. #মেঘের_বিপরীতে
পর্বঃ (১৫+১৬)
দুটো ইট পাশাপাশি রেখে মাঝখানে পুরু করে বালু বিছিয়ে রাখা হয়েছে। তার ওপর কয়লা ফেলা। এভাবেই বার বি কিউ চুলা তৈরি করা হয়েছে। খুব সুন্দর পোড়া ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে চারিপাশে। পুরো এলাকা ম ম করছে। হটপটে গরম গরম রুটি নিয়ে শারমিন তার দুই জা কে নিয়ে উঠানে আসলেন। বাকি সবাই আগের থেকেই উপস্থিত ছিলো। নন্দিতার ভালো লাগছে না। এই পূর্ণতার মাঝেও কোথায় যেনো অপূর্ণতা আছে। কি সেই অপূর্ণতা? রেহালের অনুপস্থিতি? হতে পারে। প্রতিটি মানুষের জীবনে কিছু কিছু মানুষের উপস্থিতির প্রভাব এতটাই প্রকট যে একবার যদি তার অভাব বুঝতে পারা যায় তাহলে সেই অভাব থেকে বের হয়ে আসাটা অত্যন্ত জটিল। রেহাল নন্দিতার চোখের সামনে থাকলে তাকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। আর ছুঁয়ে দেখলে বুকে জড়িয়ে রাখতে ইচ্ছে করে। অজানা এক ভয় গ্রাস করে ফেলে চতুর্দিক থেকে। যদি মানুষটা হারিয়ে যায়? নির্দয় বাস্তবতাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর বাস্তবতা হলো, যাকে হারানোর ভয়ে সারাদিন মানুষ আতংকগ্রস্ত থাকে, সে একটাসময় ঠিকই হারিয়ে যায়। সময় তাকে কেড়ে নেয়। আর ফিরিয়ে দেয় না। এর ব্যতিক্রমও দেখা যায়। নন্দিতা সেই ব্যতিক্রম মানুষদের দলে যারা বাস্তবতার সাথে লড়াই করে ভালোবাসার মানুষকে খুব যত্ন করে আগলে রাখে। কিন্তু সময়ের কাছ থেকে রেহালকে বাঁচাতে পারে নি। সে বদলে গেছে।
নন্দিতা চুপচাপ বসে আছে। শফিক সাহেব বলে উঠলেন,
“কতদিন হয়ে গেছে নন্দিতার কন্ঠে রবীন্দ্রসংগীত শুনি না।”
নন্দিতার মা বাবা ছাড়া সকলেই শফিক সাহেবের সাথে গলা মেলালেন। মরিয়ম শাড়ির আচল দিয়ে টানা ঘোমটা ঠিক করতে করতে বললেন,
“গান ধরো নন্দিতা।”
নন্দিতা ইতস্তত করে বললো,
“অনেক দিন হয়ে গেছে গান গাওয়া হয় না। গলার অবস্থা খুব বাজে।”
জহির অবাক কন্ঠে বললেন,
“বিয়ের সময় হারমোনিয়াম উপহার দিলাম কি সাজিয়ে রাখার জন্য? প্র্যাকটিস করিস না?”
“না, আসলে। ওভাবে সময় পাই না।”
“তুই গান গাওয়ার সময় পাস না? রেহাল কিছু বলে না?”
