মেঘ পরশে বর্ষণ পর্ব ৬

#মেঘ_পরশে_বর্ষণ
মোর্শেদা হোসেন রুবি

৬||
ডাক্তারের রুমে বসে আছে মেঘা। তার চেহারার সমস্ত রক্ত সরে গিয়ে তাতে ফুটে উঠেছে আতঙ্ক। একটু আগেও আরশ বমি করতে করতে কয়েকবার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আঁকড়ে গিয়েছিল। এখন নেবুলাইজ করার পর অর্ধচেতন অবস্থায় নেতিয়ে পড়ে আছে মেঘার কোলে। হা করে শ্বাস নিচ্ছে বাচ্চাটা। সম্ভবত ওর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। মেঘা বুঝতে পারছে না কী করবে। ওর হাত পা পুরো অসাঢ় হয়ে আছে। ডাক্তার আরশকে ইমিডিয়েট হাসপাতালে ভর্তি করাতে বলেছেন। ওর চিকিৎসা রাতের মধ্যেই শুরু করতে হবে। নইলে বড় ধরণের গড়বড় হয়ে যেতে পারে।

কথাটা শোনার পর মেঘার মনে হলো ওর মাথাটা পুরোপুরি খালি হয়ে গেছে। সে কোন কিছুই স্থির ভাবে ভাবতে পারছেনা। ঠান্ডা মাথায় ভাবনা চিন্তা করার মত মন বা মানসিকতা কোনোটাই এ মুহূর্তে নেই ওর। কেবল ভাবছে এসব কীভাবে কী হলো। আর হঠাৎই মনে পড়ল, ওর ব্যাগে খুব বেশী টাকা নেই। গতমাসের বেতন এখনও পায়নি। মাসের আজ নয় তারিখ। অথচ এখনও বেতন পায়নি মেঘা। উপরন্ত আজ অফিসে যে ঘটনাটা ঘটে গেল তারপর বেতন আনতে যাবার ইচ্ছেটাও মরে গেছে। বিকেলের ঐ ঘটনাটার জন্য শো-কজ করা হয়েছে ওকে। অথচ সে দোষী নয়, ভিকটিম ছিল। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ঐ অমানুষটা নিজেকে বাঁচাতে স্ট্যান্ডবাই লিখিত নালিশ করেছে অফিসে। মেঘার এগেইনস্টে বাজে ধরণের অভিযোগ এনে তার সাথে অসম্মানজনক আচরণের জন্য মেঘার পানিশমেন্ট দাবী করেছে সে। তার বক্তব্য ছিল, অফিস যদি এটার সুরাহা না করে তাহলে ধরে নিতে হবে এটা কোন ভদ্রলোকের কাজের পরিবেশ না। তাছাড়া সে একজন ফ্যামিলি পারসন। প্রয়োজনে সে মানহানির মামলা করবে। একটা ফালতু মেয়ে তাকে সামাজিক ভাবে অপদস্থ করবে, এটা সে নাকি কখনই মেনে নেবেনা। তার ভাষ্যমতে মেঘা তাকে ফাঁসাতে না পেরেই অন্যভাবে অপদস্থ করতে চেয়েছে। সে আরো লিখেছে, এসব করেই নাকি মেঘার সংসার চলে। অভিযোগ শুনে মেঘা স্তম্ভিত হয়ে বসেছিল মিনিট দশেক। এদিকে লোকটার ঐসব অভিযোগ মাখা অভিযোগ পত্র পাবার পর অফিস সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টাকে দেখতে শুরু করেছে। এক পর্যায়ে, মেঘার সহকর্মীদের মধ্যস্থতায় বিষয়টি শো-কজের উপর দিয়ে গেছে। সবচে বড় কথা, মেঘা অফিস থেকে বেরোনোর সময় লোকটা পিয়নের মাধ্যমে ইঙ্গিত দিয়েছে যে মেঘা যদি তার প্রস্তাবে রাজী হয় তাহলে সে অভিযোগ উইথ ড্র করে নেবে। নইলে মেঘাকে সে কোর্টে তুলবে। তখন তার সম্মান এমনিতেও চলে যাবে।

