মেঘের পালক চাঁদের নোলক পর্ব -১৬ ও শেষ

#মেঘের_পালক_চাঁদের_নোলক
#পর্ব_১৬ (অন্তিম পাতা)
#অধির_রায়

নিধি শাওনের গালে আলতো করে উষ্ণ ঠোঁট জোড়া স্পর্শ করে৷ হয়তো সত্য জানার পর স্পর্শ করার কোন সুযোগ হবে না৷ নিধির এই প্রথম শাওনকে ভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়েছে৷ মনের মধ্যে একটা শীতল অনুভূতির জন্ম নিল৷ নিধি সদূরে দাঁড়িয়ে আকাশ ভরা তাঁরার মেলায় দৃষ্টি ফেলে৷ মলিন কন্ঠে বলল,

“আমি জানি না আমার কথা কিভাবে নিবেন? আমি আপনাকে অন্ধকারে রাখতে পারব না বলেই কথাগুলো আজ বলা৷ এত বছর পর কথাগুলো কিভাবে আপনি গ্রহণ করবেন? ভাবতেই বুকে কাটা দিয়ে উঠে। আপনার নাম শুনি নিষিদ্ধ পল্লীর বাঈজীর কাছ থেকে৷ যা আমার জীবনে একটা কালো অধ্যায়৷ আমার মা বাবা আমাকে নিষিদ্ধ পল্লীর লোকদের কাছে বিক্রি করে দেন৷ নিষিদ্ধ পল্লীতে আমাকে নিয়ে পড়াশোনার লোভ দেখিয়ে৷ আমি জানতাম আমাকে বড় স্কুলে ভর্তি করবে৷ কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য হলো আমায় দিয়ে ব্যবসা করা। অল্প বয়স টাকা বেশি পাবে সেজন্য আপনার ঘরে আমাকে পাঠায়৷ আপনার কাছে যাওয়ার আগে শ্যামলী আপু আমাকে ঘুমের মেডিসিন দেন৷ যা আপনাকে ড্রিংক্সের সাথে মিশিয়ে খাওয়ায়৷ খাওয়ার পর আপনার ঘুম আসছিল না৷ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ছোট্ট সেই নিধির উপর৷ আপনার শক্ত হাত সাক্ষী আছে সেদিন আপনি সমস্ত শক্তি দিয়ে আমার গালে আঘাত করেন৷ ঠোঁট জোড়ার উপর চালান নির্মম অত্যাচার৷ বেশি কিছু করতে পারেননি৷ কিছু সময়ের মাঝে ঘুমের দুয়ারে পা রাখেন৷ নিষিদ্ধ পল্লীতে মেয়ে ঢুকতে পারে। বের হতে পারে না৷ ছেলেদের পোশাক পড়ে ছদ্মবেশ নিয়ে বের হয়৷ জায়গায় হয় মুগ্ধ ভাইয়ার গাড়িতে৷ সাথে আপনাদের বাড়িতে৷”

অঝোরে ঝড়ে যাচ্ছে চোখ থেকে অশ্রুকণা। গাল বেয়ে পড়ছে অশ্রু। থামকে গেছে সমস্ত পৃথিবী। নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে শাওন। কি বলবে বুঝতে পারছে না? শাওন নিধিকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,

“আমার তুমি ক্ষমা করে দাও৷ আমার জন্য তোমায় অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে৷ সৃষ্টি কর্তা তোমাকে আর কষ্টের সাগরে রাখবেন না৷ ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতেই সৃষ্টিকর্তা তোমাকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন। দেহের শেষ রক্তবিন্দু থাকা অব্দি তুমি আমার থাকবে৷ তুমি ভেবেছিলে আমি তোমায় দূরে সরিয়ে দিব৷ ভালোবাসা কি শুধু দেহ দেখে হয়? যা ১৪ ফেব্রুয়ারি কিছু অসভ্য মানুষ পালন করে৷ ভালোবাসা হলো সারাজীবন আগলে রাখা৷”

নিধি শাওনের দিকে ঘিরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল৷ ভেজা গলায় বলল,

“আমাকে কোনদিন একা রেখে যাবেন না৷ আপনি ছাড়া নিধি শূন্য। নিধির এই ত্রি ভুবনে কেউ নেই৷ আপনি আমার একমাত্র আপন মানুষ৷ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যেন আপনার হাত ধরে বাঁচতে পারি।”
_____________________

