হাতের মাঝে জলন্ত সিগারেট চেপে ধরাতে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল রাই।সাথে সাথেই রাই এর সামনে দাড়িয়ে থাকা মানুষটা তার শক্ত হাত দিয়ে রাই এর মুখ চেপে ধরে রক্ত চোখ করে রাই এর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল……
—হুস….!ডোন্ট সাউন্ড পাখি।বাসায় তো আরো লোকজন আছে।তারা শুনলে কি ভাববে বল?তুমি কি চাও তাদের সামনে আমি আমার রুপে আসি?ভেবে দেখো তাহলে সেটা কিন্তু তোমার জন্যই ক্ষতিকর হবে বেশি।
সামনের লোকটার এমন ফিসফিস কন্ঠের কথা শুনে রাই নিজের হাতের ব্যাথার কথা ভুলে ভয়ে কাপতে লাগল।রাই এর চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ দেখে সামনের লোকটা বাকা হেসে শীতল কন্ঠে বলল……
—এখন ভয় পাচ্ছো কেন পাখি?ভয়ের কাজ করার আগে মনে ছিলো না?কোন সাহসে তুমি অন্য ছেলেদের হাত ধরেছো?ছেলেদের হাত ধরার আগে মনে ছিলো না আমার কানে কথাটা পৌঁছলে আমি তোমার কি হাল করতে পারি?
কথাটা বলেই চোখ-মুখ শক্ত করে লোকটা রাই এর দিকে তাকালো।লোকটার কথার প্রতি উওরে রাই চুপ করে থেকে নিরবে চোখের জল ফেলছে।রাই কোন কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। রাই কে চুপ করে কান্না করতে দেখে লোকটা চেচিয়ে বলল…..
—কান্না বন্ধ করে কথার উওর দে।তোর ঐ ন্যাকা কান্না আমার মন গলাতে পারবে না।তোর ঐ কান্না দেখলে আমার রাগ আরো দাঊ দাঊ করে বেড়ে যায়।তুই জানিস তুই আমার সম্পত্তি তার পরেও তুই কিভাবে অন্য ছেলেদের হাত ধরে ঢলাঢলি করিস।উওর দে?
শেষের কথাটা লোকটা পাশে থাকা ফুলদানিতে লাথি মেরে বলল।সাথে সাথে ফুলদানিটা নিচে পরে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো।
তাতেই যেন রাই ভয়ে আরো কেপে উঠল।রাই কাপা কাপা গলায় বলল….
—আ-আমি কি-কিছু ক-করি নি।ঐ লো-লোকটাই…….।
আর কিছু বলার আগে সামনের লোকটা রাই এর গাল চেপে ধরে চেচিয়ে বলল…….
—তুই কিচ্ছু করিসনি না।এমনিতেই ঐ ছেলেটা তোর হাত ধরেছিলো?আমার সামনে দাড়িয়ে আমার সাথে মিথ্যে বলতে তোর মুখ কাঁপলো না?যেই মুখ দিয়ে মিথ্যে বলার সাহস দেখিয়েছি সেই মুখ আমি আজকে……।
আর কিছু বলার আগেই সামনে থেকে দিপা বেগম এর চিন্তিত কন্ঠে ভেসে এল…..
—কি হয়েছে ফাহাদ বাবা?এতো উওেজিত হচ্ছিস কেন?
দিপা বেগম এর কথা শুনে ফাহাদ,রাই এর গাল ছেড়ে দিয়ে তার দিকে রাগি চোখে তাকালো।দাতে দাত চেপে রাগি গলায় বলল……
—জানো না আমি আমার কথার মাঝে কথা বলা পছন্দ করি না।
কথাটা বলেই সজোরে দেয়ালে এক লাথি মেরে দাড়িয়ে ফোসতে লাগলো।ফাহাদের ব্যবহারে দিপা বেগম ভয়ে শুকনো ঢোক গিলে ফাহাদ এর পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে নরম গলায় বলল…….
—কি হয়েছে আমার বাবার?এমন করছে কেন আমার বাবাটা?ফুপির ভুল হয়ে গেছে বাবা।ফুপি সরি বলছে।আমার বাবাটা কি তার ফুপিকে ক্ষমা করবে না।সে কি তার ফুপিকে বলবে না তার কি হয়েছে?