মেঘা তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে আর এই অফিসে চাকরী করবে না। যদিও এই চাকরীটা ছাড়া ওর আর কোন আয়ের উৎস নেই। তারপরেও এখানে চাকরী করা ওর পক্ষে আর সম্ভব হবেনা। কিন্তু এখন ভয়টা অন্যখানে। লোকটা সম্ভবত ওর পিছু ছাড়বে না। কারণ সে মেঘাকে মানহানী মামলার ভয় দেখিয়েছে। আর মামলার ক্ষেত্র অলরেডি প্রস্তুত। পুরো অফিস সাক্ষী যে মেঘা তাকে চড় মেরেছে। তাছাড়া পিয়ন লোকটা নাকি নিজেও সাক্ষী দেবে এই বলে যে মেঘা তাকে বাজে প্রস্তাব করেছিল। সব মিলিয়ে আজকের সন্ধ্যাটা নারকীয় কেটেছে মেঘার। একমাত্র দীপাই ছিল যে ওকে বলেছিল, মেঘা যেন ভয় না পায়। সে যেন সমস্যাটা ফেস করে। এভাবেই মেয়েরা পিছিয়ে যায়। কিন্তু এরকম অমানুষের কঠিন শিক্ষা হওয়া উচিত। দীপা নিজেও বলেছে লোকটা আসলেই বদ কিন্তু মেঘা জানে, ঠিক সময়মত দীপাকেও সে পাবেনা। কে যায় নিজের সম্মান ঝুঁকিতে ফেলে পরের ঝামেলায় জড়াতে। তার উপর দীপা অবিবাহিতা। কলঙ্ক রটলে তার নিজের বিয়েই ঝুলে যাবে।

এসব হাঙ্গামা করে বাড়ী ফিরে দেখে তার সোনাবাবুটার এই অবস্থা। মাথাটা ঘুরে উঠেছিল শ্বাশুড়ীর মুখে ওর কথাগুলো শুনে। নিজেকেই অভিশাপ দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল তখন। এটা তো সত্যি যে, গত কয়েকদিনের কাজের চাপে আরশকে ভালমত যত্ন নেয়া হয়নি। তার বাচ্চাটা আজ কয়েকদিন ধরেই নাক টানছিল। মেঘা ভেবেছিল হালকা ঠান্ডা সর্দি হবে। তেমন গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু এখন ডাক্তার বলছে তার ব্রঙ্কো নিউমোনিয়া। মেঘা যেন তাড়াতাড়ি হসপিটালাইজড করে। মেঘা বুঝতে পারছেনা সে কীভাবে কী করবে। অসাঢ় ভঙ্গিতে কেবল জিজ্ঞেস করেছে, ” বাসায় রেখে চিকিৎসা করা যাবে না? ” শুনে ডাক্তার মাথা নেড়েছে।
-” নো ওয়ে। বেবীকে প্রতি দুই ঘন্টা পরপর নেবুলাইজ করতে হবে। তাছাড়া দুইবেলা ইঞ্জেকশান দিতে হবে পাশাপাশি স্যালাইন। এগুলো এসে যেয়ে করতে পারবেনা মেঘা। বাচ্চাটার সার্বক্ষণিক অবজারভেশনের ব্যপারও আছে।
সবশুনে হতভম্ব মেঘা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইরে চলে এসেছে। অবচেতন মনেই বর্ষণকে খুঁজেছে। যার কারণে এখনও বিপদকে বিপদ মনে হয়নি। অথচ এখন ওর খবর নেই। ওকে বসিয়ে রেখে ছেলেটা সেই যে গেছে তাকে আর দেখেনি মেঘা। এরই মধ্যে ডাক্তারের নির্দেশে আরশকে এক দফা নেবুলাইজ করা হয়েছে ইতোমধ্যেই। হয়ত সে কারণেই সে আরাম পেয়ে ঘুমুচ্ছে। মেঘা ঘড়ি দেখল। ঘড়ির কাঁটা এগারটা ছুঁই ছুঁই করছে। রাত বাড়ছে। মেঘা অস্থিরচিত্তে উঠে দাঁড়াতে যাবার মুহূর্তেই দেখল বর্ষণ হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করছে। এসেই ছোঁ মেরে ব্যাগ টান দিয়ে বলল,
-” আসুন। বাইরে গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে।”
-” গাড়ী ? ”
-” হ্যাঁ। এখানে তো ক্যাব পাওয়া যায়না। রাস্তার ঐ মাথা থেকে আনতে হয়েছে। এখন চলুন আর আরশকে আমার কাছে দিন। আপনি ব্যাগ আর ফাইল নিয়ে আসুন।” বলেই মেঘার কোল থেকে আরশকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেল বর্ষণ। মেঘা কেবল মন্ত্রমুগ্ধের মত ওকে অনুসরণ করল। এ আরেক নতুন অস্বস্তি। সম্পূর্ণ আনাকাঙ্খিত একজনের কাছ থেকে সাহায্য নেয়া। সুরমা ভাবির কতগুলো কথা যে পাওনা হয়ে আছে কে জানে।
গাড়ীতে উঠে বসেই মেঘা প্রশ্নটা করল, ” কোথায় যাচ্ছি আমরা? ”
-” ধানমন্ডিতে। ওখানে বাচ্চাদের একটা নার্সিং হোম আছে। প্রেসক্রিপশনে রেফার্ড দেখে ওদের সাথে ফোনে কথা বলে সিট রিজার্ভ করেছি আমি।”
-” ওহ। কিন্তু নার্সিং হোমে তো অনেক খরচ। কোন সরকারী হাসপাতালে ? ”
-” আরশের এখন ইমারজেন্সী ট্রিটমেন্ট দরকার। টাকার দিক ভাবলে ভুল করবেন।” বলেই বর্ষণ ফোন দিল কাউকে। মেঘা চুপচাপ ভাবতে বসে গেল এবার। নিশুতি রাতের নিস্তব্ধতাকে ভেদ করে গাড়ী উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে ধানমন্ডি অভিমুখে। মেঘা চিন্তিত মুখে দাঁতে ঠোঁট কামড়ে ধরল। আঘাতের প্রাথমিক ধাক্কাটা কেটে গেছে। বর্ষণ পুরো কাজটা গুছিয়ে আনায় ভাবনাটা এখন একটা নির্দিষ্ট খাতে প্রবাহিত হবার সুযোগ পেয়েছে। এখন দুটো চিন্তা। যথেষ্ট টাকা আর আরশের সুস্থতা। তারমানে সহজ। টাকা আগে সুস্থতা পরে।

গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল মেঘার। বর্ষণ ফোনে কাউকে বলছে সে একটা জরুরী কাজে আটকে গেছে। সম্ভবত তার বাসার কেউ। বর্ষণের জরুরী কাজটা কী তা সুরমা ভাবির মাধ্যমেই জেনে যাবে তারা। মেঘার হঠাৎ মনে পড়ল আম্মাকে কথাটা জানানো দরকার। তাছাড়া টাকা পয়সা ম্যানেজ করতে হলেও ওর দু’ একটা দিন সময় দরকার। মেঘা ঠিক করেছে সে তার দুই ভরির চেইনটা বিক্রি করে দেবে। তাহলে সে চিকিৎসার প্রয়োজনীয় টাকাটা জোটাতে পারবে। কিন্তু চেইন বিক্রির জন্য ওকে একবার বাসায় যেতে হবে। চেইনটা নিয়ে আবার মার্কেট যেতে হবে। এতোটা সময় তো এখন ওর হাতে নেই। মেঘার প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে কিন্তু জোর করে চেপে রাখতে গিয়ে বুক ব্যথা করছে ওর।
-” এত ভাবছেন কেন। আল্লাহ তো আছেন। আরশের চিকিৎসাটা শুরু হলেই দেখবেন অনেক কিছু ঠিক হয়ে গেছে।”
-” কী ঠিক হবে। সব এলোমেলো হওয়া ধরেছে।” কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল মেঘা। সে জানে বর্ষণ বাইরের একজন মানুষ। তার উপর সুরমা ভাবির আপন ভাই। যাকে নিয়ে মেঘাকে সন্দেহ করে ওর শ্বাশুড়ী। তার উপর গত কয়েকটা দিন ধরে সুরমা ভাবির সাথে ওর যে ঝামেলা চলছে তার মূলেও এই বর্ষণই। তাকে নিজের ঝামেলার কথা বলে কী হবে।
মেঘা বাম হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মুছল। ঢোক গিলে বলল, ” আমার ভাগ্যটা এমন কেন বলতে পারেন? ”

বর্ষণ কোন কথা বললো না। কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে বলল, ” গাড়ীর জানালা দিয়ে একটু বাইরে তাকান। দেখুন, কত সুন্দর দৃশ্য। ওদের ভাগ্য আপনার চেয়ে হয়ত ভাল।”

