#মেঘের_পালক
পর্ব-৫
অনেক সময় এমন হয় না, একসাথে সব বাদ্যযন্ত্র বেজে যাচ্ছে, অথচ কোনো সুর নেই? তাল নেই? সেরকম হয়েছে অবস্থা। বাড়ি ফিরে অরিনের মনে হলো সে পারলে একটা গার্তে ঢুকে যায়৷ এমনিতে তো সে ভালোই থাকে। ওই ছেলের আশেপাশে গেলে অমন নির্লজ্জ হয়ে যায় কেন? আজ কত কথা হলো! নিজের থেকে সে হাতটা পর্যন্ত বাড়াল প্লাবনের দিকে। অথচ ঠিকভাবে পরিচয় জানা হলো না। তাকে সত্যিই ভালোবাসে কি না সেসব কিছুই জিজ্ঞেস করা হলো না। এরকম আজগুবি কান্ড সে করবে এমন নিজেও কখনো ভাবেনি।
মনের মধ্যে অফুরন্ত ভালো লাগার সাথে কাজ করছে দ্বিধা, ভয় আর লজ্জা। কে জানে কিসের সাথে জড়িয়ে পড়ছে সে!
পরদিন ক্লাসে গেলে সবাই তার দিকে অদ্ভূত চোখে তাকাল। যেন সে চিড়িয়াখানার জীব! মনিকা চোখ মটকে জিজ্ঞেস করল, “কিরে, তোর হিরোর কী খবর?”
শিমুল হাসতে হাসতে বলল, “যে স্পিডে সেদিন পালিয়ে গেলি, আমি তো ভেবেছিলাম এতক্ষণে এন্টার্কটিকা পৌঁছে গেছিস।
তাজমিন ফোঁড়ন কাটল, “এন্টার্কটিকা গেলে অত হ্যান্ডসাম ছেলেটার সাথে প্রেম করবে কে?”
অরিনের গা জ্বলে যাচ্ছিল। সে একটা কথারও জবাব না দিয়ে খালি সিট পেয়ে বসে পড়ল। একটু পরেই তার পাশের জায়গা দখল করল মৌটুসী। বোধহয় হেঁটে এসেছে অনেকদূর, হাঁপাচ্ছে।
একটু ঠান্ডা হয়ে মৌটুসী বলল, “আর কথা হয়েছে প্লাবনের সাথে?”
“হুম।”
“কবে?”
“সেদিন রাতেই।”
“বাহ! কী বলল?”
“দেখা করতে চেয়েছে।”
“করবি?”
“অলরেডি করে ফেলেছি।”
“বলিস কী! প্রেম জমছে নাকি সব ভন্ডুল?”
“উফ! এত বকিস না। সবার কান এদিকে। ক্লাসের পর বলব।”
যদিও মৌটুসী “আচ্ছা” বলল, তবে তার মুখ দেখে মনে হলো ভেতরে ভেতরে আগ্রহে ফেটে পড়ছে।
অর্নবের দেখা পাওয়া গেল এরপর। তার আগমনে প্রতিদিনই একটা ছোটোখাটো সিনেমা হয়। মানে সিনেমার পর্দায় দেখা দৃশ্যের মতো কিছু হ্যাংলা মেয়ে এগিয়ে গিয়ে অভ্যর্থনা জানায় আর সে গাড়ির চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে সানগ্লাস চোখে ক্লাসে ঢোকে।
আজ অর্নব ঢুকে মেয়েমহলের কাছে না গিয়ে সোজা অরিনের কাছে চলে এলো। তার সামনের একটা চেয়ারে বসে পায়ের ওপর পা তুলে ব্যাগ খুলে শাড়ির প্যাকেট বের করে তাকে দিল।
কিছু মেয়েদের কাছ থেকে বিস্ময় সূচক ধ্বনি ভেসে এলো। অর্নব এবার একটু ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে বলল, “তোর কাহিনীটা কী বল তো? আমার ভাইটাকে পটালি কেমন করে? ওটা যা জিনিস, জীবনে প্রেমফ্রেম করে নাই৷ তোর সামনে এরকম ড্রপ খেয়ে গেল কী করে?”
অরিন বিরক্ত মুখে বলল, “জানি না।”
“আরে, না জানলে তো চলবে না। ও আমাকে কিচ্ছু বলছে না। তোকে বলতে হবে। কবে থেকে পরিচয় তোদের?”