দিপা বেগম এর কথায় ফাহাদ কিছুটা দমে গেলো।কিছুক্ষন সাপের মত ফোস ফোস করে লম্বা কয়েকটা নিশ্বাস ফেলে রাই এর দিকে রক্ত চক্ষু করে তাকিয়ে রাগি গলায় নালিশের শুরে বলল……
—আমাকে জিগ্যেস করছো কেন ফুপি?তোমার এই আদরের দুলালি মেয়েকে জিগ্যেস করো কি করেছে ও।ইচ্ছে তো করছে একে এখানেই জ্যান্ত পুতে ফেলি।
ফাহাদ এর কথা শুনে দিপা বেগম রাই এর দিকে তাকিয়ে কর্কশ গলায় বলল……
—কিরে পোড়া মুখি!কি করেছিস তুই?
রাই দিপা বেগম এর দিকে অস্রুভেজা নয়নে তাকিয়ে বলল…….
—কাকিমা আমি কিছু করিনি।ফাহাদ ভাইয়া শু……।
আর কিছু বলার আগেই দিপা বেগম রাইকে ধমক দিয়ে বলল…….
—চুপ কর তুই।আমি তোর কোন কথাই শুনতে চাই না।তোর ভূলের সাফাই আমার কাছে গাইতে হবে না।তুই এখনি ফাহাদ বাবার কাছে মাফ চেয়ে বল যেই ভূলই করেছিস না কেন দ্বিতীয় বার আর করবি না।
দিপা বেগম এর কথা শুনে রাই মনে মনে তাচ্ছিল্য হাসতে লাগল।এসব তার কাছে নতুন না।দোষ না করলেও রাই তার কাকিমার কাছে সব সময়ই দোষী।রাই নিচের দিকে তাকিয়ে নিরবে কান্না করছে।রাইকে চুপ করে থাকতে দেখে দিপা বেগম ধমক দিয়ে বলল…….
—কিরে চুপ করে দাড়িয়ে রয়েছিস কেন?কথা কানে যায় না।মাফ চা ফাহাদ বাবার কাছে।
রাই কাপাকাপা গলায় বলল……
—ভূল হয়ে গেছে আর হবে না।
ফাহাদ চেচিয়ে বলল……
—ভূল মাই ফুট।আজকাল খুব ঊড়ে বেড়াচ্ছিস তুই।ভার্সিটিতে পড়তে দেওয়াতে পাখা গজিয়ে গেছে তোর তাই না।তোর পাখা কেটে কিভাবে ঊড়া বন্ধ করতে হয় তা আমার খুব ভালো করেই জানা আছে।লাগবে না তোর পড়াশুনা করা।আজ থেকে তোর বাসার বাহিরে পা রাখা বন্ধ।ফুপিইইই!(দিপা বেগমকে উদ্দেশ্য করে)বিয়ের ব্যবস্থা কর।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি একে আমার খাচায় বন্দি করতে চাই।
কথাটা বলে রাই এর দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গটগট করে ফাহাদ হেটে চলে গেলো।ফাহাদ এর পিছু পিছু দিপা বেগমও ও সেখান থেকে চলে গেলো।
রাই এতোক্ষন নিজেকে শক্ত করে দাড় করিয়ে রাখতে পারলেও তারা রুম থেকে বের হতেই রাই ধপ করে বসে পরল।নিজের পোড়া হাতের দিতে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলতে লাগল।হাতের মধ্যে ভীষন জ্বালাপোড়া করছে।তার থেকে বেশি মনের মধ্যে রক্তক্ষরন হচ্ছে।কি থেকে কি হয়ে গেলো রাই নিজেও বুঝতে পারছে না।
ফ্লাসব্যাকঃ…….
ক্লাশরুমে তাড়াহুড়ো করে ঢুকতে নিয়ে হাতের ব্যাগে টান অনুভব করতেই দাড়িয়ে গেলো রাই।ঘাড় ঘুড়িয়ে পিছন দিকে তাকাতেই রাই এর চোখ বড় বড় হয়ে গেলো।কেননা একটা ছেলে রাই এর ব্যাগ পিছন থেকে টেনে ধরে দাড়িয়ে রয়েছে।রাই মাথা উচু করে ছেলেটার চেহারারার দিকে তাকাতেই রাই চমকে উঠল।সাথে সাথে মনের মধ্যে ভয় এসে ভিড় জমালো।রাই আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে নিল ফাহাদের লোকেরা কেউ আছে কিনা।যদি কেউ রাই কে অন্য ছেলের সাথে কথা বলতে দেখে আর সেটা যদি ফাহাদের কানে যায় তাহলে রাই এর খবর আছে।রাই কাপাকাপা গলায় বলল…….