নন্দিতা কোনো উত্তর দিলো না। সেসময় গ্রামে প্রতি শুক্রবার শহর থেকে একজন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী আসতেন। তাকে সবাই রিমু আপা বলে ডাকতো। গ্রামের বেশিরভাগ ছেলে মেয়ে খুব আগ্রহ নিয়ে তার কাছে গান শিখতে যেতো। প্রাইমারি স্কুলের ছোট্ট মাঠটার এক কোণায় যে কাঠগোলাপ গাছ আছে, তার পাশে একটা বেঞ্চ রাখা ছিলো। সেই বেঞ্চের ওপর হারমোনিয়ামের সুর তুলতেন রিমু আপা। তার গলার সাথে গলা মিলিয়ে গান গাইতো অনেকগুলো কন্ঠস্বর। স্বমসুরে যেনো জেগে উঠতো পুরো স্কুলের মাঠ। সোনালি সেই দিনগুলো আজ কেমন ছাইবর্ণ হয়ে গেছে। রেহাল প্রথম প্রথম নন্দিতার গান শুনতো। খুব পচ্ছন্দ করতো। এখন আর পচ্ছন্দ করে না। দিন যত যায়, মানুষের পচ্ছন্দ অপচ্ছন্দ তত বদলায়। নন্দিতাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।
“এখন আর ইচ্ছে করে না গান গাইতে। রেহাল তো প্রায় প্রতিদিন রাতেই জোরাজোরি করে। গান শোনাতে বলে। ওর গান শুনে ঘুমানোর অভ্যাস।”
কথাগুলো বলে নন্দিতা নিজেই চমকে উঠলো। সে অনেক গুছিয়ে মিথ্যে বলা শিখে ফেলেছে। আগে একদমই বলতে পারতো না। কখনো বলার চেষ্টাও করে নি। কিন্তু এখন বলতে হয়। ভালো থাকার মিথ্যা অভিনয়ও করতে হয়। একটা জিনিস নন্দিতা খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারছে, মানুষ তার নিজ জগতের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বা অভিনেত্রী। এরা কষ্টের ছায়া চোখে মুখে পড়তেই দেয় না। কৃত্রিম এক সুখী ভাব ছড়িয়ে থাকে চেহারায়। সাধারণ চোখ দিয়ে এই কৃত্রিমতা ধরা যায় না। এর জন্য দিব্যদৃষ্টির প্রয়োজন। কিন্তু সবাই নিজেদের কষ্ট লুকাতে এতটাই ব্যস্ত থাকে যে আরেকজনের কষ্ট বোঝার সময়টুকু পায় না।
“এত কিছু বুঝি না। তুই গান ধর দেখি।”
সবাই একসাথে নন্দিতাকে গান গাওয়ার পীড়াপীড়ি করতে লাগলো। নাইফ চুলোর কয়লা উল্টে পাল্টে দিয়ে বসলো। অধির আগ্রহে নন্দিতার কিন্নর কন্ঠে গান শোনার অপেক্ষা করতে লাগলো। শারমিন বেগম মেয়ের পাশে এসে দাঁড়ালেন। কাঁধে আলগোছে হাত রাখলেন। নন্দিতা মায়ের চোখের দিকে তাঁকালো। শারমিনের চোখে অনুনয়। নন্দিতা হাসলো। কয়েক পা সামনে এগিয়ে গেলো। চোখ বন্ধ করে গান ধরলো,
সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে, ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনা।
সেই স্মৃতিটুকু কভু খনে খনে যেন জাগে মনে, ভুলো না ॥
সেদিন বাতাসে ছিল তুমি জানো
আমারি মনের প্রলাপ জড়ানো,
আকাশে আকাশে আছিল ছড়ানো তোমার হাসির তুলনা ॥
সবাই মনোযোগ দিয়ে গান শুনছে। নাইফ দেয়ালে হেলান দিয়ে অন্যদিকে তাঁকিয়ে আছে। এখান থেকে তাদের বাড়ির উঠোনের বিশাল আমগাছটার মাথা দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলোয় পাতাগুলো চিকচিক করছে। নাইফ যেনো হঠাৎ দেখতে পেলো সেই আমগাছের ডালে ঝুলে থাকা দড়ি আর কাঠের তক্তা দিয়ে বানানো দোলনাটায় নন্দিতা বসে আছে। নাইফ পেছোন থেকে তাকে ধাক্কা দিচ্ছে। নন্দিতার এক হাতে আচারের বয়াম। তেলে ডুবানো জলপাইয়ের আচার। সে খুব বিরক্তি নিয়ে বললো,
“নাইফ ভাই কি করছো? ঠিকমতো ধাক্কা দিতে পারো না?”
নাইফ দাঁত কটমট করে বললো,
“ইচ্ছে তো করছে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেই তোকে। না হলেও আধা ঘন্টা ধরে দোলনায় বসে হাওয়া খাচ্ছিস। এখনো দোল খাওয়া হয় নি তোর?”
নন্দিতা মাথা নেড়ে বললো, “না।”
নাইফ দোলনার তক্তায় ধাক্কা দিয়ে সামান্য দূরে গিয়ে দাঁড়ালো।
“আমি আর ধাক্কা দিতে পারবো না। নিজে দোল খা।”
নন্দিতা মন খারাপ করে বললো,
“এমন করলে? আমি কি আর আজীবন এই আমগাছে বসে দোল খাবো? পরের বাড়ি চলে যেতে হবে না?”
“পরের বাড়ি যাবি মানে?”