মেঘা কান্না চেপে বাইরে তাকাল। ভেবেছিল বর্ষণ ওকে শান্ত করার জন্য সুন্দর কিছু দেখাতে চাচ্ছে। কিন্তু বাইরে তাকিয়ে থমকে গেল। ফুটপাথের উপর সারি সারি তাবু টানানো। প্রতিটা তাবুই ছেঁড়া বা তালি দেয়া। কোনটা কাপড়ের কোনটা চটের কোনটা প্লাস্টিকের। তাঁবুগুলোর নিচে হারিকেনের আলোয় দেখা যাচ্ছে জীবনের আরেক প্রতিচ্ছবি। একেকটা তাবু দৈর্ঘে প্রস্থে মোটামুটি পাঁচ থেকে ছয় ফুটের বেশী না। অথচ প্রতিটা তাবুতে তিনচার জন করে লোক বসে আছে। বাচ্চাগুলো ক্লান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে। বড়রা ঘুমাবার আয়োজন করছে। কেউ কেউ টিনের প্লেটে করে ভাত খাচ্ছে। এক অসম্ভব মানবেতর জীবন। অথচ তারা নির্বিকার।
মেঘার দেখা শেষ হলে বর্ষণ বলল, ” কী মনে হয়? আপনার অবস্থা কী এদের চে খারাপ?”
মেঘা মুখ নামিয়ে নিল। মনে মনে ক্ষমা চাইল আল্লাহর কাছে। নিজেকে সান্তনা দেয়া অনেকটা সহজ হল এবার। মুখে বলল, ” স্যরি।”
-“আমাকে না, আল্লাহকে বলুন। আমি ধর্মকর্ম অতটা বুঝিনা তবে আল্লাহর উপর যথেষ্ট আস্থা রাখি।”
মেঘা আর কোন কথা বলল না। বর্ষন এবার ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে গেল।
-” এই ক্লিনিকে একটা সুবিধা কী জানেন ? এখানে মা ও শিশু ছাড়া থার্ড পার্সন এলাউড না। সেকারণেই আমি এটাতে এডমিশন নিয়েছি যেন আপনার জন্য সুবিধা হয়। পরিবেশটাও ভাল। কাল দিনে হয়ত খালাম্মা এসে দেখা করে যাবে কিন্তু রাতে আপনাকে একাই থাকতে হবে। আপনি কাল সকালে অফিসে ফোন করে একটা ছুটি নিয়ে নিলে ভাল করবেন। কারণ এখন তো অফিস করতে পারবেন না।”
-” আমার অফিস নেই ! ” মেঘা দ্রুত বলে উঠলে বর্ষণ থেমে গেল।
-” অফিস নেই মানে ? ছুটি নাকি ? । ”
-” না। ছুটি না। তবে আমি চাকরীটা ছেড়ে দিয়েছি।”

বর্ষণ এবার আর কোন কথা বললো না। সম্পূর্ণ নিরব রইল। হয়ত আশা করছে বাকিটা মেঘাই বলবে। মেঘা কিছুক্ষণ থেমে থেকে অফিসের সমস্যাটা খুলে বলল। কেন বলল সে নিজেও জানেনা। কেবল এটুকু জানে, আপন কাউকে কথাগুলো বলে বুকটা হালকা করা দরকার। গত দুই ঘন্টার মধ্যে বর্ষণ নিজেকে আপনজন বলে প্রমান করে ফেলেছে। এতদিন মেঘা জানতো, এ পৃথিবীতে ওর আপনজন ওর একমাত্র ভাই আর ভাবি। কিন্তু সেই ধারণা আজ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ভাইয়ের মোটেও সময় হয়না ওকে ফোন দেবার। তার কথার ধরণে মনে হয় যেন খুলনা দেশের বাইরে। ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে ছোট বোনের খোঁজখবরের দায়িত্ব সে তার বউয়ের উপর দিয়ে রেখেছে। আর বউ এটাকে স্বামীর পেরেশানির কারণ ভেবে তাকে দুর করে রাখছে। থাক্, রাখুক দুরে। ভাল থাকুক ওরা। মেঘা ওদের ফোন করবে না। কী দরকার ফোন করে। লাভ তো নেই কোনো। ভাবি একশটা অযুহাত খাড়া করবে। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেঘা লঘু স্বরে কয়েক বাক্যে অফিসের সমস্যাটা তুলে ধরল। বর্ষণ নিরবে সব শুনে বলল, ” এটা আসলে এখনকার কমন সমস্যা। বাইরে যেসব মেয়েরা কাজ করছে তাদের অনেক কিছুই কম্প্রোমাইজ করেই কাজ করতে হয়। লোকালয়ে গেলে কিছু ধাক্কা তো খেতেই হবে।”
-” হ্যাঁ। লোকালয়। ঠিকই বলেছেন। কিন্তু আপন আলয়েও তো মেয়েরা খুব একটা নিরাপদে নেই। একে কী বলবেন ? ” বুকের ভেতর থেকে আসা দীর্ঘশ্বাসটা কোনমতে ঠেকাল মেঘা। বর্ষণ আর কথা বাড়াল না।
মেঘা হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে বলল, ” সবকিছু এত তাড়াতাড়ি ঘটে যাচ্ছে যে আমি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারিনি। ডাক্তারের ভিজিট, ক্লিনিকে ভর্তি ফি….!”
-” এ নিয়ে কথা বলার ঢের সময় পাওয়া যাবে। আপাতত যেভাবে চলছে চলুক। পরে একসময় শোধ করে দিয়েন। সমস্যা নেই।”
মেঘা দমে গেল। বাড়াবাড়ি করেও লাভ নেই। হাত খালি। তারচে টাকা হাতে এলে বর্ষণকে ফেরত দেবে সব টাকা।