—আ-আমার ব্যাগ ছাড়ুন।
ছেলেটা রাইকে মুচকি একটা হাসি উপহার দিয়ে বলল…….
—এই যে মিসঃ! তুমি কি সব সময়ই তাড়াহুড়োতে থাকো?না মানে কালকে তাড়াহুড়ো করে হাটতে গিয়ে আমার সাথে ধাক্কা লেগে পরে যেতে নিলে।ভাগ্যিস আমি হিরোর মত তোমায় হাত ধরে বাচিয়ে ছিলাম।তা না হলে তো তোমায় আজ ভার্সিটিতে আসতে হত না।ভাঙা কোমর নিয়ে হাসপাতালে বেডে পরে থাকতে হত।তার জন্য তো একটা ধন্যবাদ পাওনা আছি আমি।কাল তো অকৃতজ্ঞ এর মত ধন্যবাদ না দিয়েই পালিয়েছ।আজ অন্তত মিষ্টি করে একটা ধন্যবাদ দিয়ে দাও।
ছেলেটার কথা শুনে রাই এর চোখ চড়ক গাছে।রাই গোল গোল চোখ করে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইল।কালকে যেই ছেলে ইচ্ছে করে এসে রাই কে ধাক্কা দিয়ে মহান হতে হাত ধরে নিচে পরা থেকে বাচিয়েছে।সেই ছেলেই আজ রাই এর সামনে এসে যেচে পরে রাই এর কাছ থেকে ধন্যবাদ শুনতে চাচ্ছে।আগের রাই হলে এতোক্ষনে সে ছেলেটাকে কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে দিত।কিন্তু রাই এর এখন কোন ধরনের ঝামেলাই পছন্দ না।তাছাড়া কাল ফাহাদ ভার্সিটিতে ছিলো না।কাল তো নিজের আর ছেলেটার ভাগ্য ভালো ছিলো বলে দুজনই ফাহাদ এর হাত থেকে বেচেছে।কিন্তু আজ তো ফাহাদ ভার্সিটিতে আছে।ভাগ্য কি আর প্রতিদিন বাঘ এর মুখ থেকে বাচাতে সাহায্য করবে?রাই ছেলেটার হাত থেকে ব্যাগ ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল……
—ব্যাগ ছাড়ুন আমার ক্লাসে দেড়ি হয়ে যাচ্ছে।
—ধন্যবাদ না দিলে তো ব্যাগ ছাড়ছি না।আগে মিষ্টি করে একটা ধন্যবাদ দাও তার পরে না হয় ব্যাগ ছেড়ে দিব।
ঝড়ের গতিতে ফাহাদ রাই এর সামনে এসে ছেলেটার হাত রাই এর ব্যাগ থেকে ছাড়িয়ে তীক্ষ্ণ চোখে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে দাতে দাত চেপে বলল……
—ধন্যবাদ টা না হয় আমিই দেই চলবে?
ফাহাদ এর কাজে ছেলেটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।ছেলেটা ফাহাদ এর হাত থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল……
—কে আপনি?এটা কোন ধরনের অসভ্যতা?এভাবে আমার হাত ধরে রেখেছেন কেন?
ছেলেটার কথা শুনে ফাহাদ অট্টহাসিতে ফেটে পরল।সাথে থাকা তার লোকদের উদ্দেশ্য করে বলল…….
—আরে দেখনা ভদ্র মানুষ আমাকে সভ্যতা শেখাচ্ছে।তা ভদ্র মানুষ অচেনা মেয়েদের ব্যাগ ধরে টানাটানি করা এটা কোন ধরনের সভ্যতা বলবেন প্লিজ।
ফাহাদ এর কথা শুনে ছেলেটি কাচুমাচু করতে লাগল।ফাহাদ ছেলেটির ভীত চেহারা দেখে বাকা একটা হাসি দিয়ে ছেলেটির কলার ঠিক করে দিতে দিতে ফিসফিস করে বলল…….
—যার দিকে হাত বাড়ানোর চেষ্টা করেছিস না সে আমার সম্পত্তি।আমার জিনিস কেউ চোখ তুলে তাকালেই তার চোখ আমি তুলে দেই।এবার বোঝ তুই হাত বাড়ানোর চেষ্টা করেছিস তোর কি হাল করবো আমি।
ফাহাদ এর ঠান্ডা আওয়াজের থ্রেট খেয়ে ছেলেটি শুকনো ঢোক গিলে কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই ফাহাদ নিজের ঠোটে হাত রেখে বলল…….