নিধি হসপিটালের জন্য বের হচ্ছে৷ মাহদী দৌড়ে এসে নিধিকে জড়িয়ে ধরল৷ জিৎ ধরে বলল,

“ছোট আম্মু আমিও তোমার সাথে হসপিটালে যাব৷ আমাকেও নিয়ে চল৷ আমিও যাব৷”

নিধি মাহদীকে কোলে নিয়ে বলল,

“মাহদী আব্বু এমন করে না৷ তুমি আমার লক্ষী আব্বু৷ তোমার জন্য এত্তগুলা চকলেট নিয়ে আসব৷”

ভেজা গলায় বলল,

“না, আমার চকলেট লাগবে না৷ আমি তোমার সাথে হসপিটালে যাব৷ তুমি আমাকে একদিনও নিয়ে যাওনি৷ আমি তোমার সাথে হসপিটালে যাবে৷”

মাহদীকে শান্ত করতে না করতেই মেঘ দৌড়ে এসে বলল,

“চল আম্মু৷ আমি রেডি৷ মাহদী পচা ছেলে৷ তাকে নিয়ে যেতে হবে না৷ আমাকে নিয়ে চল৷”

নিধি কি করবে বুঝতে পারছে না? হসপিটাল থেকে বার বার ফোন আসছে৷ তার উপর নিষ্পাপ শিশুর মুখের দিকে তাকালে সব ভুলে যায়৷ নিধি বাধ্য হয়ে শাওনকে ফোন দিল৷ শাওন ফোন রিসিভ করতেই বলল,

“মেঘ, মাহদী হসপিটালে যাওয়ার জন্য কান্না করছে৷ আমি কি করব, বুঝতে পারছি না?”

ফোনের অপর পাশ থেকে শাওন বলে উঠল,

“তাদের আমার অফিসে পাঠিয়ে দাও৷ আর হ্যাঁ কাল থেকে তোমাকে ছুটি কাটাতে হবে৷ মায়ের কথা ফেলা যাবে না৷ মা শক্ত গলায় বলে দিয়েছে রিসিপশনের আগে হসপিটালে যাওয়া বন্ধ।”

“হ্যাঁ মনে আছে৷ আমায় নিয়ে ভাবতে হবে না৷ আমি কাল থেকে হসপিটালে যাব না৷”

মানবসেবা অন্যতম৷ ডক্টরের পেশা তার মধ্যে অন্যতম৷ পরিবারের আদর স্নেহ ত্যাগ করে রোগীদের সময় দেওয়াটাই তাদের কাছে প্রাধান্য। বর্তমানে কিছু অসাধু ডক্টরের জন্য সকলে ডক্টরের উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে৷ তাদের উদ্দেশ্য মহৎ কাজের নয়৷ টাকাই তাদের কাছে সবথেকে বেশি৷ টাকাকে প্রাধান্য দিতে বলে গরিব মানুষরা রোগের কথা ডক্টরদের বলতে পারে না৷ রোগ নিয়ে তিলে তিলে মারা যায়৷ বেসরকারি হসপিটালের কথা বাদ দিলাম৷ বর্তমানে সরকারি হসপিটালেও চলছে অসাধুর ব্যবসা৷ মানব সেবা নামে সরকার এবং সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লুটে নিচ্ছে সবকিছু।

নিধি তাদের অফিসে পৌঁছে দেয় হসপিটালের যায়৷ মেঘ, মাহদী তাদের ছোট আব্বুকে পেয়ে খুব খুশি৷ শাওনের সাথে পার্কে ঘুরতে চলে যায়৷
____________________

শায়লা ভিলা বাহারি রকমের ফুল দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে৷ মেহমানে ভরপুর সারাবাড়ি৷ তিথির দায়িত্বে রাখা হয়েছে মেঘ, মাহদীকে৷ সবার সাথে চলছে তাদের দুষ্টামি৷ মানুষকে বিরক্ত করা৷ অন্যের বাচ্চাকে চিমটি দিয়ে লুকিয়ে পড়া৷ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে তিথি৷ মেঘ মাহদীকে কিছুতেই শান্ত রাখা যাচ্ছে না৷

