মেঘের বিপরীতে পর্ব ১৭+১৮

. #মেঘের_বিপরীতে
পর্বঃ (১৭+১৮)
নন্দিতা এবং নাইফ পাশাপাশি বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে। নাইফের হাতে নন্দিতার লাগেজ। দুজনেই বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। আটটার বাস চলে গিয়েছে ঘন্টাখানিক আগে। নন্দিতা বাস ধরতে পারে নি। গতকাল রাতে কোনোভাবেই ঘুম আসছিলো না। বাধ্য হয়ে ইজিয়াম খেয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখের পাতায় ভর করে রাজ্যের ঘুম। নন্দিতা যখন জাগনা পেয়েছে তখন ঘড়িতে আটটা বেজে পাঁচ মিনিট। লাগেজ থেকে খুব বেশি কাপড় বের করা হয়নি। যে তিন চারটে কাপড় বাইরে ছিলো তা রাতেই ব্যাগে ভরে ফেলা হয়েছে। বিদায় নেওয়ার আগে নন্দিতা পুরো বাড়ি একবার ঘুরে দেখে। এই বাড়ির প্রতিটি কোণা তার পরিচিত। চড়কির মতো ঘুরে বেরিয়েছে চতুর্দিকে। কেমন যেনো আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। শারমিন কপালে চুমু খেয়ে অনেকক্ষণ মেয়েকে বুকে জড়িয়ে রাখেন। রফিক সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। নন্দিতা উবু হয়ে তাদের দোয়া নেয়। নন্দিতার দুই চাচা তার স্ত্রীদের নিয়ে বাড়ির বাইরের কাচা রাস্তায় অপেক্ষা করছিলেন। নন্দিতা তাদের পা ছুঁয়েও দোয়া নেয়। মিহি ছলছলে চোখে তাকে জড়িয়ে ধরে। নন্দিতা মিহির কপালে চুমু খেয়ে বলে,
“ঠিকমতো পড়াশোনা করিস কিন্তু!”
“তুমি আবার কবে আসবে নন্দিপু?”
“খুব তাড়াতাড়ি আসবো।”
“তোমাকে অনেক মিস করবো।”
“আমিও তোকে মিস করবো। নিজের যত্ন নিস। আর চাচা চাচীকে কম জ্বালাতন করিস। কেমন?”
নন্দিতার কথা শুনে মিহি কেঁদে ফেলে। কাছের মানুষের বাঁধন ছিঁড়ে দূরে থাকাটা কষ্টের। অনেক কষ্টের। কিন্তু মেয়েরা ঠিক থাকতে পারে। আসলেই কি থাকতে পারে? নাকি তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে থাকতে হয়? কে জানে! হয়তো বাস্তবতা মেনে নিয়ে স্বামীর ঘর সাজানোর মোহে মেয়েরা নিজেদের অভিভূত করে ফেলে।

নন্দিতার ঘুমের ঘোর এখনো পুরোপুরি কাটে নি। নাইফ তার পাশে লাগেজ রেখে দু কাপ রঙ চা নিয়ে এলো। চা খাওয়ার পর তার ঘুম ঘুম ভাব কিছুটা কাটলো। সাড়ে নয়টায় আরেকটি ঢাকাগামী বাস এই স্টপ হয়ে যাবে। সেই বাসের জন্য তারা অপেক্ষা করছে। নাইফ বললো,
“বাসে জার্নি করতে পারবি?”
নন্দিতা ভ্রুঁ কুঁচকালো।
“কেনো পারবো না?”
“বিয়ের পর বাসে চড়ে যাতায়াত করেছিস?”
“না।”
“তাহলে?”
“বিয়ের পর করি নি কিন্তু বিয়ের আগে তো করেছি।”
নাইফ ঠান্ডা গলায় বললো,
“বিয়ের আগের বিষয় আলাদা। বিয়ের পর মেয়েদের স্বভাব বদলে যায়। চালচলনে পরিবর্তন আসে।”
“আমার স্বভাবে, চালচলনে কোনো পরিবর্তন এসেছে?”
“হুঁ। এসেছে।”
“যেমন?”
“যেমন _ তুই আগে অনেক দুষ্ট ছিলি। তোর দুরন্তপনায় বাড়ির লোকজন অতিষ্ট হয়ে যেতো। এখন অনেক শান্ত হয়ে গেছিস। সাংসারিক হয়েছিস। আগের মতো দুরন্তপনা নেই। দুষ্টুমি নেই।”
নন্দিতা হালকা গলায় বললো,
“তখন ছোট ছিলাম। এখন বড় হয়ে গেছি। কাজেই দুরন্তপনা নেই। এই পরিবর্তন বিয়ে না হলেও হতো।”