“মেয়ে হয়ে জন্মেছি। সংসার ধর্ম পালন করতে হবে না?”
নাইফ চোখ দুটো বড়বড় করে বললো,
“তুই এত পেঁকে গেছিস? এই বয়সে সংসার নিয়ে চিন্তা করা হচ্ছে! দাঁড়া। আজকে তোর একদিন কি আর আমার একদিন।”
নন্দিতা কোনো উত্তর না দিয়ে খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে দোলনা থেকে নেমে দৌঁড় দিলো। নাইফও তার পিছে পিছে ছুটছে। হঠাৎ নন্দিতা উঁচু মাটির ঢিবীতে পা বেজে পড়ে গেলো। হাত থেকে আচারের বয়াম পড়ে গেছে। তেল ছড়িয়ে পড়েছে আশেপাশে। নন্দিতা আর্তনাদ করে ঊৎোলো। নাইফ দ্রুত পায়ে নন্দিতার কাছে যেতে লাগলো। মেয়েটা পড়ে গিয়েছে। পা মচকে গিয়েছে। তাকে হাত ধরে উঠাতে হবে। তাদের মাঝের দূরত্ব খুব বেশি নয়। আর একটু এগোলেই নন্দিতার হাত ধরে ফেলতে পারবে সে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত উঠাতে পারলো না। একাধিক হাততালির শব্দে তার মনশ্চক্ষু পুনরায় ঘুমিয়ে গেলো। নন্দিতার গান গাওয়া শেষ। সবাই খুব প্রশংসা করছে। নাইফ মনে মনে বললো, গানটা আরেকটু বড় হলেও পারতো। বাস্তবে না পারি অন্তত কল্পনায় তোর হাতটা তো আরো একবার ধরতে পারতাম!
বার-বি-কিউ তৈরি হয়ে গেছে। চাঁদের আলোয় একসাথে বসে খাওয়া হলো। গরম গরম রুটি, সালাদ আর বার-বি-কিউ মুরগী। খাওয়ার পর কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে সবাই যার যার বাড়ি ফিরে গেলো। শুধু নাইফ এখনো উঠোনে রয়ে গেছে। উঠোন পরিষ্কার করছে। এমন সময় কারো পায়ের শব্দ পাওয়া গেলো। শব্দটি অপরিচিত নয়।
নাইফ পেছোন দিকে না ফিরেই জিজ্ঞেস করলো,
“কিছু বলবি?”
“আগামীকাল আমাকে বাসে উঠিয়ে দিতে যাবে?”
নাইফ থমকে দাঁড়ালো। বুকে নতুন করে ব্যাথা অনুভব করতে লাগলো। মনে হচ্ছে কেউ যেনো তার বুকে অনবরত সুঁই দিয়ে খোঁচাচ্ছে। সে লম্বা করে শ্বাস নিয়ে পেছোন ফিরে তাঁকালো। নন্দিতা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে।
“কয়টায় বাস?”
“আটটার বাসে যাবো।”
“সাড়ে সাতটার মধ্যে তৈরি হয়ে থাকিস। বেশি দেরী করলে বাস ধরতে পারবি না।”
“আচ্ছা।”
নন্দিতার পায়ের শব্দ আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেলো। নাইফ বুঝতে পারলো নন্দিতা তার নিজের ঘরে চলে গিয়েছে। সে বারান্দার ফ্লোরে গিয়ে পা ঝুলিয়ে বসলো। শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে। চোখদুটো লেগে আসছে। ছোট টুলটা কাছে এনে দুই হাত টুলের ওপর রেখে মাথাটা রাখলো। চোখ দুটো আপনা আপনি বন্ধ হয়ে এলো। সাথে সাথে মনশ্চক্ষু জেগে উঠলো। সে দেখতে পেলো,
নন্দিতা মাটিতে আগের অবস্থাতে পড়ে আছে। নাইফ তার সামনে হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে আছে। নন্দিতা করুন কন্ঠে বললো,
“পা টা মনে হয় মচকে গেলো।”
“তাই তো মনে হচ্ছে।”
“তা এমন হাবার মতো দাঁড়িয়ে না থেকে আমার হাত ধরে টেনে তুলো না, নাইফ ভাই!”
