#মেঘ_পরশে_বর্ষণ
মোর্শেদা হোসেন রুবি
৫||
অফিসে আসতে আজ একটু দেরীই হয়ে গেছে মেঘার। আরশ সাত সকালে উঠেই আজ এমন জেদ শুরু করে দিয়েছিল যে বলার নয়। কিছুতেই ছাড়ছিল না মেঘাকে। শেষ পর্যন্ত আম্মার কোলে ওকে দিয়ে একরকম লুকিয়েই বের হতে হয়েছে। কিন্তু অফিসে এসেও শান্তি পাচ্ছে না। যতবারই ওর কান্নারত চেহারাটা মনে পড়ছে ততবারই বুকটা মুচড়ে উঠছে ওর। কিন্তু মেঘা জানে বললেই ছুটি মিলবে না। তাছাড়া ওর এবারের ইমিডিয়েট বসটা সাংঘাতিক রাগী। মেঘার আজকাল খুব ইচ্ছে করে চাকরীটা ছেড়ে দিতে। বাচ্চাটার এত কষ্ট সহ্য হয়না। সারাদিন ওকে খোঁজে। আজ তো শরীরটাই খারাপ।
একেকবার ভাবে অনলাইন বিজনেস করবে। আজকাল মেয়েরা অনলাইনে কত সুন্দর ব্যবসা বাণিজ্য করছে। মেঘাও যদি সেরকম কিছু জমাতে পারত তাহলে কতইনা ভাল হতো। এমনিতে তো বাসা ভাড়া লাগেনা ওর। আরশকে নিয়ে চলার মত যৎসামান্য কিছু হলেই চাকরীটা ছেড়ে দিত মেঘা। এই অফিসটায় কাজ করে শান্তি নেই। এরা বেতন দেবে ঘুরিয়ে। অথচ কাজ এমন করে করাবে যেন চাকুরেরা তাদের মাথা বেচে দিয়েছে এদের কাছে। খুব কষ্ট লাগে কিন্তু উপায় কী।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে তাকাতেই দারুণ সংকুচিত হয়ে গেল মেঘা। আজও ঐ হারামজাদা সামনের টেবিলে এসে বসেছে। এ আরেক উৎপাত। লোকটা মাত্র কিছুদিন হয় বদলি হয়ে এই ডিপার্টমেন্টে এসেছে। মধ্যবয়স্ক হলেও কাপড় চোপড়ে ছোকড়া সাজার চেষ্টাটা বিরক্তিকর। তার উপর তার গায়ে পড়া আচরণ তো আরো অসহ্য। লোকটা যেই না শুনেছে মেঘার স্বামী মারা গেছে সেদিন থেকেই তার আদিখ্যেতা যেন বাড়াবাড়ি রকমের শুরু হয়েছে। ইচ্ছে করে বারবার টেবিলে নক দেবে। এটা সেটা বলে মেঘার মেজাজ বুঝতে চাইবে। মেঘা শত এড়িয়ে গেলেও সে বেহায়ার মত পিছু লেগে থাকবেই। এসব তবু যেমন তেমন ছিল কিন্তু গত দুদিন ধরে সে শুরু করেছে নতুন এক যন্ত্রণা। মেঘার মুখোমুখি তার নিজের টেবিলটা বসিয়েছে সে। তার নাকি এসির বাতাস সহ্য হয়না তাই এসি থেকে দুরে বসবে, এই বাহানা। এরপর থেকেই সে কাজ ফেলে ননস্টপ মেঘার দিকে তাকিয়ে থাকা শুরু করেছে। মেঘা প্রথম দিকে বুঝতে পারেনি। ভেবেছিল হয়ত এমনিই। কিন্তু গতকাল সারাটা দিন যতবার চোখ পড়েছে ততবার দেখেছে লোকটার লোলুপ দৃষ্টি। পলক না ফেলে কেউ এভাবে তাকিয়ে থাকতে পারে এই লোককে না দেখলে মেঘা বিশ্বাস করত না। মেঘার প্রবল ইচ্ছে হচ্ছিল তাকে ধমক দিয়ে কিছু বলে। কিন্তু চেয়ারম্যান স্যারের আত্মীয় সে। বলে আবার কোন ঝামেলা হয় তাই নিরব থেকেছে। বাম হাত কপালের সামনে ধরে একভাবে কাজ করতে গিয়ে ঘাড় ব্যথা হয়ে গেছে ওর।