নাইফ নন্দিতার সাথে একমত হতে পারলো না। তার মন বলছে রেহালের সাথে বিয়ে না হলে নন্দিতা আগের মতোই থাকতো। বৃষ্টি হলে শত বারণের বিপক্ষে গিয়ে ভিজতে চাইতো। আমগাছের ঝুলন্ত দোলনায় ঝুলে দোল খেতো। নৌকায় চড়ে জলকেলি করতো। মাঠে বাচ্চাদের সাথে চিঁ বুড়ি খেলতো। পাড়ার ছেলেদের সাথে ঘুড়ি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতো আর প্রথম স্থানের অধিকারী হয়ে বাড়ি ফিরতো। নাইফকে জড়িয়ে ধরে বলতো_নাইফ ভাই, আমি এখনো ঘুড়ি ওড়ানোতে মাস্টার। সবাইকে হারিয়ে তবেই এসেছি।
নাইফকে চুপ থাকতে দেখে নন্দিতা আবার জিজ্ঞেস করলো,
“কিছু বলছো না যে?”
“কি বলবো উত্তর তো তুই দিয়েই দিলি।”
“আমার উত্তরের প্রত্যুত্তরে তোমার কিছু বলার নেই?”
“না।”
“নো কাউন্টার এট্যাক?”
“নো।”
নন্দিতার মন খারাপ হয়ে গেলো। সে আসলেই বিয়ের পর অনেক পালটে গেছে। স্বভাবে, কথা বার্তায়, চালচলনে। সে এখন নতুন এক নন্দিতা। যার চঞ্চল মনোভাব ইট পাথারের নিচে চাপা পড়ে গেছে বহু আগে।
“নাইফ ভাই, সাড়ে নটা তো বেজে গেলো বাস এখনো আসছে না যে?”
“রাস্তাঘাটের কথা কি বলা যায়? দশ পনেরো মিনিট এদিক সেদিক হতেই পারে। অপেক্ষা কর। চলে আসবে।”

অপেক্ষা কখনো কখনো মধুর। কখনো কখনো বিরক্তিকর। রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে অফিস থেকে রেহালের ফিরে আসার অপেক্ষা করা মধুর। রোদের নিচে দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করা অবশ্যই মধুর নয়। একে বিরক্তিকর অভিজ্ঞতার লিস্টে পাঠানো যেতে পারে। নন্দিতার চিন্তা হচ্ছে। ঢাকায় গিয়ে তার অনেক কাজ বাকি। কেয়ারটেকারকে দিয়ে বাজার আনাতে হবে। রান্না করতে হবে। রেহাল কেক পচ্ছন্দ করে না। তাছাড়া অফিসের কর্মচারীরা বসের জন্মদিন উপলক্ষে অবশ্যই কেক কাটার বিশাল আয়োজন করে ফেলেছে! নতুন করে কেক কাটার প্রয়োজন নেই। বাস যত দ্রুত আসবে সে তত দ্রুত ঢাকা পৌঁছাতে পারবে। ঠিক দশ মিনিট পর একটি লাল রঙের বাস স্টপে এসে থামলো। বাসের গায়ে লিখা ‘মালেক পরিবহণ’। নাইফ ইশারা করে বললো,
“তোর বাস এসে গেছে। যা উঠে বস। আমি লাগেজ এগিয়ে দিচ্ছি।”
নন্দিতা বাসে উঠলো। নাইফ লাগেজ গাড়ির পেছোনের বক্সে রেখে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো। নন্দিতা জানালার পাশেই বসে আছে। তার হাতে ব্যাগের টোকেন ধরিয়ে দিলো। গাড়ি কাঁপছে। যে কোনো মুহূর্তে ছেড়ে দিবে। নন্দিতা জানালা দিয়ে গলা এগিয়ে দিয়ে বললো,
“নাইফ ভাই, আমার একটা কথা রাখবে?”
নাইফ বললো, “কি কথা?”
“বিয়েটা করে ফেলো।”
নাইফ চুপ করে রইলো।
“অতীতের ফাঁদে পড়ে ভবিষ্যৎ নষ্ট করো না। আমার নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয়। অস্থির লাগে। আমি এই অস্থিরতা থেকে মুক্তি পেতে চাই।”
নাইফ এবারো চুপ করে রইলো। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিচ্ছে। নন্দিতা উত্তরের আসায় তার মুখের দিকে তাঁকিয়ে আছে। নাইফ হাত নেড়ে বললো,
“ভালো থাকিস।”
নন্দিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাসলো।
“তুমিও ভালো থেকো।”
গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। নাইফ একদৃষ্টিতে গাড়ির চলে যাওয়া দেখছে।