নাইফ নন্দিতার দিকে হাত এগিয়ে দিলো। নন্দিতাও তার হাত বাড়িয়ে দিলো। নাইফ খুব যত্ন করে নন্দিতার হাত ধরে তাকে টেনে তুললো। নন্দিতার এক হাত তার কাঁধের ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে রাখলো। নন্দিতা নাইফের কাঁধে ভর দিয়ে নেংড়িয়ে হাঁটছে। তার সাথে তাল মিলিয়ে নাইফও ছোট ছোট কদম ফেলছে। হেঁটে যেতে যেতে একসময় তারা অদৃশ্যে মিলিয়ে গেলো। নাইফের টুলের ওপর থেকে মাথা সরিয়ে নিলো। তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। ইনহেলার নিতে হবে। ডাক্তার সিগারেট খেতে কড়া নিষেধ করে দিয়েছে। তবুও সে সিগারেট খায়। মানা করার পর থেকে আরো বেশি করে খায়। নিষিদ্ধ কাজকর্ম বেশি বেশি করার মাঝে অন্যরকম আনন্দ। পৈশাচিক ধরনের।
নাইফের শ্বাসকষ্ট বাড়তে লাগলো। দ্রুত ঘরে ফেরা উচিত। বাকি কাজটুকু কোনোভাবে শেষ করে সে নন্দিতাদের বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো।
(চলবে…)
. #মেঘের_বিপরীতে
পর্বঃ ১৬
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল ঠিক করছে অর্চিতা। পরনে হলুদ রঙের জর্জেট শাড়ি। সে ড্রয়ায় খুলে টিপের পাতা বের করলো। মাঝারি রঙের কালো টিপ কপালের ঠিক মাঝ বরাবর পড়লো। কিন্তু টিপ কপালে লেগে না থেকে মেঝেতে পড়ে গেলো। আঠা নেই। টিপের পাতায় কালো রঙের অন্য কোনো টিপ নেই। অর্চিতা লম্বা করে শ্বাস নিলো। তার চুল এখনো ভিজে। ভিজে চুলেই হালকা করে খোঁপা করলো। উবু হয়ে মেঝে থেকে টিপ তুললো। তারপর সেই টিপে আঠা লাগিয়ে কপালে পড়লো। ড্রেসিং টেবিলের ওপর কাজলদানী রাখা। সে খুব সুন্দর করে দু চোখে কাজল লাগিয়ে নিলো। কোন ফাঁকে আঁচলের সেফটিপিন খুলে গেছে অর্চিতা খেয়াল করে নি। আয়নার দিকে তাঁকিয়ে পুনরায় আচল ঠিক করতে গিয়ে সে থমকে দাঁড়ালো। তাকে অন্য কারো মতো লাগছে। যার মতো লাগছে অর্চিতা তার নাম জানে। সেই নামের বাইরেও তার অন্য এক পরিচয় আছে। তিনি রেহাল ইসলামের স্ত্রী। সেদিন রেস্টুরেন্টে স্যারের মোবাইল স্ক্রীনে মেয়েটির ছবি ভেসে উঠেছিলো। কি সুন্দর দেখতে!
অর্চিতা ধপ করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারে বসে পড়লো। আয়নায় নিজেকে অবাক হয়ে দেখতে লাগলো। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। অর্চিতার চোখ ভীষণ সুন্দর। হরিণী চোখ। কি মায়াবী লাগে দেখতে! সবচেয়ে বেশি মায়াবী লাগে যখন চোখ দুটি পানিতে টলমল করে। মেয়েদের হাসলে সুন্দর লাগে। সে হাসির ফাঁদে আটকে শত পুরুষ প্রেমে হাবুডুবু খায়। কিন্তু কাঁদলে এতটাই মায়াবী লাগে যে, পুরুষের বুক কেঁপে ওঠে। হয়তো, সেজন্যই ছলনাময় কান্না ভয়ংকর। খুব ভয়ংকর।
স্বপন ডিউ লাইট কম্পানির ম্যানেজার। গালে চাপ দাড়ি। চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা পড়ে। বেশ সুদর্শন দেখতে। তিনি রেহালের অত্যন্ত অপচ্ছন্দের একজন ইমপ্লোয়ি। তার আচার আচরণ রেহালের অসহ্য লাগে। কিন্তু লোকটা যথেষ্ট বুদ্ধিমান। যে কোনো পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো ক্ষমতা তার আছে। স্বপনের এই দিকটি রেহালের পচ্ছন্দ। পচ্ছন্দ অপচ্ছন্দ মিলে একটি সমতা চলে এসেছে। এদিকে স্বপন সর্বদা তার স্যারকে তেল দেওয়ার ধান্দায় থাকে। স্যারের চোখের মণি হয়ে থাকার চেষ্টা করে। অবশ্য আজকাল রেহাল স্যার ছাড়াও স্বপনের মন আরেক দিকে বেশ ঝুঁকে আছে। স্যারের পি এ এর দিকে। মেয়েটির অল্প বয়স। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা। চাহনির মাঝে কি যেনো একটা আছে। সেদিন কালু অফিসে আসে নি। স্বপনের কাজের বেশ চাপ। রান্নাঘরে এসে দেখে পিএ কফি বানাচ্ছে। স্বপনকে দেখে মেয়েটি মুচকি হাসলো। মিষ্টি করে জিজ্ঞেস করলো_ ভালো আছেন?