ফলে আজ ইচ্ছে করেই কালো বোরকা পরে নিকাব করে এসেছে সে। এমনিতে নিকাব করার অভ্যাস ছিলো না মেঘার। আজ থেকেই শুরু করেছে। বেছে বেছে কালো হিজাব পরে নিকাব টেনে মুখটা পুরোপুরি ঢেকে নিয়েছে। একটু অস্বস্তি লাগলেও লোকটার দৃষ্টিশর থেকে বাঁচতে পেরে অনেকটাই স্বস্তি লাগছে এবার। যা হারামজাদা এবার তাকিয়ে দেখতে থাক্, দেখ কত মজা পাস। মনে মনে বলল মেঘা।
কাজের ফাঁকে চারপাশে চোখ বুলানোর ছলে একবার লোকটাকে দেখে নিল সে। তখনই দেখল লোকটা বিরস ভঙ্গিতে ফাইল দেখছে। মেঘা জানে আজ ওকে দেখে চোখের আরাম হবেনা লোকটার। কারণ মেঘার পরণে আজ ফুল কালো হিজাব। তার উপর চোখ ছাড়া কিছুই সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেই শুনল দীপার কণ্ঠস্বর।
-” কী ব্যপার, মেঘা ? এরকম নাক মুখ ঢেকে বসে আছেন কেন ? ”
মেঘা মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল। যা ভেবেছিল তাই। ওর পাশের টেবিলের মেয়েটাই। যার নাম দীপা।
মেঘা ম্লান হেসে বলল, ” শয়তানের কু-দৃষ্টি থেকে বাঁচতে। ”
দীপা সামান্য ঝুঁকল, ” কেস কী বলেন তো ? আপনাকে দেখে তো আমারই গরম লাগছে।কোন শয়তান এটা ? ”
-” পরে বলব। এখন থাক।” বলে মেঘা কাজ করতে লেগে গেল।
পুরোটা দিন একরকম নিকাব পরেই কাজ করল সে। অফিসের অনেকেই বিস্মিত হল। কেউ কেউ হেসে জানতে চাইল। মেঘা এটা সেটা বলে এড়িয়ে গেলেও শেষরক্ষা হলো না। ছুটির আধাঘন্টা আগে সিনিয়র অফিসারের রুমে ডাক পড়ল মেঘার। মেঘা তার রুমে ঢুকলে তিনি বেশ রূঢ় স্বরেই বললেন, ” হোয়াট ইজ অল দিস ননসেন্স মেঘা? ”
-” জি, স্যার ? মানে আমি ঠিক বুঝিনি। ”
-” না বোঝার কী আছে ! এটা কোন ইসলামিক প্রতিষ্ঠান নয় যে আপনি এরকম নাক মুখ ঢেকে অফিস করবেন। পুরো অফিসে আপনি একাই এভাবে আছেন। ব্যপারটা কেমন দেখাচ্ছে ভেবেছেন ? সমস্যা কী আপনার? ”
-” ইয়ে স্যার, মানে….! সর্দি কাশি তো।” বলে হালকা কাশল মেঘা।
-” সেক্ষেত্রে মাস্ক পড়ুন। বি স্মার্ট। এসব কী ? আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে সৌদী থেকে এসেছেন।”
-” স্যার, এটা তো আমাদের রিলিজেন ড্রেস ! ”
-” বাজে তর্ক করবেন না মেঘা। কাল থেকে যেন আপনাকে এভাবে না দেখি। বোরকা পড়ছেন , ওকে। বাট নট নিকাব। জাস্ট মাস্ক ওকে ? ”