—হুস!এখানে কোন কথা না।যা বলার পরে আরাম করে বলবে।দেখোনা সেই কখন থেকে আমার পাখিটা দাড়িয়ে রয়েছে।আগে আমার পাখিটাকে একটু খাতির দারি করে নেই।তার পরে না হয় তোমার কথা শুনবো।কি বল পাখি?(রাই এর দিকে তাকিয়ে চোখ মেরে)
ফাহাদ এর কাজে রাই ভয়ে মৃদু কাপতে লাগল।এই ইডিয়েট ছেলের জন্য যে তার কপালে যে আজ শনি আছে তা তার বুঝতে আর বাকি নেই।রাই কিছু বলার আগেই ফাহাদ রাই এর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো।ফাহাদ এর চোখ অসম্ভব লাল হয়ে রয়েছে।মনে হচ্ছে ফাহাদ চোখ দিয়েই রাই কে ভস্ম করে দিবে।ফাহাদ তার লোকদের চোখের ইশারায় ছেলেটাকে দেখিয়ে কোন কথা না বলে রাই এর হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যেতে লাগল।
বতর্মানেঃ
সব মনে হতেই রাই ডুকরে কেদে উঠল।
রাই কান্নারত অবস্থায় বিরবির করে বলতে লাগল……..
—আম্মু,আব্বু কেন চলে গেলে তোমরা?কেন আমায় এই বিশাল পৃথিবীতে একা রেখে চলে গেলে?তোমাদের ছাড়া তোমাদের প্রিন্সেস ভালো নেই একটুও ভালো নেই।আমাকে তোমাদের কাছে নিয়ে যাও আম্মু,আব্বু।আমার তোমাদের ছাড়া একা থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে।
রাই এর পুরো নাম রাইজা ইসলাম।সবাই ছোট করে রাই বলে ডাকে।রাই এর বাবা,মা দু’বছর আগে রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে।তার পর থেকে রাই তার চাচা, চাচির কাছেই থাকে।রাই এর চাচা রাহিম ইসলাম ব্যাস্ত মানুষ।সারাদিন নিজের ব্যবসা এর পিছনে খাটাখাটনি করেই তার দিন কাটে।অনেক রাতে বাসায় আসে আবার খুব ভোরে বাসা থেকে বের হয়ে যায়।যার কারনে রাই এর সাথে সময় করে ভালো মত দুটো কথাও বলতে পারে না।দিপা বেগম কে রাই এর দ্বায়ীত্ব বুঝিয়ে দিয়ে সে নিজের কাজেই মগ্ন হয়ে থাকে।
_______
বউ সেজে নিজের রুমে বসে রয়েছে রাই।না চাইতেও চোখ দিয়ে গড়িয়ে পরছে নোনা জল।পৃথিবীতে নিজেকে এখন সব থেকে অসহায় মানুষ মনে হচ্ছে তার।রাই এর কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে।চিৎকার করে কান্না করে নিজের কষ্টটা কিছুটা হালকা করতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু সে পারছেনা।কেননা এখানে তার কান্না দেখার মত কেউ নেই।আজ রাই আর ফাহাদ এর বিয়ে।রাই হাজার চেষ্টা করেও না বিয়েটা আটকাতে পেরেছে আর না এখান থেকে পালানোর কোন রাস্তা পেয়েছে।হঠাৎ লোড শোডিৎ হতেই একজন রাই এর রুমের মধ্যে ধরফরিয়ে প্রবেশ করে।অন্ধকারে রুমে কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে রাই কিছুটা ঘাবরে গেলো।ভীত কন্ঠে বলে উঠল…….
—ক-কে?
সাথে সাথেই অন্ধকার রুমের মধ্যে রাই এর কানে ভাড়ি কন্ঠে ভেসে এল…….
—রাই মা তুই এই বিয়েটা করিস না।নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরে নিজের সর্বনাশ করিস না।তুই এখান থেকে পালা মা।এখান থেকে পালা।
#চলবে?
#মেঘের_ভেলায়_চড়ে
#Ariyana_Nur
#Part_01
(ভূলক্রটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।ধন্যবাদ)