“জ্বি আপনি?”
“এইতো ভালো। আপনার নামটা মনে পড়ছে না।”
“অর্চিতা।”
“ওহ! হ্যালো মিস অর্চিতা। আমি স্বপন।”
অর্চিতা আবারো মিষ্টি করে হেসে বললো, “হ্যালো।’
“কফি বানাচ্ছেন?”
“জ্বি।”
“হুম। মনে হচ্ছে আপনি কফি পার্সন।”
“না। আমি চায়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। আসলে, স্যার প্রতিদিন এই সময়টায় কফি খান। অন্যদিন কালু নিয়ে যায়। আজ তো আসে নি, তাই আমিই বানিয়ে দিচ্ছি।”
স্বপন কেশে বললো,
“ছেলেটা বেশি ফাজিল হয়ে গেছে। অনেকদিন ধরে কারণে অকারণে অফিস কামাই দেওয়া শুরু করেছে। স্যারও দেখি ওকে কিছু বলে না। মাথায় উঠে গেছে একদম। কালুকে বেশি লাই দিবেন না। এই জাতটাকে সবসময় পায়ের নিচে রাখতে হয়। বেশি লাই দিলে মাথায় চড়ে লাফালাফি শুরু করে দেয়।”
অর্চিতা কোনো উত্তর দিলো না। মনে হয় কথাগুলো তার পচ্ছন্দ হয় নি। স্বপন আবার গলা পরিষ্কার করে কিছু একটা বলতে চাইলো। অর্চিতা হাতে কফির মগ নিয়ে বললো,
“আমার কফি বানানো শেষ। আমি বরং যাই। কফি ঠান্ডা হয়ে যাবে। হ্যাভ এ গুড ডে।”
স্বপন মুখ হাসি হাসি করে দাঁড়িয়ে রইলো। কফি বানানোর সময় কিছু চুল সামনে চলে এসেছিলো। অর্চিতা এক হাত দিয়ে চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে নিলো। আরেক হাতে কফির মগ নিয়ে স্যারের রুমে চলে গেলো। একজন পুরুষকে কাবু করার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। সেদিনের পর থেকে এই লোক অর্চিতার পেছোনে আঠার মতো লেগে আছে। যা অর্চিতার দৃষ্টিগোচর হয়েছে এবং সে বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন।
রেহালের জন্মদিন উপলক্ষে পুরো অফিস সাজানো হয়েছে। জন্মদিন উদযাপনের আইডিয়া স্বপনের মাথায় এসেছে। অফিসের সব কর্মচারী সাতটার মধ্যে উপস্থিত হয়ে গেছে। শুধুমাত্র একজন ব্যতীত । স্বপন হাতঘড়ির দিকে তাঁকালো। আটটা বাজতে চলেছে কিন্তু অর্চিতা এখনো আসছে না। সে ভ্রুঁ কুঁচকে তার ডেস্কের সামনে পায়চারী করতে লাগলো। কালু রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিলো। স্বপন তাকে দাঁড়া করালো।
“এই কালু এদিকে আয় তো।”
কালু আজকে খুব ঠান্ডা মেজাজে আছে। একদম বরফের মতো ঠান্ডা। স্যারের জন্মদিন বলে কথা। কিন্তু স্বপনের ডাক পাওয়ার সাথে সাথে তার মেজাজ গরম হয়ে গেলো। এই লোকটাকে তার একদম পচ্ছন্দ না। সে স্বপনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মুখে কিছু বললো না।
“আমাকে এক কাপ চা করে খাওয়া তো।”