রাতেই আরশকে ডাবল এম্পুলের ইঞ্জেকশন পুশ করা হল। নেবুলাইজ করা হলো আরেকবার। ক্যানুলা লাগানোর সময় বাচ্চাটার চিৎকারে ঝরঝর করে আরেক দফা কেঁদে আকুল হল মেঘা। বাধ্য হয়ে বর্ষণ সিস্টারকে ইশারা করল মেঘাকে সরিয়ে নিয়ে যেতে। আরশকে সে নিজেই কোলে করে শক্ত করে ধরে রাখল। বাচ্চাদের হাতের ভেইন পাওয়া সত্যিই ভারী মুশকিল। প্রায় সাতবারের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে অন্য হাতে চেষ্টা চালালো কর্তব্যরত চিকিৎসক। এই হাতেও তিনদফা বাটারফ্লাই সুঁচ ফোটানো হলে অবশেষে ভেইন মিলল। বর্ষণের নিজেরও খারাপ লাগছে। কিন্তু কীইবা করা।
আরশের চিকিৎসার সব কাজ শেষ করে মেঘাকে তার রাতের খাবার সহ কেবিনে পৌঁছে দিয়ে বাড়ী ফিরতে রাত প্রায় বারোটার মত বাজল বর্ষণের।

=====

সুরমা বারবারই ঘড়ি দেখতে লাগল। রাত প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। অথচ এখনও তার দেখা নেই। অবশ্য প্রতিদিনই ফিরতে রাত হয় নেহালের বাবার। আজ যেন একটু বেশীই দেরী হচ্ছে। ঘর আর বাহির মিলে অস্থির ভাবে পায়চারী করতে করতে ডোরবেলের শব্দ শুনে থামল সুরমা। সম্ভবত নেহালের বাবা এসেছে। একরকম ছুটে গিয়েই দরজা খুলল। কামাল ঘরে ঢুকে সুরমার হাবভাব দেখেই বুঝতে পারল কিছু একটা হয়েছে। শার্ট খুলেই বলল, ” আজকে আবার কী হয়েছে তোমাদের ? ”
-” আমাদের মানে কাদের? ” স্বর তীক্ষ্ম শোনাল সুরমার। কামাল অবস্থা বেগতিক দেখে হাসল, ” বাপরে বাপ। রেগে টং হয়ে আছ দেখছি। কী ব্যপার কী।”
-” হাত মুখ ধুয়ে আগে খেতে বসো। পরে শুনো এসব।” থমথমে মুখে বলল সুরমা।

কামাল কথা না বাড়িয়ে সেটাই করল। হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসল। খেতে খেতেই শুনল তার মহান শ্যালকের পরোপকারের কাহিনী। সব শোনা শেষে বলল, ” আহারে, বাচ্চাটা তাহলে হাসপাতালে? ”
-” সাতখন্ড রামায়ন পরে এখন আসছো সীতা কার বাপ জিজ্ঞেস করতে, তাই না ?” সুরমা এবার খেউ করে উঠল। “বাচ্চার অসুখ হয়েছে হাসপাতালে গেছে। কেন আমাদের বাচ্চা কাচ্চার অসুখ হয়নি ? আমরা কী ঘর গুষ্ঠি নিয়ে হাসপাতালে গেছি নাকি। ঐ ** আমার ভাইয়ের সামনে নাটক করে বেশী। ও ইচ্ছে করে এটা করেছে। জানে তো বর্ষণ আমার ঘরে। সুযোগ বুঝে নাটক বানিয়ে একা রওনা দিতে গেছে। তাই যেন কেউ ওর কান্না শুনে সাথে যায়। সেটাই হয়েছে।”
-“কিন্তু তোমার ভাই গেল কেন ? সে কী ডেকেছে নাকি, যত্তসব। তোমার ভাইও তো কম না।”
-” বর্ষণের কী দোষ। ওরকম কান্নাকাটির রোল তুলে মাতম করতে করতে গেলে বর্ষণ কেন, রাস্তা দিয়ে যাওয়া পথিকও সাহায্য করতে চাইবে।”
-” এখন কী অবস্থা ? ”
-” কার ? ”
-” আহা, পরশের বউ বাচ্চার।”
-” বাচ্চার খবর দিয়ে তুমি কী করবে ? ” চিৎকার করে উঠল সুরমা। ” দরদ তো দেখি বেয়েছেয়ে পড়ছে। আমি বলি কী আর আমার সারিন্দা বাজায় কী।”

কামাল সারেন্ডার করার ভঙ্গিতে বলল,” আচ্ছা, আচ্ছা। মাফ চাই। বলো কী বলতেসো।”
-” বর্ষণ নাকি এখন বাড়ী ফিরেছে। একটু আগেই আম্মার সাথে কথা হয়েছে আমার। ও হয়ত খাওয়া দাওয়া সেরে এখন ঘুমাবে। কাজেই এখন ওকে কিছু বলার দরকার নাই। কাল তুমি ওরে সরাসরি তোমার অফিসে ডাকো। জিজ্ঞেস করো, হিমাদের বাসায় কবে যাবে ! ”
-” হিমা যেন কে ? ” বোকার মত তাকাল কামাল।
-” আমার মেজাজটা খারাপ করবানা নেহালের বাবা। ” সুরমা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল।
-” আরে ভাই। এত রাগ করতেসো কেন। তোমার ভাই যুবা পুরুষ। অল্পবয়সী সুন্দর মেয়ে দেখলে চিত্তচঞ্চল হবেই। এগুলি টেকনিকালি হ্যান্ডেল করতে হয়।”
-” কে অল্পবয়েসী সুন্দর মেয়ে ? ” সুরমার কণ্ঠস্বর হঠাৎ তুলনামূলক শান্ত হয়ে গেল। এটা বড় ধরণের ঝড়ের পূর্বাভাস মনে করে আর কোনো জবাব না দিয়ে ঘাড় গুঁজে খেতে লাগল কামাল ।
সুরমা এবার নিজেকে সামলে নিয়ে ঠান্ডা স্বরে বলল, ” নজর ঠিক করো বুঝলা ? ছোটভাই এর বউ এর দিকে চোখ তো দেখি ভালোই যায়। তাহলে আর আমার ভাইয়ের দোষ কী। দুই বাচ্চার বাপ হয়ে যদি এক বাচ্চার মা’কে বলো সুন্দর তাহলে বর্ষণ তো পোলাপান। তো চেহারা নাহয় সুন্দর বললা বুঝলাম, কিন্তু অল্পবয়স বললা কোন বিবেচনায়, শুনি ? সে আমার ভাইয়ের চেয়ে বয়সে অনেক বড়ই হবে।”
-” ওহো….! বয়স নিয়ে পড়লা কেন আবার?”
-” তো পড়বো না ? কমবয়স বললা কেন তুমি? ”
-” আরে বাবা, ওটা তো কথার কথা। আমাদের বয়সের হিসাবে বললাম কথাটা। তাছাড়া তুমি তো আর তোমার ভাইরে বিয়ে করাবা না , যে বয়স নিয়ে টানাটানি করতেসো ! ”
-” আচ্ছা, এসব কথা বাদ দাও। তুমি বর্ষণকে কেমন করে সামলাবা সেটা চিন্তা করো। ওর হাবভাব আমার ভালো লাগতেসে না। আমি হলফ করে বলতে পারি ঐ বেটি আমার ভাইরে তাবিজ করসে। নইলে বর্ষণ সব বাদ দিয়ে ওর বাচ্চার জন্য এত টান টানবে কেন, তুমিই বলো। আমি শিওর, এগুলো সব তাবিজ তুম্বার কাজ।”
-” আরে ধুর। এসব কিছু না। এগুলা বয়সের দোষ। এক কাজ করো, তুমি কালকে ফোন করে ঐ মেয়েদের বাসার সাথে প্রোগ্রাম ঠিক কর। মেয়ে দেখতে যাবার কথা বলে ঠাস করে কাবিনটা করায়া দাও। ব্যাস, তারপরেই দেখবা তোমার ভাই সব বাদ দিয়া ঐ মেয়ে নিয়ে পড়ে থাকবে।”
-” আইডিয়াটা মন্দ না। তাহলে ঐটাই করি। হিমাদের বাসায় ফোন করে প্রোগ্রাম ফিক্স করে বলি যে এ সপ্তাহেই কাবিন করাবো। আর বর্ষণকেও কিছু একটা বলে চাপ দিয়ে বিয়েটা করাতে পারলে জানটা বাঁচে। তারপর এই ** রে আমি দেখে নেব।”
-” আগে করাও তারপর ঐসব ভাবো। তোমার ভাই কিন্তু ঘাড়তেড়া। মনে রেখো।”
-” ও ঘাড় তেড়া হলে আমি পুরা মানুষটাই তেড়া। এইটা তুমিও মনে রেখ।”

=====

আরশের জ্বর আজ পুরোপুরি নেমে গেছে। বাচ্চাটা আজ বর্ষণকে দেখে সামান্য হেসেছে। পা দুটো ছুঁড়ে দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করতে চেয়েছিল তারপর আবার কী ভেবে যেন রয়ে গেছে। তবে একদৃষ্টে সে বর্ষণকেই দেখছে।
ব্যপারটা খেয়াল করে বর্ষণ বলল, ” আরশ কিন্তু আমাকে তার বন্ধু হিসেবে পছন্দ করেছে। ”
মেঘা দুর থেকে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। মুখে কিছু বললো না। যদিও আরশের ব্যপারে সে এখন অনেকটাই চিন্তামুক্ত কিন্তু গতকাল শ্বাশুড়ী আম্মা যেসব কথা বলে গেছেন তারপরে আর চিন্তামুক্ত থাকার উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। আম্মার মুখেই শুনেছে সুরমা ভাবি মহা ক্ষেপে আছে ওর ওপর। গতকাল বর্ষণের পাত্রীপক্ষের বাড়ীতে দাওয়াত ছিল বর্ষণের। বর্ষণ সেখানে যায়নি উপরন্তু সাফ জানিয়ে দিয়েছে যে মেয়ে নাকি পছন্দ নয় তার। এটা নিয়ে সুরমা ভাবির সাথে মহা গ্যঞ্জাম বেঁধে গিয়েছিল ভাই বোনে। অথচ বর্ষণ এখানে এসে কিছুই বলেনি। সুরমা ভাবি নাকি সরাসরি বর্ষণকে ঐ বাড়ীতে যেতে মানা করে দিয়েছেন। শ্বাশুড়ী আম্মার মুখে এসব কথা শুনে রীতিমত আঁতকে উঠেছিল মেঘা। তার হাত ধরে বলেছে, আমি এসবের কিছুই জানিনা আম্মা। বর্ষণকে আমি কোনভাবেই এসব করতে বলিনি।
শ্বাশুড়ী আম্মা মুখ গম্ভীর করে বলেছে, ” এইগুলি কথা সুরমা বিশ্বাস করব না। তারচে তুমি নিজেই সুযোগমত বর্ষণরে মানা কইরা দাও যেন না আসে তোমার ধারে। আর ডাক্তারখানার খরচ সব শোধ কইরা দিও অরে। ছেড়াটার মতিগতিও বুঝিনা। দুনিয়ার আবিয়াত্তা মাইয়া থাকতে হেয় তোমার পিছে কেন পড়সে আল্লাহই জানে।”

মেঘাকে নিরব দেখে বর্ষণ বলল, ” আমি জানি আপনি আমার এখানে আসাটা পছন্দ করছেন না। আমি শুধু আরশের জন্য এখানে আসি। বিশ্বাস করেন এটা? “বর্ষণ আরশের মাথায় হাত রাখল। সাথে সাথেই আরশ ওর হাত ধরার জন্য পাগল হয়ে গেল। শুয়ে শুয়ে সাইকেল চালাচ্ছে সে এখন।

বর্ষণের কথাটা শুনে কিছুক্ষণ নিরব রইল মেঘা ।
মৃদুস্বরে বলল, ” আমি আপনার ঋণ কোনদিন শোধ করতে পারব না।”
-” একথা বললে কিন্তু পুরো ধরা খেয়ে যাবেন। এমন অনেক পথ আছে ঋণ পরিশোধের। কাজেই ঋণের প্রশ্ন তুলবেন না। আমি চাইনা, আপনি বিপদে পড়ে যান। তবে আমার মনে হয় আপনার নিজেকে নিয়ে ভাবা উচিত।”
মেঘা চমকে গিয়ে তাকাল। বর্ষণ আরশের কাঁথাটা ঠিক করে দিয়ে বলল, ” এভাবে অভিভাবকহীন ভাবে কতদিন। আপনার বয়সও তো কম।”
-” কম দেখলেন কোথায় ? আপনার বড় আমি।”
-” বারবার এটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে লাভ নেই। এটা শুনলেই আপনাকে বড়আপু বলে ডাকা শুরু করব না আমি। তাছাড়া আপনাকে দেখলে বয়সের চিন্তা মাথায় আসেনা। যেটা আসে সেটা না শোনাই ভাল।