মেঘা সামান্য মাথা নেড়ে বেরিয়ে এল। আর তখনই খেল ধাক্কা। অন্যমনস্ক থাকায় খেয়াল করেনি সে। পরমুহূর্তে তাকাতেই টের পেল এ সেই লোকটা। তার মুখোমুখি বসে থাকা অমানুষটা। বেয়াদবটা অত জায়গা থাকতেও ইচ্ছে করে মেঘাকে ধাক্কা দিয়েছে। বাম হাতের বাহুতে তার হাতের ধাক্কা যথেষ্টই ব্যথা দিয়েছে মেঘাকে। এরকম অতর্কিত আক্রমনের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না মেঘা। পড়তে পড়তে বেঁচে গেছে। ডান হাত দিয়ে বাম হাত আঁকড়ে ধরে নিজেকে সামলে দাঁড়াতেই লোকটা হঠাৎ দু হাতে মেঘাকে ধরে বলল, ” ওহ্, স্যরি স্যরি। লেগেছে ? ”
মুহূর্তে সারা গায়ে আগুন ধরে গেল মেঘার। স্থান কাল পাত্র ভুলে গেল। প্রবল চড় কষাল লোকটার গালে। গত তিনদিনের জমানো ক্ষোভ ঢেলে দিল যেন চড়টাতে। পুরো অফিস স্তম্ভিত হয়ে গেল ঘটনাটা দেখে।
======
আরশের শরীরটা আজ বাস্তবিকই খারাপ। সারাটা দিনই ঘ্যান ঘ্যান করেছে বেচারা। কোহিনুর বেগম আজ একরকম হাঁপিয়েই উঠেছেন নাতিকে নিয়ে। বেশ কয়েকবার ঘর বাহির করেও নাতিকে শান্ত করতে পারছেন না তিনি। একবার এই কোল আরেকবার ঐ কোল করে পেরেশান হচ্ছেন তিনি। কিন্তু তারপরেও আরশ থামছেনা। সে আজ সারাক্ষণই ‘আম্মা ” আম্মা’ বলে অবিরাম কেঁদে চলেছে।
এক পর্যায়ে বেশ বিরক্ত হয়েই মোবাইল হাতে নিলেন কোহিনুর। জরুরী প্রয়োজনের কথা ভেবে একটা ছোট্ট বাটন সেট কিনেছিলেন কয়েক মাস আগে। সেটা থেকেই ফোন দিলেন মেঘাকে। কিন্তু বেজে বেজে থেমে গেল ফোনটা। মেঘা রিসিভ করল না। কোহিনূর বেগমের প্রচন্ড রাগ উঠে যাচ্ছে। একদিকে নাতির বিরামহীন কান্না। অপরদিকে সন্ধ্যে পার হয়ে যাবার পরও মেঘার দেখা না পাওয়া তাকে একরকম টেনশনেই ফেলে দিয়েছে। বুড়ো মানুষ তিনি। কোনদিকে যাবেন। ছেলেরাও বাড়ীতে নেই যে কাউকে কিছু বলবেন। আর বলেই বা কী হবে। তারা তো আর বাচ্চাকে ডাক্তারের কাছে নেবেনা। ওর মা’কেই লাগবে। অন্য বৌদের একবার বলেছিলেন বাচ্চাটার কী হয়েছে দেখতে। তারা তিনজনেই এড়িয়ে গেছে। বলে ডাক্তার দেখলে বলতে পারবে।
এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে সেজ ছেলের ঘরে উঁকি দিলেন। সেজ বৌ সবে মাত্র ভাত ঘুম দিয়ে উঠেছে। তাকে মেঘার কথা বলতেই সে বলে ঊঠল, ” আমি কী করব আম্মা। আপনার পুতের বৌ অফিস শেষ করে কই বসে আড্ডা মারতেসে দেখেন গিয়ে।”
কোহিনুর বেগম কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরে চলে এলেন। এমন সময় বেল বাজলে আশান্বিত হয়ে প্রায় ছুটে বেরোলেন ঘর থেকে। আজ অবশ্যই মেঘাকে একটা কঠিন বকা দেবেন তিনি। কী মনে করে সে এত দেরী করল। কিন্তু দরজা ঠেলে বর্ষণকে ঢুকতে দেখে হতাশ হলেন । কিছুটা ভয়ও দানা বাঁধল নতুন করে। মেঘার কোন বিপদ হয়নি তো।