নিধির অনেক বন্ধু এসেছে৷ হসপিটালের স্টাফ সবাই এসেছেন৷ সকলের হাতে দামী দামী গিফট। বড়লোকদের বিয়ে মানেই দামী গিফটের সমাহার। নিধির বিয়ের কথা শুনে স্বচ্ছের মন ভেঙে গেছে৷ দু’চোখে নেমে এসেছে ঘন অন্ধকার। এক পাক্ষিক ভালোবাসা রয়ে গেল স্বচ্ছের মনে৷ মেডিক্যালে পড়ার সময় থেকে নিধিকে ভালোবেসে আসছে৷ সবাই জানত শাওন আর নিধি ভাইবোন৷ বন্ধু মহলে হইচই লেগে গেল৷ নিধি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“আমাদের বিয়ে পাঁচ বছর আগেই হয়ে গেছে৷ তোদের এতদিন বলা হয়নি৷ পারলে আমায় ক্ষমা করিস৷” স্বচ্ছকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুই কোনদিন আমায় তোর ভালোবাসার কথা বলিস নি৷ আমি তোকে বাকীদের মতো ভালো বন্ধু ভেবেই এসেছি৷ আমি জানলে কখনও তোকে মরিচীকার পিছনে ছুটতে দিতাম না৷ আমায় ক্ষমা করে দে৷”

স্বচ্ছ এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল৷ ভেজা মলিন কন্ঠে বলল,

“পারব না তোকে ক্ষমা করতে৷ তুই কেন এতদিন আমাদের সত্য কথা বললি না? তুই কোনদিন বুঝতে পারলি না আমার অনুভূতি। আমাকে কেন এত ভালোবাসা দেখাতে আসলি?”

“তুই বুঝার চেষ্টা কর৷ আমার স্বামী থাকতে আমি কেন অন্যের প্রেমে পড়তে যাব৷ আমি সিঙ্গেল থাকলে হয়তো তোর প্রেমে পড়ে যেতাম৷”

“হয়েছে অজুহাত দিতে হবে না৷ যা ক্ষমা করে দিলাম৷ আমার পা ধরে সালাম কর। তোকে দশটাকা দিব৷ দোয়া করব তুই যেন সুখে থাকিস৷”

নিধি অপরাধী কন্ঠে বলল,

“সত্যি তুই আমায় ক্ষমা করছিস?”

“তোকে ভালোবেসেছি বলেই নতুন রাস্তা দেখতে পেলাম৷ ব্যর্থতা মানুষকে নতুন পথ দেখায়। আমি মন থেকে তোর জন্য দোয়া করি৷”
__________________

কাঁচা ফুলের বাসর ঘরে বসে আছে নিধি৷ ফুলের সৌরভ ছড়িয়ে পড়েছে ঘরে৷ বাসর নিয়ে প্রতিটি মেয়ের অনেক স্বপ্ন থাকে। শাওনের জন্য প্রহর গুনছে নিধি৷ নিধির অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে শাওন রুমে প্রবেশ করে৷ বড়দের কথামতো নিধি শাওনের পা ছুঁয়ে সালাম করতে গেলে শাওন নিধিকে আটকায়৷ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে মাথানত করবে না৷ অন্যের কাছে কেন তুমি মাথা নত করবে? যে আল্লাহর প্রকৃত বান্দা সে কখনও কারো সামনে মাথা নত করে না৷”

নিধি ভিতু কন্ঠে বলল,

“কিন্তু বড়দের কথা শুনতে হয়৷ এটা বিয়ের একটা নিয়মের মধ্যে পড়ে৷”

শাওন নিধিকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল,

“এসব মানুষের মনগড়া নিয়ম৷ মহান আল্লাহ বা নবী রাসুলগণ এসবের কথা বলেন নি৷ সুতরাং এসব কুসংস্কার থেকে দূরে থাকবে৷”

“আপনি ঠিক বলছেন৷ এসব কুসংস্কার থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে৷”

“এসব ভারী শাড়ি গহনা চেঞ্জ করে আসো৷ আজ আমরা আমাদের মেঘের পালক চাঁদের নোলক সম্পুর্ন করব৷”

শাওন নিধির কপালে আলতো করে ভালোবাসার পরশ একে বারান্দায় চলে যায়৷ ফ্রেশ হয়ে নিধি শাওনের কাঁধে মাথা রেখে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে৷ নিধি বলল,