নন্দিতার ঠিক পেছোনের সীটে এক বিবাহিত দম্পতী বসেছে। সাথে তাদের এক বছরের বাচ্চাও আছে। বাচ্চাটির মুখ দিয়ে ক্রমাগত লালা পড়ছে। সেই লালা মাখানো হাত দিয়ে ইতিমধ্যে চার পাঁচবার বাচ্চাটি নন্দিতার চুল ধরে টান দিয়েছে। নন্দিতার বিরক্ত লাগলেও কিছু বলছে না। মাঝে মাঝে জীবনে বিরক্ত হওয়ার জন্য কারো উপস্থিতি প্রয়োজন। দুই ক্ষেতের মাঝের পাকা রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটছে। আকাশে এক ঝাঁক পাখি উড়ছে। ক্ষেতের ওপর দু একটি ঘাসফড়িং দেখা যাচ্ছে। তাপমাত্রা এখনো বেশ স্বাভাবিক। গরম বাতাস অনুভব করা যাচ্ছে না। ঠান্ডা বাতাস চোখে মুখে আছড়ে পড়ছে। নন্দিতার আরামে ঘুম চলে আসছে। বাসের কন্ট্রেকটর এখনো ভাড়া তুলতে আসে নি। সেজন্য নন্দিতা জেগে আছে। দেখা যাবে যখনি সে একটু ঘুমের মতো আসবে বাস কন্ট্রেকটর এসে টাকা চাবে। আগে যখন ভার্সিটি থেকে গ্রামে যাতায়াত করতো এমনি হতো। মাস্টার্স পরীক্ষার সময় নন্দিতা বিবাহিত। তখন রেহালের গাড়ি নিয়েই ক্লাস করতে যেতো।নন্দিতা যখন ভার্সিটি প্রথম বর্ষের ছাত্রী সেবছর রেহাল গ্র‍্যাজুয়েশন শেষ করে বের হয়ে যাবে। ফ্রেশারদের ধরে ধরে র‍্যাগ দেওয়া ভার্সিটির সিনিয়দের পুরোনো প্রথা। সেই প্রথা পালন করতে গিয়ে নন্দিতার সাথে পরিচয়। পরিচয় থেকে প্রেম। রেহাল ভার্সিটি শেষ করে ব্যবসার হাল ধরলো। ব্যবসা সামলানোর ফাঁকে মাস্টার্স কমপ্লিট করলো। পোস্ট গ্র‍্যাজুয়েট হওয়ার দ্বিতীয় বছর নন্দিতাকে ঘরের বউ করে তুললো। দুই পরিবারের কোনো অসম্মতি ছিলো না। তারা খুশিমনে এই বিয়েতে রাজী হয়ে যায়। রেহালের মা এখন অনেক আফসোস করেন। বিয়ের চার বছর হয়ে যাবে অথচ ঘরের বউ বংশের আলো জ্বালাতে পারবে না একথা জানলে তিনি কখনোই এই বিয়েতে মত দিতেন না।
বাসের দুলুনিতে নন্দিতার ঝিমুনি এসে গেলো। কন্ট্রেকটারের ডাকে ভেঙ্গে গেলো।
“আপা ভাড়া।”
নন্দিতা কন্ট্রেকটরকে ভাড়া দিয়ে দিলো। বাসের যাত্রীসংখ্যা কম। তার পাশের সীট খালি পড়ে আছে। রাস্তার থেকে নতুন যাত্রী তুলবে বলে মনে হচ্ছে না। পিছের বাচ্চাটির কোনো আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। হয়তো ঘুমিয়ে গিয়েছে। নন্দিতাও ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নিলো। তার মনে হচ্ছে ঘুম থেকে উঠেই সে দেখবে ঢাকা পৌঁছে গেছে।
(চলবে)