অরিন আকাশ থেকে পড়ল। “কবে থেকে মানে? ওকে প্রথম দেখেছি তোর পার্টিতে।”
অর্নব দ্বিগুণ বিষ্মিত হয়ে বলল, “বলিস কী!” তারপর রেগে গিয়ে বলল, “একদম মিথ্যে বলবি না। পার্টিতে তো তোদের কথা বলতে দেখিনি একবারও। তাহলে ভালোবাসাবাসিটা হলো কখন?”
অরিন লাল হলো। সেও বুঝতে পারছে না কিছু। বলল, “হয়তো লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট ছিল!”
“মোটেও না! ও ওরকম ছেলেই না। এর আগে আমার এক আগুন সুন্দরী বান্ধবীর সাথে বাজি ধরেছিলাম ওর সাথে প্রেম করে দেখাতে হবে। কিন্তু শালা এত কারসাজির পরেও পটে নাই! শেষে বাজিতে হারলাম। সেই মেয়ের তুলনায় তুই কিছুই না!”
অরিনের এবার অপমান বোধ হলো। সে রুক্ষ স্বরে বলল, “যা আমার সামনে থেকে!”
“আমি আবার কী করলাম?”
“তুই যাবি এখান থেকে?”
অর্নব উঠল। যাওয়ার আগে বলল, “আমার কী মনে হয় জানিস? প্লাবন তোকে একটু বাজিয়ে দেখছে। প্রেমফ্রেম কিচ্ছু না৷ সেদিন তোকে প্রপোজ করেছিল আমাদের সাথে বাজি ধরে। শালা ড্রিঙ্ক করে না। বাজিতে হারলে পুরো বোতল শেষ করতে হতো। সেটা পারবে না দেখে তোর কাছে গেছে। তুই ভাবছিস এই চেহারা নিয়ে অমন ছেলে পটিয়ে ফেলবি? হেহ!” বিদ্রুপের হাসি হাসতে হাসতে চলে গেল অর্নব।
পুরো ক্লাস এখন চেয়ে আছে অরিনের দিকে। অরিনের চোখ পানিতে ভর্তি হয়ে আসছে। ভাগ্যিস স্যার চলে এলো, সবার চোখ সরে গেল তার থেকে। আর অরিন আলগোছে মুছে নিল চোখের পানি।
★
লাঞ্চ ব্রেকে সে সবটা খুলে বলল মৌটুসীকে। মৌটুসীও দেখা গেল রেগে গেছে। বলল, “তুই ভালো করে চিনিস না জানিস না, সেই ছেলের হাতে ভাত খেয়ে ফেললি? তোর হাত ধরে তোকে বাসায় দিয়ে গেছে? তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে না ওই ছেলে জাদুটোনা করেছে বল তো? আমি এত ছাগলের মতো কাহিনী করতে কোনো মেয়েকে দেখি নাই। ওইযে মেয়েগুলা যারা জামাকাপড়ের মতো বয়ফ্রেন্ড বলদায়, ওরাও এত সহজে স্লিপ খায় না!”
“আমি কী করব? নিজের ওপর কোনো কন্ট্রোল ছিল না আমার!”
“ঘোড়ার ডিম! তুই একটা বেকুব!”
অরিন কিছু বলল না। শুধু নাক দিয়ে একটা শব্দ করল।
মৌটুসী তাকে বলদ, শিম্পাঞ্জি, ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চা ইত্যাদি আরও বহু বিশেষণে বিশেষায়িত শেষে বলল, “এবার কী করবি সেটা বল।”
অরিনের চোখের কোল এখনো ভেসে যাচ্ছে। সে চোখ মুছে বলল, “আমি তো আর জানতাম না এসব বাজি ধরে করেছে। প্লাবন নাটক করছে জানলে আমি তো আর এরকম মোমের মতো গলতাম না। এখন যা হবার হয়েছে, আমি আর কিছুতে নেই।”
“যাক ভালো একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিস।”
“হুম।”
“আর ফোন ধরিস না ওর। কে কোন উদ্দ্যেশ্যে ঘোরে ঠিক আছে? এখনকার ছেলেরা সবই অর্নবের মতো ফোর টুয়েন্টি। ওরই তো ভাই!”
“ঠিক বলেছিস।”
★
দুপুরের পর থেকে প্লাবনের ফোন থেকে অনবরত ফোন আসতে থাকল। ধরল না অরিন। বিকেলে ক্লাস শেষে বের হবে, এমন সময় মেসেজ এলো, “আমি তোমার ক্যাম্পাসের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। চলো একটু ঘুরব।”
অরিন উত্তর দিল না। সোজা পথে না বের হয়ে উল্টোদিক দিয়ে বের হয়ে বাড়ির পথ ধরল।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু





