মোনালিসা পর্ব ২২

মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-২২
আকাশে ধীরে ধীরে মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে। ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে গগণ। এই আকাশেই আস্ত অত্যুজ্জল চাঁদ দেখা যায়, চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত হয় ধরনী। আবার এই আকাশেই দেখা যায় ঘন আঁধার মাখা রাত।যেখানে এক ফোঁটা আলো কেউ খুঁজে পাবে না। এই বিচিত্রময় গগণ কে আরো বিচিত্র রূপ দান করে সাত রঙা রংধনু। মাঝে মাঝে কি স্বচ্ছ নীল আকাশ,শুভ্র মেঘ যেখানে ছুটে বেড়ায়। আর এখন আকাশ’টা কি ভয়ংকর!
মানুষের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে ভাবে যেন জড়ানো আকাশে এই বিচিত্র’টা। যেখানে সুখ পূর্নিমার রাতের মত আর দুঃখ কালো মেঘাচ্ছন্ন আকাশের ন্যায়। মোনা ক্ষীণ নিঃশ্বাস ফেলে। একটু পরেই বজ্রপাতের শব্দ আর আলোতে প্রগাঢ় নিঃশব্দ ধরনী যেন অস্থির হয়ে উঠে। নিশান এসে মোনার কোল ঘেঁষে বসে। মেঘের ডাকে ভীতি হয়ে যায় নিশান, ভীতি বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায় মোনার দিকে। মোনার চোখে আশ্বাসের জোয়ার, নিশানের ভয় হ্রাস পায়।
তৃষ্ণার্ত পৃথিবীর পিপাসা মিটাতে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আকাশ থেকে নিঃসৃত হচ্ছে। বৃষ্টি মোনার কোন কালেই পছন্দ ছিলো না। বৃষ্টি বিলাস, বৃষ্টিস্নাত রাত এসব কথায় মোনার রোমাঞ্চকর অনুভূতি উপলব্ধি হয়নি। বর্ষার সাথে যেন মোনার আজন্ম শত্রুতা। তারপরও মোনা বর্ষার অপেক্ষা করত।বৃষ্টির জন্য না, কদম ফুলের জন্য।
মোনার রুমের সাথে লাগোয়া সংকীর্ণ এক চিলতে বারান্দা ছিলো। বারান্দার কোল ঘেঁষে ছিলো এক কদম গাছ। সারা বছর কদম গাছটা ফুলের অভাবে অপূর্ণতা, নিঃসঙ্গতা অনুভব করত যেন। বর্ষা হলেই ফুলে ফুলে পূর্ণ হয়ে যেত গাছ’টা। শুভ্র, পরিস্ফুট কদম ফুল দেখে মোনার চোখ জুড়িয়ে যেত। ফুলে ফুলে গাছ’টার শোভাবর্ধিত হত। মোনা অপেক্ষা করত বর্ষার কদম ফুল দেখার জন্য। গাছ’টা এখনো আছে, মোনার সেই চিরচেনা বারান্দার পাশেই আছে। এতদিনে হয়ত শাখা-প্রশাখা আরো বিস্তৃত হয়েছে। এই বর্ষায়ও হয়ত ফুলে ছেয়ে গাছ’টা। কিন্তু ফুল দেখার জন্য অধীর আগ্রহে ব্যাকুল মোনা তো আর নেই সেখানে। মোনার চোখ এখন কোন কিছুর জন্য ব্যাকুল থাকে না,অধীর থাকে না। মোনার সমস্ত আবেগ যেন বিবর্ণ হয়ে গেছে। ফ্যাকাশে, পান্ডুর হয়ে গেছে।
সকাল বেলা মোনা ঘুম থেকে উঠে। ঘুম ঘুম চোখে খাট থেকে নামে। আড়মোড়া ভাঙে। ঘুম জড়ানো চোখেই নাস্তা রেডি করে। নিশান কে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে নিজে ভার্সিটি’তে যায়। এখনো হালকা হালকা বৃষ্টি পড়ছে। প্রায় সবার হাতেই ছাতা। কেউ কেউ বৃষ্টি’তে যেন মাতাল হয়ে উঠেছে। মোনা সে দলের না। বৃষ্টি দেখে মোনা বিরক্ত’তে মুখ বিকৃত করে। মোনা ভার্সিটি তে গিয়ে সবার আগে শ্রুতি’কে খোঁজ করবে। শ্রুতি ক্যাম্পাসের দক্ষিণ দিক’টায় বসে বসে আড্ডা দিচ্ছে ওয়াটস এর সাথে। ক্লাসের ভিতর এই ছেলে’টার সাথে শ্রুতির সখ্যতা। মোনাও টুকটাক কথা বলে। মোনা’কে দূর থেকে দেখে লম্বা সুরে নাম ধরে ডাকলো ওয়াটস। মোনা ফিরে তাকায়। ওয়াটস ছেলেটার মুখ সব সময় হাস্যউজ্জ্বল। মোনা’কে দেখেই মুখের হাসি’টা আরো ফুটিয়ে তুলে বলল,