কালু ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালো। হঠাৎ করে তার মন ভালো হয়ে গেলো। সে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ফুরফুরে মেজাজে রান্নাঘরে ঢুকলো। চুলায় কেতলি বসালো। পানি ফুটতে শুরু করেছে। চায়ের কাপে পরিমাণমতো দুধ চিনি মিশালো। কেতলিতে চা পাতি দিয়ে কিছুক্ষণ জাল দিলো। খুব সুন্দর রঙ এসেছে। কাপে চা ঢাললো। কালুর চোখ জ্বলজ্বল করছে। চা হয়ে গেছে। এখন শুধু ছোট্ট একটি কাজ বাকি। কালু এদিক সেদিক তাঁকিতুঁকি করে চায়ের কাপে একদলা থুথু ফেললো। ছোট্ট কাজটি সম্পন্ন হয়েছে। সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। চামচ দিয়ে ভালোভাবে চায়ে থুথু মিশিয়ে স্বপনের কাছে গেলো। স্বপন কাপে চুমুক দিয়ে মুখ দিয়ে ‘আহ’ জাতীয় শব্দ বের করলো।
“চা মজা হয়েছে রে কালু! থ্যাংক ইউ।”
কালু খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,
“ওয়েলকাম, স্যার।”
“এখন চেহারার দিকে তাঁকিয়ে না থাকে কাজে যা। খালি ফাঁকিবাজি।”
কালু আবার ঘাড় কাত করে রাজকীয় ভঙ্গিতে সেই স্থান পরিত্যাগ করলো। সে খুব চেষ্টা করছে হাসি আটকিয়ে রাখতে। কিন্তু পারছে না। সবসময় হাসি আটকিয়ে রাখা যায় না।
অর্চিতা বাস থেকে মতিঝিলে নামতেই তার মনে হলো স্যারের জন্য কোনো গিফট নেওয়া হয় নি। ট্রাফিকে আটকে সে এম্নিই লেট। তার ওপর বাস আজকে অফিস থেকে বেশ দূরে নামিয়ে দিয়েছে। পায়ে হেঁটে যেতে পনেরো মিনিট লাগবে। ফোনেও নেটওয়ার্ক কাজ করছে না। আজকাল অকারণে নেটওয়ার্ক থাকে না। সিমকার্ড বদলাতে হবে। অফিসে দ্রুত পৌঁছানো জরুরি। আবার খালি হাতে যাওয়াটাও একদম বেমানান। অর্চিতা পার্স খুলে দেখলো কিছু ভাংতি বাবদ তার কাছে মাত্র পাঁচশ টাকা আছে। গতকাল বাড়ি ফেরার সময় একটি ঘড়ির দোকানে কিছুসময়ের জন্য দাঁড়িয়েছিলো। একটি জেন্টস ঘড়ি তার ভীষণ পচ্ছন্দ হয়। দাম সাড়ে তিনশ টাকা। রেহাল ব্র্যান্ড ছাড়া ঘড়ি পরে না। অর্চিতার এখন হাজার তিনেক টাকা খরচ করে ঘড়ি কেনা সম্ভব না। মধ্যবিত্তরা চাইলেই দামী গিফট কিনতে পারে না। তাদের বিলাসিতার জগৎ অনেক ক্ষুদ্র হয়। ক্ষুদ্রতার মাঝে তারা বাঁচতে শেখে। তাই, ঘড়িটা কেনা হয় নি।
অর্চিতা একমনে হাটছে। আচমকা সে থমকে দাঁড়ালো। ফুলের ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। গাড়ির পেট্রোল আর ধোঁয়ার গন্ধের চেয়েও এই সুবাস অত্যন্ত প্রকট। অর্চিতা বুক ভরে শ্বাস নিলো। বামে ফিরতেই দেখলো একটি ছোট্ট ফুলের দোকান। এই অফিস আর রেস্টুরেন্টের ভীড়ে ফুলের দোকান খুঁজে পেয়ে অর্চিতা বেশ অবাক হয়। এতদিন এই রাস্তা দিয়েই যাতায়াত করেছে সে। কখনো এই দোকান চোখে পড়ে নি। অর্চিতা ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো। একজন মধ্যবয়স্ক লোক ফুলে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে। প্রতিটা ফুল টসটসে। একদম তাজা। কি মিষ্টি সুবাস বেরুচ্ছে! অর্চিতাকে দেখে দোকানদারের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। পানির মগ পাশে রেখে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো,
“কার জন্য ফুল নিবেন আপা?”