-” আরশ কাঁদছে কেন খালাম্মা? ” বর্ষণ এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিল। এক সেকেন্ড থমকে গিয়ে কী ভেবে হঠাৎ কোনরকম দ্বিধা ছাড়াই আরশকে ওর কোলে দিয়ে দিলেন কোহিনুর। বাচ্চাটা বলতে গেলে আজ সারাদিনই তার কোলে। তার উপর বিগত দুই ঘন্টা যাবৎ একাধারে কাঁদছে। বিরক্ত না হলেও সারা শরীরে খিঁচ ধরে গেছে তার। কোমড় ব্যথা করছে। বুড়ো হাড্ডিতে কত ধকল সহ্য হয়। হয়ত সেকারণেই বর্ষণ চাওয়া মাত্র তার কোলে আরশকে ছেড়ে দিতে দ্বিধা করেন নি কোহিনুর বেগম। আরশ নিজেও কোল বদলের কারণেই হোক বা আরাম পেয়েই হোক ঠান্ডা মেরে গেছে। দাদুর কোলে একটু অস্বস্তিতেই ছিল বেচারা। এখনকার কোলটা বেশ উঁচু আর বড়সড়।
বুকে মাথা রাখতেই সমস্ত সত্তায় যেন এক পিতৃত্বের অনুভূতি খেলে গেল বর্ষণের । বাচ্চাটার মাথায় গাল ঠেকাতেই টের পেল সেটা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ গরম। সাথে সাথেই বলল, ” ওর তো জ্বর এসেছে খালাম্মা।”
-” হ, জ্বরই তো আইসে। এর লেইগাই তো কানতাসে সারাদিন ধইরা। নাইলে নাতি আমার কান্দে না সহজে। ও কান্দইনা পোলা না।”
-” জ্বরের অষুধ দেন নি?” সরাসরি ওর মায়ের কথা জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না বর্ষণের। কোহিনুর বেগম আবার কী না কী মনে করেন কে জানে। কিন্তু কোহিনুর বেগম নিজেই গজগজ করে উঠলেন, ” জ্বরে কুন ওষুদ খাওয়ায় আমি কী জানি। অর মা’য়ের তো অখনো কোন খবর নাই।”
-” ওহ্…!” বলে আর কথা বাড়াল না বর্ষণ। আরশকে কোলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বড় বারান্দার দিকে চলে গেল সে।
বাচ্চাটা আরাম আর দুলুনি পেয়ে বর্ষণের বুকেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে কপালে আলতো চুমু খেল বাচ্চাটার। প্রায় সাথে সাথেই বেল বাজানোর শব্দ পেয়ে বুঝল সম্ভবত বাচ্চার মা চলে এসেছে। তার মিনিট পাঁচেক বাদেই কোহিনুর বেগমের চড়া কণ্ঠ শুনে অবাক হল বর্ষণ। আলাদা করে কান পাততে হলো না। এখান থেকেই স্পষ্ট শোনা যেতে লাগল কথাগুলো। কঠিন সব বাক্যবাণে বিদ্ধ করছেন তিনি আরশের মা’কে। তবে অপরপক্ষের কোন সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। বর্ষণ একবার ভাবল যাবে কী না। পরক্ষণেই চিন্তাটা বাদ দিল। থাক, কেউ না কেউ এসে