-“মিসেস ব্লু আই’স।”
মোনার কপালে ভাঁজ পড়লো কয়েক’টা। আড়চোখে তাকালো শ্রুতির দিকে। শ্রুতির দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙালো। শ্রুতি ওয়াটসের কাছে বলেছে এসব। এগুলো ওয়াটসের কাছে বলার কি আছে?মোনা চরম তিক্ততা বোধ করে। শ্রুতি হেসে উঠে বলল,
-“ট্রাস্ট মি মোনা।আই ডোন্ট টেল এ্যনিথিংক।”
মোনা এ প্রসঙ্গে কিছু কথা না বাড়িয়ে ওঁদের পাশে বসল। ওয়াটস আবার বলল,
-“তোমার ব্লু আই’স এর কি খবর?”
মোনা বিরক্ত মুখে তাকালো ওয়াটসের দিকে। অধৈর্য্য গলায় বলল,
-“প্লীজ ওয়াটস, না জেনে কথা বলো না তো। শ্রুতি সব সময় বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলে।”
মোনার শ্রুতির উপর রাগ হয়। মোনা মুখ গম্ভীর করে ফেলে। শ্রুতি মোনার অভিব্যক্তি দেখে হেসে উঠে । শ্রুতির কাঁধে হাত রেখে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল,
-“মোনা তুমি এমন কেন বলো তো? জোকসও বুঝো না!সব কিছুতে গুরুত্বর মুখাবয়ব হয়ে যায় তোমার।”
মোনার ভিতর থেকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেড়িয়ে আসতে চায়,মোনা খুব সন্তর্পণে একটা ক্ষীণ নিঃশ্বাস ফেলল। আসলেই মোনা অনুভূতিহীন হয়ে যাচ্ছে, ভিতর’টা রুক্ষ হয়ে যাচ্ছে। মোনার আচরণেও নির্জীবতার আত্মপ্রকাশ ঘটছে। পরিস্থিতি যাকে এমন অনুভূতিহীন ভাবে তৈরি করছে,সে কি চাইলেই নিজেকে অনুভূতি সম্পন্ন মানুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে? কেউ তো জানে মোনার এই ক্ষুদ্র জীবনে কত রকমের অভিজ্ঞতার ডায়েরি রচিত হয়েছে।
ক্লাস শুরু হয়ে গেলে ওঁরা ক্লাসে চলে গেলো। ক্লাসেও এখন মনযোগী থাকার চেষ্টা করছে । ক্লাসে স্যার থাকাকালীন শ্রুতি মোনার কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,
-“ছুটির পর কথা আছে। চলে যেয়ো না আগে আগে।”
এই শ্রুতির যত কথা আছে,সব স্যার ক্লাসে থাকাকালীন সময়ে মনে আসবে। মাঝে মাঝে সামান্য বিষয় নিয়েও ক্লাসে স্যার থাকাকালীন সময়ে শ্রুতির হাসির জোয়ার বয়ে যাবে। শব্দ করে না, ঠোঁট কামড়ে হাসবে শ্রুতি। এভাবে হাসার কারণে শব্দ না হলেও শ্রুতির শরীর ভূমিকম্পের মত কম্পিত হয়।
ভার্সিটি শেষে মোনা শ্রুতি’কে একটা ক্যাফেটেরিয়া’তে নিয়ে আসে। মোনা বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে, কাজে যেতে হবে। শ্রুতি কফির তে চুমুক দিতে দিতে বলল,
-“সমীরের সাথে দেখা হয়েছিল প্রিয়মের। সে দুঃখ প্রকাশ করলো। তুমি তাঁকে অবজ্ঞা করে যাচ্ছো শুধু তাই।”
মোনা শ্রুতির দিকে তাকালো স্বাভাবিক দৃষ্টিতে। আগ্রহী গলায় বলল,
-“আর কি বলেছে?”
-“যাক এই প্রথম কোন কিছু শোনার জন্য আগ্রহী হলে তুমি।”
শ্রুতি একটু থেমে আবার বলল,
-“বলেছে তুমি তাঁর লাইফস্টাইল পছন্দ করো না,এটা তাঁকে অবজ্ঞা করার প্রধান কারণ।”
মোনা চুপচাপ শুনে যাচ্ছে। শ্রুতি তাঁর চঞ্চল গলায় বলছে। হাত-পা নাড়িয়ে অসাধারণ ভঙ্গিতে বলছে। অস্থির দুটো চোখ শ্রুতির, গোধূলি লগ্নে নীড়ে ফিরা পাখির মত অস্থিরতায় ব্যস্ত দুটো চোখ।
-“মোনা মানুষ যেরকম পরিবেশে বড় হবে সে তো সেরকমই হবে। মানুষ তো ছোট বেলা থেকে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের দ্বারা দীক্ষিত হয়। এটা কাউকে অপছন্দের কারণ হওয়া উচিত হতে পারে না। উপরোক্ত সে যদি তোমার মনের মত হওয়ার চেষ্টা করে,তখন তাঁকে অবজ্ঞা করার জন্য শাস্তি পাওয়া উচিত।”
মোনা হাসলো কি ভেবে যেন। কোন জবাব দিলো না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তাড়াহুড়ো করে বলল,
-“যেতে হবে শ্রুতি।”
মোনা উঠে পড়ে। মাথায় রাজ্যের চিন্তা নিয়ে সামনে পা ফেলে। প্রিয়মের এত দ্রুত বদলে যাওয়া খাপছাড়া লাগে। মানুষ ভালোবাসার জন্য বদলাতে পারে কিন্তু প্রিয়মের সেই বদলানো যদি ক্ষনিকের জন্য হয়? কিংবা খামখেয়ালির বশে হয়? মোনা কিভাবে বুঝবে প্রিয়মের এই ভালোবাসা, এই বদলে যাওয়া রূপের স্থায়িত্ব কতটুকু সময়? মানুষ চেনা বড্ড কঠিন, প্রচন্ড ঢেউয়ের ভিতর সাঁতরে সাগর পার হওয়ার মত কঠিন।
মোনা অফিসে যায়। লরি মোনায় দেখে সৌজন্যমূলক হেসে ভাব বিনিময় করে। মোনা একটা বিষয় বুঝতে পারছে না, এলিন মেয়েটা মোনায় দেখে বিরক্ত বোধ করে। মোনা সহজ আচরণ করে। মাঝে মাঝে নিজ থেকে গিয়ে কথা বলে, কিন্তু এলিনের আচরণে মোনা দমে যায়। কথা বেশি এগুতে পারে না। মোনা শেষে ভেবে নিলো, পৃথিবী’তে তো অনেক অদ্ভুত ব্যাপার আছে। যার কোন ব্যাখ্যা,বিশ্লেষন কিংবা কারণ নেই। এলিনের এই বিরক্ত হওয়ার কারণ’টাও বুঝি এমন কিছু। মোনার কাজ শেষ হলে বৃষ্টি প্রাদুর্ভাব আরো বৃদ্ধি পেলো যেন। মোনা প্রায় আধ ভেজা হয়ে যায়।
মোনা বাসে উঠে পড়ে। এখানে বাস গুলো তে উপচে পড়া ভীড় নেই, বাদুর ঝুলা হয়েও যেতে হয়না। বাসের সামনের দিকটা বৃদ্ধ আর প্রতিবন্ধীদের জন্য। মোনা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ে। নিশান ঝড়-বৃষ্টি ভয় পায়। নিশান একা বাসায় ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আছে। মোনা’কে দেখা মাত্রই সব ভয়,আড়ষ্টতা চোখের পানি হয়ে আষাঢ়ের ধারার ন্যায় পড়তে শুরু করবে।
মোনা বাসায় ফিরে দেখা নিশানের মুখ’টা শীর্ণ হয়ে আছে, ভয়ে চুপসে আছে। মোনা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করে। ইস! কি অসহায়ত্ব, ভয়, আড়ষ্টতার এতক্ষণ গ্রাস করছিলো নিশান’কে।
মোনা আধ ভেজা কাপড় পরিবর্তন করে। টনসিলে একটু একটু ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। মোনা একটা মাফলার পেঁচিয়ে নেয়। গায়েও জ্বর জ্বর এসেছে।
——-
মোনার পরীক্ষা শুরু হয়। পড়তে পড়তে মোনার দিশেহারা অবস্থা। এর উপর চাকরি’টা কে প্যারা মনে হচ্ছে। মোনা জানে চাকরি না করলে ওঁর ভালো ভাবে চলে যাবে। লিলি বেগম মাসে মাসে ডলার দিবে বেহিসেবে, জ্যাক তো আছেই! কিন্তু কারো কাছে নির্ভরশীল না হওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় রয়েছে মোনার। কখন কে বদলে যাবে, সাহায্যের হাত গুটিয়ে নিবে। মানুষের নিশ্চয়তা বা কি?
মোনার পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়। রাত জেগে পড়ার কারণে চোখের নিচ’টা কালো হয়ে গেছে।
গত কয়েকদিনে যাবৎ প্রিয়মের কোন খোঁজ নেই, এমন আগে কখনো হয়নি। সারাক্ষন বিরক্ত করা মানুষ’টা, বিরক্ত করা ছেড়ে দিলেও বোধ হয় মানুষ ভাবনায় পড়ে যায়। লিলি বেগমের সাথে দিনে দুই-এক বার ফোনে কথা হয়। কিছুদিন পর পর বাসায় এসে মোনার রুম গুছিয়ে দিয়ে যাবে, কিচেন পরিষ্কার করবে। এলোমেলো বাসা’টা সুশৃঙ্খল ভাবে সাজিয়ে দিয়ে যাবে। মোনা চায় লিলি বেগম প্রতিদিন আসুক,মায়ের ওম পায় লিলি বেগমের কাছে। মোনার বাসায় আসা নিয়েও হয়ত হাবিব সাহেবের অনেক কথার মুখোমুখি হতে হয় লিলি বেগমের। সেগুলো হয়ত গোপনই থেকে যায়, প্রকাশিত হয় না।
মোনা লিলি বেগমের কাছে ফোন দেয়। ফোন দেওয়ার মূল কারণ প্রিয়মের খোঁজ নেওয়া। ফোন দিয়ে প্রথমেই যদি প্রিয়মের কথা জিজ্ঞেস করে তাহলে ফোন করার মূল কারণ যে প্রিয়মের খোঁজ নেওয়া এটা বুঝে যাবে লিলি বেগম। লিলি বেগম বুঝলেও সমস্যা নেই, কিন্তু মোনা বুঝাতে চায় না নিজের আপন চিন্তা ভাবনা থেকে। মোনা অনেকক্ষণ কথা বলে বলল,
-“খালা প্রিয়ম ভাই,এরিক কেমন আছে?”
মোনা সচরাচর কখনো প্রিয়ম বা এরিকের কথা জিজ্ঞেস করে না। লিলি বেগম বলল,
-“প্রিয়ম তো পা ভেঙ্গে বাসায় বসে আছে। এরিক ভালো আছে।”
মোনা চমকে উঠলো অবচেতন মনে। স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করল,
-“বলো কি?কিভাবে পা ভেঙেছে?খুব মারাত্মক নাকি?”
-“না মারাত্মক না, পা মচকে গেছে। কিছুদিন হাঁটাহাঁটি করতে পারবে না এই আর কি!”
লিলি বেগম একটু থেমে আবার বলল,
-“তুই হঠাৎ এত কথা জিজ্ঞেস করছিস?”
মোনা দ্রুত প্রসঙ্গ বদলে ফেলে। বলে,
-“কয় দিন হয়ে গেলো একবার বাসায় আসো নি, আসো না একবার।”
-“তুই আয়।তোকে তো আবার বাসায় আসতে বললে তোর মুখ মেঘবর্ন ধারন করে। প্রিয়ম’কে দেখে যাবি, তাছাড়া সেই যে গেলি আর তো আসিস নি।”
মোনা তাড়াহুড়ো ভাব নিয়ে বলল,
-“খালা রাখছি, নিশান ডাকে।”
মোনা ফোন রেখে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জানালার ফাঁক দিয়ে।লিলি বেগমের বাসায় যাওয়ার মত পরিস্থিতি থাকলে, প্রিয়ম’কে দেখার জন্য হয়ত যেত হয়তোবা যেত না। মোনা চিন্তা ভাবনার অধ্যায় বন্ধ করে নিশানের মুখে খাবার তুলে দিতে লাগলো।
(চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here