অর্চিতা মুখ ফসকে বলে ফেললো, “উনার জন্য।”
দোকানদার বললো,
“বুঝছি। বুঝছি! ভালোবাসার মানুষের জন্য নিতাছেন। খাড়ান আমি একটা কম্বো বানাইয়া দিতাছি।”
অর্চিতা হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে আছে। দোকানদারের কথা যেনো শুনতেই পেলো না। সে একদৃষ্টিতে গোলাপ ফুলগুলোর দিকে তাঁকিয়ে আছে। রেহালকে সে সবসময় ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করে। ‘উনি’ বলে সম্বোধন করে না। দোকানদারকে অর্চিতা সহজভাবে বলতে পারতো_ স্যারের জন্য ফুল নিচ্ছি। আজকে তার জন্মদিন। কিন্তু সে তা বলে নি। টিফিন পিরিয়ডে স্কুলের মাঠে অর্চিতার বন্ধুদের গোল বৈঠক বসতো। বৈঠকের বিষয়বস্তু খুবই ভয়ংকর। বড়রা শুনতে পেলে আস্ত রাখবে না। বিয়ের পর কে তার স্বামীকে কি বলে ডাকবে? কেউ কেউ বলতো, আমি নাম ধরে ডাকবো। আবার কেউ কেউ বলতো, আমি পুরোনো দিনের নায়িকাদের মতো ‘ওগো শুনছো?’ বলে ডাক দিবো। শুধু অর্চিতার দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো আলাদা। সে আকাশের দিকে তাঁকিয়ে উদাস কন্ঠে বলতো, আমি তাকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করবো। কখনো নাম ধরে ডাকবো না। ‘আপনি’ বলে ডাকার মাঝে শুধু শ্রদ্ধা নয়, অজস্র ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে।
দোকানদার অর্চিতাকে দ্বিতীয় বার ডাক দিলো,
“আফা?”
অর্চিতার শরীর হালকা কেঁপে উঠলো। অপ্রস্তুত হয়ে বললো, “জ্বি”
“এই নেন আপনার ফুল।”
অর্চিতা ফুলের তোড়া হাতে নিলো। বেশ কয়েকটি ফুলের কম্বিনেশনে তোড়াটি বানানো হয়েছে। গোলাপ আছে, জারবেরা আছে, ঘাসফুল আছে। আরো একটি ফুল আছে। অর্চিতা ফুলটির নাম জানে না। তার জানতেও ইচ্ছে করছে না। দোকানদার বললো,
“কি ভাবতাছেন আপা? ভাই পচ্ছন্দ করবো কিনা?”
“সেরকম কিছু না।”
“চিন্তা কইরেন না। আপনি ভালোবাইসা ফুল লইয়া যাইতেছেন। দেখবেন ভাই মেলা খুশি হইবো।”
অর্চিতা হাসার চেষ্টা করে বললো, “কত দিবো?”
“ষাইট টাকা।”
পার্স থেকে চকচকে পাঁচশ টাকার নোট বের করে দোকানদারের দিকে এগিয়ে দিলো সে।
অফিসের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে অর্চিতা।যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে অফিস দেখা যায়। রোদের তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে। কপালে ফোটা ফোটা ঘাম জমছে। তার অফিসে যেতে ইচ্ছে করছে না। শাহরিনের বাসায় যাওয়া যেতে পারে। মতিঝিল থেকে ধানমন্ডি রুটে যে বাসটা যায় তা মিনিট দশেকের মধ্যেই চলে আসবে। অর্চিতা মনস্থির করলো। সে আজ অফিস যাবে না। শাহরিনের বাসায় যাবে। সে উল্টোপথে হাঁটা শুরু করলো। হাতে ফুলের তোড়া। অর্চিতার মনে হতে লাগলো, সে যেনো এক মরুভূমিতে বিচরণ করছে। আশেপাশে কেউ নেই। তার খুব তেষ্টা পেয়েছে। সে ভীষণ ক্লান্ত। পরিশ্রান্ত। তার ঠিক পেছোনে জলাশয়। কিন্তু সে জলাশয় ফেলে তৃষ্ণার্ত হৃদয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। মরীচিকার ফাঁদে পড়া যাবে না। মায়া কাটিয়ে তাকে বারবার এভাবেই ফিরে আসতে হবে।
(চলবে…)
লিখাঃ আতিয়া আদিবা।