. #মেঘের_বিপরীতে
পর্বঃ ১৮
নন্দিতাদের এপার্টমেন্ট দশ তলার। তারা থাকে দুই তলায়। রেহালের ইচ্ছে ছিলো ছয় তলার ফ্ল্যাটটা কিনবে। ঘরে মুক্ত বাতাস প্রবেশ করবে। পোকা মাকড়ের জ্বালাতন সহ্য করতে হবে না। বিশেষ করে মশার উপদ্রব কমে যাবে। পূর্ণিমা রাতে চাঁদের আলোয় প্রতিটি ঘর আলোকিত হয়ে যাবে। কিন্তু নন্দিতার জন্য কেনা সম্ভব হয় নি। তারা যেদিন ফ্ল্যাট দেখতে এসেছিলো ছয়তলার বারান্দা দিয়ে নিচে উঁকি দিতেই মেয়েটা মাথা ঘুরে পরে গেলো। রেহাল ব্যস্ত হয়ে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ডাক্তার বললো,
“আপনার স্ত্রীর ফোবিয়া আছে।”
“কি ফোবিয়া?”
“এক্রোফোবিয়া। সহজ বাংলায় উচ্চতাভীতি। এই ফোবিয়াতে আক্রান্ত রোগীরা উঁচু জায়গায় দাঁড়ালে মাথা ঘুরে পরে যায়। ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। আমি কিছু ওষুধ প্রেসক্রাইব করে দিচ্ছি। নিয়মিত খাওয়াবেন। রোগীর মুখে শুনলাম, আপনারা ফ্ল্যাট দেখতে গিয়েছিলেন। আপাতত দুই তলার উর্ধ্বে কোনো ফ্ল্যাট কিনতে যাবেন না। রোগীর জন্য সিড়ি দিয়ে উঠা নামায় সমস্যা হবে। মাথা ঘুরে পরে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে।”

ছয় তলার ফ্ল্যাটটা আর কেনা হয় নি। নন্দিতার একটু মন খারাপ হয়েছিলো। আকাশ তার ভীষণ পচ্ছন্দ। ছয় তলার বারান্দা থেকে আকাশ কত কাছে বলে মনে হতো! দুই তলার বারান্দা থেকে আকাশ এতটা কাছে বলে মনে হয় না। হাত বাড়ালেই স্পর্শ করা যাবে এমন অনুভূতি হয় না।