“আল্লাহ তায়া’লা আমাদের নিয়তিতে এটাই লিখে রেখেছিলেন৷ আজ আমাদের দু’টি আত্মা দু’টি মন এক হতে পেরেছে৷ আল্লাহকে হাজার হাজার শুকরিয়া।”

নিধি নিরবের হাত ধরে কোমল কন্ঠে বলল,

আজ আমার জন্য একটা গান বলেন৷ না না গান নয়৷ গজল বলবেন৷ শুধু গানে রোমান্টিক থাকে না৷ গজলেও অনেক রোমান্টিক থাকে৷ ভালোবাসার মানুষকে খুশি করার অনেক কথ্য থাকে৷”

শাওন নিধির মুখ প্রাণে চেয়ে গজল শুরু করল৷

তোমায় ভালোবাসাব বলে,
সুখে দুঃখে পাশে থাকব বলে,
হৃদয়টাকে শবে দিয়েছি৷
{তুমি বন্ধু আমার জীবন সাথী।
মহান রবের দেওয়া উপহার।
প্রভুর র’হম যেন থাকে সারা জনম,
সেই দোয়া আজই শুধু বারে যায়৷}(২)

ছোট খাটো ভুল থেকে মান অভিমান
বেড়ে যায় ভালোবাসা,
কাঁদে দু’টি প্রাণ।
তুমি বন্ধু আমার জীবন সাথী।
মহান রবের দেওয়া উপহার।
প্রভুর র’হম যেন থাকে সারা জনম,
সেই দোয়া আজই শুধু বারে যায়৷

দু’টি প্রাণ একই নীড়ে বেঁধেছে বাসা,
জান্নাতি পাখি হয়ে মিলবে পাখা।
তুমি বন্ধু আমার জীবন সাথী।
মহান রবের দেওয়া উপহার।
প্রভুর র’হম যেন থাকে সারা জনম,
সেই দোয়া আজই শুধু বারে যায়৷
তোমায় ভালোবাসাব বলে,
সুখে দুঃখে পাশে থাকব বলে,
হৃদয়টাকে শবে দিয়েছি৷
{তুমি বন্ধু আমার জীবন সাথী।
মহান রবের দেওয়া উপহার।
প্রভুর র’হম যেন থাকে সারা জনম,
সেই দোয়া আজই শুধু বারে যায়৷}(২)

নিধি মুগ্ধ হয়ে গজলটা শুনল৷ নিধি প্রথম এত সুন্দর রোমান্টিক গজল শুনল৷ এমন রোমান্টিক গজল আছে জানা ছিল না৷ সৃষ্টি কর্তা সবাইকে সব দিক থেকে পরিপূর্ণ দিয়েছেন৷ কিন্তু আমরা সে দিকটা বেছে নিতে ব্যর্থ।

ভালোবাসার মুহুর্তগুলো কিভাবে কেটে গেল? এখন রাতের শেষ প্রহর চলছে। পাখিরা নীড়ে, মানব তার বাসস্থানে তন্দ্রায় মগ্ন৷ নিধি শাওনকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“আমাদের নতুন পথ চলা আল্লাহর নাম নিয়ে শুরু করি৷ এখন তাহাজ্জুদের সময়৷ আমরা দু’জনে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে মোনাজাতে একে অপরকে চাবো। সৃষ্টি কর্তা যেন সারা জনম আমাদের একত্রে রাখে৷ শুধু ইহকালে নয়৷ পরকালে আমরা একে অপরের পরিপূরক হয়ে থাকব৷ আমার জীবনের প্রতিটি অংশ জুড়েই তো আপনার বাস। আপনার একাংশ জুড়েই হোক, না আমার সর্বনাশ।

শাওন নিধির কথায় সম্মতি দিল৷ আল্লাহর নাম নিয়ে শুরু হলো নতুন জীবন। শাওন নিধির ভালোবাসা আজ পরিপূর্ণ।

সমাপ্ত……..

প্লিজ সবাই কমেন্ট করবেন৷ সবার কমেন্টের রিপ্লাই দেওয়ার চেষ্টা করব৷ সকলের প্রতি রইল আমার ভালোবাসা এবং সালাম। আসসালামু আলাইকুম।
কাল সবাইকে আমার আসল পরিচয় দিব৷ চোখ রাখেন আমার আইডিতে অধির রায়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here