মেঘার মুখ রাঙা হল এবার। সেটাকে আড়াল করতে মুখ দৃঢ় করে বলল, ” আপনার বড় বোনের জা আমি। এতোটুকু শ্রদ্ধাবোধ তো থাকা উচিত।”
-” শ্রদ্ধাবোধ থাকলে কী করতে হয় ? ”
-” আমাকে এখন থেকে আপা বলে ডাকলে খুশি হব। আপনাকে আমি ছোটভাই এর নজরেই দেখি।”
-” মিথ্যা বলা কবীরা গুনাহ। ”
-” আমি মিথ্যা বলিনি ভাই।”
বর্ষণ এবার সরাসরি মেঘার দিকে তাকিয়ে বলল, ” স্রষ্টার বিধানকে অমান্য করে যারা এসব পাতানো সম্পর্ককে প্রাধান্য দেয় বা দিচ্ছে তাদের সবাইকে এর দায় নিতে হবে। আপনি আমার বড়বোন কেন মা সাজলেও আপনাকে আমি বিয়ে করতে চাওয়ার শারঈ অধিকার রাখি আমি । ধর্ম কে এত সস্তা মনে করবেন না। এটা মানুষের তৈরী আইন না যে মনগড়া ভাবে এটা সেটা বলে সংশোধন আনবেন।”

বলতে বলতেই বর্ষণের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল আর মেঘার চেহারা হলো ম্লান ।দেখে মনে হলো যেন কেউ এক পোচ কালি মেখে দিয়েছে। বর্ষণ হঠাৎ কিছুটা রেগে গিয়ে বলে উঠল, ” সেই তখন থেকে বড় বোন, আপা, ছোটভাই….এসব লাগিয়ে রেখেছেন ? এসব বলে বরং নিজেকে আরো বেশী প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। সহজ ব্যপারটা বুঝতে পারছেন না কেন। আপনি নিজে থেকে কাউকে বিয়ে করতে রাজী না হলে কেউ জোর করতে যাবেনা। আপনি রাজী নন। এটুকুই তো যথেষ্ট। এতো মা বোন চাচী নানী বানাতে হবে কেন নিজেকে ? নিজেকে প্রাকটিসিং মুসলিম দাবী করেন অথচ আল্লাহর বিধানের ওপর দেখছি বিশেষ আস্থা রাখেন না। সমাজটাকে কঠিন আর পাপী বানিয়েছেন তো আপনারাই।” রেগে গেল বর্ষণ।
-“আল্লাহ নিজে যেখানে সবাইকে বিয়ে করার অনুমতি দিয়ে দিল নির্দিষ্ট চৌদ্দজন ছাড়া। সেখানেও আপনাদের জা, বড়আপা, বোনের মত, ভাইয়ের মত…হেন তেন দুনিয়ার ফ্যাকড়া খাড়া করছেন। আমি কী একবারও বলেছি যে আমি আপনাকে বিয়ে করবই ? এত অস্থির হবার কী আছে ? আপনার কী ধারণা, হিমা মেয়েটাকে আমি আপনার জন্য বারণ করেছি ? আশ্চর্য। আপনাদের মেয়েদের এই এক সমস্যা। নিজেদের বিরাট ইম্পরটেন্ট ভাবেন। হিমাকে তো কারো জন্য বারণ করিনি আমি। ওকে এমনিতেই পছন্দ হয়নি আমার। সেকারণেই বারণ করেছি। অন্য কোন কারণ নেই। অথচ আপনি সেই তখন থেকেই আমাকে বোঝাতে লেগেছেন। ”
-” আ….আমি স্যরি।” মেঘা চুপসে গেল। সে বুঝতে পারেনি বর্ষণ হঠাৎ এত রেগে যাবে।
– ” স্যরি ফর হোয়াট ? কি জন্যে স্যরি হয়েছেন ? ”
-” না মানে আমি যা যা বলেছি তার জন্য আপনি কষ্ট পেলে আমি স্যরি।”
-” তারমানে আপনি স্বীকার করছেন আপনি আমার বড়বোন নন ? ”
মেঘা অসহায়ের মত কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে এবার উঠে রুম ছেড়ে বেরিয়ে বারান্দায় চলে গেল।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here