এমন টান অনুভব করি? নাকি সত্যি তোকে ভালোবেসে ফেলছি আমি? কিছু জানি না আমি। শুধু জানি তোকে আমার লাগবে।

মৃদুল বাসায় ঢোকার পরপরই এদিক সেদিক সাবাকে খুঁজতে লাগলো। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে মাত্রই বাসায় ঢুকেছে সে।সাবা আজকাল চোখের সামনে না থাকলে ওর ভালো লাগে না। কিরকম জানি একটা অস্বস্তি কাজ করে। মনে হয় কি জানি নেই। রুমে, বারান্দায়, ওয়াসরুমে, মায়ের রুমে, মিথিলার রুমে খুঁজেও সাবাকে পেলো না। এমনকি কিচেনে, ড্রয়িংরুমেও নেই। গেলো কোথায় মেয়েটা? মৃদুলের কেমন জানি ছটফটানি শুরু হয়েছে। এই মুহুর্তে সাবাকে ওর ভীষণ প্রয়োজন। মিথিলা ওর শ্বশুর বাড়ি।নয়তো মৃদুল সিউর থাকতো সাবা মিথিলার কাছে আছে। মায়ের রুমের কাছে গিয়ে উঁকি মেরে মৃদুল জিজ্ঞেস করলো,

— আম্মু, সাবা কোথায়?

— তোর রুমে নেই?

— থাকলে কি তোমাকে জিজ্ঞেস করি?

— আমি তো রুমেই দেখেছিলাম। এখন কোথায় বলতে পারবো না। তবে তুই একবার ওদের ফ্ল্যাটে দেখে আসতে পারিস।

মায়ের বলতে দেরী মৃদুলের দৌড় দিতে দেরী নয়। সাবাদের ফ্ল্যাটে এসে কয়েকবার কোলিং বেল বাজাতেও কারো রেসপন্স পাওয়া গেলো না। এতে মৃদুলের ছটফটানি বেড়ে গেলো। কতখনে দরজা খুলবে সেই চিন্তায় বিভোর সে। অল্প একটু দেরীও তার সহ্য হচ্ছে না। মিনিট দুই পর দরজা খুললো সিয়াম। মৃদুলকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,

— আরে মৃদুল ভাইয়া! এসো ভেতরে এসো।

— আমি বাসার ভেতরে ঢুকতে আসিনি।

— তাহলে?

— তোর আপু কোথায়?

— কেন, আপু তো তোমাদের বাসায়।

— আমাদের বাসায় তো নেই। তাই ভাবলাম তোদের বাসায় এসেছে কিনা।

সিয়াম উত্তর দেওয়ার আগে ভেতর থেকে নাসিমা বেগম চেচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— এই সিয়াম কে এসেছে?

— আম্মু, মৃদুল ভাইয়া এসেছে।

— ভেতরে আসতে বল।

— আচ্ছা।

মৃদুল সিয়ামকে তাগাদার সুরে বললো,
— সত্যি তোদের বাসায় আসেনি সাবা?

— না ভাইয়া। আপু আসলে আমি কি না বলতাম?

সিয়ামের মুখ দেখে মনে হচ্ছে না সে মিথ্যে বলছে। মৃদুলের সাথে সিয়াম কখনো মিথ্যে বলেও না। সিয়ামের কথা শুনে মৃদুলের কপালে চিন্তার ভাঁজ পরলো। বিরবির করে বললো,

— তাহলে গেলো কোথায়?

— তোমার সাথে কি কোন ঝামেলা হয়েছে আপুর? নয়তো এই বেলায় গেলো কোথায়?

— আমার সাথে কিছু হয়নি।

— তাহলে আন্টির সাথে?

— সেটা আমি জানি না। এখন ওকে আমি খুঁজবো কোথায় বলতো?

সিয়াম কয়েক মিনিট চোখ,মুখ কুঁচকে কিছু একটা ভাবলো। তারপর মৃদুলকে বললো,

— ভাইয়া তুমি একবার ছাদে দেখে আসো তো। মাঝে মাঝে আপু ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হতে পারে এখনো ছাদে গিয়েছে।

সিয়ামের কথা শুনে মৃদুলের মুখটা খুশির ঝলক দিলো। এতখন তো চিন্তায় ছাদের কথা ভুলেই গিয়েছিলো। সিয়ামের কাঁধে চাপর মেরে দৌড় দিলো ছাদের দিকে। ছাদে গিয়ে এদিক সেদিক খুঁজে দেখতে পেলো কোণার দিকে সাবা পিছন দিক ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। সে সারা দালান খুঁজে হয়রাণ। আর সাবা এখানে দাড়িয়ে আছে। তা দেখে মৃদুলের মাথায় চিনচিন করে রাগ উঠে গেলো। মৃদুল দিকপাশ না তাকিয়ে দৌড়ে সেদিক গিয়ে সাবাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে গালে ঠাটিয়ে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিলো।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here