ঠিকই নিয়ে যাবে বাবুটাকে। হয়ত ওর দাদীই আসবে। ভাবনা শেষ হবার আগেই কোহিনুর বেগমকে দেখা গেল বারান্দার দরজায়। তিনি হাত বাড়ালে কোনোরকম প্রশ্ন না করে আরশকে তার কোলে দিয়ে দিল বর্ষণ। টের পেল বাচ্চাটার গা আগের চেয়ে গরম হয়ে উঠেছে। এদিকে নড়াচড়া টের পেয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেল আরশের। অমনিই শুরু হলো কান্না। কোহিনুর বেগম দ্রুত বাচ্চাটাকে তার মায়ের কাছে নিয়ে গেল। বর্ষণও চুপচাপ চলে এল বড় বোনের ঘরের দিকে ।
সুরমা সবেমাত্র মাগরিবের নামাজ শেষ করে উঠলেন। ভাইকে দেখেই সরু চোখে তাকালেন তিনি। তারপর হাতের জায়নামাজটা ছুঁড়ে ফেলে বললেন, ” তুই কী মনে করে ঐ বাচ্চাটাকে সেধে কোলে নিলি বলতো? ”
-” বাচ্চাটা কাঁদছিল আপা। তাছাড়া ও আমাকে দেখে আমার কোলে নিজেই আসতে চেয়েছিল।”
-” তা তো চাইবেই। এগুলো তো সব মায়ের ট্রেনিং।”
-” কী যে বলো না আপা। অতটুকু বাচ্চা ট্রেনিং এর কী বোঝে ? ”
-” না বুঝুক। কিন্তু তোকে যেন আমি আর ঐ বাচ্চার সাথে আহ্লাদ করতে না দেখি। ওর মা হচ্ছে এক নম্বরের বদ। বাচ্চা আবার কত ভাল হবে।’
-” আপা, তুমি নিজেও জানো না তুমি কী বলছ। তাছাড়া তোমাদের বড়দের এসব ঝামেলায় বাচ্চাটাকে না জড়ানোই ভাল। সে একটা অবুঝ শিশু।”
-” হয়েছে, তোকে আর সাফাই গাইতে হবেনা। এখন বল্, চা খাবি না কফি…!”
-” আইসক্রিম। তোমার ফ্রিজে তো সবসময় আইসক্রিম থাকে। ঐটাই দাও।” বলে ধপ করে নেহালের বিছানায় গড়িয়ে পড়ল বর্ষণ। সুরমা এবার হেসে ফেলল। সে তার ছোট ভাইটার এসব আচরণের সাথে পরিচিত। হুটহাট এসে বলবে আপা এটা বানিয়ে দাও, ওটা বানিয়ে দাও। সুরমা তখন সব ফেলে ভাইয়ের মনমতো পছন্দের খাবারটা প্রস্তুতে লেগে যান।
-” মেয়েটা কেমন দেখলি রে বর্ষণ ? ” র্ফ্রিজ থেকে আইসক্রিম বের করে বাটিতে সার্ভ করতে করতে বললেন সুরমা। নেহাল মোবাইল গেম খেলছিল। বর্ষণ ওর পাশে শুয়ে শুয়ে সেই গেমই দেখছিল মনযোগ দিয়ে ।সুরমা আবার ডাকলেন।
-” এই বর্ষণ ? ” বোনের ডাক শুনে বর্ষণ এবার তাকাল, ” কোন মেয়ে ? ”
-” ঢং করিস না। তোর না আজকে মেয়ে দেখতে যাবার কথা ছিল ? ”
-” ওহ, হ্যাঁ। দেখেছি তো।”
-” পছন্দ হয়েছে ? কেমন রে দেখতে ? ”
-” সিংহী মামী।” বলে এবার নিজেই নেহালের মোবাইল টেনে নিয়ে খেলতে শুরু করে দিল সে। নেহাল মামার কাঁধের ওপর দিয়ে খেলা দেখতে লাগল।