নন্দিতা চাবি ঢুকিয়ে দরজার লক খুললো কিন্তু হাতল ঘুরিয়ে ঘরে ঢুকে গেলো না। দূরে নাম না জানা এক পাখি ডাকছে। সে চুপ করে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পাখির ডাক শুনতে লাগলো। এমন সময় ঘট করে শব্দ হলো। নন্দিতা দেখলো পাশের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ হাসি হাসি। নন্দিতা কি বলবে খুঁজে পেলো না। ভদ্রমহিলা নিজের থেকেই বলা শুরু করলো।
“আপনি এই ফ্ল্যাটের মালিক?”
নন্দিতা বললো, “জ্বি।”
“তাহলে তো আপনি আমার প্রতিবেশী! আমরা গতকাল সকালে ফ্ল্যাটে উঠলাম। নুফজার আব্বু ফ্ল্যাট দেখেই কিনে ফেললো। এত পচ্ছন্দ হয়েছে তার। অবশ্য বিকালে কয়েকবার আপনাদের কলিং বেল বাজিয়েছিলাম। কেউ দরজা খুললো না।”
“আমি বাবার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম কয়েকদিনের জন্য। সেজন্য আর কি।”
“আপনি একাই থাকেন?”
“না। আমি আর আমার হাজবেন্ড থাকি। ও সকালে অফিস চলে যায় একদম রাতে ফিরে।”
ভদ্রমহিলা সব বুঝে ফেলেছেন এমন ভাবে মাথা নাড়লেন। হঠাৎ কোথা থেকে একটি পিচ্চি মেয়ে মহিলার সামনে এসে দাঁড়ালো। মহিলা হেসে বললো,
“আমার মেয়ে নুফজা।”

নন্দিতা মেয়েটির দিকে ভালো করে তাঁকালো। বয়স কত হবে? চার অথবা পাঁচ। ধবধবে ফর্সা। পাতলা চুলে দুটো বেণী গাঁথা। চোখ দুটো বড় বড়। লাল রঙের ফ্রক পরে আছে। এই মেয়ের নাম নুফজা না হয়ে অন্য কিছু হওয়া উচিত ছিলো। কি হওয়া উচিত ছিলো নন্দিতা ভেবে পাচ্ছে না। সে মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“আপা ভেতোরে আসেন।”
“আপনি মাত্র বাইরে থেকে আসলেন।”
“সমস্যা নেই আসেন। এক কাপ চা খেয়ে যান।”
মহিলা কিছুক্ষণ চুপ করে কি যেনো ভাবলো। তারপর সম্মতি জানালো। নন্দিতা দরজার হাতল ঘুরিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো। মহিলা তার মেয়েকে নিয়ে তার পিছে পিছে ঘরে ঢুকলো। নন্দিতা ড্রইং রুমের লাইট জ্বালালো। ফ্যান ছাড়লো। ঘর সে যেভাবে গুছিয়ে রেখে গিয়েছিলো ঠিক তেমনি আছে। রেহালের বাচ্চাদের মতো ঘর এলোমেলো করার স্বভাব আছে। গতবার বাবার বাড়ি থেকে ফেরার পর সারাদিন শুধু ঘর গোছাতে হয়েছে। এত বাজে অবস্থা করে রেখেছিলো। এবার তেমন কিছুই হয়নি। ভদ্রমহিলাকে বসতে বলে নন্দিতা রান্নাঘরে গেলো। চুলা জ্বালিয়ে চায়ের পাতিল বসালো। দুকাপ চা বানিয়ে ফিরে এলো। মহিলা চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বললো,
“এতো কথা হয়ে গেলো কিন্তু আপনার নাম জানা হলো না।”
“আমি নন্দিতা।”
“আমার নাম মিনু। ওর আব্বার নাম আফজাল।মেয়ের নাম নুফজা। আমাদের বাচ্চার নাম আমার আর ওর আব্বার নাম মিলিয়ে রাখা হয়েছে। মিনু এর ‘নু’ আফজাল এর ‘ফজা’ নুফজা।”

একথা বলে মহিলাটি হাসতে লাগলো। কি সুন্দর সহজ ভাবে কথা বলছে। তাকে দেখেই বোঝা যায় মনে কোনো কষ্ট নেই। বর বাচ্চা নিয়ে সে সুখেই আছে! নুফজা একবার মায়ের দিকে কৌতূহলী চোখে তাঁকাচ্ছে আরেকবার নন্দিতার দিকে তাঁকাচ্ছে। নন্দিতার বাচ্চাটিকে অনেক গুলো চকলেট কিনে দিতে ইচ্ছে করছে। সে যদি জানতো বাসায় এসে পরীর মতো ফুটফুটে একটি বাচ্চার সাথে তার দেখা হবে, বাস থেকে নেমেই অনেকগুলো চকলেট কিনে ফেলতো।