-” সিংহী মামী মানে ? ” সুরমা কাজ থামিয়ে তাকালেন। বর্ষণ জবাব দিল না। আচমকা “হো….! লেভেল পার করেছি।” বলে ডান হাত মুঠো করে শূণ্যে তুললে নেহাল অতি উৎসাহে মামার বুকের উপর চড়ে বসে খেলা দেখতে লেগে গেল।
সুরমা বিরক্ত হয়ে বরলেন, ” আহা, কী শুরু করেছিস ? এসেই গেম নিয়ে বসলি। নে তোর আইসক্রিম” বলে আইসক্রিমের বাটিটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ” সিংহী মামী বললি কেন মেয়েটাকে। আমি তো ছবি দেখেছি। শুকনা পাতলা সুন্দর।”
বর্ষণ এবার মোবাইল ছেড়ে উঠে বসে বাটি হাতে নিল। এক চামচ আইসক্রিম মুখ পুরে বলল , কমনসেন্সের অভাব।”
-” কেন, কী করেছে সে ? ”
-” কী করেছে শুনবে ? এত্তটুক চেহারার উপর চুলগুলোকে কেশরের মত ফুলিয়ে এসেছে। দেখতে পুরা আজব লাগছিল। মেয়েটার চুলগুলো দেখে ওকে অনেকটা কেশর ফোলানো সিংহের মত লাগছিল। মেজাজটা এত্ত খারাপ হয়েছিল যে বলার না।”
-” এগুলো তোর বিয়ে না করার ধান্ধা ফিকির। আমরা আর তোর জন্য মেয়ে দেখতে পারব না। এই সিংহী মামীরেই তোর বিয়ে করতে হবে।”
-” পাগল হয়েছ আপা ? রাত বিরতে ভয় পেয়ে হার্ট এটাক করব আমি। এরকম চীজ আমি বিয়ে করতে পারব না।”
-” মারব থাপ্পড়। চীজ কী রে? কিরকম বিয়ে করবি তুই? ”
বর্ষণ হেসে উত্তর দেবার আগেই উচ্চস্বরে কান্নার শব্দ পেয়ে চমকে উঠল সে।
-” দেখ তো আপা কী হল ? ”
সুরমা কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ হয়ে শোনার চেষ্টা করল শব্দটা। তারপর মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বললেন, “আরে ঐ পরশের ছেলে কানতেসে। বাদ দে ওসব। তুই আমার কথার জবাব দে…!”
বর্ষণ বোনের কথার জবাব দিতে গিয়েও থেমে গেল। বাইরে মহিলা কণ্ঠের কান্না, বাচ্চার এলোপাতাড়ী চিৎকার সব মিলিয়ে একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি টের পেয়ে তখনই ছুটে বেরোল বর্ষণ। আর তখনই বুঝতে পারল আরশ মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছে। নইলে ওভাবে নেতিয়ে পড়ত না। বাচ্চাটার মা সমানে কাঁদছে। পেছন থেকে তার শ্বাশুড়ীও কাঁদছেন।
-” অরে তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে নেও বৌমা। কত্তডি বমি করল গো বাচ্চাটা। আহারে, আমার নাতিটা এত কষ্ট সহ্য করব কেমনে গো আল্লাহ।”
মেঘাকে দেখা গেল উদভ্রান্তের মত এককাঁধে বাচ্চার ব্যাগ আর অপর কাঁধে বাচ্চাকে নিয়ে মেইন ডোর খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে। বারবার তার কাঁধ খসে ব্যাগটা পড়ে যেতে চাচ্ছে আর সে সামলানোর চেষ্টা করছে। ঐ দিকে বাচ্চাটা মায়ের কাঁধে মাথা রেখে সমানে কাঁদছে। আর সমানে লালা ঝরছে ওর মুখ থেকে। দেখলেই বোঝা যায় মাথা তোলার শক্তি পাচ্ছেনা বাচ্চাটা।
বর্ষণ কয়েক সেকেন্ড থমকে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখল। তারপর আর থাকতে পারল না। ছুটে গিয়ে আরশকে টেনে নিল নিজের কোলে। ঘটনার আকস্মিকতায় বিভ্রান্তের মত বর্ষণকে দেখল মেঘা। তারপরেই প্রবল বাঁধা দিয়ে বাচ্চা নিজের কাছে নিয়ে নিতে চাইল।
-” আরে, পাগলামি করছেন কেন? এখন কী এসব করার সময় ? দেখি ছাড়ুন।” বলে বর্ষণ একরকম ধমক দিয়েই বাচ্চাটা কেড়ে নিল। তারপরেই পায়ে সেন্ডেল গলিয়ে বেরিয়ে গেল বাড়ী থেকে। হতভম্ব সুরমা নিরবে চেয়ে চেয়ে ভাইয়ের যাওয়া দেখল কিন্তু বাঁধা দেবার কোন সুযোগই পেল না।
অসহায় বিপর্যস্ত মেঘার পক্ষেও বর্ষণকে অনুসরণ করা ভিন্ন কোন উপায় রইল না কারণ বর্ষণ ততক্ষণে লম্বা লম্বা পা ফেলে বড় রাস্তার দিকে চলে গেছে।
রিক্সার স্ট্যান্ডে প্রচুর রিক্সা কিন্তু কেউ যাবেনা বলে জানাল। এদিকে মেঘার অবস্থা শোচনীয়। একে তো বাচ্চার অমন বেহাল দশা তারনউপর সুরমা ভাবির চোখের সামনে দিয়ে তার ভাইয়ের সাথে বেরিয়ে এসেছে। এখন কী এক রিক্সায়ও উঠতে হবে ওকে ? হায় আল্লাহ, এ কোন পরীক্ষায় ফেললে তুমি?”
তাকিয়ে দেখল ঐদিকে বর্ষণ বাঁজখাই গলায় চেঁচাচ্ছে, ” যাবিনা মানে ? তর বাপে যাবে। শালার বাচ্চারা চোখে দেখস না রুগী নিয়া দাঁড়ায়া আছি। শালা ধান্ধাবাজের দল। এ্যাই, তুই হুড খোল। নাইলে লাত্থি মাইরা তর রিক্সা ভাঙ্গুম।
বর্ষণের প্রবল ধমকা ধমকিতে দুটো রিক্সা রাজী হল। বর্ষণ মেঘাকে ইশারা করতেই মেঘা সম্বিত ফিরে পেল সে। ওর বুঝতে সময় লাগল যে আসলে দুটো রিক্সা ঠিক করেছে বর্ষণ। মনে মনে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানাল মেঘা। দ্রুত রিক্সাটায় উঠে বসতেই বর্ষণ নিজেও লাফ দিয়ে অপর রিক্সাটাতে উঠে বসল। তার কোলে অর্ধ নেতানো আরশ। বাচ্চাটা এখনও সমানে ওয়াক ওয়াক করছে। হয়ত বমিও করে দিয়েছে। বর্ষণের টি শার্ট মাখামাখি। কিন্তু তার সেদিকে কোনো ভ্রু ক্ষেপ নেই। সে রিক্সাওয়ালাকে ধমক দিয়ে বলল, ” এ্যাই, মহিলার রিক্সা আগে দে। আর তাড়াতাড়ি চালা। কুইক।”
রিক্সায় বসে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল মেঘা। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই দেখল বর্ষণ তার বাচ্চাটাকে আঁকড়ে ধরে বসে আছে। দৃশ্যটা ওর সমস্ত চেতনায় এক বড় সড় ধাক্কা মারল।
চলবে…