“জানেন আপা? নুফজা আমাদের বড় আদরের।বিয়ের এক বছর পর থেকে চেষ্টা করছিলাম একটা বাচ্চা নেওয়ার! কত ডাক্তার, কবিরাজ দেখালাম কাজ হলো না। কারো কোনো সমস্যা নাই। তাও বাচ্চা হয় না। আমার শাশুড়ি অনেক ভালো মানুষ। তিনি সবসময় বলতেন নিরাশ না হতে। তার কথায় সাহস পেতাম। নুফজার আব্বুও আমাকে অনেক ভালোবাসে। তিনি সবসময় আমাকে বুঝাতো। বাচ্চা না হলেও তিনি আমাকে ভালোবাসেন একথা সবসময় বিশ্বাস করাতে চাইতো। বিয়ের আট বছর পর আমার ঘর আলো করে ‘নুফজা’ আসলো।”
“আট বছর!”
“জ্বি আপা। নুফজা যেদিন হলো ওর আব্বা পুরো হসপিটালে মিষ্টি বিলিয়েছিলো। কিন্তু তখনো জানতাম না ওর একটা সমস্যা আছে।”
নন্দিতা অবাক হয়ে বললো,
“কি সমস্যা?”
“ও কথা বলতে পারে না। কানেও শোনে না।”

নন্দিতার মাথায় কেউ যেনো কোনো ধাতব পদার্থ দিয়ে আঘাত করেছে। তার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। সে নুফজার দিকে তাঁকিয়ে পাথরের মতো বসে রইলো। মিনু বললো,
“সবাই ওকে প্রতিবন্ধী বলে। কিন্তু আমি বলি না। আমার মেয়ে অনেক সুন্দর আর্ট করতে পারে। আমার বিশ্বাস ও বড় হয়ে অনেক ভালো একজন আর্টিস্ট হবে।”

নন্দিতার দম আটকে আসলো। সে বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছে। গলা চেপে আসছে। ছোট্ট মেয়েটার কি মনে হলো কে জানে? সে ফিঁক করে হেসে ফেললো। সামনের একটি দাঁত নেই। দুধ দাঁত পরতে শুরু করেছে। কি সুন্দর লাগছে দেখতে! নন্দিতা নুফজার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে থেকে বললো,
“অবশ্যই হবে। আপনার মেয়ে একদিন অনেক বড় আর্স্টিস্ট হবে।”
মিনু হাসলো। চায়ের কাপ রেখে বললো,
“আপা। আমি যাই। নুফজার আব্বু দুপুরে বাসায়
খায়। রান্না চড়াতে হবে। আরেকদিন বেশি সময়
নিয়ে আসবো। অনেক গল্প করবো।”নন্দিতার নিজেরও অনেক কাজ বাকি। রান্না করতে হবে
ঘরটা একটু সাজাতে হবে।
সে বললো, “ঠিকাছে।”

মিনুকে দেখে নন্দিতার দুঃখী মানুষ বলে মনে হয়নি। কিন্তু তার সুখের আড়ালেও কত কষ্টের বসবাস! আসলে কোনো মানুষই প্রকৃত সুখী নয়। কিন্তু সবাই নিজেদের অবস্থানে দাঁড়িয়ে মনে করে অপরজন কি সুখেই না আছে!
হয়তো সেজন্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাঁকুর বলেছেন_
“নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস, ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস। নদীর ওপার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে; কহে, যাহা কিছু সুখ সকলি ওপারে। ”
নুফজা মায়ের হাত ধরে গুটগুট করে এগিয়ে যাচ্ছে। দরজার সামনে যেতেই সে একবার নন্দিতার দিকে ঘুরে দেখলো। তারপর আবার সামনে তাঁকিয়ে মায়ের সাথে ঘরে ঢুকে গেলো। নুফজার জন্য সুন্দর একটি নাম নন্দিতার মাথায় এসেছে। মায়াবিনী। মেয়েটার চোখে মুখে মায়া। আর ঠিক এখানেই ‘মায়াবিনী’ নামকরণের স্বার্থকতা।
(চলবে)
লিখাঃ #আতিয়া_আদিবা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here